দস্যু-তস্কর-লুটেরাসঙ্ঘ যখন পরদেশের ভূমী গ্রাস করে দখলদারসঙ্ঘ বনে যায় তখন তাদের সেই দখল বজায় রাখতে যা যা করতে হয় তাই তাই করেছে বঙ্গভূমীর বৃটিশ দখলদারসঙ্ঘ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। অব্যহতভাবে লুন্ঠিত ও চোষিত সম্পদ নিজ দেশে পাচারের জন্য তারা নানান প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। সেই সব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। দখলদারদের স্বার্থ রক্ষায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলা হয়েছে যা সমাজদেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-উপাঙ্গকে সংক্রমিত করতে পারে। বৃটিশ লুটেরা-দখলদার সেই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের সবচে বড় সর্ব্বনাশা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ এই দেশের যা কিছু দুর্ভাগ্য ও লাঞ্ছনা তার সূতিকাগার এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই অতি-নেতিবাচক মন্তব্য সবিস্তারে ব্যাখ্যার দাবী রাখলেও এই অংশে কেবল একটি উদাহরণ ব্যবহার করব। সেই উদাহরণ বুঝতে অনেকটা সহায়তা করবে কেন এই পরিণতি হল।
আমরা জানি, ভাষা কেবল চিন্তার বাহনই না, চিন্তার স্মারকও বটে। মানুষের ভাষাই বলে দেবে তার চিন্তার শক্তি ও দুরাবস্থার কথা এবং ইঙ্গিত দেবে তার ভবিষ্যতের। এই কথাটা প্রেক্ষাপটে রেখে আমরা বুঝতে চাইব ‘ইউনিভার্সিটি’ ভাব-প্রত্যয়টি কীভাবে বাংলায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ অভিনামে আত্মস্থ হয়েছে এবং তার পরিণতি কী।
যতটুকু বুঝতে পারি, ‘বিদ্যালয়’ শব্দটা বাংলাভাষায় খুব বেশিদিন হয় চালু হয়নি। কলিকাতায় প্রথম স্কুল “সেন্ট থমাস স্কুল” প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮৯ সালে। ১৮০০ সালে এসে হয় প্রথম কলেজ— “ফোর্ট উইলিমাম কলেজ”, তার ১৭ বছর পর ‘হিন্দু কলেজ’ চালু হলে ‘কলেজ’ প্রত্যয়টা নিজেদের ভাষায় বুঝে নেয়ার তাগিদ তৈরী হয়ে থাকবে। স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছুতে কলিকেতার লেগেছিল অর্দ্ধশত বছরের বেশী। ১৮৫৭ সালে এসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি’। অনুমান করি এই সময় কালেই ‘বিদ্যালয়’ শব্দটা বাংলাভাষায় পাট্টা গেড়েছে।
সে কালে ইংরেজী ভাষা থেকে বাংলা করার দায় ছিল বাংলা-না-জানা লুটেরা-দস্যু-দখলদার ইংরেজদের। দস্যুবৃত্তির সক্ষমতা যেহেতু তাদের ছিল সুতরাং তাদের আজ্ঞা পালনের লোকের অভাব হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব পালন করছিলেন বাংলা-অপছন্দ-করা সংস্কৃত-পণ্ডিতরা। এই কাণ্ডে অনেক অপ্রচলিত বা স্বল্প প্রচলিত সংস্কৃত শব্দ তারা বাংলায় চালু করেছেন আবার সংস্কৃত নিয়মে নতুন বাংলা বানিয়েছেন। মনে রাখা দরকার, প্রাণের তাগিদে তারা এই কাজ করেননি, করেছেন আয়-উপার্জনের প্রেষণে। স্বভাষার স্বভাব তাদের বিবেচনায় রাখতে হয়নি। অনুমান করি, ‘বিদ্যালয়’ তাদেরই আমদানি। আমাদের গুরুগৃহ ছিল, টোল ছিল, চতুষ্পাঠী ছিল, পাঠশালা ছিল, বিহার ছিল, মক্তব ছিল; মাদ্রাসা ও জামিয়ার সাথে অনেকের পরিচয় ছিল কিন্তু ‘বিদ্যালয়’ ছিল না। ‘বিদ্যালয়’ শব্দটা ব্যবহারের সূচনাকালে বিদ্যাপীঠ, বিদ্যামন্দির, বিদ্যায়তন ইত্যকার শব্দও ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু কল্কে পায় ‘বিদ্যালয়’।
বিদ্যার সাথে শিক্ষার পার্থক্য বিপুল। কিন্তু অনুবাদকদের কল্যাণে উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে ‘বিদ্যা’ শব্দটা ‘শিক্ষা’র সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলার বিভিন্ন শিক্ষামন্দির বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অভিহিত হতে শুরু করে। এই তিন প্রতিষ্ঠানই দেয় বা দিতে চায় “শিক্ষা” কিন্তু তাদের নাম— “বিদ্যালয়”!
যারা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ইংরেজী নামের বাংলা করছিলেন তাদের খুব ভাল করে ইংরেজী ভাষা বা ইংরেজদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রত্যয়গুলোর সাথে গভীর পরিচয় থাকার সুযোগ ছিল না। আবার যাদের জন্য তারা এই নামগুলোর বাংলা করছিলেন সেই দখলদার ইংরেজদেরও বাংলা ভাষা সম্পর্কে ভাল জানা-শোনা ছিল না। এই সুযোগে গোঁজামিল দিয়ে কাজ চালানোর মতো কিছু একটা বাংলা দাঁড় করালেই সে সময় চলে যাচ্ছিল। সুতরাং স্কুলের বাংলা ‘বিদ্যালয়’ হল, কলেজের বাংলা হল ‘মহাবিদ্যালয়’। উল্লেখ্য, ‘নালন্দা মহাবিদ্যালয়’ সম্পর্কে পণ্ডিতদের (যারা একই সাথে হিন্দু ও সংস্কৃত ভাষায় বিজ্ঞ) নিশ্চয়ই শোনা বা পড়া ছিল কিন্তু বৌদ্ধদের এই জ্ঞানপীঠকে যে ঠিক কোন্ পরিচয়ে সনাক্ত করা যায় এবং/বা কোন স্তরে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে দিকে মন দেওয়ার অবকাশ সম্ভবত তাদের ছিল না। কোন একটা ভাষা ব্যবহারের আদ্যোপান্ত অনুসরণের কঠিন পথে না হেঁটে কয়েকটা চুরি করা কথার আশ্রয় নিয়েই তারা মনে করেছেন খুব একটা জ্ঞানের কাজ সারা গেল!
অনেক ক্ষেত্রেই ভুলভাল একটা কিছু অনুবাদ করে দিলেই সমাজ-মানসে তা সহজে গৃহীত হয় না। কিন্তু বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় হল। ‘কেন হল’ এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে গিয়ে যে কথাটা মনে ধরেছে সেটিও কম মন্দ নয়!
বাংলায় ‘বিদ্যা’ শব্দটার একটি অর্থ চৌর্যশাস্ত্র বা চুরি। স্কুল কলেজগুলোয় তখন যা হচ্ছিল এবং তা থেকে এদেশের বিদ্যার্থীরা যা নিচ্ছিলেন বা পাচ্ছিলেন তাকে চৌর্যশাস্ত্র বলাই সম্ভবত সমীচীন মনে করেছে তৎকালের জনমানস। সুতরাং স্কুল কলেজের বাংলায় ‘বিদ্যা’ শব্দটা আলয়ের পূর্ব্বপদ হিসেবে জুড়ে গেলে আপত্তির কিছু দেখেনি এই ভাষার সাধারণ ব্যবহারকারীরা।
বঙ্কিম থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমার কথার সমর্থনে ‘বিদ্যা’ শব্দটার ব্যবহার দেখানো যায়— “সে বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা।” এটি বঙ্কিম থেকে নেওয়া বটে কিন্তু সত্য হচ্ছে, এটি এ সমাজে প্রবাদ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত। তার মানে ‘বিদ্যা’ শব্দটাকে চৌর্যশাস্ত্র বা চুরি দিয়ে প্রতিস্থাপন করাটা এই সমাজমানসে আগে থেকেই প্রোথিত ছিল। নইলে সুধীন্দ্রনাথ কেন ‘মহাবিদ্যা’ শব্দটার এমন ব্যবহার করতে যাবেন— “হয়ত মহাবিদ্যার অপবাদটা অনেকখানি লঘু হত৷” না আমি ‘দশ মহাবিদ্যার’ কথা ভুলে যাইনি। “এ তো দশ মহাবিদ্যা প্রকীর্ত্তিতাঃ” বলে দেয় ‘দশ মহাবিদ্যা’র দশা সম্পর্কে বাঙালিমানস শত শত বছর ধরেই সচেতন ছিল, তা সত্ত্বেও তন্ত্রমন্ত্রের বাইরে থাকা মানুষ বিদ্যার ব্যাঙ্গার্থকেই আপন করেছিল যথা-অর্থ হিসেবে।
এরই ধারাবাহিকতায় ‘ইউনিভার্সিটি’র বাংলা হিসেবে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটা যখন চালু হল তখনও সাধারণ মানুষ তা গ্রহণ করে নিল। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়— এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন পরের ভাবের ঘরে চুরি করে বা নকল করে বানানো, তার ভেতরে কায়কারবার যা হয় সেসবও যেহেতু নকল করেই চলে, এ কারণেই সম্ভবত বাঙলার সাধারণ মানুষ তাদের ভাষায় বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শব্দ তিনটি গ্রহণে আপত্তির কারণ দেখেনি। আর এতেই এই নামকরণের ভেতরে লুকিয়ে থেকে গেল সে সময়ের পণ্ডিতদের কোন একটা ভাবপ্রত্যয় বাংলায় অনুধাবন ও অনুবাদে যথেচ্ছাচারের ইতিহাস।
প্রথম যখন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল তখন স্কুলের বাংলা করার দরকার হয়ত তেমন ছিল না। কিন্তু যখন নিজেদের মত করে হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজ তৈরী করা গেল তখন তার একটা জনবোধ্য বাংলা নাম অবশ্যই জরুরী হয়ে থাকবে। সুতরাং তখনই বাংলায় জন্ম নিয়ে থাকবে ‘বিদ্যালয়’ শব্দটি। বাংলা একাডেমী তার বিবর্ত্তনমূলক বাংলা অভিধানে ‘বিদ্যালয়’ শব্দটার প্রথম ব্যবহারের যে উদাহরণ দিয়েছে সেটি ১৮২৯ সালের বঙ্গদূত থেকে নেওয়া।
বিদ্যার আলয় হচ্ছে বিদ্যালয়। কিন্তু বিদ্যা শব্দটার অর্থ হচ্ছে, “যাহার দ্বারা বিদিত হওয়া যায় তাহার আধার” বা “যাহার দ্বারা জ্ঞান সাধিত হয়”। কার বা কিসের দ্বারা বিদিত হওয়া যায় বা জ্ঞান সাধিত হয়? উদাহরণ— শাস্ত্র বা বই দ্বারা। তার মানে, বিদ্যার ‘আলয়’ বা ধারক যদি কিছু থাকে সে শাস্ত্র বা বই। বই নিজেই ‘বিদ্যালয়’ কিন্তু ‘স্কুল’ তো বই নয় বা বিদ্যার আলয় নয়। সম্ভবত এ কারণে ‘বিদ্’ ক্রিয়ামূলে অসংখ্য শব্দ বাংলায় থাকলেও ‘বিদ্যালয়’ শব্দটা ঊনিশ শতকের আগে বাংলায় সুলভ হয়নি।
কলেজ যেহেতু বিদ্যালয়ের চেয়ে গায়েগতরে অনেক অনেক বড় বা বিশাল দেখায় সুতরাং তার বাংলা হল ‘মহাবিদ্যালয়’! (স্মরণ করুন, বাংলায় ‘মহাবিদ্যা’র একটি অর্থ চুরিবিদ্যা) কিন্তু অচিরেই যখন ‘ইউনিভার্সিটি’র সাথে বঙ্গীয় পণ্ডিতদের পরিচয় ঘটল এবং তার বাংলা করা জরুরী হয়ে দাঁড়াল তখন তৈরী হল বিপদ। ‘ইউনিভার্সিটি’ তো আরও আরও বড়, বেশ কিছু স্কুল কলেজকেও সে পেটের মধ্যে রেখে দেয় কিন্তু ‘ইউনিভার্স’ তথা মহাজগতের ‘মহা’ তো এরই মধ্যে খরচ করে বিদ্যালয়ের আগে বসিয়ে দিয়ে কলেজের বাংলা ‘মহাবিদ্যালয়’ করা হয়ে গেছে, এখন বিদ্যালয়ের আগে কোন্ শব্দ বসিয়ে ‘ইউনিভার্সিটি’র বাংলা করা যায় সে নিয়ে নিশ্চয়ই ঝামেলা হয়ে থাকবে! শেষ পর্য্যন্ত ‘বিশ্ব’ শব্দটা বিদ্যালয়ের আগে বসিয়ে কাজ সারা হল, আমরা পেলাম ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ অভিধাটি। যদিও ‘বিশ্ব’ শব্দটার ইংরেজী ‘ওয়ার্ল্ড’ হিসেবেই জারি ছিল তারপরও ইউনিভার্সকে ‘ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হল ।
বিশ্ববিদ্যালয় কথাটা কীভাবে তৈরী হয়েছিল তা ভাবলে বিস্ময় তৈরী হয়। ‘বিশ্ব’ কি বিদ্যালয়ের আগে বসে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হয়েছে, না কি ‘আলয়’ শব্দটার পূর্ব্বপদ হিসেবে ‘বিশ্ববিদ্যা’ বসিয়ে তা তৈরী হয়েছে? একই প্রশ্ন মহাবিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও ওঠে। যদি ধরে নেই ‘বিদ্যালয়’ শব্দটার আগে ‘বিশ্ব’ যোগ করা হয়েছে তাহলে এটি পরিষ্কার যে সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতরা তাদের ক্ষুদ্র ও অপরিণামদর্শী চিন্তা-বিশ্বের আলোকে ‘বিশ্ব’ শব্দটাকে একটা অবোধ্য ধারণার প্রতীক মাত্র ঠাউরে ছিলেন।
বস্তুত, ‘বিশ্ব’ শব্দটা এত অদ্ভুত অর্থ ধরে যে তা ক্ষুদ্র থেকে সুবৃহৎ সব কিছুকেই ধারণ করতে পারে। এই আমার যেমন একটা বিশ্ব আছে, পিঁপড়ারও একটা বিশ্ব আছে, পৃথিবীরও একটা বিশ্ব আছে, ব্রহ্মাণ্ডেরও একটা বিশ্ব আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কার বা কোন্ বিশ্বের আলয় আমাদের ‘বিশ্ববিদ্যালয়’?
আর যদি ‘সর্ব্ব’ অর্থে ‘বিশ্ব’ শব্দটা বিদ্যার আগে বসানো হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠে ‘মহা’ শব্দটা কী অর্থে বিদ্যালয়ের আগে যুক্ত হয়ে ‘মহাবিদ্যালয়’ হল আর কেন তাহলে ইউনিভার্সিটির বাংলা মহাবিশ্ববিদ্যালয় হল না? নিখিল, ব্রহ্মাণ্ড বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডবিদ্যালয়ও অবশ্য হতে পারত! সম্ভবত পশ্চিমে ‘কসমস’ শব্দটা একাডেমিক স্তর-বিন্যাসে কোনোভাবেই হাজির ছিল না বলে ও যাত্রায় শব্দগুলো রেহাই পেয়েছে!
আবার যদি ‘বিশ্ববিদ্যা’ কথাটার সাথে ‘আলয়’ জুড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হয় তাহলে স্মরণ করতে হয় যে, বাংলার আদি চিন্তকদের ভাবনায় যে চতুর্দ্দশ বা বত্রিশ বিদ্যা ছিল তাতে “বিশ্ববিদ্যা” বলে কিছু ছিল না। এটিও অভিনব সৃজন, যা মহাবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে কিন্তু মহাবিদ্যাকে অতিক্রম করতে পারে না।
অনুমান করি, শুরুতে গুরুতর ঝামেলা হয়নি বলে এই বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শব্দত্রয়ী ক্রমাগত প্রচারিতই হয়েছে। কিন্তু যখন ইউনিভার্সিটি কলেজগুলো নিজেদের পরিচয় “ইউনিভার্সিটি কলেজ” হিসেবে দিতে গেল তখন চোখ কুঁচকে গেল তাদের। “ইডেন ইউনিভার্সিটি কলেজ”— এর বাংলা কীভাবে করবেন, “ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় মহাবিদ্যালয়”? কন্যার গর্ভে মাতার জন্মের ব্যাপারটা বুঝে নেওয়া আয়েসসাধ্য বলে ইউনিভার্সিটি কলেজ-এর বাংলা আর পুরাটা করার চেষ্টা করেননি কেউ!
এ আলোচনায় এই কথাটা উল্লেখ করা দরকার যে, “অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তন।” কিন্তু ইউনিভার্সিটির বাংলা হিসেবে ‘সর্ববিদ্যায়তন’ জনমান্য হয়নি। নিশ্চয়ই এর কিছু কারণ থেকে থাকবে।
বিগত অন্তত আড়াইশ বছর ধরে শিক্ষিত-বাঙালীর ভাব-ভাষা-চিন্তার জগতের প্রায় সব কিছুই চুরি করা। এ অবারিত চৌর্য্যবৃত্তির কারণেই বাংলায় শব্দসংক্ষেপণের কোনো বিধি না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ “ঢাবি” এবং তার বিদ্যালি ছত্রধর এই আমার পরিচয় “ঢাবিয়ান”! এই ঢাবিয়ান শব্দটা এমনভাবে তৈরী যা গাধা ও ঘোড়ার সংমিশ্রণে তৈরী হওয়া খচ্চরের কথা মনে করিয়ে দেয়!
কোনো একটা ভাব-প্রত্যয় সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে যখন সেই ভাব-প্রত্যয়টি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয় তখন শেষ পর্য্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি- এই প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপ জানলেও তাদের মানসপ্রকৃতি না জেনেই দখলদার বৃটিশের সহযোগী শিক্ষিত-বাঙালীরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন এবং স্বাভাবিক নিয়মেই তারা অনুকরণেও ব্যর্থ হয়েছেন। তবে শিক্ষাক্রমের মধ্যবর্ত্তী সোপানের ‘মহাবিদ্যালয়’ নামটি গ্রহণের মাধ্যমে তারা তাদের চুরি বা চৌর্যশাস্ত্র চর্চ্চার পদছাপ রেখে দিয়েছেন। আর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ সেই মহাবিদ্যারই চূড়ান্ত প্রকাশ হয়ে উঠতে চেয়েছে।
এই যে নকল করার বিদ্যা— এটিকেই স্বাভাবিক করে তুলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তার সকল কিছুই নকল করা। এমন কি পাঠ্যসূচিগুলো পর্য্যন্ত নকল। আরও বিস্ময়কর হচ্ছে, অনুল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বাদে তাদের সকল বিভাগের পাঠ্যসূচী আজও পরভাষায় লিখিত। এই মহাবিদ্যা চর্চ্চাকারীরা দাস্যমনোবৃত্তির কারণে অনুমান করে, পরের ভাষা চুরি করেই তারা বিশ্বদরবারে মর্য্যাদার আসন পাবে। এই বিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে তারা এই চুরি এতটাই সিনাজুড়ির সাথে করতে শুরু করে যে পুরো দেশের সকল প্রতিষ্ঠান আজ এই ব্যধিতে সংক্রমিত হয়ে গেছে।
বাংলাভাষার আজ যে অবনমন, যে অধস্তন দশা; তার সূতিকাগার ও রূপকার এই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। এই অভিনামকে অনুসরণ করে পরবর্ত্তীতে তৈরী হয়েছে ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’। ‘ঢাকা’ থাকলে ‘উন্মুক্ত’ হতে দোষ কি! এভাবে পরের ভাষা আর পরের ভাবের ঘরে চুরি করাকে অতিস্বাভাবিক করে তুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচে বড় অর্জ্জন ও অপরাধ। জ্ঞান নয়, শিক্ষা নয়, দীক্ষা নয় পরভাষায় অপরিণামদর্শী বিদ্যাচর্চ্চার কলঙ্ককে সে মণিহার করে তুলতে চেয়েছে। এক অর্থে, আজকের বাংলাদেশের যে সর্ব্বগ্রাসী অধঃপতন তার অন্যতম উৎস এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কেবল নিজেই নষ্ট হয়নি, এ দেশের আর সবগুলো প্রতিষ্ঠান নষ্ট করেছে ঢাবি। অধিকাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত অক্ষম অসৎ পাচাটা প্রতিহিংসাপরায়ণ অহমসর্ব্বস্ব শিক্ষিত-বাংলাদেশীর জন্ম দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
শত বর্ষের অভিজ্ঞতায় সংশয়হীনভাবে এ কথা বলা যায়, খোলনলচে বদলে ফেলতে না পারলে পাচার ও প্রভুরঞ্জনের আদি ভূমিকার বদল হবে না ঢাবির। সেই বদলের অমিত আশা নিয়ে আজ এই ক্ষণে এইটুকু কেবল চাওয়া, দখলদার প্রভূদের ভাব আর ভাষার মহাবিদ্যা চর্চ্চা থেকে বের হয়ে আসুক সে। আর নিদেন পক্ষে দেশের সংখ্যাগরীষ্ঠ মানুষের ভাষায় কথা বলতে শিখুক এই শিক্ষালয়।
আর রাজী
জন্ম: নাটোর, বাঙলাদেশ।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা: গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সহকারী অধ্যাপক: যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রিয় ক্ষেত্র: বাংলা সাংবাদিকতার ভাষা-ভাবনা-চিন্তা অনুসন্ধান।
প্রচ্ছদ, আলোকচিত্র ও অলঙ্করণ মেহেরাজ হাসান শিশির