ব্যক্তিমনে বা চিদাকাশে এবং সমাজমনের আকাশে খ্যাতি (সুখ্যাতি, কুখ্যাতি) যখন দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে আমরা ‘খ্যাতি’ বা ‘যশ’ বলে আখ্যা দিই; অর্থাৎ কুকীর্ত্তি বা সুকীর্ত্তির খবর দ্রুতগতিতে/বিদ্যুৎবেগে মানুষের মনের গভীরে আলোড়ন বা ঝড় তুলে গভীর খাত তৈরী করে স্থিতিলাভ করে আর তাকেই আমরা ‘যশ’ বা ‘খ্যাতি’ নামে অভিহিত করি।
পলাশীর যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, জগৎ শেঠরা খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জ্জন করেছিলেন স্বদেশের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। অর্থাৎ তাদের সমস্ত শক্তি তারা প্রয়োগ করেছিলেন কীভাবে ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী’র হাতে অবিভক্ত পূর্ব্ব ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ ছাড়পত্র, বাজার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক কর্ত্তৃত্বকে হস্তান্তরিত করা যায়; ভারতবর্ষকে বৃটিশ উপনিবেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা করা যায়।
পক্ষান্তরে সিরাজৌদ্দোল্লা, মোহনলাল, মীরমদন এরা যশস্বী হয়েছিলেন দেশীয় সার্ব্বভৌমত্বকে রক্ষার জন্য পরাধীনতার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব্ব বীরত্বপ্রদর্শনে এমনকি জীবনপাত করতেও পিছপা হননি বলে, এবং তারাও সেই সুখ্যাতি অর্জ্জন করেই ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। যশস্বী বা কীর্ত্তিমান মানুষের ‘যশ’/খ্যাতি প্রকৃতিজগতের ঝড় ঝঞ্ঝা বা ঘূর্ণিবাত্যার মত অত্যন্ত দ্রুতবেগে মানুষের চিদাকাশেও ছড়িয়ে পড়ে। ক্রিয়ার দিক থেকে উভয়ের কী অদ্ভুত সাদৃশ্য!!
বাস্তব জগতে ভূমণ্ডলে বা বায়ুমণ্ডলে গতিশক্তি প্রয়োগের ফলে জল বায়ু, গ্যাস, অগ্নি, ধূলি বা বালুকারাশি ইত্যাদির মত প্রাকৃতিক অস্তিত্বগুলি যখন দুর্ব্বার গতিতে চরাচরে ব্যাপ্ত হয়ে মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বস্তুসম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতিসাধন করে কুখ্যাতি অর্জ্জন করে অর্থাৎ অস্বাভাবিক দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ঝড়, ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণিবাত্যা ইত্যদি ঘটার ফলে মানুষের জীবনে বিপর্য্যয় নেমে আসে তখন তাকে ক্রিয়ার দিক থেকে দেখতে গেলে ‘যশ’ নামে অভিহিত করতে অসুবিধা হয় কি? আদিতে সমস্ত ভাষাই যে ক্রিয়াভিত্তিক ছিল; ক্রিয়াকে ভিত্তি করেই নামবাচক শব্দ গড়ে ওঠেছিল এবং সেই নাম যাদৃচ্ছিক ছিল না— একথা আজ প্রমাণিত সত্য।
তবে অতীতের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মবিস্মৃতির কারণে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্ব ভুলে প্রতীকী লোগোসেণ্ট্রিক বিশেষ্যভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়লেও এক এক জাতি বা ভাষাগোষ্ঠী একই ক্রিয়ায় অসংখ্য অভিমুখগুলির কোন একটিকে আজও অজান্তে ধরে রেখেছেন। বর্ত্তমানে বাংলাসহ ভারতীয় সব ভাষাতেই ‘যশ’-এর অর্থটি সুখ্যাতি অর্থেই স্থিতিলাভ করেছে, কুকীর্ত্তি নিন্দনীয় হয়ে গেছে। কুখ্যাতিও যে সুখ্যাতির মতই একইভাবে দ্রুতগতিময় ব্যাপ্তি বা বিস্তারণ ক্রিয়াকে বোঝাতেই ব্যবহৃত হতে পারে সেকথা ভুলে গেলেও অংশত হলেও শুধু সুখ্যাতিকেই ‘যশ’ অর্থে স্থিতিশীলভাবে ধরে রেখেছে।
সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত ওমান দেশের ভাষাতে যশ বা ইয়াস শব্দের অর্থ ‘হতাশা’ অর্থেই স্থির হয়ে গেছে। বিপর্য্যয়কারী সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের অস্বাভাবিক দ্রুততায় ব্যপ্ত হয়ে পড়ার ক্রিয়াকে ভুলে গেলেও সেই ক্রিয়ার ধ্বংসাত্মক পরিণাম যা মানুষকে দুঃখ ও হতাশায় নিমজ্জিত করে, সেই ক্রিয়াফল বা ক্রিয়ার পরিণামটিকে ধরে রেখেছে। তবে শব্দার্থের এই ভিন্নতা সত্ত্বেও শব্দার্থের ভিতরে ক্রিয়ার যোগসূত্র বা সম্পর্কের বিশ্লেষণ থেকে ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের যাথার্থ্য এবং গুরুত্বকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
‘যশ’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক বর্ণভিত্তিক অর্থব্যাখ্যা নিম্নরূপ—
যশ = “যায়ীর (য-এর) শক্তিরূপে বিচ্ছুরণ যহাতে; অথবা, যে যায়ী (কীর্ত্তিকথার যাওয়া) সার্ব্বিকভাবে বিচ্ছুরিত হইয়াছে”— [কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত ‘সরল শব্দার্থকোষ’]। প্রতীকী অর্থগুলি— সর্ব্বত্রব্যাপী’, কীর্ত্তিজাত, শৌর্য্যাদিজাত খ্যাতি/অখ্যাতি।
য = (ইঅ = ই + অ = গতি + স্থিতি) গতি ও স্থিতি করে যে = যায়ী, যাতা, যাত্রী;
শ = আপাতপূর্ণ শক্তির যোজন বা প্রয়োগ করে যে, কিংবা শক্তির সার্ব্বিক বিচ্ছুরণ করে যে; অথবা যতখানি মানসিক বা দৈহিক যেরূপ শক্তি চাই ততখানি ও সেরূপ শক্তি প্রয়োগ করে যে; কিংবা, আপাতপূর্ণ জ্ঞানশক্তির, করণশক্তির, মননশক্তির, গণনশক্তির … বা ঐপ্রকার কোন শক্তির প্রয়োগ যাহাতে; অথবা, প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগ করে যে; কিংবা, শক্তি দান করে যে। প্রতীকী অর্থসমূহ— আপাতপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় শক্তির যোজন বা প্রয়োগকরণ, তদ্রূপ শক্তিপ্রয়োগকারী, শক্তিদাতা, শক্তিমান। — “সরল শব্দার্থকোষ”।
নারায়ণচন্দ্র দাস
ভাষা গবেষক ও সম্পাদক : বঙ্গযান । নিবাস: শিলিগুড়ি, ভারত ।
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ মেহেরাজ হাসান শিশির