শামশাম তাজিলের গুচ্ছকবিতা

0

কবি শামশাম তাজিল জন্মগ্রহণ করেন ১ এপ্রিল ১৯৮৪ এ । এখন অব্দি কোনো বই প্রকাশিত হয়নি । ই-মেলঃ shamshamtajil@gmail.com

স্নান

বৃষ্টি থেমে গেছে। সিগারেটে পুড়েছে সন্ত্রাস।
কেবল একবার তাকালে… স্নানের ঘরে নগ্ন দুটি চোখ।
বাসি খোঁপায় ঘুমোয় সংসারি চড়ুই
যেই মাত্র শরীর থেকে খুলে দিলে লাজ চড়ুইছানার স্বরতন্ত্রি ছিঁড়ে… সেও নির্মোক

শরীরের বন্দনা করি

ভাঙ্গে তৈজসপত্র, গোলা ঘর।
ইঁদুরের দাঁতে শৈশব পালিয়ে যায়,
গর্তের ভেতর উঁকি দেয় হারানো চাঁদ,ভাবনার কুহক।
দিন কেটে গেলে হাতড়ে খুঁজি মৎসের গন্ধ,
পাতার মর্মর, জলের বিস্তার বুকের পাটাতন জুড়ে।
প্রত্যুষে শিশির মেয়ের গোপন স্নান-
আত্মমগ্ন ভোরে রোদের কোলাহল, বেদের বহর।
বেদেনীর বুকের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ছুরি যতোটা না কেটেছে,
তার বেশী নটিনীপনা। সাপ তো কাটে না,কাটে বেদেনীর বুক|
যে-পুরুষ পায় না নারী অঙ্গের দরদ,
অর্থের বিনিময়ে করে কামের বেসাতি;
যদিও কাম কভু পায় না পরিতৃপ্তি।
যদি সন্দেহ হয় জেনে নিও বেশ্যাপুরাণ।
আল মাহমুদ আমাদের পৌরুষে নির্লজ্জ প্রমান।
ভাঙে ঘর, ঘুণপোকায় কাটে শরীর,
সময় তার পাওনা মিটিয়ে নেয়, সুদসমেত।
আমাদের ভেতর বাস করে শিশু, বেহায়া পুরুষ,
আর অনির্বাপিত কাম।
দাঁত পড়ে গেলেও লোল ঝরে,ঝরে জল,চোখের পানি।
আমরাও ভেঙে যাই,
সময়ের দাঁতাল ইঁদুর কেটে ফেলে গোপন চাঁদ।
হিম অন্ধকারে কান্নার আওয়াজ, জীবনানন্দীয় বিষাদ গ্রাস করে ভুবন।
ইঁদুরের সঙ্গে সহবাস করি, কুটকুট করে কাটি বেদেনীর বুক।
নিজের ভেতর বাস করে যে-বেগানা পুরুষ অনিঃশেষ কাঁদে।
হারিয়ে শরীর, -বন্দনা করি আর গাই দেহের গান। দেহের ভেতর শরীরী নির্বাণ।

মৃত্যু

শঙ্খচুড়
বাড়িয়ে জিভ
শুনছে কী?
করেছে কার
প্রাণহরণ,
বদনসিব
কোন লোকের?
কোথা’ দূরে
ফুটেছে ফুল
হাস্নুহেনা-
পূজ্যমান
সর্প সব
আজ তবু-
গাইতে হয়
পুরবী গীত
এই রাতে
তার তরে!
আর তারা
বাড়িয়ে জিভ
কাটছে কার-
বাসর ঘর|
বদনসিব
কোন লোকের?
ঘুমন্ত
এক নদী
তলিয়ে যায়
মৃত্যুলীন
তার চোখে…|

প্রার্থনা

কোথা ঈশ্বর? তুলি দুই হাত
এই রাত্রি তবু পুণ্যের
সুধা গন্ধ শ্বেত পদ্ম
পেয়ে কাজ নাই; পুনরুত্থান
জানি সত্য, চাই দুর্মদ
তোমা’ ঈশ্বর; আর পিঞ্জর
খুলে বক্ষের কাঁদি দিন-রাত
লও এই প্রেম উপঢৌকন
আমি মুসাফির একা যাত্রী
হায় ঈশ্বর দাও সহবত
পথক্লান্তি যতো কণ্টক
পায়ে মাড়িয়ে চাই মোলাকাত

আর পিঞ্জর
খুলে বক্ষের কাঁদি দিন-রাত

কস্তুরীর ঠোঁটে সুবাসিত দুপুর

কস্তুরীর ঠোঁটে সুবাসিত দুপুর
আমার দৃষ্টি তোমার কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে:
সর্ষের সুবাস ছড়িয়ে আমোদিত চোখে দেখছো পিঁপড়ের নিবিড় চলমানতা
সামান্য ধুলো চোখে চুমু খেলে হাতে রগড়িয়ে লাল–
নতুন জন্ম মৃত্যুর ভেতর; তাকিয়ে দেখেছি ছোড়া তীর
নিজের স্বরের উঠানামা বিভঙ্গ রয়ে গেছে বোধের আড়াল
পড়েনি দৃষ্টির উত্তাপে
বৈঠা ভেঙ্গেছে জল, আমার বুকের পাড়া; স্রোত তবু ছুঁয়ো নি তোমায়
একদিন সময়ের পৃষ্ঠায় ধুলো জমলে কান্নার দাগ মুছে যাবে
গন্ধ ছড়াবে সেদিন অন্তর্গত বেদনা, প্রলাপ বকবে পথে
পথে পথে ছড়িয়ে গেছো পাথর, কণ্টক; – ঠোঁটে করে সরিয়েছি কাঁকর, বালি–
এমন কি তোমার পায়ের ছাপ ঠোঁটে করে বুকের ভেতর তুলে রেখেছি
তুমি তার কিছুই জানো নি পৃথিবীর মানচিত্র অস্থির, পরিবর্তনপ্রবণ
তবু রক্তের ভেতর বয়ে চলে স্থির টান- প্রবাহিত প্রেম
ঘুমের মতো বিরাজিত চোখে দেখেছো জগৎ!
দেখেছ? সন্দেহবাদী নই, জানি বধির নও, দৃষ্টিও যথেষ্ট স্বাভাবিক
আমাকে পড়ে নি চোখে, ইন্দ্রিয়ের ঘনতায় শোনো নি যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি?
তোমার ঠোঁটের স্পর্শধন্য চামচ দাঁতে কামড়ে বাঁচি।

অনুকাব্য


নগ্ন পায়ে হেঁটেছ ঘাসের সবুজে, শিশিরের প্রাণ
সুযোগ পেলেই গোপনে কিছু একটা খোঁজার উছিলায় ঘাসে চুমু খাই


মাঝে মাঝে আমি খেই হারিয়ে ফেলি
তুমি তখন আমার উদ্ধার
গতকাল বলে দিলে তোমার সঙ্গে কখনোই কোনো কারবার ছিলো না।
এতকাল কার হাত ধরে ছিলাম?


শীতরাতে ওমের উষ্ণতার হাত তুলে দিয়ে হাতে
তুমি তখন লেজ খসা টিকটিকি
হাতের মুগ্ধতার ভিতর খুঁজেছিলাম আত্মার নির্যাস
– এই ফাঁকে তুমি চলে গেলে।

টিকটিকি দেখলেই তোমার কথা মনে পড়ে।

হিটলার

যুদ্ধ ফেরত সৈনিকের হাতে আজীবন বারুদের গন্ধ লেগে থাকে।
হিটলার তুমিও ছিলে নিঃসঙ্গ সৈনিক। তোমার হাতে তবু পাই রঙের ঘ্রাণ। কার মুখ আঁকতে চেয়েছিলে তুমি? তোমার চিত্রের জন্য কি খুব রক্তের ছিলো প্রয়োজন?
তোমার ক্যানভাসে রক্তাক্ত ভুবন। তোমাকে বুঝলো না কেউ!
এই অভিমানে ডেমোস্থিনিসের প্রতিভা তুমি হারালে বেকার।

নির্বেদ

যে-ঘোড়ায় হয়েছি সওয়ার তাতে দিতে হয় জিকিরের দম,
চলতে গিয়ে বিলয়ের পথে কে শেখায় নির্বেদ?
গুরু বাক্য ধরেছে জবান: স্রষ্টার সঙ্গে তার কী বা প্রভেদ!
ঘোড়া তো জানে আমি পড়েছি তার প্রেমে, ঘোড়াও নির্বোধ|
আমাকে বসিয়ে পথে সওয়ারি হয়েছে উধাও,
আমিও অবোধ।
খুঁজতে গিয়ে আত্মার রূপ,দেখি নিজের উপর হয়েছি সওয়ার;
শ্রীকৃষ্ণ ভগবান যিনি, সেই তো কালাপাহাড়!
সব বাক্য সব স্থানে কহিতে নিষেধ,– এই কথা ব্যক্ত করে জানাই গুরুকে প্রণাম|
গুরু না চাহিলে সকলি নিঃজ্ঞান; বোঝার সাধ্য কার? খোদার কালাম |

দুর্ঘটনাপ্রবণ কবিতার উৎস

হাত তো গুণবে গুণিন। — আসলে গুনার নামে ছুঁয়ে দেখে স্বপ্ন।
আমি হাত গুনি না, গুনি পায়ের পাতা।
মেধাবী পায়ের মসৃণতায় ছবি আঁকে সলাজ কবিতা।
ফিতে ছিঁড়ে গেলে তোমার হাতে শেষ নিশ্বাস ফেলে অলৌকিক জুতো।
ইচ্ছে হলো খুলে ফেলি আমার জুতো মুজো
নিজেকেই গলিয়ে দেই তোমার পায়ে।
ভগবান অনেক পেয়েছেন,এবার জুতোর পূজো হোক।
– এই কথা কাউকে বলি নি, তবু জেনেছ শিক্ষিত চোখে।
মাঝে মাঝে জুতো জোড়া ছিঁড়ে যাওয়া ভালো।
জুতোর সনির্বন্ধ আলিঙ্গনে পায়ের পাতার চুমো পৌঁছায় না চোখে।
তোমার পা দেখার অবসর তো পেলাম।
ভালো তো কবেই বেসেছি ,আজ থেকে পায়ের গোলাম।

হাঁস

বিষ্ণুর খোয়াড়ে একটিও হংস নাই।
ধুয়ে গেছে প্রাচীন রক্তের প্রবাহমান দাগ স্মৃতির নিদ্রা ভেঙ্গে– তবু মৃত্যুর চিৎকার, ডানার ঝাপ্টা আর পাখনার ওড়াউড়ি|ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন মেঘের আড়াল খোঁজে, ভয়ের অনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে গায়ে ধীরে হাত দিয়ে দেখে– স্পর্শেন্দ্রিয়ের মগ্নতায় যদিও কেঁপে অস্থির– কিসের স্রোত শরীরের ভেতর?
দূরে,– দূরে মানুষের ক্ষীণ কোলাহলের শব্দে আশ্বস্ত হয়
নিজের উপর ফিরে পায় একিন|
কী করে উদ্ধার করবে ব্যাস্‌কুট? স্বয়ম্ভু নিজেই অন্তরীণ…
আলো এসে পড়ে চোখের কোটরে
ইন্দ্রিয়ের সক্ষমতায় তবু কিসের বেদনা লেগে থাকে,– অধরা, সর্পের অরণ্যে যে-পুকুরে ফোটে কুমুদকহ্লার তার ছায়া যেনো কাপে বুকের গভীরে অধির
সারারাত হংসের দাপাদাপি, হাশাঁক শাঁক হাশাঁক শাঁক প্যাঁক প্যাঁক, মৃত্যুর হলাহল
কে? কার মৃত্যুর জঘন্য উন্মাদনায় নির্বংশ হল ডিম্ব আর হংস?
কোথায় উড়ন্ত সুন্দর? কোথায় বলাকা?
জীবনানন্দ সবগুলো হংস কবিতার প্রহেলিকায় করে দিয়েছেন উধাও, তাঁর কাব্যের নিবিড়তার ভেতর হংসের ডাক– মলাট উল্টালেই পাখনার ঘ্রাণ, রক্তের উন্মাতাল নাচ, আর অবলুপ্ত সভ্যতার শেষচিহ্নের মতো মাথা তুলে রাখে হংসের মারণ চিৎকার
সন্দেহ জাগে, জাগে অতল জিজ্ঞাসা– কোথায় হংস-মিথুন?
পৃথিবীতে একটিও হংস নাই আজ, যা আছে কেবল হাঁস
মিলনের অবসরে লুকিয়ে থাকে বিরহের তীব্র অভিলাষ
হংস জেনেছিল হংসির গ্রীবায় কোন মরণের ছিলা
আজো ঘাড় বাঁকিয়ে চায় নারী, নির্মাল্য গ্রীবায় শরবিদ্ধ আর্তনাদ
হংস নাই ব্রহ্মার খোয়াড়ে,
নারীর কুন্তল থির জলমহাল, টেটাবিদ্ধ মরণের ফাঁদে শব্দান্তরে কুরুক্ষেত্রে পড়ে থাকে ১০০ মৌমাছি আর অক্ষমের প্রমাদ
নারী তার গতরে লুকিয়ে রেখেছে সবচে ভয়ানক গিরিখাত, তার অতলে গোপনে পোষে হংস
হংস জানে হংসির গ্রীবায় কোন মরনের ছিলা
উড়ে যাচ্ছে শর, ভেঙ্গে যাচ্ছে মেঘ- ভালোবেসে মেলে দিলে অধির বনভুমি, ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে শর, সরে সরে যায় নির্মাল্য ঊর্মিলা।

আদম পাহাড়

আদম হাওয়ার কাছে ফেরত চেয়েছিলো বুকের হারানো পাঁজর
হাওয়া দিয়েছে গোপন বিদ্যা শিকারের: ছুড়েছে পাথর
সেই থেকে পাথর চুম্বন, হাজরে আসওয়াদ স্মৃতি হয়ে আছে তার
এখনো পুরুষের বুকে ব্যথা হয়ে বাজে আদম পাহাড়
মানুষের পাপের ভারে পাথরে জ্বলে উঠে অগ্নি, বুকে তার রৌরব
সে স্বয়ং আগলে রাখে নরকের দ্বার
আদমের বুকে ব্যথা হয়, হাওয়ার বক্ষে কাঁদে আদম পাহাড়

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার