আমাদের আদি সংস্কৃতি গুলোর দিকে একটু পেছন ফিরে তাকাই। যেমন— কবিগান, পালাগান, জারী, সারী, ভাটিয়ালী, যাত্রাপালা আরো বহুবিধ সংস্কৃতি ছিল বাংলার অঙ্গনজুড়ে। যাত্রাপালা বাঙ্গালী জাতীর সবচেয়ে বৃহৎ প্রেক্ষাপটে এক আদি সংস্কৃতি। সিনেমা এসে এ ভুখন্ডে তখনও পৌঁছায়নি, অষ্টাদশ শতক অর্থাৎ ১৭০০ সালে যাত্রা ধারণাটি ছড়িয়ে পড়ে উপমহাদেশের বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে। বিভিন্ন তথ্যসূত্র মতে জানা যায়, অষ্টম ও নবম শতকে পালা গান ও পালার অভিনয় হত। এসব পালাগান বা যাত্রাপালার সুরে সুরে উঠে আসত সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার ইতিকথা। ইতিহাস ভিত্তিক, দেশপ্রেম মূলক, ভক্তিমূলক, যাত্রা পালার আবেদন ছিল একেবারে অন্যরকম। এছাড়া পৌরাণিক, মিথ, রূপকথার গাঁথা নিয়ে যাত্রাপালারও বেশ জনপ্রিয়তা ছিল।
সাধারণত নবান্ন উৎসবের সঙ্গে এসব সংস্কৃতির একটি গভীর যোগসূত্র ছিল। অক্টোবর থেকে শুরু হত পালাগান বা যাত্রাপালার আয়োজন।
আদিতে জমিদার বাড়ীতে যাত্রাপালার আয়োজন করা হত। পরবর্ত্তীতে বিভিন্ন মেলায় বা এক্সিবিশনে যাত্রার আয়োজন থাকত। আমরা খুব ছোট বেলায় যাত্রার আয়োজন দেখেছি এক্সিবিশনে। এসব নির্ম্মল সংস্কৃতি তখনকার সহজ সরল মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল যেন অপার আনন্দের উৎস আর উৎসবে।
ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু, বেহুলা-লখিন্দর, মা-মনসা, লক্ষ্মীর মহিমা, কমলাবতী রাণী, রিক্সাওয়ালা, গরীবের মেয়ে, টিপু সুলতান, বনবিবি, খুদিরাম, আলতাবানু, সিরাজুদ্দৌলা, ওপরতলার মানুষ, সোনাভান, তিতুমীর, শাহজাহান, মধুবালা, বিন্দুমতী, আনারকলি, পুস্পমালা, ভেলুয়াসুন্দরী, সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামান এরকম হাজার হাজার রকমের যাত্রার আয়োজনের মাইকিং এর মাধ্যমে মহড়া চলত গ্ৰামে গঞ্জের পথে প্রান্তরে।
১৮৬০-৭৮ সময়কালে ঢাকায় পালাকার ছিলেন কৃষ্ণকমল গোস্বামী। পরবর্ত্তীতে মুকুন্দ দাস দেশপ্রেম, স্বদেশী, সমাজ সংস্কারমূলক, জাতিভেদবিরোধী, পণপ্রথাবিরোধী বক্তব্য ও কাহিনিভিত্তিক যাত্রাপালা রচনা করেন। তাঁর রচিত স্বদেশিযাত্রা ইংরেজশাসকদের রোষানলে পড়ে। পরবর্ত্তীতে মনমোহন বসু, মীর মশাররফ হোসেনও পালা লিখেছেন।
মানিকগঞ্জের আব্দুল করিম, নরসিংদীর জালাল উদ্দিন, হিরেন্দ্র কৃষ্ণদাস, মুন্সীগঞ্জের আরশাদ আলী, কেরাণিগঞ্জের রফিকুল, পটুয়াখালীর মাস্টার সেকেন্দার আলী, খুলনার ডুমুরিয়ার এম এ মজিদ, নান্দাইলের কফিল উদ্দিন, মানিকগঞ্জ সদরের ডা. সদর আলীসহ অনেক যাত্রাপালাকার সেকালে মানুষকে উপহার দিয়েছেন এক সুস্থ বিনোদন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র সহ সমস্ত সাহিত্যিকদের সাহিত্যের মধ্যেও উঠে এসেছে যাত্রা সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রেক্ষাপট।
এসব সংস্কৃতি একদিকে যেমন ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ অপরদিকে সুস্থ, নির্ম্মল, শুদ্ধ বিনোদন ভিত্তিক।
যাত্রাপালার দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা খুব জরুরী। প্রথমত পালার যে দৃশ্যের মাঝে কোন অপরাধমূলক সিকোয়েন্স তৈরী হত সেখানে হঠাৎ করে ‘বিবেক’ নামক একটি চরিত্রের উপস্থিতি ঘটত যা কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে দিত এক ইতিবাচক পরিসমাপ্তির দিকে। এসব সংস্কৃতি তৎকালীন সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মনস্তত্ব গড়তে সহায়ক হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, পালা কারদের একটি আদর্শ ও প্রতিশ্রুতি ছিল— তারা এ সংস্কৃতির ভেতরে কখনো কোন অপসংস্কৃতি, অশ্লীলতা, যৌনতার অনুপ্রবেশ ঘটতে দেননি। মঞ্চনাটকে যে পরিচ্ছন্নতা আজও বিদ্যমান। তদুপরি যে কোথাও কখনো এসব ঘটেনি তা নয়। অশ্লীলতার দায়ে পরবর্ত্তীতে অনেক যাত্রাপালার বিলুপ্তি ঘটেছে। আলোর পাশে যেমন অন্ধকার বিরাজমান তেমনি সবকিছুতেই ভালমন্দ দুইই আছে।
বলা হয়ে থাকে সংস্কৃতি মানুষকে অপরাধপ্রবণতা থেকে দূরে রাখে। এবং একটি সংস্কৃতিমুখী জাতীই পারে মূল্যবোধ ভিত্তিক একটি সুশীল সমাজ গড়ে তোলতে।
সমাজ কখনো পিছায় না। এগিয়ে যায় শিক্ষায়, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তথা সমস্ত কিছুতে।
প্রথমত; টিকটক, লাইকি তৈরী এবং এসব ভিডিও তৈরীর পেছনের যে ইতিহাস ক্রমাগত উঠে আসছে তাতে এদেশের সাংস্কৃতিক বা সামাজিক অঙ্গনে কোন্ ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটেছে?
দ্বিতীয়ত; সারাদিনের কর্ম্মক্লান্তি শেষে কখনো কখনো বিনোদন প্রয়োজন যা পরবর্ত্তীতে মানুষকে কর্ম্মোদ্দীপ্ত করে তোলে। ডিজে পার্টি, পুল পার্টি কেন্দ্রিক যে অসুস্থ এবং নোংরা বিনোদন আমাদের যুব সমাজকে যেভাবে গ্ৰাস করছে সেখানে কোন বিবেকের উপস্থিতি তো নেই বরং এসব সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে সংঘঠিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ, যার চিত্র উঠে আসছে বিভিন্ন মিডিয়াগুলোতে। এ দায় কার? সমাজের দূর্নীতিগ্ৰস্ত পিতা-মাতার অবৈধ সম্পদের পাহাড়ে চড়তে গিয়ে নৈতিকতার স্খলনে পা ফসকে পড়ে যাচ্ছে যুবসমাজের একাংশ। অবিলম্বে লাগাম টানা দরকার এসব অবৈধ সম্পদের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা অপসংস্কৃতির।
আমরা কোন্ যুবসমাজের কাছে রেখে যাচ্ছি ভবিষ্যত রাষ্ট্র ও সমাজ??
মীরা মেহেরুন
Director, 5 Stars Stoves Bangladesh Limitedপড়াশুনা শুরু হয়েছে বাড়ীর পাশের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন লেখা একটি ছড়া পুরো পরিবারে সারাদিনের হাসির খোরাক যোগায়। পড়াশুনার বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু শুরু হয় বাবার তৈরী ঘরোয়া লাইব্রেরি থেকে। মীরা মেহেরুন শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতির ঘরে প্রবেশ ঘটে একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি। পৈতৃক নিবাস খুলনা শহরে। খুলনা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে এসএসসি (মানবিক) পাশ করেন স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৮৬সালে। খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে এইচএসসি পাশের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৯৭ সালে। এরশাদ পতন আন্দোলনের সেশন জটে মেয়াদ দীর্ঘ হয়। বিবাহিত জীবনে ২ সন্তানের জননী। পড়াশুনা শেষে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের শাখা বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে ‘গবেষক’ পদে যোগদান করেন ১৯৯৯ সালে। দীর্ঘ ১৫ বছর একই পদে কাজ করে স্বেচ্ছা-অবসর গ্ৰহণ করেন ২০১৫ সালে। অতঃপর তিনি নিজস্ব উদ্যেগে একটি ফার্ম হাউস তৈরী করে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আলোকিত শহরে বড় হয়ে উঠতে উঠতে আলো অসহনীয় হয়ে ওঠেছে তার চোখে। আপন আলো খুঁজে ফিরছিলেন তিনি যেখানে নিজেকে। সেই প্রত্যাশার হাত ধরে শুরু হলো এগ্ৰো খামার। মীরা মেহেরুনের কৃষক মন যেন খুঁজে পেল পল্লী নিভৃতে নিজেকে বিলীন করার।
স্বপ্নবিলাসী মীরা মেহেরুন কবিতা, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, কলাম লেখার ভেতর দিয়ে জীবন কে তুলে আনতে প্রয়াস খোঁজেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নির্বাহী সদস্য হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশ বেতারে ১৯৯৭ থেকে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০০৯ থেকে তালিকা ভুক্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করছেন। কাজের পাশাপাশি লেখালেখি, পড়াশুনা আর সঙ্গীতের মাঝে নিজেকে সঁপে আনন্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে দিন পেরিয়ে যায় অক্লান্ত।
জ্ঞানভিত্তিক, সংস্কৃতিময়, শিক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন লালন করে তিনি ‘সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার” প্রতিষ্ঠা নিয়ে গবেষণা ও সামাজিক কাজ করে যাচ্ছেন।
একটি সুন্দর সমাজের স্বপ্ন নিয়ে তার প্রতিটি ভোর হয় আর সে স্বপ্নে ভর করে চলে চলে তার অষ্টপ্রহর।
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির
[(শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ, কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তীর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষারীতি অনুসৃত) চারবাক-এর বানান রীতিতে সংস্কৃতির সেকাল একাল প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়]