শব্দের উৎস কিংবা (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক) অর্থ সন্ধান (পর্ব্ব— চার) || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

সূচী:
ফু ফুঁ ফুল ।। মট্, মটকী ।। সভ্য, অসভ্য ।। ঘ থেকে ঘটক এবং ধর্ম্মঘট ।। নাম ।। দব (তেজ)

 

ফু ফুঁ ফুল
ব্যঞ্জনধ্বনি পূর্ণতা পায় স্বরবর্ণের মাধ্যমে। প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণ কোন না কোন ক্রিয়া প্রকাশ করে। ইংরেজীতে ক্রিয়া প্রকাশে verb ব্যবহার করতে হয়, বাংলায় ব্যঞ্জনবর্ণই বিভিন্ন ক্রিয়া প্রকাশ করতে সক্ষম স্বরবর্ণের মাধ্যমে, এটা বাংলা বর্ণমালার বিশেষ শক্তি।

বর্গস্থিত প্রথম ও তৃতীয় বর্ণ ক্রিয়াকে অন করে। আর দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণে সেই ক্রিয়া স্থিতি লাভ করে। যেমন, ক্ বর্ণটি করণ বোঝায়, গ্ বর্ণটি গমন, এভাবে চ্— চয়ন, জ্— জনন, ট্— টঙ্কারণ, ড্— ডয়ন, ত্— তারণ, দ্— দান, প্— পালন, ব্— বহন।

প বর্ণে পালনকারী বা পায়ী, ফ বর্ণটিতে পালনস্থিত হয়। সেই পালনস্থিত নবরূপ লাভ করে ফু হলে। আবার ফু-এর রহস্যরূপ থাকে ফুঁ-তে। (ঁ) চন্দ্রবিন্দু হল রহস্যময় বর্ণ কারণ এর রূপটি অব্যক্ত। এই কারণে এটি একা বসতে পারে না। বর্ণের ওপরে বসে। চন্দ্রবিন্দু দিয়ে শব্দ শুরু হয় না, যেমন ঙ, ঞ, ণ, য়, ং, ঃ এসব বর্ণ দিয়েও শব্দ শুরু হয় না, এজন্য এগুলো রহস্যময়।

ফু এবং ফুঁ এর পার্থক্য আছে। যেমন আপনি বাঁশীতে সুর তুলবেন, ইচ্ছানুসারে বাঁশী ঠোঁটে লাগালেন, মুখ ফুলিয়ে প্রস্তুত হলেন, তখন পর্য্যন্ত এটা ফু। আর যখনই ভেতর থেকে শক্তি প্রয়োগ করে মুখের বায়ু এনে বাঁশির ছিদ্রে ছুঁড়ে দেবেন তখনই হবে ফুঁ, আর এই ফুঁ-এর জন্যই বাঁশীটী বাজবে।

যারা তন্ত্র মন্ত্র করেন তারা বিপদ কাটাতে ফুঁ দেন, ফুঁ-এর মাধ্যমে যে বাতাস বের হবে তাতে বিপদ দূর হবে এমনটাই লোকে বিশ্বাস করে। বেলুন ফোলাতে ফুঁ লাগে, চুলো জ্বালাতে ফুঁ লাগে, রাজার পরামর্শদাতা রাজার কানে ফুঁ দেন অর্থাৎ পরামর্শ দেন। এই যে ফুঁ, এগুলো নানারকম— কানে যে ফুঁ দেওয়া হয় তাতে থাকে মন্ত্রনা শক্তি, বাঁশীতে বেলুনে লাগে বায়ুপ্রবাহকরণ শক্তি, চুলোতে লাগে ফুৎকার যাতে থাকে অনিয়ন্ত্রিত বায়ুপ্রবাহের শক্তি। ফুঁ দিতে হলে ফোকর বা ফুটো লাগে, ফুঁ-দাতাও লাগে। ফুঁ দিয়ে বেলুন ফুলে, কারণ বেলুনে বাতাস প্রবেশ করে, যাকে বলে পাম্প করা, আর সোজা বাংলায় পাম দেওয়া। মানুষও মানুষকে ফুঁ দিয়ে ফুলায়, পাম্প করে, যাকে বলে পাম দেওয়া। সবটাই ওই ফুঁ-এর কেরামতি।

