এক—
কখনো কখনো বাস্তবতা থেকে দূরে সরে গিয়ে কবীরা স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করেন। নির্ম্মাণ করেন নিজস্ব মায়ার শহর। শব্দের প্রতিবেশিতার ফাঁকে ফাঁকে সুবাসিত হয় পরাবাস্তব সৌন্দর্য্য। যেমন, কোলরিজের কুবলা খান।
কুবলা খানের জানাডুর মতন রবীন্দ্রনাথও ‘উজ্জয়নিপুর’ তৈরী করেছেন। পবিত্র আলফ নদীর মত, রবীন্দ্রনাথেও শিপ্রানদী বয়ে যায়; যার পাড়ে আধোঘুমে আধো-স্বপ্ন-জাগরণে কবী পূর্বজন্মের প্রথম প্রেমিকাকে খোঁজেন।
এদিকে আমার ক্লান্তি, আমার তন্দ্রা, বিদ্যুতের কম ভোল্টেজে আলো-আঁধারির উৎপাত আমাকে এক স্যুরিয়েল জগতে নিক্ষেপ করে। আমি মৃত ঘুঙুর নদীর সবুজ ডাঙায় হারিয়ে যাওয়া এক যুবতীকে ডালসিমার বাঁজাতে দেখি। না ঘুমে— না স্বপ্নে— প্রাচীন এক বাদ্যযন্ত্র আমার শরীরের ভেতর কেবলই বেঁজে চলে…… কেবলই আমাকে ছিঁড়ে ফেলে আদিম মূর্চ্ছনা।
দুই—
যেকোনো সাহিত্যকর্ম্মের পিছনের গল্পের চেয়ে কোলরিজের ‘কুবলা খান’-এর গল্প (খুব সম্ভবত) সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত। কোলরিজের দাবী, যখন তিনি আফিমের নেশায় ‘হাই’ হয়ে ছিলেন, কবিতায় বর্নিত সব দৃশ্য ধরাছোঁয়া যায় এমন হয়ে তাঁর সামনে এসেছিল। এবং তখনই এইসব দৃশ্য, জায়গা, আর মানুষজনের বিবরণ নিয়ে ৩০০ লাইনের এক কবিতা স্বতস্ফুর্ত্তভাবে তাঁর মাথায় খেলে যায়। কেমিক্যাল রোমান্সের শেষে— নেশার ঘোর কাটার পর— তিনি লিখতে বসেন, আসলে হাই হয়ে থাকার সময় যে তিনশ লাইন পোনা মাছের ঝাঁকের মতোন মাথায় এসেছিল সেগুলো টুকে নিচ্ছিলেন। সেই সময় এক অনাহুত অতিথি কোলরিজের ফার্মহাউসের (সমারসেট, ইংল্যান্ডে অবস্থিত) দরজায় কড়া নাড়ে। ঠক্ ঠক্ ঠক্। কোলরিজের কাজ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। এই যে কেমিকেল রোমান্সের ঘোরের স্বপ্নে পাওয়া মাথায় থাকা কবিতা খাতায় আনার কাজে ব্যাঘাত হল, এটা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত ব্যাঘাত। অতিথি বিদায় করে কোলরিজ যখন আবার লিখতে বসলেন, মাথায় থাকা কবিতার শব্দেরা, দৃশ্যেরা ততক্ষণে গায়েব হয়ে গেছে। ৩০০ লাইন সাকুল্যে ৫৪ লাইনে এসে অসম্পূর্ণ থেকে গেল।
কবিতাটি (খুব সম্ভবত) ১৭৯৭ সালে লেখা হলেও (অবশ্যই ১৮০০ সালের পরে লেখা নয়), অজানা কারণে ১৮১৬ সালের আগে প্রকাশিত হয়নি। পরে লর্ড বাইরনের চাপাচাপিতে কোলরিজ প্রকাশ করেন। তারপর থেকেই কবিতাটি দুনিয়ার অতি বিখ্যাত, প্রশংসিত, এবং বিতর্কিত কবিতা হয়ে যায়। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্পেন্সার হিল বলেন, “It must surely be true that no poem of comparable length in English or in any other language has been subject of so much critical commentary. Its fifty-four lines have spawned thousands of pages discussion and analysis. “Kubla Khan” is sole or a major subject in five book-length studies…”
কবিতাটির একটা জাদুকরী ক্ষমতা আছে; মায়ার ঘোর আছে; আছে রহস্যময় ছবির জগৎ। কোলরিজের কন্ঠে আবৃত্তি শোনার পর আরেক কবী চার্লস ল্যাম্ব লিখেছিলেন, “…so enchantingly that it irradiates and brings heaven and Elisian bowers into my parlour while he sings or says it. “
তিন—
যখন মনে হয়, আমি কেবলই ছিঁড়ে যাচ্ছি, আদিম মূর্চ্ছনায় বাজছি, আমি আশ্রয় খুঁজি সংগীতে, সাহিত্যে, চিত্রকলায়। আজ সন্ধ্যায় আশ্রয় পেলাম এলিস ডিউকের (যিনি কাল্পনিক জিনিসের চিত্রায়ণে সিদ্ধহস্ত) কুবলা খানের ফ্যানটাস্টিক জগতের চিত্রে।
হাসিব উল ইসলাম
জন্ম: ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে, কুষ্টিয়ায়।
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক
(বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা সেনানিবাস।)
কবিতা, অনুবাদ ও শিল্পসাহিত্য বিষয়ক লেখালেখিতে বিশেষ আগ্রহী।
প্রকাশনা:
কবিতা, বাংলা থেকে ইংরেজি কবিতা, চিত্রকলা সম্পর্কিত লেখার অনুবাদ, বিদেশী গল্প-কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্রিকায়।
প্রচ্ছদ মেহেরাজ হাসান শিশির
{[‘কুবলা খানের জগতে’ বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}