শব্দের উৎস কিংবা (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক) অর্থ সন্ধান (পর্ব্ব— পাঁচ) || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

সূচী:
ঢল ।। রক্ত ।। সৌদামিনী ।। মেদ, মেধ ।। নমস্কার ও প্রণাম

 

 

এই অতিমারীর কালে যখন বলা হচ্ছে, ঘরে থাকুন ঘরে থাকুন— রাস্তায়, শপিংমলে, যানবাহনে তখন মানুষের ঢল নেমেছে। ঢল তো নামে পাহাড় থেকে, অতিবৃষ্টির কালে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে ঢলের পানী গড়িয়ে গড়িয়ে সমতলে আসে, আর আমরা তখন বলি ঢল এসেছে। এই ঢল কত বাড়িঘর, ফসলিজমী ভাসিয়ে যায়, ডুবিয়ে যায়; বাঙালিজাতী জলের ঢলের সাথে খুব ভালই পরিচিত। যেমন ধরি এককাপ ভর্ত্তি জল, মনে হচ্ছে উপচে পড়তে যাচ্ছে কিন্তু পড়ছে না। কাপে জলের এই অবস্থা হল টলটলে জল, সেই জল বাতাসে টলমল করে। শচীন দেব গেয়েছিলেন, ‘টলমল টলমল ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলিয়া যায় রে’ এর মানে বাতাসেও ঢেউ খেলে সে ঢেউ টলমলে ঢেউ।

কাপের ভিতর যদি এবার পিন ফেলতে থাকি, টলমল জল তখন ঢলঢল অবস্থায় চলে যায়, ঢলঢল জল আর কাপের ভেতরে নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না; ঢলে পড়ে যাবে। টলমল জলে পরিধির বন্ধন থাকে, নিষেধের বেড়া থাকে কিন্তু জল ভর্ত্তি কাপে পিন ফেলতে থাকলে তার আর উঁচুতে ওঠার উপায় থাকে না, ডাইনে বাঁয়ে গড়িয়ে বা ঢলে পড়ে যাবে।

ঢল অর্থ জলের পঙ্কিলতা, শিথিল, আলগা, হেলিয়া পড়া, বিচলিত হওয়া, প্রাবাহিত হওয়া। ঢল এর পুনরাবৃত্তি হল ঢলঢল। একটী পুকুর কানায় কানায় পূর্ণ কিন্তু জল উপচে পড়ছে না, সেই অবস্থা হল পুকুরটীর টলটল বা টলমল অবস্থা। টলমল জল যখন আরেকটু উপরে ওঠার চেষ্টা করে, তখনই সে ঢলে পড়ে যায়; ডাইনে বায়ে গড়িয়ে যায়। জল যখন ঢলে পড়ে তখন সে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে, সমান এলাকায় বা নীচের দিকে।

ঢল হতে জাত শব্দ ঢাল, ঢাল এর আধার ঢালা। ঢেলে দিলে ঢালা হয়, ঢালু বেয়ে সে নীচে গড়ায়। পাহাড়ী ঢল যখন নামে, তখন সে নিম্নভূমীকে প্লাবিত করে, জলের উচ্চতা যখন বাড়তে থাকে তখন ক্রমশঃ উচুঁভূমীকে প্লাবিত করে। আবার ঢল যখন থেমে যায়, জল নামতে শুরু করে উঁচু থেকে ক্রমশঃ নীচের দিকে। ঢাল যখন নবরূপে উত্তীর্ণ হয় তখন তা ঢালু।

রূপ যখন উপচে পড়ে, তখন তা ঢলে পড়ে। ভরা চাঁদের আলো ঢলে পড়ে পৃথিবীর গায়ে, নারীর সৌন্দর্য্য যখন উপচে পড়ে, তখন তাতে ঢল নামে। ঢল এর পুনরাবৃত্তি হলে ঢলঢল হয়, তাইতো গোবিন্দ কবীর ভাষায়, “কাঁচা অঙ্গের লাবণি, অবনী বহিয়া যায়।” আর রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ঢালো ঢালো শশধর, ঢালো ঢালো জোছনা/ সমীরণ, বহে যা রে ফুলে ফুলে ঢলি ঢলি।’

