ছোটকালে স্কুলে একবার রমজান মাসে সেহেরীতে কে কী খায় এই নিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। এক বান্ধবী বলল সেহরিতে সে পাস্তা খায়। বাকী যারা ছিল তারা প্রায় সবাই তারপর সেহেরির যে তালিকা প্রকাশ করল তা পাস্তা, নুডলস, স্যান্ডউইচ খুব জোর বিরিয়ানী আর ফ্রাইড রাইস পর্য্যন্ত ঠেকেছিল। আমি ছা পোষা সরকারি চাকরিজীবী বাঙালী মায়ের মেয়ে তখন বোধ করলাম, ছোটোবেলায় দাগটানা খাতায় হাজারবার করে লেখা “আমি ভাত খাই” বাক্যটার কোথাও একটু যেন নীচু গন্ধ আছে। বড়বেলায় উঠে জানলাম ডায়েট মানে ভাত না খাওয়া। সুস্থ থাকতে হলে, সুন্দর দেখাতে হলে, ক্লাসী হতে হলে সাথে আর যা কিছুই থাকুক না কেন শুরুটা ভাত না খাওয়া দিয়ে করতে পারলে লোকে এক ধাপে অনেকগুলো সিঁড়ী ডিঙিয়ে যায়। তারপর যখন দাগটানা খাতা বইয়ের বাইরে পা দিলাম, জানলাম পরিবেশের রক্ষাকর্ত্তাগণ নাকি বলেছেন দানাশস্য বর্জ্জন করতে, তাতে অনেক বেশী পানী খরচ হয় চাষাবাদে। আমি তো অবাক! তা বাপু পানীর কাজটা কী? না, আমাকে বলুন, পৃথিবীর মিঠা পানী দিয়ে মানুষ নামক প্রাণী কী করবে? মুখ দেখবে? …
আচ্ছা ভাত নাহয় সইলাম, কিন্তু তাই বলে ডাল, গম, ভুট্টা, জোয়ার, বজরা, যব সব? তবে যারা গর্ব্ব করে বিরিয়ানী আর কেক খায় তাদের কী হবে? নাকি বিরিয়ানীর ভাতটা আর কেকের গমটা একটু ক্লাসী বলে এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলী? সে অনেক বড়বড় লোকদের হিসাব আমার গরীব মগজে তেমন একটা ঢুকল না। পানীর খরচ কমাতে ভাত ডাল ছেড়ে দিচ্ছে, গোসল ছেড়ে দিচ্ছে এমনকি শৌচকার্য্যও ছেড়ে দিচ্ছে এমন সব মহান আদর্শের সামনে কোকাকোলার বোতলে লুকিয়ে পানী খেতে গিয়েও গলায় আটকে যায় যায় অবস্থা! কবে না বলে বসে পানী খাওয়া উচিৎ না এই ভয়ে থাকি সবসময়! বোতলটাও তাদের আদর্শের মত স্বচ্ছ না হলে কি হত না? যাই হোক! …
একদিকে ভেতো বাঙাল একটু গ্লোবাল হওয়ার জন্য ভাত ছাড়তে কত মন্ত্রই না জপছে, আরেকদিকে পোভার্টি পর্ণ বেচে দুবেলা দু’মুঠো ভাত যোগাড় করা গ্লোবাল রিয়েলিটি শো তে নাকি আজকাল লোকে পান্তাভাত খেতে শুরু করেছে এইরকম পুলসিরাতে পড়ে ভদ্দরনোকদের হঠাৎই কান্নার ঢেকুর হেঁচকি একসাথে ওঠার দশা। তবে ডায়বেটিস থেকে হেপাটাইটিস আর ডায়েট থেকে হেমা মালিনী সে যে যাত্রাই হোক না কেন চণ্ডাল থেকে নাইটধারী ব্রাহ্মণ হওয়ার তীর্থ সফল করার পথে ভাতের একটা খলনায়কত্ব আছে এ তেমন নতুন খবর নয় বাংলার রোগী আর রমনীদিগের কাছে। ভাতের চেয়ে অবশ্য রাইসের খলনায়কত্ব কিছু কম। কিন্তু ভাত শব্দ উচ্চারণ করলেও কারও কারও অ সুখের ওজন বেড়ে যায়।
নতুন খবরটা হল ভাত মাছ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর! যদিও স্যালমন আর কোরাল-এর জন্য লোকে আজকাল হাপিত্যেশ করছে! ওরা মাছ নয় কি না। ফিশ! না থাক, মাছে না যাই। এ বড় আবেগের জায়গা। আজ বরং ভাতেই থাকি।
তো যা বলছিলাম, ভাত কতটা ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ করে সেটা বুঝলাম যখন হঠাৎ দেখি গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত সময়ে লোকজন ‘মানুষ বায়ু ত্যাগ করে বলেই (মানে ওই নিঃশ্বাস আর কী) এত গরম পৃথিবীতে’ এরকম হলোকাস্ট ডেকে আনছে আর তখনই দেশের তাবড়-তাবড় মিডিয়া হঠাৎ সংবাদ প্রকাশ করে বসল বাংলাদেশের আকাশে না কি রহস্যময় মিথেনের ছায়া! আমি ছাদের তল থেকে বেরিয়ে মিথেন দেখতে যাব কি না ওই দেখি আরেক হেডলাইন, ধানচাষের ক্ষেত থেকে নিঃসরিত মিথেন গ্যাসের প্রভাবে গরম হয়ে যাচ্ছে নাকি বাংলাদেশ! খবরটা পড়তেও পারিনি পুরোটা ওদিকে মাতৃদেবী হুঙ্কার দিচ্ছে, ‘টেবিলে ভাত দিয়েছি কানে যাচ্ছে না জমিদারের’। তা এখন জমি থাক বা না থাক ওই ভাত কি আর গলা দিয়ে নামে বলেন? উভয় সঙ্কট! এদিকে দেশমাতার গরম ওদিকে গৃহমাতার গরমের মাঝখানে কূল রাখি না শ্যাম রাখি করতে করতে আমি ভাবলাম, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় আর পূর্ণিমার চাঁদ একথাল গরম ভাত!
সুকান্তের মুখে ছাই দিয়ে একথাল ভাত গিলে এসে ফের ব্যাক টু মিথেন। খুব খটকা লাগলো এতবড় গবেষণাটা করল কে! জাতিসংঘ নাকি বলেছে জলবায়ু ঠেকাতে মিথেন কমাও! আর ব্লুমবার্গের এপ্রিলের রিপোর্ট বলছে বাংলাদেশে অনেক বেশী মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে কারণ এক স্যাটেলাইট রিপোর্টে দেখা গেছে বাংলাদেশের ঢাকার বায়ুমণ্ডলে প্রচুর মিথেন গ্যাস জমে আছে, আর তার অন্যতম কারণ হল ধানচাষ! ঢাকায়ও আজকাল ধানচাষ হচ্ছে মেনে নিলাম, গোরাদের গবেষণা বলে কথা!
কী আর বলব বলুন! মানচিত্র পড়তে না জানা র্যাডক্লিফ দিয়ে এঁকে দেয়া জাতীয়তাবাদের আশীর্ব্বাদক্রমে সাদা চামড়ার পশ্চাদ্দেশও চোখ বুঁজে চেটে এসে আহা হা কস্তুরী ঘ্রাণ বলে আটখানা হয়েছেন পূর্ব্বপুরুষেরা। আজ কী আর বলা যায়, ওরে অবোধ বায়ুতেও কি তোর র্যাডক্লিফ আছে যে মিথেন যেখানে দেখেছিস সেখানেই উৎপন্ন হয়েছে বলে মানতে হবে? গোরারা বলেছে বলেই তাল মিলিয়ে বলতে হবে কৃষিকাজ মিথেনের উৎস? যায় না! এ যে বহুকালে সাধনায় অর্জ্জিত ভদ্দরনোকের বিশ্বাস। এই ধর্ম্মে হাত দেবে কার ঘাড়ে কটা মাথা!
তবে যায় হোক, বায়বীয় সবকিছুই র্যাডক্লিফ নয় বলেই বাংলার ভাগ্যাকাশে এবং সংবাদাকাশে মিথেনের ঘনঘটা বেশিদিন পাত্তা পেল না যদিও সে মিথেনের উৎস পরীক্ষা আর হয়েছে বলে জানা যায় নি! কিন্তু, ভাতের ভাগ্যাকাশ থেকে কিছুতেই শনি কাটছে না! দেড় লক্ষ জাতের ধান থেকে কমে আজ সাত কি আটশতে নামিয়ে এনেও ভাতের ওপর রাগ মিটছে না আণবিক সাহেবদের! কী এমন বাড়া বোমায় ছাই দিয়েছে ভাত তাদের? এককালে ভুট্টাকে ভারতীয় বলে গালি দিয়ে শূকরকে খাওয়াতো ব্যাপটাইজড লোকেরা আর মাটির নীচে জন্মাত বলে আলুকে নরকের ফল ঘোষণা করে দিয়েছিল। ভুট্টা আর আলু সে রাহুগ্রস্ততা কাটিয়ে বীরদর্পে নিজের রাজত্ব ঘোষণা করেছে বহুদিন হল, কিন্তু একালে জাহাঙ্গীর কবির নাইটদের থেকে ভাতের ইজ্জত ছিনিয়ে আনবে কে?
শুনেছি চিনের রাজারা অমরত্ব পেতে খেতেন কালো চালের ভাত! চাল ধোয়া পানী দিয়ে মুখ ধুলে নাকি সুন্দরী হওয়া যায় বলে চুটিয়ে ব্যবসা করে নিচ্ছে কর্পোরেট! ওদিকে ভাতকে এত দুয়ো দিয়েও বিজ্ঞসমাজের অবস্থা না পারি ফেলতে না পারি গিলতে, তাই জিএমও নাকি ভারতের ব্লাডি নেটিভদের সোনার ভাত (গোল্ডেন রাইস) খাওয়াবে বলে উঠে পড়ে লেগেছে! সোনা দিয়ে মুড়েও যদি ভাতের লজ্জা ঢাকা যায়! আবার হালের ক্লাসিনেসে শুরু হয়েছে ঢেঁকিছাঁটা চালের গুণগান যদিও ঢেঁকি কোন স্বর্গ থেকে আসবে আর তাতে পাড় দেবে কে সেটা নিয়ে কোন কথা বলতে নেই। জ্ঞানের রাজ্যে এমন কত কত প্যারাডক্সিকাল সাজিদ আমাদের চোখে সর্ষেফুল হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেয়!
তবে যাই দিক মাথা পেতে নিতে কিন্তু আমরা মোটে সন্দেহ করি না। গোরারা যতক্ষণ বলছে বিজ্ঞান তাদের ভ্যাটিকান বাপের সম্পত্তি ততক্ষণ ওসব নিয়ে অযথা কেন মাথা ঘামানো বাপু। সুতরাং ভাতের গোষ্টীর তুষ্টি করে, কৃষিপ্রধান দেশে জিরো সয়েল প্রজেক্ট চালিয়ে আর কৃষিজমীর ওপর গগনচুম্বী অট্টালিকায় ছাদবাগানে এভোক্যাডো ফলিয়েই একমাত্র আমরা বিশ্বসমাজে কিছুটা জাতে উঠতে পেরেছি এ তো লেফট ইকুয়েল রাইট প্রমাণিত।
সেই ‘ভেতো বাঙাল’ প্রবাদের যবে থেকে উৎপত্তি এসব তো আমরা তবে থেকেই মাথা পেতে নিয়েছি। নিজের কাছা বেচে হলেও ভেতো হওয়া যাবে না তাতে যত কনসেন্ট আর যত লজিক ম্যানুফ্যাকচার করতে হোক না কেন ভ্যাটিকান এর নামে শপথ করে হোয়াইট ম্যানদের এই বার্ডেন আমরা নিজেদের তামাটে কাঁধে তুলে নিয়েছি। কাঁধে কাঁধ মেলানোটা বড্ড জরুরী কি না!
কিন্তু এই মা-খালা-নানীদেরকে বোঝাবে। নাহয় কবিতার নাম হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন, তা বলে কি প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনেই থাকে নারীর অবদান এ কথা তারা পড়ে নি? এদের ভাত রান্না যেন থামেই না! যতবারই আহত ক্ষুধিত আত্মা নিয়ে তাদের সামনে গিয়ে হাভাতে নয়নে বলি ‘ক্ষিধা লেগেছে, খেতে দাও’ কী যেন এক নীরব ষড়যন্ত্রের নীলনকশা এঁকে ঠান্ডা গলায় গরম চোখে একই উত্তর দেয় ‘ভাত আছে, ভাত খা’।
এইসব জগদ্ধাত্রী রণরঙ্গিণীর চোখের গরমের কাছে মিথেন আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং সব নস্যি। অগত্যা আমরা চাইলেও ভেতো বাঙাল হওয়া থেকে নাজাত পাই না। সেই উন্নতির পুলসিরাত আটকে খড়গহস্ত দাঁড়িয়ে থাকেন এসব নৃমুণ্ডমালিনী। এদেরকে সিভিলাইজড করবে কে সে দুশ্চিন্তায় আমার চোখের কোলে কালি পড়ে যাচ্ছিল। যদিও মাতৃদেবী বলেন তা তসবি (ফোন) টেপার ফল। তবে কথায় আছে যখন মন থেকে কেউ কিছু চায় তখন সারা ব্রহ্মাণ্ড সে জিনিস নাকি খুঁজতে লেগে যায়! শাহরুখ খানের সবচেয়ে বড় ভক্ত যে আমাদের জুকার কাকু তাতে আমার আজ আর কোন সন্দেহ নাই। মনের কথা শুনে ফেলেই কি না তিনি একের পর এক আমার জন্য রন্ধনশিল্পের ভিডিও পাঠিয়ে যাচ্ছেন আর আমিও তাদেরকে আঁকড়ে ধরে মাড়ের সাগর পাড়ি দেব করতে করতে লকডাউনের দুখানি বছর বিছানাকে প্রায় পশ্চাদপ্রদর্শন না করেই কাটিয়ে দিয়েছি। তো একদিন অনেক সাহস সঞ্চয় করে মাতৃদেবীকে গিয়ে বললাম ‘দেখো’। এই আশায় যে যদি এবার অন্তত এসব অন্ধকারপুরবাসিনী পতিত আত্মার নবজাগরণ ঘটে আর তাদের এনলাইটমেন্টের ছুতায় হলেও আমরা ব্লাডি নেটিভ থেকে সিভিলাইজড হয়ে ভাতের মুখে ছাই দিয়ে দুবেলা পিজা পাস্তা সুশির অমৃত চাটতে পারি।
আমার স্বর্গীয় দাদী একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘কপালে আছে হাড় কী করবে চাচা খাজনদার’। কোথায় সেই স্কুলের আড্ডা থেকে ছোট হয়ে থাকা আমার শুকনো মুখখানা এবার একটু সাহেবী স্বাদের আলোয় চকচক করে ওঠবে সেই আশায় ফর্ক নাইফ আর চপস্টিক এটিকেট এর ভিডিও দেখব কি না ওমা কোথাকার কোন এক বাদামী কিশোয়ার দেখি গোরা সাহেবদের পান্তাভাত খাইয়ে আমার সমস্ত সাধনার মুখে চুনকালি মেরে দিল! এ কী সওয়া যায় না সওয়া উচিৎ বলেন? একের পর এক ভাত, তরকারী, মাছ, মাংস, নেহারী দিয়ে সাহেবী ডাইনিং আর আমার মাতৃদেবী দুজনকেই খুশি করে যাচ্ছে! যেনো এদের টিআরপি ব্যাবসার একমাত্র টার্গেট অডিয়েন্স আমাদের মাতৃজাতি আর ভিক্টিম হলেম গিয়ে একটু সভ্য হতে চাওয়া আমরা! বিরিয়ানী পোলাও তাও মানা যায়, তাই বলে সোজা পান্তা? জানে রহম নাই নাকি এ মেয়ের? থাকবে কী করে, এদের তেজের কাছে স্বয়ং শিব চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়েছিল আর এ তো তুচ্ছ মানব!
ফাইন ডাইনিং, এটিকেট, প্রতিযোগিতা, লোকে কী বলবে সব ছুঁড়ে ফেলে তাই কিশোয়ারকে যখন বিদেশী মিডিয়ায় ভাত রাঁধতে হয় তখন আমি বুঝি বংশোদ্ভূত কাকে বলে, রক্তের ভাত কী সহজে যায়! জানি না, তিনি সভ্যকরণ, উপনিবেশ শাসন, জাতিভেদ, বর্ণপ্রথা, পরিবেশবাদ, নবজাগরণ, এনলাইটমেন্ট নিয়ে কতটা সচেতন কিংবা আদৌ এ তার প্রতিবাদ কি না! রিয়েলিটি শো লোকের আবেগ বেচেই খায় সুতরাং এই পুরো বিষয়টাই হয়ত স্ক্রিপ্টেড। তবে মিথেন ঢাকা শহরের রান্নাঘরে যে নারী ভাত রাঁধছে তার এত জানার দরকার নেই। যেমন তামিলনাড়ুর নারী কোলাম শিল্পীদের একথা জানার দরকার নেই চালের গুঁড়ো গুলে যে নক্সা তিনি একটানে এঁকে চলেছেন সেই একই নক্সার মত দুটো প্রতিসম জ্যামিতি আঁকতে লাখ টাকার কম্পিউটার প্রোগ্রাম দরকার হয়। কেবল চেতনাবাজির দেশে দাঁড়িয়ে এসব অবচেতন স্রোতকেও আমরা আমাদের সীমিত চেতনাজ্ঞান দিয়েই বিচার করি এবং শেষ অবধী কুতর্কের আসর জমাই। যা আবহমান, যা চিরকালীন, যা মহকালের মহাচক্রের মত প্রকৃতির নিগূঢ়তম রহস্যময় সত্তায় এবং নারীর অবচেতনায় সদা জাগ্রত তা আমাদের মেকলীয় জ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় আর যায় বলেই আজও প্রবহমান। তাই কিশোয়ারের চোখের জল আসলে কোন বিলুপ্ত সরস্বতীর প্রবাহ, নাকি কেবলই গ্লিসারিন খরচ করে লোককে ভাত খাওয়ানোর ধান্দা তা জানতে সময় নষ্ট না করাই ভাল। কিশোয়ারও জানেন না বলেই আমার ধারণা। তবে তিনি কিটোর কপালে কুলোর বাতাস দিয়ে ভাত রাঁধেন, ভাত খান এবং সন্তানদের ভাত খাওয়ান। তিনি বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম, চিন, জাপান যে মাটীরই হোন না কেন কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ ক্লাবে দাঁড়িয়ে গোরাদের বিজ্ঞান, বিশ্বায়ন, উপনিবেশ এর চোখে চোখ রেখে মাথা উঁচু করে বলেন ‘আমি ভাত আর আলুভর্তা রেঁধেছি’। নিজেদের সবকিছুকেই বিলেতের সাথে বাইনারি কাতারে ফেলে বাংলা সাবান আর বিলেতী সাবানের গুণবিচারী ভদ্দরনোকেরাও তখন চোখের জল নাকের জল এক করে বলতে শুরু করেন বাংলাদেশী কুইজিন এর নাম। যদিও তার নিজেরই যে মহাকাব্যিক রসনাশাস্ত্র আছে সেদিকেও ততদিন চোখ পড়বে না যতদিন না আবার কোন কিশোয়ার কোন বিলেতী মিডিয়ায় নাকের জল চোখের জল ফেলে সেই শাস্ত্র তারই সামনে মেলে ধরবেন।
যদিও তাতে এসব রসনার আবহমান বাহক ছোটলোকের জাতের কিছু এসে যায় না। বরং এ পৃথিবীর অসংখ্য হারানো ধান আর হারানো চাষীর বিদ্রোহ যে মিডিয়ায় কোন দিন উঠে আসেনি তাকেও কালের চক্রে পড়ে ভাত রান্না দেখাতে বাধ্য হতে হয় টিআরপি বেচতে। এবং ভাতকে ক্রিমিনালাইজ করা দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসা যে আসলে স্রেফ ভণ্ডামি সেটা আরেকটু পরিষ্কার হয়। ধানচাষকে, ভাত খাওয়াকে, ভাত রাঁধাকে ক্রমাগত নতুন নতুন সব যুক্তি দিয়ে হেয় করা এক অডিয়েন্স প্রজন্মের বেকিং আর ভেগানিজমের অলক্ষ্মীকে কুলার বাতাস দিয়ে তাড়ানো লক্ষ্মীদের নিরব মাতৃতন্ত্রকে আজও ভাত আঁকড়ে থাকতে দেখি।
দেখি ক্ষুধার্ত্ত, বিষাক্ত পৃথিবীর সমস্ত পুষ্টির, অন্নের দায় কাঁধে নিয়ে সবুজ বিপ্লবের বিষে জর্জ্জরিত হয়ে দাঁড়িয়েও বসুমাতা হাত বাড়িয়ে ডেকে বলেন ‘আয়, ভাত খা’। তপ্তচক্ষু অন্নপূর্ণার সামনে হাঁটুমুড়ে বসে ভাত খেতে খেতে দেখি সভ্যতার সমস্ত অসুখের ভয় কেটে গেছে। দেখি হাজার দুর্য্যোগ, অত্যাচার, উচ্ছেদ, উৎখাত, উপনিবেশ, গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ সয়েও এখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি এ জাতি কারণ এইসব ছিঁচকাঁদুনে মেয়েরা কোন বিজ্ঞান আর যুক্তির ধার না ধেরেই ভাত রেঁধে জনম জনম ধরে পূর্ব্বপুরুষদের জেনেটিক মেমোরিতে চালের ড্রামে লুকানো টাকার মতো লুকিয়ে গেঁথে দিয়েছিলো ভাতের চর্ব্বি। এবং আজ বৃহৎ পুঁজিকে তাদের ভাত রাঁধা আর কান্নাকাটি দেখাতে হয় জায়ান্ট মিডিয়ায় কারণ নাহলে তার ব্যবসা টেকে না। দেখি অদৃশ্য, অস্বীকৃত সব কেমন খুব ধীরে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
তাই কিশোয়ারকে আপনার যেমনই লাগুক না কেন, ভাত খান। ওসব ফাইন ডাইনিং এর ফাইন অসুখবিসুখ সারিয়ে তুলতে কালো চাল, লাল চাল এর ভাত খান। পরিবেশ রক্ষার, আর পরী হওয়ার দৌড়ের মুখে ঝামা ঘসে দিয়ে গামলা গামলা ভাত খান তাতে করে আসন্ন সমস্ত ঝড়, বন্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ পাড়ি দেয়ার শক্তি পাবে আপনার পরবর্ত্তী প্রজন্ম। আর যেসব কিশোয়ার আপনার ঘরে ভাত রাঁধে তাদেরকে আমার মতো ওসব ফাইন রেসিপি দেখাতে যাবেন না। কারণ এরা তো বিফলে মূল্য ফেরত দেয়ই না এবং এই লেখকও কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায় নেবে না।
বরং বাজার থেকে সেক্সী মিনিকেটের বদলে পারলে আনসিভিলাইজড, ঢেঁকিছাঁঠা, লাল, কালো চাল কিনে আনুন। তাতে আপনার ডাক্তারবাবুও সন্তুষ্ট থাকবেন, চেহারা, শরীর, পরিবেশ সব একদম ঝকঝকে তকতকে থাকবে। আজ যেমন টিআরপি বেচতে গোরা মিডিয়াকে পান্তাভাতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে বলা যায় না, কাল যদি কোন দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচতে আপনার সন্তানের জেনেটিক মেমোরিতে ভাতের গুণাগুণ দরকার হয়, আর তা যদি না থাকে তখন কিটো মিটো কোন স্টেথোস্কোপ ধারীরই কিন্তু টিকি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তাই ওসব পুঁজির কুবেরের বিজ্ঞান আর কর্পোরেট ডাকিনীর মিষ্টিমুখে ঝাঁটা মেরে কব্জী ডুবিয়ে ভাত খান, ছবি তুলুন, পোস্ট করুন, পারলে দাগটানা খাতা নিয়ে লিখতে বসে যান। বাকিসব পরে দেখা যাবে।
নুসরাত জাহান
জন্ম : ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে।
পদ্মাপাড়ের রাজশাহী জেলায়। বর্ত্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{কলিযুগের কিটো এবং কিশোয়ার [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}