চৈত্রের শুরু, বৃষ্টির দেখা নাই, আকাশেও মেঘের ছিটেফোঁটা দেখা যায় না। প্রচণ্ড খরা, মাঠ, ঘাট শুকিয়ে ঠনঠন। তন্ময়ের দাদুর বাড়ীতে সামনে যে পুকুরটা তাতে জল শুকিয়ে এসেছে, কামলারা আড় বেঁধে কুইন দিয়ে পাশের খালে জলসিঞ্চন করছে। খাল বেয়ে জলের ধারা গিয়ে ধান ক্ষেতে পৌঁছবে। পুকুরের জল প্রায় নিঃশেষ, কামলারা এবার কাদায় নেমে মাছ ধরছে। তন্ময়ের ভারী অদ্ভুত লাগে এই মাছ ধরা দেখতে। চাচাতো ভাইরাও নেমেছে, তন্ময়েরও ইচ্ছে ছিল কাদাজলে নামে, কিন্তু বড় চাচা পইপই করে নিষেধ করে দিয়েছেন। গ্রামের উৎসুক কিছু মানুষ ভীড় করেছে, আর ছোট ছোট ছেলেপুলে রয়েছে। বড়দের মাছ ধরা শেষ হলে ওরা নামবে, তখন যে মাছ পাবে সে মাছ তার। বড় বড় বাঁশের খলুইতে মাছ আলাদা আলাদা করে রাখা হচ্ছে, জীওল মাছ গুলো আলাদা, পুঁটী, মেনী, টাকী এগুলো আলাদা। বেলা প্রায় পড়ে এল মাছ ধরতে ধরতে। বিকেলে বড়আম্মা বাড়ীর পিছনের পুকুরপাড়ে সদ্য তৈরি করা বড় বড় গর্ত্তের পানিতে জীওল মাছগুলো রেখে দিলেন, ওগুলো জীবিত থাকবে ওখানে। তন্ময় ভাবে, কেন শিং, মাগুর, কৈ এমনকি শোল মাছও আলাদা আলাদা গর্ত্তে রাখা হল, সব মাছ কেন রাখা হল না। মনে মনে ভাবতে ভাবতে তন্ময় গল্পদাদুর উঠানে এসে থামে। গল্পদাদু উঠানের বেঞ্চিতে হুঁকো হাতে বসে আছেন। তন্ময়ের চিন্তাক্লিষ্ট মুখ দেখে দাদু নিমেষেই বুঝে নিলেন নিশ্চয়ই মাথায় কোন শব্দ এসেছে। হাত ইশারায় ডেকে পাশে বসালেন, ‘তারপর তন্ময় দাদু! কিছু কি ভাবছ!’
তন্ময় মাথা নাড়ে, ‘দাদু, জীওল মাছ নিয়ে ভাবছিলাম।’
গল্পদাদু হেসে হুঁকোতে একটা টান দিলেন।তারপর বললেন, সে অনেক কথা, জীওল, জল এগুলো নিয়ে অনেক কথাই আছে; বলছি শোন—
(গল্পদাদু এবার একটা পান মুখে দিয়ে শুরু করলেন, তন্ময় মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল।)
আমরা বলি জীওল মাছ, এগুলো জল থেকে তুলে আবার জলে রেখে জ্যান্ত থাকে; তারমানে জলজ্যান্ত। জলে জীবন্ত থাকে যা, তাই জলজ্যান্ত। জল ছাড়া মরে যাবে তাই শিঙী, মাগুর, কই, টাকী, টেংরা এসব মাছকে জলাশয় থেকে তুলে এনে জালার মাঝে রাখা হয়, যেন এগুলো জীবিত থাকে। সাধারণত এ মাছগুলি রুগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কেন পথ্য? অন্য মাছ নয় কেন?
এর কারণ কি এই যে এগুলো পথ্য হিসেবে খুব ভাল কিংবা এগুলো খেলে রক্ত বাড়বে? আসলে তা নয়। এই মাছগুলোর টিকে থাকার ক্ষমতা কিছুটা বেশী। তাই জল থেকে তুলে এনে এসব মাছকে জালায় রাখা হয় এবং এগুলো এভাবেও বেশী দিন বেঁচে থাকতে সক্ষম। সেজন্য সহজপ্রাপ্যতার সুবিধার জন্য এগুলো পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জালার জলে রাখা সত্ত্বেও এগুলোকে জলজ্যান্ত মাছ আমরা বলি না, বলি জিওল মাছ।
দাদু, জালা কী?
জল যে কৃত্রিম আধার বা পাত্রে রাখা হয়, তাই জালা। এবার আসি জলজ্যান্ত কথাটীতে। জলজ্যান্ত কথাটী আমরা ব্যবহার করি, কিন্তু জীওল মাছ জলে থাকলেও আমরা তাকে জলজ্যান্ত বলি না। তাহলে জলজ্যান্ত কথাটী কোথায় আছে? জলজ্যান্ত কথাটী জনসাধারণের মধ্যে জিওল মাছের মত জ্যান্ত আছে। জনসাধারণের মধ্যে জীবিত অর্থে জলজ্যান্ত কথাটী শব্দোৎপাদনকারীরা তৈরি করেছিলেন। এজন্যই কেউ ডাহা মিথ্যে বললে বলা হয় জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা। কেউ লাপাত্তা হলে বলে, জলজ্যান্ত মানুষটা লাপাত্তা হয়ে গেল। যে ঘটনা সবার চোখের সামনে ঘটেছিল এবং মনে আছে তা হল জলজ্যান্ত ঘটনা। তেমনি জলজ্যান্ত সত্যি, জলজ্যান্ত ব্যাপার ইত্যাদি।
(গল্পদাদু একটু থেমে আরেকটী পান মুখে পুরেন। তন্ময় জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে।)
গল্পদাদু আবার শুরু করেন, কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলো ভাল লাগে তেমন একটী শব্দ হচ্ছে জল। কবিতায়, গানে জল শব্দটী খুব বেশীই ব্যবহৃত হয়। জল কী? জল = জন্য লালিত হয় যাহাতে। জন্য হল জনন থাকে যাহাতে, জ্ — অন করে যে, বা জ বর্ণ। জল = জন্য লালিত হয় যাহাতে। জ = জন্য, ল = লালন।
লালন করা বিষয়ে একটু জেনে নিই— লালন করা হচ্ছে লাই দেয়া। লাই দেওয়া হল তুমি যে বিষয় পছন্দ কর, যেদিকে তোমার যেতে মন চায় সেদিকে যেতে সাহায্য করা। এই যে তুমি শব্দের বিষয়ে জানতে চাও, সেটা জানিয়ে আমি তোমাকে লাই দিচ্ছি। আর অনেক স্থান আছে, যেখানে জনন থাকে না তা হল অজ। যেমন যে পাড়াগাঁয়ে ফসলও জন্মে না, বা ব্যবসা-বাণিজ্য নাই সেটাকে বলে অজ পাড়াগাঁ।
পুরাণের নাম শুনেছ নিশ্চয়!
তন্ময় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। দাদু আবার বলতে থাকেন, সেই পুরাণের অনেক জায়গায় জল শব্দটী দিয়ে জনসাধারণকে বুঝানো হয়েছে।
এখনও আমরা কোথাও জনসমাগম হলে বলি জনসমুদ্র। জলের তো স্রোত থাকে, তেমনি চলমান জনগণও স্রোতের মত চলতে থাকে, তাই চলমান জনগণকে বলি জনস্রোত। জলে থাকে মাছ, কুমীর, রুই কাৎলা; তেমনি মানুষরূপী জলেও থাকে (জনসাধারণের মাঝে) টাকার কুমীর, ঘোড়েল, রাঘববোয়াল, রুইকাতলা। জলে থাকা প্রাণীদের সাথে স্বভাব যেমন, তেমন স্বভাব অনুযায়ী সমাজে বাস করা জনগণকে নামকরণ করা হয়েছে, এ থেকে আমরা বুঝতে পারি জল শব্দের অর্থ। প্রাচীন কালে জল শব্দ দ্বারা একই ধরনের আবেগ নিয়ে একত্রিত জনগণকে জল হত। জল থাকে সমুদ্রে, কাজেই জনসমুদ্র। জলে থাকে স্রোত কাজেই জনস্রোত। সেজন্য জলজ্যান্ত, টাকার কুমীর, রাঘববোয়াল, রুইকাৎলা এসব শব্দ দিয়ে জলের সাথে মিল আছে এমন মানুষকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
জলের তিনটী রূপ— তরল, বায়বীয়, কঠিন।
বায়বীয় রূপটী মেঘ হয়ে আকাশে ভাসে। মেঘ ভারী হয়ে গর্জ্জন করে, তেমনি নেতৃস্থানীয় লোকেরা সমাজের ওপরিভাগে উঠে সম্পদ বন্টন করত, শাসন করত। এদের বলা হত গর্জ্জনকারী মেঘ, বজ্রকণ্ঠ বজ্রনিনাদ শব্দও বোধহয় এভাবেই এসেছে।
আর যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা অপরিবর্ত্তনীয় এবং তা বোঝা হিসেবে জনগণের ওপর চেপে বসে তাকে বলা হত হিমালয়। তাই জল বলতে যেমন জনন-লালনকারী শ্রমিক-কর্ম্মী জনমজুর বোঝায়, তেমনি ইংরেজী water- কেও বোঝায়। √জল (আচ্ছাদন) + অন্ = জল, ছাত্রবোধ অভিধান। সে অনুযায়ী জলের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হয় আচ্ছাদন করে যে।
লোকটী জনসমুদ্রে হারিয়ে গেল, আর খুঁজে পাওয়া গেল না। মানুষ জলের ভিতর (জনসাধারণের) ভিতরে আত্মগোপন করে আত্মরক্ষা করে, যেভাবে রাজনৈতিক কর্ম্মীরা অনেক সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে যান।
জল সমতা পছন্দ করে, শান্ত জলের ওপরিভাগ তাই সমান থাকে। জনগণও সমতা পছন্দ করেন, সমান থাকা পছন্দ করেন। কিন্তু যারা ধনী, নিজেকে অভিজাত প্রমাণ করতে চান তারা সকল মানুষ একই স্তরে তা মানেন না, নিজেকে জলের ঢেউয়ের মত একটু উপরে রাখতে সুখবোধ করেন, তাদের জলি বলে, জল যেখানে গতিশীল তাই জলি। ইংরেজী jolly শব্দটী হচ্ছে জলির উত্তরাধিকার।
জল যেমন চলতে থাকে, দূরে হারিয়ে যায়, মানুষও তো জলের মতই হারিয়ে যায়, কারণ মানুষের স্বভাবও তাই, কারণ জলের স্বভাবের সাথে মানুষের স্বভাবের মিল রয়েছে।
জলা— জলের আধার যে। জলি— জল গতিশীল যাহাতে। জলকন্টক— জলের কাঁটা যে, পানিফল, কুমীর। জলে বসবাসকারী প্রাণীর পথের কাঁটা কুমীর, আর জনসমুদ্রে সাধারণ মানুষের কাঁটা হল টাকার কুমীর। উভয়েই গিলতে উন্মুখ, গিলে ফেলে। জলকন্যা— জল হইতে জাত যে কন্যা; অপ্সরা। জলজ্যান্ত— যাহা জলে জীবিত ছিল। জলে জ্যান্ত বা জীবিত থাকে যে সত্তা। এই শব্দটী জলে থাকা প্রাণীর ক্ষেত্রে নয় বরং মানুষের ক্ষেত্রেই অর্থাৎ জনসাধারণের মধ্যে জীবিত অর্থে প্রচলিত। যেমন, লোকটী জলজ্যান্ত মিথ্যে বলল। জলদ— জল দেয় যে।
গল্পদাদু এবার থামলেন।
ইতিমধ্যে দাদুর সামনে চা এসেছে। দাদু চা নিয়ে ব্যস্ত হলেন। তন্ময়ের তর সইছে না যেন। সে প্রশ্ন করে, ‘দাদু, জলে থাকে মাছ, কুমীরও থাকে। আরো কত প্রাণী থাকে। সবারই কি মানুষের সাথে মিল রয়েছে?’
দাদু চায়ের কাপ শেষ করে, পান মুখে দিয়ে আবার শুরু করেন—
হ্যাঁ, মানুষের স্বভাবের সাথে মিল করেই এরকম নামকরণ। আগের দিনে মানুষের সম্প্রদায়কে জল বলা হত আগেই বলেছি। সেই জলের মধ্যে যাদের প্রচুর ব্যক্তিগত ধনসম্পদ ছিল তাদেরকে সাধারণ ভাবেই মৎস্য বলা হত। যাদের একেবারে কম ধনসম্পদ ছিল তাদের চুনোপুঁটী বলা হত। যাদের যথেষ্ট ধনসম্পদ ছিল তাদের বলা হত রুই কাৎলা। যারা অন্যের সম্পদ হরণ করে প্রচুর সম্পদ সঞ্চয় করত, তাদের বলা হত রাঘববোয়াল। যাদের সম্পত্তি অন্যদের জন্য বিপজ্জনক ছিল তাদের বলা হত ঘড়িয়াল। আর যারা কুম্ভ অর্থাৎ নিজস্ব সম্পদাগারের মালিক ছিল তাদের বলা হত কুম্ভীর বা কুমীর।
তন্ময় অবাক হয়ে শুনছিল দাদুর কথা। ওদিকে সন্ধ্যা হয় হয়, তন্ময়ের ডাক পড়ল ঘর থেকে। তন্ময় গল্পদাদুকে সালাম দিয়ে নিজেদের ঘরমুখো হবে, দাদু তখন আবার বললেন, ‘তন্ময় তুমি কোন ক্লাসে পড় এবার!’
তন্ময় বলে, ‘দাদু, ক্লাস এইটে।’
তখন দাদু আবার বললেন, আরো দুয়েকটা কথা বলছি বন বিষয়ে— পরিবারে পরিবারে যে সমাজ সমাজ ছড়িয়ে, তা হল বন। সেই সমাজের সামগ্রিক উচ্ছাস, উল্লাস, প্লাবণ, বিপ্লব সবই বানের মত, তাই আমরা বলি আনন্দের বান ডেকেছে এরকম।
এই পারিবারিক সমাজের যা গুণাগুণ, সম্পদ বিপদ সেগুলি সবই বন্য। সেই বন্যগুণ যখন চতুর্দ্দিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন তা বন্যা। জল যেমন জনসাধারণকে বোঝায়, তেমনি জনসমুদ্র, জনারণ্য বলতে জনসাধারণকেই বোঝায়। আমরা বন বলতে অরণ্য বুঝি, বান বলতে বর্ষার উচ্ছ্বসিত জলরাশি বুঝি। বন ও বান আসলে সাধারণ মানুষের সাথেই সম্পর্কিত। আমরা চোখে দেখতে পাই যে বন, বান এবং তার মানেও বুঝতে পারি। তার পাশাপাশি সমাজের যে বন ও বান আছে তা চোখে দেখতে পাই না, তবে ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণে তা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তো দাদু! এবার ঘরে যাও, সন্ধ্যা হয়ে এল, আমাকে আবার ও পাড়ায় যেতে হবে।
তন্ময় ধীর পায়ে দাদুর ঘর থেকে বের হয়ে এল। তার কানে শব্দগুলো একটানা যেন বেজে চলেছে …
রুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে। বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারি চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।