ফু যখন ফুলে ওঠে তখন ফুল হয়। ফুলে থাকে প্রফুল্ল, যা দেখে আমরা হই উৎফুল্ল।

আজ এ পর্য্যন্তই।

 

মট্, মটকী
মট্ করে আঙ্গুল ফোটানোর শব্দটির সাথে আমরা পরিচিত, গ্রাম্যজীবনের সাথে যাদের এতটুকু পরিচয় আছে, মটকী শব্দটি হয়ত তাঁদেরও পরিচিত। মাটী থেকে মটকা হয়, মটকীও হয়। মটকী হল মাটীর তৈরী পাত্রবিশেষ, মাটীর বড় কলস। আগের দিনে ঘি রাখায় মটকীর ব্যবহার ছিল। গ্রামের বাড়ীতে ছোট ছোট মটকীতে জালার ধান, চাল, শুটকী, শিমের বিচী, কাঁঠাল বিচী রাখা হত। মটকী আবার তিন রকম। ছোটোগুলিকে বলে মুনী, একটু বড় হলে বলে মাইট এবং একদম বড়োগুলিকে বলে মটকী। মুনীতে সাধারণত নিত্যদিনের চাল রাখা হত পাটাতনের ওপর, মাইটেও দীর্ঘদিনের চাল রাখা হত। বড় বড় মটকীতে ধান রাখা হত। এই কয়েক দশক আগেও নাইয়া নামের ধান কাটার একদল লোক ধান কাটতে স্থানান্তরে যেত, তারা নৌকায় করে মটকী নিয়ে যেত, ধানের বিনিময়ে মটকী বিক্রি করত।

মটকী শব্দটি সম্পর্কে জেনে নিই।

গাছের একটা শুকনো ডাল ভাঙতে গেলে মট করে শব্দ হয়। যে কোন শুকনো কঠিন জিনিস ভাঙতে গেলে তাতে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এই শক্তি প্রয়োগ হল ওই জিনিস টিকে সঙ্কুচিত করা, সঙ্কুচিত হয়ে সে ভেঙে গিয়ে মট করে শব্দ করে। সেই জিনিসটি কিছু অংশ নিজের করে রাখে, বাকীটা পরিত্যাগ করে। মট্ হল পরিমিতের টঙ্কারণ, অর্থাৎ সে সঙ্কুচিত হয়েছে এবং ভেঙে পড়েছে তার একটা জানান দেয় মট্ শব্দ করে, কাজেই মট্ ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দ মট হল এই জানান দেওয়া ঘটে যে সত্তায়। শক্ত জিনিস ভাঙলে মট্ করে শব্দ হয়, আঙ্গুল ফোটালেও মট্ শব্দ হয়। বয়ষ্ক মানুষের হাড়গোড় যখন ক্ষয়ে যায় তখন শরীর নড়াচড়া করলেই মট্ মট্ শব্দ হয়। মট্ করলে মটক হয়, মটক হয় মটকায়। মটক যখন শুরু হয় তখন হয় মটকি, মটকি-এর সার্ব্বিক রূপ হল মটকী।

মট্ ক্রিয়ামূলের আরেকটি শব্দ মাটী। মট্ হতে জাত মাট, মাট সক্রিয় হয় মাটিতে, মাটির সার্ব্বিক রূপ মাটী অর্থাৎ মাটী হল কারী। মটক নামে রেশমী কাপড় আছে, আছে মটকা নামের কাতান শাড়ী। ঘরের চাল যেমন মটকা, তেমনি মাটীর বড় পাত্রকেও মটকা বলে। মরার মত পড়ে থাকলে বলা হয় মটকা মেরে থাকা। মাটীতে মাট থাকে। মাট হল খোলা প্রান্তর, ভূমী জমী ইত্যাদি ইত্যাদি, মাট থেকেই মাটী। মাট যখন সঙ্কোচিত হতেই থাকে তখন শক্ত হতে হতে এক সময় পাথরে পরিণত হয়। সেই শক্ত পাথররূপ মাটী হয়ত কোনো কাজে লাগে, কিন্তু তার আর বিকাশ হয় না, তবে মানুষের কাজ সঙ্কোচিত হতে হতে যখন অসার হয়, তখন সবই হয় মাটী। সেরকম প্রেম মাটী হয়, সম্পর্ক মাটী হয়, মরে গেলে দেহ পচেও মাটী হয়। বড়সড় গোলযোগ মিটে গেলে মিটমাট হয়, সেই মিটেও মাট থাকে।

মৃত্তিকা ও মৃৎ শব্দ দুটিও বিবর্ত্তিত হয়ে মাটী হয়েছে বাংলা ভাষায়, যথেষ্ট সংশয় থাকলেও বঙ্গীয় শব্দকোষ তাই মনে করেন। সে যাই হোক, আমরা ভুলতে বসেছি পরিবেশবান্ধব মাটীর তৈরী মটকী, পরিবর্ত্তে ব্যাবহৃত করছি প্লাস্টিকের তৈরী ছোট বড় পাত্র, এতে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

 

সভ্য, অসভ্য
সভ্য:
সভ্য = সহযোগীরূপে শোভা পাওয়া থাকে যাহাতে বা যে যোগ্যতায়; সভ থাকে যাহাতে। সভ = একত্রে শোভা পায় যে বা যাহারা। একত্রে তারা শোভা পায় যে জায়গাটিতে সেটি হল সভা। সভ-এর আধার হল সভা। সভা একটি স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ। সভা যেহেতু বহুজনের আধার, এবং শব্দশাস্ত্রের নিয়মে আধারশক্তি হল প্রকৃতি, প্রকৃতি হল স্ত্রীলিঙ্গ, কাজেই সভা শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গ। সভার প্রত্যেকটি সদস্য হলেন সভার সভ্য। যে কোনও সভার সভ্য বা সদস্য হতে হলে কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। সদস্যদের আপাতত সমতায় আসতে হয়। আজকাল আমরা দেখি অনেক সভায় ড্রেসকোড থাকে। থাকে আরও কিছু বিধিনিষেধ, যেগুলো মেনেই তবে সভার সভ্য হতে হয়। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আছে, কোন সভায় অংশগ্রহণ করলে, একত্রিত হলে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ যথাসম্ভব চাপা দিয়ে রাখতে হয়, তিক্ত কথা মনে থাকলেও মুখে মধু মিশিয়ে কথা বলতে হয়। নিজেকে ছেঁটে কেটে অন্যদের সঙ্গে একত্রে থাকার যোগ্যতা অর্জ্জন করে নিতে হয়, তবেই সভ্য হওয়া যায়। জগতেও টিকে থাকতে হলে জগতের সমস্ত বিষয়ের সাথে মিল রেখে চলতে হয়। খাপ খাইয়ে নিতে হয়। জগতে মানুষ যখন আবির্ভূত হয় তখন সে ভব হয়, আর যখন জগতের সাথে নিজেকে মানিয়ে চলে তখন সে হয় ভব্য। সমাজ ও জগৎ দুটো বিষয়ে যখন মানুষ খাপ খাইয়ে চলতে পারে তখন সে হয় সভ্য ও ভব্য। শহুরে শিক্ষিত মানুষেরা তুলনায় সভ্য-ভব্য হতে পারেন, কারণ তারা নিজের স্বরূপকে সহজে লুকিয়ে মেকি রূপ ধরতে পারেন।

অসভ্য:
অসভ্য = সভ্য নয় যে।

প্রকৃতির কাছাকাছি যারা বাস করেন, কিংবা গ্রামের সহজ সরল মানুষ যারা নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধকে লুকিয়ে রাখা জানে না, তারা চট্ করে মনের কথা বলে ফেলে; কে কী ভাববে সে বিষয়ে চিন্তাই করে না, সভ্যদের কাছে তারাই অসভ্য। যেহেতু তারা অসভ্য সেহেতু তারা কোন সভার সদস্য হতে পারে না।

 

ঘ থেকে ঘটক এবং ধর্ম্মঘট
ঘ বর্ণটি আগে চিনে নিই ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায়। ঘ = গ্ + হ, গ্ = গমন। সেই গমন থেমে যায় যেখানে, সেখানে গমনস্থিত হয় অর্থাৎ ঘ হয়। গমনস্থিত হল গমনের সমাপ্তী। মনে করেন আপনি এখান থেকে ঢাকা যাবেন, আপনি যাত্রা শুরু থেকে ঢাকা যাওয়া পর্য্যন্ত যে যাওয়া হল তাই গ্ বা গমন, আর ঢাকা পৌঁছে আপনার যাত্রা সমাপ্ত। আর গমন নেই, গমনস্থিত হল, এটাই ঘ।

ঘট:
ঘ্ বর্ণে জাত শব্দতালিকায় আছে ঘট।
ঘট্ ক্রিয়ামূলের বংশে জাত একটি শব্দ ঘট। ঘট = ঘ + ট, ঘ যেখানে টঙ্কার করে সেখানে ঘট হয়। ‘ট’ টঙ্কার করে, কীভাবে? টং টং শব্দ করে, তীব্র/কটু/উগ্র/ঝাঁজ/টক গন্ধ বা স্বাদে। ঘট-এর অনেক অর্থ আছে, সবচেয়ে বেশি প্রচলিত পাত্র বা ভাণ্ড হিসেবে। ঘটে বা পাত্রে কোনও বস্তু রাখা হয়। সাধারণত কাদামাটী থেকে ঘট তৈরী হয়, ঘট তৈরীর জন্য মানুষের মেধা ও শ্রম লাগে, কাজেই কাদামাটী + মেধা, শ্রম = ঘট। এখানে গমনস্থিত = কাদামাটী + মানুষের মেধা ও শ্রম। নতুন জিনিস তৈরী হলে তা জানান দেবে দেখে, দেখিয়ে, ব্যবহার করে। এর সবটাই টঙ্কার।
“যত্নসাধ্য সব উৎপন্নই ঘট”
মানুষ অনেক পরিশ্রম করে জ্ঞান অর্জ্জন করে, মানুষের ইচ্ছা, শ্রম, মেধা জ্ঞান সব গিয়ে মাথায় জমা হয়। জমা হয়ে জানান দেয় বা টঙ্কার করে, এজন্য মস্তিষ্ককে ঘট বলে।

ঘটন:
ঘট না-করণ/অন-করণ থাকে যাহাতে। ঘট, ঘট না-করণ/অন-করণ করেই ঘটনা ঘটায়।

ঘটনা:
ঘটন এর আধার হল ঘটনা।
ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় ঘটনা = ঘ-এর গতিশীল টঙ্কার না-করণ/অন-করণ থাকে যাহাতে তাহার আধার। অর্থাৎ ঘটনায় ঘট থাকবেই, ঘট আশ্রয় নেয় ঘটনায়।

ঘটক:
ঘটক ছাড়া ঘটনা ঘটা সম্ভব? কাজেই কোনও ঘটনা ঘটবে তখন যখন তাতে ঘটক থাকবে। ঘটা হল ঘট এর আধার। তাই যখন ঘটনা ঘটে তখন ঘটা হয়। আর ঘট যে করে সে হয় ঘটক। ঘটকের কাজ হল ঘটা করে ঘটনা ঘটিয়ে দেয়া ঘট করে। ঘটক হল যোজক। যেমন বিয়েতে বর-কণের যোজন হিসেবে ঘটক ঘটকালি করে ঘটা করে ঘটনা ঘটায় অর্থাৎ বিয়ে হয়। এই বিয়েটা হল ঘটনা।

ধর্ম্মঘট:
আরেক প্রকার ঘট আছে যা ধর্ম্মঘট নামে পরিচিত। ধর্ম্ম রক্ষার্থে যে ঘট স্থাপন করা হয় তাই ধর্ম্মঘট। অনেক স্থানে তৃষ্ণার্ত্ত পথিককে জল দেবার জন্য পথিমধ্যে স্থানে স্থানে মাটীর বড় বড় পাত্রে জল রাখা হত যা ধর্ম্মঘট নামে অভিহিত হত। আমি ছোটবেলায় পিলখানায় এরকম বিরাটাকৃতির ঘট দেখেছি। তৃষ্ণার্ত্তকে জল দিলে ধর্ম্ম রক্ষা হয়, তেমনি যে কোন ধরণের ধর্ম্ম (নৈতিক, মানবিক, আধ্যাত্মিক) পালনের জন্য যে সকল ঘটনা ঘটানো হয় তার সবগুলোর মধ্যেই ঘট থাকে এবং সেগুলো সবই ধর্ম্মঘট।

ঘট নিয়ে আমাদের তিনটি শব্দ ছিল, ১। ঘটবারি ২। ঘটস্থাপন ৩। ধর্ম্মঘট। প্রথম শব্দ ঘটবারি সবাই বুঝতেন, যার অর্থ যে ঘটে বারণ গতিশীলভাবে বিরাজমান। সেই ঘট মাটীর ঘটমাত্র, যা বৈশাখ মাসে ধর্ম্মঠাকুরের নামে স্থাপন করা হত, তাতে থাকত জল। তা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করা হত, ‘যতদিন না বৃষ্টি হবে, ততদিন প্রত্যহ রাত্রীতে উপবাস করা হবে’। দ্বিতীয় শব্দের অর্থ কিছু কিছু নিম্ন অধিকারী বুঝতেন। ঘটস্থাপন হল ঘটের অস্তিত্বকে রক্ষা করে পালন করা। সেটি হল কিছু বাহ্যবস্তু ঘটানো বা প্রস্তুত করা। তৃতীয় শব্দ ধর্ম্মঘটের অর্থ কেবল উচ্চঅধিকারিগণ বুঝতেন, যার অর্থ ছিল ধর্ম্ম অনুসারে (স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ও সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে) যে ঘটনা ঘটে, ঘটায়, ঘটানো হবে … ইত্যাদি। একালের উদাহরণে, একটি চালু শিল্পকারখানা মানে সজল ঘটবারি, শিল্প কারখানা যেহেতু অনেকখানি জমির উপর গড়ে ওঠে, সেটা হল ঘটস্থাপন, আর এই কারখানায় যা ঘটনাসকল ঘটবে, বা ঘটে চলেছে, বা ঘটানো হবে তার সবই ধর্ম্মঘট।
ইংরেজী strike-এর প্রতিশব্দ হিসেবে আমাদের পণ্ডিতগণ ধর্ম্মঘটকে চালু করলেন। যা ধর্ম্মঘটে এর প্রকৃত অর্থকে উপস্থাপন করে না। হিন্দী হরতাল, বাংলায় ধর্ম্মঘট ইংরেজীর strike এর সমার্থক হয়ে নিজের বিশাল ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

 

নাম
নাম শব্দটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত। বৈশিষ্ট্য দ্বারা আমরা পৃথকিকরণ করি, নাম দ্বারাও তাই করি। যেমন কোকিল যত কাকের বাসায় ডিম পারুক না কেন, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে ঠিক চেনা যায়, ওটা কোকিলের ছা; কাকের নয়। আবার আম গাছে আমই ধরবে, কখনও কাঁঠাল নয়। আমের গন্ধ আর কাঁঠালের গন্ধ এক নয়। শব্দ শুনেও বোঝা যায় কোন্টা কুকুর আর কোন্টা বিড়াল। নামকরণের ক্ষেত্রে সত্তার বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব পায়, প্রাচীন কালে নামকরণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হয়েছিল।

নাম = ম্না + মন্ (মনিন্) — কর্ম্মবাচ্যে। (বঙ্গীয় শব্দকোষ)

ম্না ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দ হল নাম। ম্না + মন্ = যাহা দ্বারা ম্না-কে মনে করা হয়। ম্না = সত্তার (ম্ন = ম্ + ন) সর্ব্বাধিক সীমায়িত রূপ, অতিসীমিত না- করণ /অন-করণ (সক্রিয়) যে আধারে। [ম বর্ণটি মিতকরণ বা সীমায়িত করণ বোঝায়, ন বর্ণ অন-করণ (সক্রিয়) অথবা ন-করণ (নিষ্ক্রিয়) বোঝায়। এখানে ম্মা ক্রিয়ামূলে ন সক্রিয়তা বোঝাচ্ছে]

যখন আমরা শিশুর জন্মের পর তার নামকরণ করি, তাকে বারবার ওই একই নামে ডাকা হয়। তখন ওই শিশুটি ওই নামে চূড়ান্তভাবে সীমায়িত (ম) হয়ে যায়। তার মানে তাকে যে নামে ডাকা হয়, ওই শিশুটি ওই নামে আমাদের মনে ম্না (মনে করা) হয়। আমাদের মনে যে ভাবনার যে ধারা আছে তাতে বারবার ডাকার ফলে ওই নামে ওই শিশুটি ম্নাত হয়। আগের দিনে এই নামকরণ কিছুটা বিলম্বে করা হত, শিশুটির কিছুটা বেড়ে ওঠার পর, তার যে বৈশিষ্ট্য প্রকট, সে অনুযায়ী নামকরণ করা হত। এখনও দেখা যায়, কোনও মানুষ যে বৈশিষ্ট্য দ্বারা বেশী নিজেকে প্রকাশ করে, তাকে ওই বৈশিষ্ট্যসূচক নামে ডাকতে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে নামকরণের রীতিটা ছিল সত্তাসূহের ক্রিয়া বা স্বভাব অনুযায়ী। যেমন: গা আচ্ছাদিত যাহার, সে হয় গাছ ; হিংসা করে যে, সে হয় সিংহ; ব্যাপকভাবে আঘ্রাত হয় যে, সে হয় ব্যাঘ্র। ম্নাত— অভ্যস্ত, অনুশীলিত, অধীত, পঠিত। কোন একটি বিষয়কে তার নাম ধরে বারবার উচ্চারণ করে বললে, তাকে বলা হয় ম্নাত, স্মাত-এর আধার আম্নাত, যার আরেকটি অর্থ নাম। প্রতিটি সত্তাই তার নামকরণ দ্বারা আমাদের মনে ম্নাত হয়। যেমন: একটি বাঘকে আমরা বাঘ হিসেবে মনে মনে যে রূপে কল্পনা করি, বাঘ শব্দটী উচ্চারিত হলে তার সেই রূপটিই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। বাঘ বললে শেয়াল বুঝি না, আবার শেয়াল বললে বাঘ বুঝি না। যাকে মানুষ চিনেছে, বুঝেছে তাকেই একটি অভিধার ভিতরে সীমায়িত করে নিয়েছে।

কাজেই নাম হল সেই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি, যা একটি বস্তু বা বিষয়ের সংক্ষিপ্ততম ধ্বনিরূপ, যে ধ্বনির ভিতরে বস্তু বা বিষয়টী সূক্ষ্মতমরূপে ধরা থাকে। নাম কোনও অর্থহীন শব্দ নয়, অর্থপূর্ণ ও বারংবার ব্যবহারযোগ্য ও ব্যবহৃত শব্দ। সমস্ত ভাষার সমস্ত প্রাচীন নাম অর্থপূর্ণ ছিল। প্রাচীন মানুষ প্রথমে অদৃশ্য কিন্তু সক্রিয় সত্তাসমূহের নামকরণ করে, পরে দৃশ্য সত্তাসমূহের নামকরণের রীতিটাও চলে আসে। বাংলায় যা নাম, ইংরেজীতে সেটা name, প্রাচীন ইংরেজীতে nama, জার্মান name, ল্যাটিনে nomen।

 

দব (তেজ)
“পাশা চৌপর সতরঞ্জ খেলা আমার বন্ধে জানে, খেলব এবার বন্ধের সনে” এটি হাছনরাজার গান। বিয়ের সময় গাওয়া হয়, সনাতন ধর্ম্মালম্বীদের বিয়ের সময়ে পাশা খেলার একটা পর্ব্ব থাকে। পাশা খেলায় দান থাকে, কড়ী দিয়ে খেলাটি খেলা হয় বর কনের মাঝে। পাশা আর দাবা খেলা এক নয়। তবে দাবাকে শতরঞ্জ খেলা বলা হয়। শতরঞ্জ খেলায় মন্ত্রীর হাতে থাকে সর্ব্বময় ক্ষমতা, সেজন্য সে সকল বলকে দাবিয়ে রাখে, তাই হয়ত মন্ত্রীকেই দাবা বলা হয়ে থাকে। দুই রাজার মধ্যে যুদ্ধের অনুকরণে যে খেলা, যদিও মন্ত্রীর-ই সব ক্ষমতা।

দাব ক্রিয়া চালায় যে সেই দাবা। দাবা হল দাব-এর আধার। দব হতে জাত দাব। দু ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দ দব, √দু + অ (অচ্) — কর্ত্তৃবাচ্যে। দব = (তেজ) দাতাকে বহন করে যে। দব এর অর্থ বন, অরণ্যবহ্নি, দাবানল, অগ্নি, জ্বর, উত্তাপ। দাব এর অর্থ দব, আধিপত্য, প্রভাব, দমন, তাড়া, ধমক, চাপ, দমন করা, শাসন করা, ভয় দেখান, চাপ দেওয়া, চাপা দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। দবদব = দপদপ। দপ, দব শব্দটি কেবল দৃশ্য অর্থ বহন করে তা নয়, অদৃশ্য অর্থও বহন করে। আরবী ভাষায় দবদবা, ইংরেজী ভাষায় dab, dap এরকম শব্দ একই উৎস থেকে জাত বলে মনে করা হয়।

যার দাব আছে সে দাবকি দেয়। দাব দাবড় দিলে মানুষ দাবড়ানি খেয়ে পালায়। যার ক্ষমতা আছে, তেজ আছে সে সবাইকে দাবিয়ে রাখে, অর্থাৎ তার দাব-অন আছে। দাবানল কথাটি আমরা শুনে থাকি। যে অনল অন্য সবকিছুকে দাবায়, যে অনল দাব দাব (দাউ দাউ) করে জ্বলে সেই অনল হল দাবানল। কাঠে কাঠে ঘর্ষণে যে অনল উৎপন্ন হয়। তার মানে কাঠের দাবশক্তি আছে। সে বনকে পুড়িয়ে ফেলে। দাব নবরূপে উত্তীর্ণ দাবু-তে। গরুরগাড়ীতে মাল বোঝাইর সময় দাবু কথাটী ব্যাবহৃত হত। গরুরগাড়ীতে মাল বোঝাইর সময় খেয়াল রাখতে হত যেন আগে পিছে সমান ভার থাকে। সামনের দিক বেশী ভার হলে তাকে বলা হত দাবু। পিছনের দিক বেশী ভার হলে বলা হত উলাড়। দাবু সামান্য বেশী হলে জোয়াল গরুর কাঁধে ঠিকমত চেপে বসে তখন গাড়ী ঠিকঠাক চলে। উলাড় হলে গাড়ী চলতে পারে না।

বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ আজকের দিনের মধ্যবিত্তের জীবনকে গরুরগাড়ীর বলদের মতই ভাবছেন। তাদের সামনে পারিবারিক চাপ, পিছনে অফিসের কাজের চাপ। ভারসাম্য আর কিছুতেই রক্ষা হয় না, টানাটানিতে দিশেহারা অবস্থা।

 

তথ্যসূত্র:
বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, টি.এস রহমান।

 

 


রুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে।
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারি চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার