ঔপনিবেশিক আমল শেষ হয়েছে বহুদিন হল। কিন্তু এর প্রভাব রয়ে গেছে আজ অব্দী। ভবিষ্যতেও হয়ত এ ধারা চলতে থাকবে। যে নয়া-ঔপনিবেশিক আমলে আমরা বসবাস করছি সেটা আসলে উপনিবেশেরই ধারাবাহিকতা। উপনিবেশী আমলে উপনিবেশকরা তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে নিজেদেরকে সবচেয়ে উঁচু স্থানে রেখেছে। আর উপনিবেশীতদের দেখিয়েছে নিকৃষ্ট, অধম হিসেবে। তাদের তৈরী ডিসকোর্স তাদের আধিপত্যবাদী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।
ফয়েজ আলম ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে বইয়ে নয়া-উপনিবেশ, এর ধরন ও প্রতিরোধ কৌশল বিষয়ে আলোচনা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। উপনিবেশোত্তর সময়টা আসলে কেমন, কেমন করে তৈরী হয়েছে আধিপত্য বিস্তারের নানাবিধ কৌশল, কেমন করে তা যুগ যুগ ধরে জিইয়ে রাখা হচ্ছে মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে— তা বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষন করেছেন লেখক। আসলে এর বিস্তার এতো গভীর ও সুদৃঢ় যে তাত্ত্বিক আলোচনা পাঠ শেষে প্রচলিত সিস্টেমকেই প্রশ্নের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে ফেলার প্রয়াস পাওয়া যায়। ফয়েজ আলম তার আলোচনায় দেখিয়েছেন কীভাবে উপনিবেশিক শক্তি স্থানীয় জনগণের মনোজগতে সূক্ষ পরিবর্ত্তন করে তাদের আজ্ঞাবাহী করে ফেলে। আর একবার যদি মানুষের মনে পরিবর্ত্তন ঘটে যায় তাহলে তা আর পূর্ব্বাবস্থায় ফেরত আসে না। শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে এক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলে। ফলে দেখা যায় উপনিবেশকরা চলে গেলেও তাদের রীতিনীতি, আচার, রয়ে যায় বেশ ভালো করেই। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের শাসকগোষ্ঠী ঔপনিবেশিক আমলের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নিজ দেশের জনগণের প্রতি আধিপত্যশীল হয়ে ওঠে। ফয়েজ আলম দেখিয়েছেন উপনিবেশকরা স্থানীয় দালাল শ্রেণী তৈরী করে যারা তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করে। তাদের মাধ্যমেই তারা নিজেদের মতবাদগুলো প্রচার করে। কেননা স্থানীয়দের একটা প্রভাব থাকে যা তারা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়।
নয়া-উপনিবেশের করিবর্গা প্রবন্ধে লেখক আলোচনা করেছেন কীভাবে নয়া-উপনিবেশ গড়ে উঠছে এবং টিকে থাকছে। স্থানীয়দের মগজ ধোলাই তো আগেই হয়ে গেছে। এর প্রভাবেই হয়ত তারা এখনও নিজেদেরকে হীন ভেবে এককালে যারা তাদেরকে শোষণ করেছে তাদেরকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে। তাদের সবকিছুকেই নিজেদের চেয়ে উন্নততর ভাবে। পশ্চিমাদের তৈরী শিক্ষাব্যবস্থা যা মনোজগতে পরিবর্ত্তনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে তা বহাল থেকে যায়। এ শিক্ষা পদ্ধতি পশ্চিমাদের শ্রেষ্ঠ ভাবতেই শেখায়। ফলে নয়া-উপনিবেশ স্থাপনে বেগ পেতে হয় কম। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ, সাংস্কৃতিক কর্ম্মকাণ্ড, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থা— এগুলোর মাধ্যমে নয়া উপনিবেশ তার ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। বর্ত্তমানে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের যে আগ্রাসী ভূমিকা চলছে তাতে করে নয়া— উপনিবেশ স্থাপন আরও টেকসই হয়েছে। দরিদ্র দেশগুলোকে বৈদেশিক ঋণ, সহায়তা ইত্যাদির মাধ্যমে একটা জালে আটকে ফেলছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে সহজ হয়েছে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার। কেননা এ বাজারে সবকিছুই পণ্যের মর্য্যাদা লাভ করে। পণ্যের মাধ্যমে বাহিত হয় সংস্কৃতি। উপনিবেশী আমলের তৈরী কাঠামো শিখিয়ে দিচ্ছে ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে যা আসে তা-ই শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ নয়া-উপনিবেশী পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক ব্যাপার সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ব্যাপারসমূহের চেয়ে কোনোভাবে কম নয়—
সাংস্কৃতিক কর্ম্মকাণ্ড নয়া-উপনিবেশী আগ্রাসনের আরেকটি শক্তিশালী মাধ্যম। প্রাক্তন উপনিবেশী দেশগুলোর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে উপনিবেশের সাংস্কৃতিক প্রভাব বহাল থাকে। এর ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হয় নয়া-উপনিবেশী সাংস্কৃতিক তৎপরতা। এর প্রধান হাতিয়ার প্রচারযন্ত্রগুলো।
বর্ত্তমানে নয়া-উপনিবেশ স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ ও আমেরিকার যৌথপ্রচেষ্টার ফলে উপনিবেশী আমলের ‘মালমশলা’কে ভিত্তি করে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এসব দেশের নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্য্যন্ত এদের খপ্পর থেকে রেহাই পায় না। ক্ষমতার অংশিজনরা বরং এ ব্যাপারে একটু এগিয়েই থাকে—
নয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই শ্রেণীর নেতা, মুনাফাখোর জাতীয় বুর্জোয়া এবং একশ্রেণীর নামে-বুদ্ধিজীবী উপনিবেশকদের ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়। এদের হাতে আসে সম্পদ, পুলিশ-মিলিটারী ও আইন। উপনিবেশ চলে গেলেও উপনিবেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি অটুট থাকে। আর নেতারা তখন মনের লুক্কায়িত বাসনা পূরণের জন্য নিজেদের ইচ্ছামতো দেশ চালাতে শুরু করে।
ভাষাই কী ক্ষমতা নাকি ভাষা ক্ষমতাকে বিস্তৃত করতে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে? ইংরেজী ভাষা এত শক্তিশালী কেন? শাসকের ভাষা বলে? যারা একসময় উপনিবেশ স্থাপন করে বেড়িয়েছে। বর্ত্তমানের নয়া-উপনিবেশের চালকদের ভাষাও তো ইংরেজী। তাহলে ভাষার সাথে ক্ষমতার একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। ফয়েজ আলম ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে প্রবন্ধে এসব বিষয়ে বিস্তরিত আলোচনা করেছেন। ফুকো এবং দেরিদার ভাষ্যের আলোকে তিনি দেখিয়েছেন ভাষা কীভাবে ক্ষমতার বাহন হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমাদের তৈরী ডিসকোর্সের বিষয়টি আসে। ডিসকোর্স ভাষায় নির্ম্মিত তাই ডিসকোর্সের ভাষিক ক্ষমতা আছে— এ বিষয়টি ভাবার মত। উপনিবেশী ডিসকোর্স উপনিবেশকে শক্তিশালী করেছে। এ ডিসকোর্স শেখায় শাদা মানুষের সবকিছু ভাল। উপনিবেশকদের সংস্কৃতি উন্নত। উপনিবেশিতের আসলে কোন সংস্কৃতি নেই, থাকলেও তা নিকৃষ্ট। পশ্চিমাদের তৈরী ডিসকোর্স উপনিবেশের মানুষদের দমিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে।
ফলে দেখা যায় যে ভাষার ক্ষমতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মানুষর অবচেতনে ভাষিক ক্ষমতার প্রভাব এত মারাত্মকভাবে পড়ে যে তা তাকে আমূল বদলে দেয়—
উপনিবেশী ডিসকোর্সকে প্রায়-ভাষিক ডিসকোর্সই বলা যায়। ক্ষমতার পুঁটলিবাহী হিসেবে ভাষাই ওখানে প্রধান। মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে দেশীয় মানুষদেরকে আরও দুর্ব্বল করার ব্যাপারে ভাষার কাজই ওখানে মূখ্য।
বর্ত্তমান সময়ে ভাষিক আধিপত্যের অন্যতম উপায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে প্রচারমাধ্যম। বিশ্বের নামকরা প্রচারমাধ্যমগুলোর প্রায় সবগুলোই পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে এগুলোতে তাদের স্বার্থের অনুকূলে থাকে এমন খবরই প্রচার করা হয় বা খবর এমনভাবে তৈরী করা হয় যাতে মনে হবে ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা করছে সেগুলো সঠিক। ভাষার মাধ্যমে গড়ে ওঠা উপনিবেশের ধারাবাহিকতা বহন করছে এরা—
ইউরোপ-আমেরিকার প্রচারমাধ্যম তো এতটাই সুসংগঠিত ও সমর্থ যে গোটা একটা জাতী এমনকি দেশের চরিত্র অর্জ্জন করে একে সন্ত্রাসের আখড়া হিসেবে তুলে ধরতে পারে বিশ্বের সামনে। এই প্রচারমাধ্যমেই ফিলিস্তিনিদেরকে দেখানো হয়েছে সন্ত্রাসী, আগ্রাসী, শান্তি-বিরোধীরূপে। বুদ্ধিজীবীরা এইটাকেই বলেছেন প্রচারমাধ্যম কর্ত্তৃক ভাবমূর্ত্তি নির্ম্মাণ ও প্রতিনিধিত্বকরণ।
সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও উত্তর-উপনিবেশী প্রতিরোধ কৌশল প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন উপনিবেশোত্তর কালেও কীভাবে উপনিবেশক দেশগুলো সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক আধিপত্য বিরাজ রাখছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারসমূহের পেছনে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে সাংস্কৃতিক ব্যাপারসমূহ। তাই লেখক বলছেন সংস্কৃতিকে কেবল নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেই চলবে না। এর পেছনের আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় নিতে হবে।
আন্তোনিয় গ্রামসি যেভাবে দেখিয়েছেন হেজেমনির মাধ্যমে নিম্নবর্গের সংস্কৃতি কীভাবে প্রভাবিত এবং পরিবর্ত্তীত হয় তা উত্তর-উপনিবেশ তত্ত্বের প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আমাদের কাছে ধরা পড়ে। সাবেক উপনিবেশক দেশগুলো বর্ত্তমানে সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমেই তাদের মূল উদ্দেশ্য ধরে রাখছে। বর্ত্তমানে যোগাযোগের সহজতর মাধ্যম তৈরী হওয়ায় এবং তথ্যের অবাধ বিস্তারের ফলে সংস্কৃতির প্রবাহও সহজ হয়েছে। তবে দুঃখজনকভাবে এটা ঘটে ওপর থেকে নিচের দিকে। আর তা ঘটে পোষাক, খাবার, বিনোদন সহ আরও নানাবিধ অনুষঙ্গের মাধ্যমে।
প্রবন্ধকার বলছেন— নাতিশীতোষ্ণ দেশের মানুষ যেমন কাপড় পড়বে শীতপধান দেশের মানুষ তেমন কাপড় পরবে না। প্রকৃতপক্ষে তা-ই হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এর ব্যতিক্রম হতেই দেখা যায়। উপনিবেশক দেশগুলোর অনুকরণ করতে গিয়ে গরমের সময়েও এদেশের মানুষ কোট, ওভারকোট পড়ছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এ অনুকরণ প্রবৃত্তি জাগিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন উপনিবেশের তলে থেকে, তাদের তৈরী কাঠামোর ভেতরে বসবাস করার কারণে মনের গভীর পর্য্যন্ত এর শেকড় চলে গেছে। তাহলে কী এভাবেই চলতে থাকবে?
লেখক এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন এ প্রবন্ধে। উপনিবেশী প্রভাবের কারণে যে ‘নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ হারিয়ে গিয়েছে সেখানে কাজ করতে হবে। আত্ম-পরিচয় অর্জ্জনের বাসনা পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। উত্তর-উপনিবেশবাদী ভাবনায় ‘নিজস্ব ঐতিহ্য ও জ্ঞানচর্চ্চার পথ খুলে দেয়ার’ যে প্রণোদনা রয়েছে তা গ্রহণ করার মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আর এ লড়াই হবে দীর্ঘমেয়াদী। এর একটি উৎস সম্পর্কে লেখক ধারণা দিয়েছেন—
উত্তর-উপনিবেশী জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ উপনিবেশী শাসনকালে এবং স্বাধীনতার পর উপনিবেশী প্রভাবের মধ্যে বেঁচে থেকেও পূর্ব্ব-পুরুষের ভাবজগৎ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। এগুলোও শনাক্ত করতে হবে। এগুলোকে ঐতিহ্যের মূল্য দেওয়া দরকার। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের ভাবজগৎ ও সংস্কৃতির মধ্যে এ ধরনের অনেক উপাদান এখনও অটুট। গত কয়েক দশক ধরে ভার্চুয়াল টেকনোলজির আগ্রাসী প্রসারের কারণে সেগুলো লোপ পেতে বসেছে সত্যি। বাংলাদেশে ওই জায়গাটা লড়াইয়ের একটা জরুরি ও বিস্তৃত ক্ষেত্র হিসেবে নেওয়া প্রয়োজন।
তবে এ লড়াই চালিয়ে যাওয়া সহজ নেয়। পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তার প্রভাব সব জায়গাতেই পড়েছে। তাদের প্রচারিত ‘আদর্শ মানুষ’ এর যে চিত্র আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তা ভেঙ্গে ফেলার জন্য থাকতে হবে যথাযথ প্রস্তুতি। বিদ্যমান কাঠামোর ভেতরে থেকেই এই প্রস্তুতি নিতে হবে—
প্রথমে দরকার একটি তাত্ত্বিক প্রণোদনা, উত্তর-উপনিবেশবাদ যার যোগান দেয়। অতঃপর ঐতিহ্য-ইতিহাসের ভিত্তিতে আত্ম-পরিচয় পুনর্গঠন ও তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পালা। এরপরই আসে সেই সব মাধ্যমে কাজ শুরু করার ব্যাপার যেগুলো দ্রুত গণ-পর্য্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম।
উপনিবেশের প্রভাব সর্ব্বব্যাপী। উপনিবেশিতের মনন জগতকে পরিবর্ত্তন করে দেয়ার বিবিধ কৌশল তারা গ্রহণ করে। এর মূল উদ্দেশ্য উপনিবেশকে টিকিয়ে রাখা। মানুষের মনন পরিবর্ত্তন করার অন্যতম হাতিয়ার শিক্ষা, সাহিত্য ইত্যাদি। ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন করে। এর মাধ্যমে তাদের অনুগত, তাদের মতবাদ প্রচার করা ও টিকিয়ে রাখার জন্য একটা শ্রেণী তৈরী করে। এক্ষেত্রে মেকলের অবদান সর্ব্বাধিক। ফয়েজ আলম বাংলা সমালোচনায় উপনিবেশিতর বোধ প্রবন্ধে এসব বিষয় আলোচনা করেছেন। এ প্রবন্ধে মূলত সাহিত্যে উপনিবেশের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যেহেতু সাহিত্য আলোচনার সাথে শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে তৈরী মনন জগৎ জড়িত সেহেতু তা অপ্রাসঙ্গিক ভাবা যাবে না।
শিক্ষার মাধ্যমে ইংরেজী সাহিত্য ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এটা কোন আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনারই ফসল। কেননা তারা চিন্তা করেছে— সাহিত্যের আছে নন্দনতাত্ত্বিকতার লেবাস আর বিশ্বজনীনতার দাবী। তাই ইংরেজী সাহিত্য সর্ব্বজনের সাহিত্যরূপে চালিয়ে দিতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। আবার পাঠকগোষ্ঠী খুব নিশ্চিতভাবেই সেই সাহিত্যের রগরগে চলমান ব্রিটিশ ধ্যান-ধারণা ও খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার সংস্পর্শে আসবে।
এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়নি। তাদের শেখানো কাঠামো সাহিত্যে গেঁড়ে বসে। ইংরেজদের শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিগণ তাদেরই চোখে দেখতে থাকেন বাংলার সমাজ ও সাহিত্যকে। ইংরেজী সাহিত্যের আদর্শকে গ্রহণ করার ফলে তাদের সাহিত্যের মাধ্যমে চর্চ্চিত নেতিবাচক দিকগুলো এঁদের নজরে পড়েনি। কারণ তারা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন—
ইংরেজী সাহিত্য থেকে বাংলা সমালোচনার আদর্শ অনুসৃত হওয়ার কারণে উপনিবেশের মতো জঘন্য একটি ব্যাপার সম্পর্কে সচেতনতা এবং মানদণ্ড হিসেবে তার ব্যবহারের চিন্তা বাঙালী সমালোচকের মাথায় ঢুকে নাই।
সমালোচনার সেই ধারা এখনও বহমান। উপনিবেশী যে জ্ঞানভাষ্য এখানকার লোকজনের মনের ভেতর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তাতে করে চেনা জগৎ পাল্টে যায়। যে চিন্তা ও উপলব্ধির জগৎ গড়ে ওঠে তাতে থাকে উপনিবেশকদের সরাসরি প্রভাব। ফলে এর প্রভাব যেমন লেখকদের ওপর পড়ে তেমনি পড়ে সমালোচকদের ওপর। তারা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডের আলোকে। পশ্চিমাদের তৈরী এই হেজেমনির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে না পারলে নিজস্ব আদল গড়ে ওঠবে না। কেবল ধোঁকার ভেতরেই বসবাস করতে হবে—
সমালোচকের লেখায় উপনিবেশী বা নয়া-উপনিবেশী সাংস্কৃতিক আধিপত্যের এই ব্যাপারগুলো প্রতিফলিত হতে হবে, বিচার-বিশ্লেষণের আওতায় আসতে হবে। না হলে বাংলা সমালোচনার মুক্তি ঘটবে না।
ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে বইয়ের প্রবন্ধগুলোতে উপনিবেশ, নয়া-উপনিবেশ ও এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উপনিবেশকরা উপনিবেশ স্থাপন ও তা টিকিয়ে রাখার জন্য নানা ধরনের পন্থা উদ্ভব করছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের পাশাপাশি তারা সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করেছে ও বিভিন্ন কৌশলে তা টিকিয়ে রাখছে। ফয়েজ আলম তার গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলোতে সেসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন। একই সাথে উপনিবেশের হাত ধরে এগিয়ে আসা নব্য-উপনিবেশের প্রভাব মোকাবিলার কতিপয় উপায় নিয়েও আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশে উপনিবেশবাদ চর্চ্চার অন্যতম সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে এটিকে মেনে নেয়া যায়।
শামসুল কিবরিয়া
জন্ম : ০৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫, হবিগঞ্জ জেলায়।
গল্প ও প্রবন্ধ লিখেন। ‘চারবাক’ ও ‘শুক্কুরবারের আড্ডা’র সাথে আছেন দীর্ঘদিন ধরে।
প্রকাশিত গল্প বই : বৃত্তাবদ্ধ জীবনের প্রতিবিম্ব (চারবাক, ২০১৯); কতিপয় স্মৃতির আর্তনাদ (বেহুলা বাংলা, ২০২১)
সম্পাদিত পত্রিকা : বইকথা
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে : নয়া-উপনিবেশী আধিপত্যের মূল উন্মোচন ও প্রতিরোধ কৌশল [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}