অর্থাৎ ঢালা বা ঢালোর সাথে ঢলে পড়ার সম্পর্ক আছে।

ঢল সক্রিয় হয় ঢলি-তে। তাই ঢল আর ঢলি মিলে হয় ঢলাঢলি। বেশী ঢলাঢলি ভাল নয়। ঢল + অন = ঢলান, যার অর্থ লোক হাসান। যে নারী ঢলাঢলি করে ঢলান কার্য্য করে তাকে বলে ঢলানী। আরেকটী কথা, ঢাল-তলোয়ার দিয়ে আগের দিনে যুদ্ধ হত। বিবিধ প্রকার ঢাল ব্যবহার করে মানুষ আত্মরক্ষা করে। এই ঢাল-এ যখন আঘাত লাগে তখন সে আঘাত পিছলে যায়, আঘাতটা কার্য্যকরী হয় না। ঢাল-এ লেগে তা ঢালা হয়ে যায়, অন্যদিকে গড়ায়।

তো করোনাকালে নৌপথে, শপিংমলেও ঢল নেমেছে। এই ঢল জলের নয়, মানুষের। করোনার বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে আমরা কেউ কেউ ভ্যাক্সিন নিয়েছি, কেউ মাস্ক ব্যবহার করছি, কিন্তু সানাজিক দূরত্ব মেনে চলছি না, কাজেই এই যে মানুষের ঢল আমাদের শেষ পর্য্যন্ত কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তা সময়ই বলে দেবে।

 

“বসন্ত দিন আসবে যখন/ ফুল হয়ে নয় ফুটবো তখন/
হিমেল রাতে দুঃখ তোমার/ ভূষণ করে ঢাকো”

বসন্তে যখন ফুল ফোটে প্রকৃতিতে তখন রঙের ছোঁয়া লাগে। আনমনে মন গান করে যেন, “আজ সবার রংয়ে রং মেশাতে হবে”।

রঙ কী? রং বলি আর রঙ বলি এর একটী অর্থ হল বর্ণ— হলুদ, সবুজ, কালো ইত্যাদি। যেমন গায়ের রঙ, কালো হয় ধলো হয়। কালো রঙ কেউ পছন্দ করে না, মুখে বলে অনেকে কিন্তু বিয়ের পাত্র-পাত্রী খুঁজতে প্রথমে রঙ-ই বিবেচ্য হয়। আলাদা করে রংধনুতে সাতরং আছে। রঙের কাজ হল রঞ্জিত করা।

“এত রং খেলে মেঘে, জলে রং ওঠে জেগে”

রঙ এর আরো অর্থ আছে। তাস খেলায় রঙ আছে, সেটী খেলার তাসের নাম। কথায় রঙ লাগানো হয় যেমন, তেমনি ঘরবাড়ীতেও রঙ লাগানো হয়; প্রথমটী কথাকে বিকৃত করতে আর দ্বিতীয়টী সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করতে। এই দুটো রঙ-ই প্রকৃতকে আড়াল করে। মানুষ রঙ তামাসা করে, কখনও রঙ পরিবর্ত্তন করে এমনভাবে যে চেনাই যায় না। রঙ যেমন ঢালা হয়, তেমনি রঙ দেওয়াও হয়। ফল পাকলে রঙ ধরে, আবার উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মনে নাকি রঙ-ও লাগে।

বলছিলাম রক্ত বিষয়ে চলে গেলাম রঙ এ। কারণ রক্তে রঙ আছে। যাকে রঙ করা হয়েছে, তাই রঞ্জিত। রঙ দিয়ে রঞ্জিত হয় আর যা কিছু রঞ্জিত তাই রক্ত। রক্ত = রং (আবর্ত্তিতের রহস্যরূপ) জনিত ও তারিত যাহাতে। রক্ত = √রন্ জ্ (রঙ করা) + ত (ক্ত), বঙ্গীয় শব্দকোষ। অনুরাগযুক্ত, অনুরক্ত, শ্রবা, ক্রীড়ারত, লোহিত, রক্তবর্ণ, শোণিত, রুধির— ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমরা জানি রেগে গেলে চোখের রঙ হয় রক্তবর্ণ। আরো বেশী রেগে গেলে মাথায় চড়ে রক্ত, রক্তগরম মানুষ হলে তাই হবে। আবার যে কণ্ঠ মধুর শোনা যায় তার নাম রক্তকণ্ঠ। রক্ত দিয়ে কত ফুলের নাম আছে! রক্ত বলতে আমরা blood বুঝি কেবল। কিন্তু রক্ত শব্দের নিহিতার্থ শুধুমাত্র blood বোঝায় না। গায়ের রক্তই হোক বা অন্য কোনো রকম রঞ্জিত বাহ্যিক বা মানসিক বস্তু বা বিষয়ই হোক, যা কিছু রঞ্জিত তার সবই রক্ত। মনে রঙ লেগে রঞ্জিত হলে হয় মানসিক অনুরাগ বা আসক্তি। রঙে অনুরাগিত হলে হয় অনুরক্ত, রঙে বিরাগিত হলে হয় বিরক্ত। মন যে রঙ পছন্দ করে তাতে রাঙিয়ে দিলে হয় অনুরক্ত। মন যে রঙ পছন্দ করে না তাতে রাঙিয়ে দিলে হয় বিরক্ত। বিরক্ত = যে বিপরীত ভাবে রক্ত বা রঞ্জিত হয়েছে, তা সে যে রঙই হোক না কেন। বিরক্ত সক্রিয় হলে বিরক্তির সৃষ্টি হয়। যেমন পছন্দসই রঙে মন রঞ্জিত হলে আরক্তিম হয়, অপছন্দের হলে তেমনি অবয়বে ফুটে ওঠে বিরাগের চিহ্ন; তখন মুখ হয় কালো।

দেহে রক্ত থাকে, মনেও থাকে রক্ত। মনের রক্ত অনুরাগে সিক্ত হয় বলেই কবি কবিতা লিখেন, শিল্পী গান করেন, ফুলের সৌরভে পৃথিবী মোহিত হয়।

আর যদি মনের রক্ত বিরাগে সিক্ত হয়, তবে তা বিরক্তির কারণ হবে, বিরক্তিকর লাগবে তার সবকিছু।

 

 

“চেয়ে দেখ, প্রিয় সখী, কি শোভা গগনে সুগন্ধ-বহ-বাহন, সৌদামিনী সহ ভ্রমিতেছে মন্দগতি প্রেমানন্দ মনে!”
— জলধর / মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

সৌদামিনী একটী মেয়ের নাম। তার নামের অর্থ জানা চাই। সৌদামিনী অর্থ বিজলী, তড়িৎ। কিন্তু এটুকুতে তো মন ভরে না, আরো জানা চাই তার কারণ হাতের কাছে যখন বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ আছেই। আমরাও জেনে নিই সৌদামিনীর সাথে বিস্তারিত—

সৌদামিনী এসেছে ‘দো’ ক্রিয়ামূল থেকে, যার অর্থ বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ বলেছেন ‘নবরূপী উত্তীর্ণ দানের অস্তিত্ব যাহাতে, সর্ব্বপ্রকারের দান ক্রিয়া থাকে যাহাতে। আর সৌদামিনী অর্থ সু যে দামিনী।’

দামিনী অর্থ তাহলে কী?

বঙ্গীয় শব্দকোষ ‘দামিনী’ শব্দের অর্থ দিয়েছেন— দামযুক্তা, বিদ্যুৎ, মালাধারিণী। দাম অর্থ যাহা দ্বারা গতি খণ্ডিত হয়।

তাহলে সৌদামিনীর সাথে দাম-এর একটা সম্পর্ক আছে। দাম বিষয়ক তথ্যগুলো জেনে নেওয়া যাক—

দাম = √দো + মন (মনিন্) — করণবাচ্যে, বঙ্গীয় শব্দকোষ। দম হতে জাত শব্দ দাম। দম হল গতিদাতার সীমায়ন থাকে যাতে। সে শক্তিদান করে অন্যকে সীমায়িত করে বা দমায়। সে সংযত করে, শাসন করে, সংযম করে, শাসিত হয়, শ্বাস নেয়— ইত্যাদি ইত্যাদি।

যে দড়ীতে অনেক গরু বাঁধা যায়, সেটী যেমন দাম তেমনি পণ্যের মূল্যকে বেঁধে রাখাও দাম, দাম দিয়ে গতিকে বিভক্ত করা যায়। দামী বস্তুর দাম থাকে। কোন জিনিস কিনতে গেলে দাম চুকিয়ে দিতে হয়।

তো দামাল, দামড়া, দামন, দামনী, দামামা, এই শব্দগুলো কীভাবে এল! কিংবা শৈবালদাম?

দাম-এর আধার লালিত-লয়প্রাপ্ত দামাল-এ। যে বালক অতিশয় দুরন্ত তাকে শাসন করা দরকার, তাকে দমন করা উচিৎ, সেই রকম বালক-ই দামাল। গরুকে বিশেষ কায়দায় দমানো হয়, তাকে ষাঁড় বানানো হয় তখন তার মধ্যে যে পরিবর্ত্তন হয়, সেটী হল দাম-এর গড়ান-উড়ান; দামড়া হল সেই গড়ান-উড়ানের আধার। সেজন্য কিশোর বয়সী পুংবলদকে দামড়া বলা হয়। অকাজের কিশোর-তরুণকেও দামড়া বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার রীতি আমাদের সমাজে আছে।

দামন শব্দটী ফারসীতে রয়েছে, বাংলায় এর ব্যবহার করেন কবি নজরুল। এই দামনে দাম-করণ বা বন্ধনকর্ম্ম চলে। বধূ তার বরকে আঁচলে বেঁধে রাখে, দয়িতাকে বিপদেআপদে কখনই ত্যাগ না করার অঙ্গীকার।

গরু পাইকাররা হাটে গরুর গলায় দড়ী দিয়ে একত্রে বেঁধে রাখে, এই দড়ী হল গরুর পাইকারী দাম যা গরুগুলোকে ক্রেতার কাছে যেতে দমায় বা আটকায়; একই সাথে পাইকারিমূল্যও তাদের আটকিয়ে রাখে। গরুগুলোকে যে দড়ী আটকে রাখে তাকে যেমন দামনী বলা হত, তেমনি এই পাইকারী দামকে দামনী বলা হত আগের দিনে। এই পাইকারী দাম বা দামনী সবাইকে জানান দেওয়ার জন্য যে ঢাক বাজানো হয়, সেটাই হল দামামা।

যে নদীর জলে প্রচুর শৈবাল থাকে, তাতে কি সহজে সাঁতার কাটা যাবে? পদে পদে সাঁতারুর গতি শ্লথ হবে, আটকে যাবে, দমে যাবে। এজনই বুঝি শৈবালদাম, কারণ দক্ষ সাঁতারুও দীঘীর শৈবালদামে আটকে যেতে পারে।

এবার আসি সৌদামিনী-তে।

বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ যাকে বলেছেন, সু (উত্তম) দামিনী হইতে জাত, দাম গতিশীলভাবে অন হয় যে প্রকৃতি আধারে। দামিনী অর্থ দামযুক্তা, বিদ্যুৎ, মালাধারিণী।

যার হাসির ঝিলিক উচ্চমূল্য সেই তো সৌদামিনী, যাকে সহজে মিলে না, যে থাকে রহস্যময় অবগুণ্ঠনে। যদি সে প্রেমিকা হয়, তবে পরিবারের চোখরাঙানি, বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে পর্দ্দার আড়াল থেকে হাসির ঝিলিক দেয়। যদি সে আকাশের হঠাৎ আঁধারচেরা চমক হয় তবে সে মেঘের আড়াল থেকে ঝিলিক দেয়। যদি সে পণ্য হয়, তবে যে কালে পণ্য বিনিময় নিষিদ্ধ ছিল, সেকালের সামাজিক বিধিনিষেধ আর চোখরাঙানি উপেক্ষা করে আড়ালে থেকে নিজের পণ্যের জানান দিতে ও ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে গোপনে দেওয়া হাসির ঝিলিক। তাই সৌদামিনী কখনও প্রেমিকা, কখনও পণ্যবিক্রেতা, কখনও আকাশের বিদ্যুৎ।

সৌদামিনী এবার আপনমনে ভাবে, সেকি তবে প্রেমিকা! নাকি পণ্য নাকি আকাশের বিদ্যুৎ!

