নথ (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শনের গল্প) || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল, বেলা বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টি ধরে এল। তন্ময়দের হালট পর্য্যন্ত বর্ষার ঘোলাজল। বহুদূর পর্য্যন্ত দেখা যায় বারান্দায় দাঁড়ালে। কত ধরনের নৌকা যে কোথায় চলে যায়। তন্ময় গুনতে গুনতে খেই হারিয়ে ফেলে। আকাশে রোদ মেঘের খেলা চলছে যখন তখনই তাদের বাড়ীর ঘাটে এসে একটা ছইওলা নৌকা এসে ভিড়ল।

এমনদিনে সাধারণত গ্রামের বাড়ীতে তেমন একটা কাজ থাকে না, সেজন্য পাটী পাখা সহ দরকারি জিনিসপত্র বানানো চলে, বৌঝিয়েরা ছেলেপুলে নিয়ে বেড়াতে যায়। তন্ময়দের বাড়ীতেও তার ফুফুরা আর চাচাত বোনেরা বেড়াতে এসেছে, এই বেড়ানকে বলে নাইওর আসা।

নৌকা এসেছে শুনে বাড়ীর মহিলারা এসে দাপরের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছেন কে এল, পুরুষ মানুষ থাকলে বের হওয়া যাবে না। অবশ্য সব পুরুষ নয়, মান্যগণ্য পুরুষ থাকলে পর্দ্দা করতে হয়।

নৌকা থেকে রঙবেরঙের শাড়ী বিশেষ কায়দায় পরা দু’জন নারী বের হয়ে এল। তাদের খোঁপার ধরণও অন্যরকম। মাথায় ঝাঁপি। হাসিমুখে ওরা এসে বসল বারান্দায়, শুরু হল ওদের গল্প। ওদের নাকে কানে কত বিচিত্র গয়না, নাকে যে কত ফুটো আর তাতে কত বিচিত্র গয়না। তন্ময়দের বাড়ীর মেয়েরা আজ নাকে কানে ছিদ্র করবে। এই মহিলা যারা আসল তাদের গাইনী বলা হয়। গাইনীরা খুব করে বোঝাচ্ছে নাকে কানে গয়না না পরলে কী কী সমস্যা হতে পারে।

তন্ময় নিজে নিজে ভাবতে থাকে, আসলে বিষয়টা কী! গাইনিমহিলা বলছে নাকের নথ না পড়লে বিয়ে হবে না, হলেও স্বামীর অমঙ্গল হবে। নথের সাথে মানুষের মঙ্গল অমঙ্গলের কী সম্পর্ক তা বুঝতে হবে তাকে। ভরা মজলিস ছেড়ে তন্ময় গল্পদাদুর ঘরের দিকে রওয়ানা হয়।

গল্পদাদু বসে পত্রিকা পড়ছিলেন, তন্ময়কে দেখে খুশী হলেন। ‘কী দাদু! কিছু বলবে?’

তন্ময় আঙ্গুল দিয়ে তাদের বারান্দা দেখায়। এরপর বলে, ‘দাদু, নথ এর সাথে মানুষের কী সম্পর্ক? ওরা বললেন, নথ না পরলে নাকি অমঙ্গল হয়! তাহলে আমাকেও কি নাক কান ফুটো করতে হবে?’ গল্পদাদু এবার হা-হা-হা করে হেসে ওঠলেন, এত মজার কথা যেন আগে শোনা হয়নি।

‘বস তন্ময় দাদু, বলছি সব।’

তন্ময় মোড়া পেতে বসে, দাদুর মুখের দিকে তাকায় উৎসুক দৃষ্টিতে।

গল্পদাদু শুরু করেন—
‘নথ বুঝতে হলে আমাদের আগে ন বর্ণটী বুঝতে হবে। ন বর্ণ হল অন্-কারী ও ন-কারী। সে না-কে হ্যাঁ করে আবার হ্যাঁ-কে না করে। সে সৃষ্টিকারী আবার নাশকারী। ন যেখানে থাকবে সেখানে নাক থাকবে, আবার নাক থাকলে নথ থাকবে এটাই হল কথা। তোমাকে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ এর কথা বলেছিলাম, মনে আছে?’

তন্ময়ের খুব মনে আছে, সে অন্যরকম এক অভিধান যার কথা গল্পদাদু বলেছিলেন। শব্দগুলো আমরা চিনি একভাবে আবার এর ভেতরে থাকে অন্য রকম পরিচয়। তন্ময় সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

গল্পদাদু আবার শুরু করেন, ‘নথ হল ন যেখানে থাকে। ন করে যে সে হল নক। আবার নক থেকে জাত হল নাক। নাক আমরা আরেকভাবে পাই, সেইটী হল নেই অক (অকারক) যাতে। নাক দিয়ে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ করি। ন করে যে নাক, সে একটা সময় মানুষের অস্তিত্বকে ন-করে। অর্থাৎ নক করার আধার যে নাক সেইটী হল আমাদের দৈহিক নাক যা দিয়ে আমরা কোনকিছুর ঘ্রাণও পাই, আবার মানুষের অস্তিত্ব যখন ফুরিয়ে আসে তখন এইটী দিয়ে শেষনিঃশ্বাসও ত্যাগ করে।

আমাদের বাহ্যজগতে অনেক সম্পদ আছে, সেইসব সম্পদের ঘ্রাণও আছে যা আমরা টের পাই মানসিক নাক দ্বারা। এই মানসিক নাক বিবিধ সম্পদের গন্ধ পায়, এই গন্ধ থেকে সংঘাত আর সংঘাত থেকে শুরু পণ্যবাহী সমাজের। কাজেই নাক শব্দটী দু’ভাবে তৈরী হয়েছে তবে তারা পরস্পর সম্পর্কহীন নয়। নাক নিয়ে অনেক শব্দ আছে।

যেমন নাক করা। যার অনেক সম্পদ আর সম্মান আছেন তিনি নাক করতে পারেন, অর্থাৎ অহংকার দেখিয়ে অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করতে পারেন কারণ তাদের নাক উঁচু (উন্নাসিক ভাব) থাকে। নাক কাটা গেলে মান সম্মান যায়, বাস্তবে নাক কাটলে মানসিক নাকও কাটা যায়। এরা আবার অন্যের বিষয়ে নাক বরাবর (সোজা) নাক গলায় (যুক্ত হওয়া), নাক টেনে (ভণিতা করে) তারপর অনায়াসে বাড়ী গিয়ে নাকে শর্ষের তেল দিয়ে ঘুমায় (নিশ্চিন্তে)। মেয়েরা নাক নেড়ে কথা বলে, নাক ঝামটা দেয়; এগুলো তার মানসিক নাক যেমন সম্মান সম্পদ বা রূপের ঝিলিক।

তবে নাক উঁচুদের নাক গলানো স্বভাব খুবই অসহনীয় বিষয় যা তারা বোঝে না।’

দাদু এবার থেমে গ্লাসে রাখা জল ঢেলে নিলেন, তারপর তন্ময়কে বললেন, ‘দাদু কিছু বুঝতে পারলে?’

তন্ময় বলে ‘হ্যাঁ দাদু, নাক দু’রকম একটা মানসিক নাক আরেকটা দৈহিক নাক। নাকের অন্যান্য বিষয়ও বুঝলাম কিন্তু নথ এর সাথে নাক এর সম্পর্ক বুঝলাম না।’

‘বলছি দাদু’ দাদু জল শেষ করে মুখে পান দিয়ে আবার শুরু করলেন—

‘বুঝলে দাদু, প্রাণ-সম্পদ মানস-সম্পদের আধার হল যে মানসিক নাক, সেখানে ন থাকে। তাকে ধারণ করার যে প্রতীকী রূপ তা হল নথ। ন যেখানে থাকে সেটাই নথ। বাস্তব সম্পত্তির মালিকানাবোধ নথ দ্বারা প্রকাশ পায়। কাউকে নথ পরানো মানে হল তার মালিকানা নিয়ে নেওয়া। নথ গতিশীল থাকে নথি-তে। সম্পদের লিখিত বিবরণী থাকে যে দলিলে/আধারে তাই নথী।

আবার নথ থেকে জাত নাথ। নাথহরি বলে একটী শব্দ আছে। ছাত্রবোধ অভিধান নাথহরি বলতে নাকফোঁড়া পশুকে বুঝিয়েছেন। নাথ সম্প্রদায়ের নাম ও পদবী হিসেবে ব্যবহৃত হয় আবার ব্যক্তী নামের শেষেও ব্যবহৃত হয়।

আদিম যৌথসমাজে সামাজিক সংগঠনগুলি গাছ ও এর উৎপাদিত বস্তুকে ফল বলা হত। তখন উৎপন্ন ছিল কিন্তু পণ্য ছিল না। উৎপন্ন যখন থেকে বিক্রির জন্য উৎপাদিত হতে শুরু করল তখনই তা পণ্য হল। সেই পণ্য বিক্রির জন্য মাধ্যম দরকার। সেই মাধ্যম হল প্রকৃতিগুণসম্পন্ন অহংকার বোধ যার আছে সে, উৎপন্ন হয় পণ্য আর পণ্যের হয় মালিক, এভাবে ব্যক্তিমালিকানা পূর্ণরূপ পেয়ে প্রতিষ্ঠা পায়। এই অহংকার যে বুঝে তার নাকউঁচু থাকবে। কারণ পণ্যের গন্ধ থাকে সেই গন্ধ বোঝার নাক থাকা চাই। সেই নাকের গৌরববোধকে দমন করতে, সসীম করে নিতে পরানো হয় নথ। এই নথ পণ্যের ক্ষেত্রে হল দাম। এই নথ যিনি পরিয়ে দেন তিনি নাথ। গরুর নাকে নথ পরিয়ে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হয়, গরুর নাথ হচ্ছে তার মালিক। পণ্যের নাথ আছে পণ্যের দাম নির্দ্ধারণ করতে, স্ত্রী নাকে নথ পরতে হয় স্বামীর কারণে, যেন তার মালিকানা কেবল তার স্বামীর, তাই স্বামী তার নাথ। এই জগতেরও একজন নাথ আছেন যিনি সকলকে নিয়ন্ত্রণ করেন নথ পরিয়ে দেওয়ার মত, তিনি জগন্নাথ। আগেই বলেছি নাক থাকলে তাতে গন্ধ ধরা দেবে। এই নাক হল মানসিক নাক যেখানে জাগতিক সকল সম্পদের গন্ধ ধরা দেয়। আবার নক থেকে জাত নাক-এ মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালায়, এইটী বাহ্যিক নাক যার দ্বারা মানুষ নিজ দেহের বা অন্য বাহ্যিক সত্তার গন্ধ পায়। তবে এই দুই প্রকার নাক পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন নয়।

নাক যেখানে থাকে সেখানেই ন (অন-কারী ও ন-কারী) থাকবে। ন থাকা মানেই নথ থাকা। কাউকে নথ পরানো মানেই হল তার মালিকানা নিয়ে নেওয়া, তার অহম খর্ব্ব করা।

আদিম সমাজে যখন যৌথসম্পদ ও যৌথবধূর ধারণা থেকে ব্যক্তিগত সম্পদ ও ব্যক্তিগত বধূর ধারণায় পৌঁছালো তখন থেকেই মেয়েদের নাকে নথ পরানোর চল শুরু হয়ে থাকবে বলে বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ধারণা করেন।’

গল্পদাদু এবার থামলেন। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তন্ময়দাদু, জানি তোমার জন্য একটু কঠিন হয়ে গেল আলোচনাটী, তবে মালিকানা প্রতিষ্ঠায় নাক, নথ এগুলোর যে একটা ভূমিকা আছে, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তুমি যখন আরো বড় হবে তখন আশা করি নিজেই এই ভাষার জগতে ঢুকতে পারবে, নিজে নিজেই অনেক কিছু বুঝতে পারবে।’

তন্ময় মৃদু হাসে আর ভাবে, ‘ইস্! কবে যে বড় হব!’ …

 

 

 


রুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে।
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারি চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{নথ || রুবি বিনতে মনোয়ারের গল্প [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার