You need to validate that!
চমকে উঠলাম, কী ভ্যালিডেট করব! আধা ঘুম আধা জাগরণে খেই হারিয়ে ফেলছি, বুঝতে পারছি না আমি জেগে, নাকি ঘুমে, আদৌ কি বেঁচে আছি? বড্ড ক্লান্তি একটা অবসাদ আবার কেড়ে নিচ্ছে শব্দ হয়ত আবার ফিরে যাচ্ছি মিউট মোডে অথচ সেদিন যখন তুমি এলে কথা ছিল, আমি দাঁড়িয়ে থাকব দরজায়, অপেক্ষায় … দাঁড়ানোর কথা ভুলে তখন আমি ব্যস্ত হাজার কাজে … হঠাৎ দেখলাম তুমি আমার কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালে … তোমার চোখ কাউকে খুঁজছে …তেমন রিপিট তোমায় করতে দেখি না, তবে সেদিন তুমি পরেছ সেই স্যুট … তারপর যখন তোমার পালা এল তুমি ওঠলে, কোন দিকে না তাকিয়ে হেঁটে এলে আমার সামনে, হাত বাড়ালে যেন জানতে আমার কাছেই থাকবে তোমার পাওয়ার পয়েন্টের রিমোট …
— পর্ণাদি ও পর্ণাদি! আমার স্নান হয়ে গেছে, তুমি স্নানে যাও, মাসিমা এখুনি খেতে ডাকবে!
স্ক্রিপ্ট থেকে চোখ ওঠালো সূপর্ণা, জানলা দিয়ে দেখল, স্নান সেরে ঘরের লাগোয়া ছোট্ট ব্যলকনীতে কাচা জামা কাপড় মেলছে টুকান।
সকাল থেকে প্ল্যাস্টিক চেয়ারে বসে কাজ করছে বুঝল ঘাড়টা শক্ত হয়ে আছে, বেশ ব্যথা, ষ্ট্রেচ করতে করতে ভাবল কী করে যে এই গল্পটা সিলেক্ট করল পিযুষদা! লেখকের স্টাইল অদ্ভুত, কবিতা না গল্প বোঝা ভার, এমন একটা গল্প থেকে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে পর্ণার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।ছোট হলেও খোলামেলা বারান্দায় একফালী রোদ, ফুলের টবে টুকানের লংস্কার্ট থেকে টুপটুপ করে ঝরছে জল …
মাসিমার ফুলের শখ, নানা রঙ-এর ফুলেরা বারান্দা আলো করে ফুটে আছে, বসন্তে চোখের আরাম হলেও অ্যালার্জির এই সিজিন পর্ণাকে কিন্তু খুব ভোগায় …— এখনও ওঠনি! কখন বলেছি স্নানে যাও! আমার কিন্তু খিদে পেয়েছে! সারাদিন ঘাড় গুজে এই টেবিলেই কাটাবে জানি! স্নান খাওয়াটাতো অন্তত সারো!
— টেবিলে বসে কাটাব নাতো কী করব! লকডাউন না হলে তোর দেখা পাওয়া যেত? ছুটির দিন মানেই তো চড়কিবাজি! চা খেয়েই ছুটতি আর রাত দশটার আগে বাড়ী ঢুকতি? নেহাত মাসিমার কার্ফ্যু আছে তাই নইলে আদৌ বাড়ী ফিরতিস না সৌম্যর বাড়ীতেই থেকে যেতিস্ কে জানে!
— আহা সৌম্যের মা, বৌদি যেন বরনডালা সাজিয়ে বসে আছে আমার জন্য।
কথা বলতে বলতেই আলনা থেকে জামাকাপড় নিয়ে স্নানঘরের দিকে রওনা দিল পর্ণা। এক সপ্তাহ হয়ে গেল লকডাউন, ঘরকুনো পর্ণার তেমন কোন অসুবিধে হচ্ছে না বরং লেখা গুলোয় মন দিতে পেরেছে …
প্রান্তিক শহরের মেয়ে সে, ছোট থেকেই পড়াশোনার সাথে সাথে পারফরমিং আর্টসে ইন্টারেষ্ট, নাটক, আবৃত্তি আর অল্পসল্প লেখালেখি। ইকোনমিক্সের প্রফেসর বাবা সারাজীবন গ্রুপ থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন।
কিন্তু যাদবপুরে কমপারেটিভ লিটারেচার নিয়ে পড়তে পড়তে মাঝপথে যখন পর্ণা ঠিক করল সিনেমা নিয়ে পড়বে তখন কিন্তু বাবাও ওকে সাপোর্ট করেনি …
Royal Academy of Cinema & Performing Arts (RACPA) institute-এ জয়েন করার পর হোষ্টেল ছেড়ে মাসিমার পেয়িংগেষ্ট হয়ে এই বাড়ীতে, টুকানই ওকে এনেছিল।
মাসিমার গল্পটা খুব কমন, রিটায়ার্ড অধ্যাপিকা, বিধবা, ছেলে বিদেশে। ফ্ল্যাটের একটা ঘরে নিজে থাকেন, সাজানো গোছানো ছেলের ঘর সারাবছর তালাবন্ধ। তাই অন্য ঘরটা বিনে পয়সায় টুকানকে দিয়েছেন থাকার জন্য। মাসিমার ফেলে আসা গ্রাম বীরভুমের মেয়ে টুকান।
টুকানের সাথে পর্ণার ইন্সটিটিউটেই আলাপ, ও যখন মরিয়া হয়ে ঘর খুঁজছে তখন টুকানই ওকে প্রস্তাবটা দেয়, মাসিমাও কোন আপত্তি করেননি একটার জায়গায় দুটো মেয়ে পেয়ে আরো খুশী বিশেষ করে ঘরকুনো পর্ণা এখন মাসিমার সর্বক্ষনের সঙ্গী …
স্নান সেরে খেতে এসে পর্ণা দেখল টুকান মাসিমার সাথে রান্নাঘরে এমনিতে নমিতা মাসীই ওদের রান্নাবান্না করে কিন্তু লকডাউনের জন্য ওকে টাকা পয়সা দিয়ে মাসিমা বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপর ওরা তিনজনে সব কাজ ভাগ করে নিয়েছে। লিষ্ট করে বাজার হাট, ওষুধপত্র পর্ণাই সব নিয়ে এসে স্টোর করেছে লকডাউনের আগেই, বেশিদূর যায়নি পাড়ার দোকান থেকেই সব এনেছে …
রান্নাবান্নার দায়িত্বে মাসিমার সাথে হাত মেলায় টুকান …
পর্ণা আসলে টুকানের ভাড়াটে একটাই ঘর দুজনে শেয়ার করে। মাসে কিছু টাকা দেয় ঘরভাড়া বাবদ টুকানের হাতে। সুরঞ্জনা ঘরভাড়া না নিলেও ওরা অনেক বুঝিয়ে খাওয়া দাওয়া জন্য কিছু টাকা ওনার হাতে দেয় … তাতে, বাইরে খাওয়ার খরচা এবং শরীর দুটোই বাঁচে …
বাবা মায়ের মতের বিরুদ্ধে পড়তে এসেছে পর্ণা, বাড়ী থেকে খরচের টাকা পয়সা নেয় না, মনে মনে ঠিক করে রেখেছে পড়াশোনার খরচাটাও একদিন বাবাকে ফেরত দেবে; খরচা চালাতে ইন্সটিটিউটের পড়াশোনার পাশাপাশি টুকটাক প্রুফ রিডিং আর একটা ছোট কোম্পানীতে স্ক্রিপ্ট, আর ডায়লগ লেখার চাকুরী করে; ছুটির দিনেই ঘরে বসে কাজ তাই সারাদিন ঘরেই থাকে, ধীরে ধীরে মাসিমার ডান হাত হয়ে ওঠেছে পর্ণা, এ বাড়ীর যত বাইরের কাজ, বাজারহাট, বিল দেওয়া, প্লাম্বার খোঁজা সব কিছুতেই পর্ণা; সোসাইটির সবাই বেশ মিলেমিশে থাকে, একে অন্যের খোঁজ খবরও রাখে।
গেটের বাইরেই দোকানপাট, অটো স্ট্যান্ড, যদিও ওলা, উবারের জন্য আজকাল ট্যাক্সির দেখা মেলে না। সুরঞ্জনার কড়া নির্দ্দেশ চেনা অটোতে ইন্সটিটিউটে যাবে, অচেনা কারো গাড়ীতে ওঠতে মানা। পর্ণা, টুকান গৌরাঙ্গদাদার অটোতেই যাতায়াত করে, বাড়ী ছেড়ে আসার দুঃখ প্রায় ভুলতে বসেছে মাসিমার আদরে, ভালবাসায় …
খেতে বসে পর্ণা দেখল আজো প্রচুর পদ লকডাউন যেন একটা ছুটির আবহাওয়া তৈরি করেছে, বহুদিন কর্ম্মরতা সুরঞ্জনা নিজের হাতে রান্নার ভার পেয়ে মনের খুশীতে এখন রেঁধে চলেছেন …
— কী করেছ মাসিমা! বিউলীর ডাল, আলুপোস্ত, মাংস, চাটনী রবিবারের দুপুর তো জমে গেছে!
— বিকেলে চায়ের সাথে ভেজিটেবল চপ, সব সবজী সেদ্ধ করে রেখেছি, তোমরা হেল্প করবে হাতে হাতে গড়ে নেব।
— আর রাতের মেনু কী, জান পর্ণাদি? কাৎলার কালিয়া আর মুড়িঘন্ট আর মুসুরীর ডালের সাথে ঝুরঝুরে আলুভাজা।
— এবেলা বিউলী আবার ওবেলা মুসুরী?
— কাল চিকেন বিরিয়ানী। এই সুযোগে আমার রান্নাটা শেখা হয়ে যাচ্ছে …
পর্ণা মনে মনে প্রমাদ গোনে, হিসেব করে বোঝে লকডাউনের স্টক নিশ্চই শেষের দিকে ভাবতে ভাবতেই মাসিমার গলা …— কাল সকালে ওঠেই বাজারটা সেরে আসিস … এক ব্যাগ চাল ছাড়া সবই বাড়ন্ত …
যা ভেবেছে, তাই! এই বাজারে লোকে স্টক করছে যাতে বাজারে যেতে না হয় আর এরা মোচ্ছব শুরু করেছে …— আমার ঘাড়ে খুব ব্যথা, খুব ক্লান্ত লাগছে … আমি খেয়ে উঠে আজ একটু শোব … বিকেলে উঠে তোমাদের চপ বানাতে হেল্প করব।
(পর্ণা ঘরে এসে শুয়ে পরে …)— পর্ণাদি ওঠ! ও পর্ণাদি ওঠ! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল যে!
(গায়ে হাত দিয়ে টুকান চমকে ওঠে!)— ও মাসিমা শিগগিরি এদিকে এস পর্ণাদির গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!
চোখ মেলে পর্ণা বুঝতে পারল না কোথায় আছে তারপর ধীরে ধীরে মনে পড়ল সব …
টুকানের চ্যাঁচামেচিতে মাসিমা ছুটে এলেন তারপর কী করবেন বুঝতে না পেরে পাশের ফ্ল্যাটের ডাক্তার সমরেশ বাবুকে ডাকলেন …এরপরের ঘটনা পর্ণা আর মনে করতে চাইল না … সোসাইটির সেক্রেটারী এসে ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে অসুস্থ পর্ণাকে গেটের বাইরে বার করে দিল …
সারারাত ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অসহায় পর্ণা জ্ঞান হারিয়েছিল নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না …
— কেমন বোধ করছেন এখন?
— আপনি গ্লাভস্ পরেননি কেন? মুখে মাস্ক নেই কেন?
— কারন আপনি করোনা আক্রান্ত নন তাই …
— কে বলেছে?
— ডাক্তার বাবু দেখে গেছেন আপনার সাধারন ভাইরাল ফিভার হয়েছে
— আমাকে হসপিটালে কে আনল? পুলিস?
— না, আপনার সোসাইটির লোকেরা পুলিসে খবর দিয়েছিল কিন্তু রাতে পুলিস আসেনি …
— আপনার সোসাইটির বাইরে একজন অটোওয়ালা আপনাকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে গেছে …
পর্ণার মনে পড়ল মাসিমার কান্না, টুকানের অসহায় চিৎকার ওরা অনেকবার বলতে চেয়েছে ওর অ্যালার্জির ধাত, এই সিজিনে ওর এমন হয় … কেউ ওদের কথা শোনেনি …পর্ণার মনে পড়ল ঘরে সব বাড়ন্ত টুকান আর মাসিমা কী যে করছে …
সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায়
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ও মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার শেষে কিছুদিনের শিক্ষকতা-জীবন। তারপরেই প্রবাসে পাড়ি।
গত বাইশ বছর যাবৎ ঠিকানা নিউ জার্সি।
পেশায় মন্তেসরি শিক্ষক। ২০০৮ সাল থেকে ছদ্মনামে ব্লগ লেখা শুরু।
২০১০ থেকে ইন্ডিয়া ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও শারদীয়াতে নিজের নামে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লেখা চলতে থাকে|
কমিউনিটির বিভিন্ন ভলেন্টারি কাজের পাশাপাশি নাটক ও সঞ্চালনা করে
সময় কাটাতে ভালবাসেন|