যাই হোক না কেন সে, তাকে খাঁটি হতে হবে। খাঁটি হতে হলে তাকে আলোর কাছে যেতে হবে। চিন্তার আকাশটাকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। আলো ছাড়া অন্ধকার দূর হয় না। অপ্রকাশিত সৌন্দর্য্য হল সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য্য, কারণ মানুষ রহস্য ভালবাসে, রহস্য উন্মোচন করতেও।

 

সেই শব্দটী, যাকে আমরা মেদ হিসেবে জানি, যা মিদ্ ক্রিয়ামূল থেকে জাত। ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় মিদ্ হল সীমায়িতের গতিশীল বা সক্রিয় দান, এবং মেদ হল দিশাগ্রস্ত সীমায়িতের দান যাহাতে।

মেদ: √মিদ্ + অ (অচ্) — কর্ত্তৃবাচ্যে।
মেধা শব্দটীকে জানতে মেধ শব্দটীকে জানতে হবে। √মেধ্ ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দ, ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় মেধা হচ্ছে দিশাগ্রস্ত সীমায়িতের ধারণ যাহাতে।

মেধ: √মেধ্ + অ (ঘঞ্) — অধিকরণবাচ্যে, বঙ্গীয় শব্দকোষ। মেধ এর আধার মেধা।

মানুষকে দৈহিক শ্রম করতে হয়, মানসিক শ্রমও করতে হয়। দৈহিক শ্রমের ফলে মানুষের শরীর থেকে ঘাম বা নির্য্যাস বের হয় তা হল দেহরস, মানসিক শ্রমের ফলে যে রস নির্গত হয় তা হল মনোরস। দৈহিক শ্রম যদি না করা হয় তবে শরীরের রস বের না হয়ে মেদরূপে সঞ্চিত হয় এবং রোগের সৃষ্টি করে, মেদ হল মানুষের দেহরস। সমাজদেহেও মেদ জমে, যদি সম্পদ (জ্ঞান, ধন) সুষ্ঠুভাবে বিতরণ না হয়ে কেন্দ্রীভূত হয়। কেন্দ্রগুলো তখন ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তখন সমাজের শরীরে মেদ জমলে সামাজিক রোগগুলো দেখা দেয়।

মানুষের মানসিক রস জমে মনের মধ্যে স্থুলতার সৃষ্টি করে। তখন সে নতুন কিছু চিন্তা করতে পারে না। মেদ জমে মেদামারা রোগ হয়, আর মেধ জমে মাথামোটা চিন্তাভাবনা ছাড়া আর কিছু হয় না। মেধ এর অর্থ যজ্ঞ, যজ্ঞীয় পশু। মেধ যা কিনা দিশাগ্রস্ত সীমায়িত সত্তা ধারিত যাহাতে, মে হল দিশাগ্রস্ত সীমায়িত সত্তা যা অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জ্ঞানরসের কণা; এগুলো ধারিত থাকে যাহাতে তাই মেধ। জ্ঞানরসের ক্ষুদ্রকণাগুলো পুঞ্জীভূত থাকে দক্ষ মানুষের মাথায়, মনোরসে। দক্ষ মনোরসের আধারকে মেধা বলে। ইতিহাসে ছিল তিন প্রকারের দক্ষ প্রজাতী, যথাক্রমে অশ্ব, নৃ, পুরুষ। একালের ভাষায় বিশেষজ্ঞ, দক্ষকর্ম্মী, ও পরিচালক। মেধ বা যজ্ঞের মাধ্যমে মনোরস ঝরিয়ে দেওয়া হয়।

অশ্বমেধ এর কথা আমরা কমবেশী জানি—

যে মেধ-এ অশ্বকে মেধ করা হয়, তাকে বলে অশ্বমেধ। এই অশ্ব যদি সামাজিক অশ্ব হন তবে তিনি বিশেষজ্ঞ এবং অশ্বমেধ দ্বারা তাঁর মেধ ঝরানো হয়।

নৃমেধ হল যে মেধ দ্বারা নর-কে (নৃ) মেধ করা হয়। এই নৃ হলেন দক্ষ কর্ম্মী মানুষেরা, নৃমেধ দ্বারা দক্ষদের মেধ ঝরানো হয়। পুরুষমেধ দ্বারা পুরুষ বা সামাজিক পরিচালকদের মেধ ঝরানো হয়। আমাদের প্রাচীন পূর্ব্বসূরিগণ মেধ ঝরানোর পন্থা হিসেবে অশ্বমেধ, নৃমেধ, পুরুষমেধ প্রভৃতি কর্ম্মযজ্ঞের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন প্রতীকী আচরণের মাধ্যমে প্রকৃত আচরণকে উপস্থাপন করার রীতি ছিল, তাই বাস্তবে এইসব যজ্ঞাদি চালানোর আগে প্রতীকী যজ্ঞাদির আয়োজন করা হত।

এই যজ্ঞাদির প্রকৃত ইতিহাস ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় পুরাণাদিতে বর্ণিত আছে, যার প্রকৃত মর্ম্ম উদ্ধারে ব্যর্থ ইংরেজ পণ্ডিতেরা ভুল ব্যাখ্যাদি দিয়ে মেধ এর প্রকৃত ইতিহাসকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছেন।

সবশেষে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী বলি, মেদ দিশাগ্রস্ত সীমায়িতের দান থেকে, এবং মেধ দিশাগ্রস্ত সীময়িতের ধারণ থেকে গড়ে ওঠে। মেদ এবং মেধ জমলে মানবশরীর ও সমাজশরীর উভয়ের জন্য অহিতকর।

 


নমস্কার = নম্ ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দ নমঃ।

নম্ = ন-এর সীমায়ন। নম = ন সীমায়িত যাহাতে।

নমঃ: √নম্ + অস্ (অসুন্) — ভাববাচ্যে, বঙ্গীয় শব্দকোষ। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী, নমঃ (নমস্) = ন-এর সীমায়নের শেষ যাহাতে। নমঃ (নমস্) অর্থ নতি, প্রণাম, নমস্কার।

নম থাকে নম্য-এ, যার অর্থ নমনীয়। নমস্ থাকে নমস্য-এ। নমস্ করা অন হল নমস্করণ-এ। নমস্করণ থাকে নমস্কার-এ।

নম করা মানে অন্যকে বা নিজেকে সংকুচিত করা, মিত বা পরিমিত করে নেওয়া। নমঃ বা নমস্ হল সেই সংকুচিত বা মিতকরণের চূড়ান্ত পর্য্যায়, যেন সংকুচিত হতে হতে বিন্দুসম পরিণত করা বা হওয়া। সংকোচন যখন নিজের ক্ষেত্রে হয় তখন তা ইতিবাচক। বড় মাপের কেউ আত্মসংকোচন করে নিজেকে অন্য মানুষের সমপর্য্যায়ে নিয়ে এসে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সংকোচন যখন অপরের ক্ষেত্রে হয়, তখন তা মন্দ। নমঃশূদ্র শব্দটী আমাদের সেই কথা মনে করিয়ে দেয় যে ভারতসমাজ একদিন একটী বিশেষ শ্রেণীর মানুষকে আত্মসংকোচনের চূড়ান্ত পর্য্যায়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল।

প্রণাম = প্রণাম শব্দটীও নম্ ক্রিয়ামূল থেকে জাত। প্র + √নম্ + অ (ঘঞ্) — ভাববাচ্যে, বঙ্গীয় শব্দকোষ। প্রণাম = প্রকৃষ্টভাবে নামা হয় যাহাতে। প্রণাম অর্থ প্রণতি, নমন, নম্রীভাব। প্রণাম শব্দের মূল অর্থ ছিল নমনীয় হওয়ার বা নামার প্রকৃষ্ট রূপটীর আচরণ করা, নিজে নমনীয় হওয়া, অন্যকেও নমনীয় করা। প্রণাম করতে হলে মাথা ঝুঁকিয়ে বা নামিয়ে করতে হয়, তা নমন দিয়ে নমস্যকে নমনীয় করে দিয়ে।

 

তথ্যসূত্র: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, বাঙ্গালা ভাষার অভিধান।

 

 

 

 


রুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে।
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারি চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।

 

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার