চাচাকাহিনী (পর্ব্ব– ২) || কামরুল হাসান

0


চাচাকাহিনী (পর্ব্ব– ১)

চার—
ইন্টারভ্যু বোর্ড বসেছে, প্রার্থী একজন, প্রশ্নকর্ত্তা তিনজন। আসলে একজনই। প্রায়শই বোর্ডর অপর দুই সদস্য আপন ও আমাকে প্রধান প্রশ্নকর্ত্তার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। চাচা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিদ্ধান্ত কী?’ এ যেন আধুনিককালের সক্রেটিস, শিষ্যদের মৌলিক প্রশ্ন করে এলোমেলো করে দেন। ফাণ্ডামেণ্টাল নলেজের পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমাদের ফাউণ্ডেশনেই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি অবশ্য এই উত্তরটা জানি। কারণ এটা (Decision Making) আমি পড়াই। স্কোয়াড্রন লিডার কিছু একটা উত্তর দেয় যেটা অনেকটা সেই পুরনো গল্পের মত। গণতন্ত্র কী? গণতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্র। আপনি যদি কোন কিছুকে সেটা দিয়েই ব্যাখ্যা করেন তবে তাকে বলা হয় Pedagogical Error, অর্থাৎ সিদ্ধান্তকে সিদ্ধান্ত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমি দেখেছি অনেক শিক্ষিত মানুষের ফাউণ্ডেশন নলেজ দুর্ব্বল। তারা ভাবে আরে ওটা তো জানি। সংজ্ঞায়িত করতে বল্লে, থতমত খেয়ে যায়। জ্ঞান অর্জ্জনের যে তিনটী স্তর আছে যাতে তিনটী বৃত্ত দিয়ে এঁকে বোঝানো যায়, তার একবারে কেন্দ্রে আছে ফাণ্ডামেণ্টাল নলেজ। এটাকে বলা হয়, Must Know। এটা সম্পন্ন হলেই শিক্ষার্থী দ্বিতীয় বৃত্ত Should Know-র দিকে এগিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটী কোর্স শিক্ষক সেমিস্টারের সীমিত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীকে প্রথম দুটী বৃত্ত পড়াতে পারেন আর দেখিয়ে দিতে পারেন তৃতীয় বৃত্ত Nice to Know এর পরিধি। বস্তুত এই শেষ বৃত্ত অসীম। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টী স্পষ্ট হবে। ধরুণ কেউ রসায়নশাস্ত্র পড়তে চায়। তাকে প্রথমেই ১০৫টী মৌলিক পদার্থের প্রতীক যেমন লোহা (Fe) সীসা (Pb) সোনা (Au) জানতে হবে। জানতে হবে অনু পরমাণুর গঠন। এ ছাড়া সে রসায়নশাস্ত্র এক পা-ও এগুতে পারবে না। কারণ এরপরেই তাকে শিখতে হবে বিভিন্ন যৌগের সংকেত, রাসায়নিক সমীকরণ। রসায়নশাস্ত্র শেখার জন্য যা যা প্রয়োজনীয় তাকে শিখতে হবে। কিন্তু শেখা তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডীর ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। সে যখন উচ্চতর গবেষণা করতে যাবে বা যোগ দিবে কোন বিজ্ঞান গবেষণায় তার প্রয়োজন হবে বিস্তারিত জ্ঞান। রসায়নশাস্ত্র নিজেই এক বিপুলা জটিল পৃথিবী। ধরুন ঔষধশাস্ত্র (Pharmachology)। প্রতিটী ঔষধ একেকটী জটিল যৌগ, তৈরী হয় রাসায়নিক সূত্র ও সমীকরণ মেনে। জগতের হেন বস্তু নেই যার রাসায়নিক সংজ্ঞা বা সংকেত নেই। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ কিংবা আমাদের সময় বোর্ড ডাবল স্ট্যাণ্ড করা তুখোড় মেধাবী ছাত্র, আমার সহপাঠী বন্ধু গোলাম সামদানী যে রসায়নশাস্ত্রকে বেছে নিয়েছিলেন উচ্চতর গবেষণার (পিএইচডি) জন্য তাতে প্রতীয়মান হয় এর ভেতরের সৌন্দর্য্য তাদের শিল্পমুগ্ধ চোখে ধরা পড়েছিল।

স্কোয়াড্রন লিডারের উত্তর শুনে চাচার মনে পড়ল তাঁর স্কুলের ইংরেজী শিক্ষক জনাব ফকরুল ইসলামের কথা। তিনি ক্লাসে ছাত্রদের একটী ইংরেজী প্যাসেজ বাংলায় অনুবাদ করতে দিয়েছেন। চাচা সবার আগে খাতা জমা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ফকরুল স্যার প্যাসেজটী আড়াআড়ি দুটী দাগ দিয়ে কেটে দিলেন। ‘স্যার আমারটা কি হয়নি? তিনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। ফকরুল স্যারের উত্তর ছিল, ‘জিয়াউল কুদ্দুসের মত হয়নি’। ‘সিদ্ধান্ত কী’ উত্তর যিনি দিয়েছেলেন তিনি বুঝে গেলেন কত মার্ক পেয়েছেন।

প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতি ভেসে উঠতে তিনি আবেগতাড়িত হলেন। বল্লেন, আমরা আমাদের শিক্ষকদের কী শ্রদ্ধাই না করতাম। এখন শিক্ষকদের সামাজিক মর্য্যাদা কমে গেছে। আমি যেহেতু এখনো পড়াই, আমি বল্লাম, শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্দ্ধাবোধ এখনো আছে, হয়ত অতীতের মত সে মাত্রায় নেই। এর জন্য শিক্ষকদেরও দায়ভার আছে। আমাদের পিতামাতারা সন্তানদের পই পই করে বলে দেন শিক্ষকদের কথা শুনতে। চাচা বল্লেন আমাদের সময় তো নীতি ছিল, Spare the Rod and Spoil the Child । তারা নাকি সন্তানদের স্কুলে দিয়ে আসার সময় এমনও বলতেন যে হাড়গোড় ফিরে এলেই চলবে, অর্থাৎ পিটুনিতে মাংস কিছু না থাতলেও চলবে। আমি বল্লাম সেটা ছিল Theory X-এর যুগ, এখন আমরা বাস করি Theory Y-এর যুগে। মারামারি নিষিদ্ধ, সেটা কী বাবা-মা, কী শিক্ষকের। আমাদের দেশে এখনো মিশ্রপদ্ধতি চলছে (Theory Z), তবে পশ্চিমা বিশ্বে মারামারি একবোরেই নিষিদ্ধ।

চাচা স্কোয়াড্রন লিডারকে প্রশ্নটী করলেন একারণে যে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে ঢাকা থেকে কাটিরহাঁটে গিয়ে থাকতে পারবে কি না। স্কোয়াড্রন লিডার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জানালেন, তিনি পারবেন। জানালেন এটাই তাঁর জীবনের শেষ পেশাগত প্রকল্প হবে। বিমানবাহিনী থেকে স্বেচ্ছাঅবসরে গিয়ে তিনি কিছুকাল পরিবারসহ আমেরিকায় কাটিয়েছেন। এরপরে ফিরে এসেছেন স্বদেশে। একটী স্কুলের সাথে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা শিক্ষার প্রতি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। চাচা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর দাদার প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষের গৌরবময় স্কুলটিকে আধুনিক করবেন। নতুন ভবন তৈরী করবেন, জনবল বাড়াবেন। স্কোয়াড্রন লিডারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি রাজধানী ছেড়ে মফস্বলের একটী এলাকায় গিয়ে কাজ করবেন কি না।

সিদ্ধান্ত বিষয়ে আলোচনার পরে চাচার নতুন আলোচনার বিষয় ‘দায়িত্ব’। একদার মার্ক্সবাদী মানুষটী জীবনের মধ্যগগন থেকে ধর্ম্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেছেন। তার আলোচনায় মার্ক্সবাদ যেমন উঠে আসে তেমনি উঠে আসে কোরাণ হাদিস। তিনি দায়িত্ব প্রসঙ্গে কোরাণের বাণী উল্লেখ করলেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষের মাঝে আমি কাহাকে কাহাকে মর্য্যাদায় উন্নত করি কাজটী করাইয়া লইবার জন্য।’ তাই হয়তো যুগসন্ধিক্ষণে নেতার আবির্ভাব ঘটে।

চাচার কথা বলার একটী বৈশিষ্ট্য হল তিনি ক্রস রেফারেন্সে চলে যান। এক্ষেত্রে তাকে অরিজিনাল ‘চাচাকাহিনী’র লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাবশিষ্য বলা যেতে পারে। তিনি ফের পবিত্র কোরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিলেন, যেখানে আল্লাহ বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘আমি কোনো সৎকার্য্যকে পুরস্কার না দিয়ে থাকি না’। আর গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘তোমার যা নাই তা তুমি দিতে পার না।’ অর্থাৎ কর্ম্মসম্পাদন করতে হলে যোগ্যতা অর্জ্জন করতে হবে। অর্জ্জন করলে পুরস্কার মিলবে। চাচা আমাদের সকলকে ভগবদ গীতাকে একটী অবশ্যপাঠ্য পুস্তক হিসেবে পড়তে বললেন। গীতায় জোর দেওয়া হয়েছে কর্ম্মের ওপর। আমাদের অবশ্যই কোরাণ পড়া উচিৎ তবে অর্থ বুঝে, না বুঝে নয়। তোতাপাখীর মত আরবী পড়লাম, বুঝলাম না একবিন্দু, পড়লাম কিন্তু জীবনে প্রয়োগ নেই একবিন্দু— তাহলে হবে না। পড়তে হবে বুঝে এবং নিজের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। কোরাণে বলা আছে, ‘আমি (সৃষ্টিকর্ত্তা) আশাতীত জায়গা থেকে রিজিক দিতে পারি।’ কাটিরহাট স্কুলের লাইব্রেরী, বিজ্ঞান ল্যাব ও কম্পিউটার ল্যাব করার জন্য করার জন্য ডিজাইন কম্পিটিশন আহবান করা হল। তিনটী ফার্ম ডিজাইন পেশ করল, একটী মনোনীত হল। টাকা লাগবে ৩৮ লক্ষ। কোথায় পাবেন এত টাকা? সবাই চাচার পরিকল্পনাকে অবাস্তব ভারছে এমনি সময়ে এক পুরনো ছাত্র এসে ৪০ লক্ষ টাকা দিয়ে দিল। তা দিয়ে একটী আধুনিক, চমৎকার নক্সার লাইব্রেরী, বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি ও কম্পিউটার ল্যাব তৈরী হল। ‘তুই তো দেখেছিস সেইসব?’ আমাকে জিজ্ঞাসা চাচার। আমি বল্লাম শহরের অনেক ভাল স্কুলেও অত ভাল গ্রন্থাগার ও ল্যাব নেই। চাচা বললেন, চট্টগ্রাম শহরে ৪০ জন চিকিৎসক আছেন যাদের আয় দুর্দ্দান্ত, তারা এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। এমনি অসংখ্য প্রাক্তন ছাত্র ভাল পেশায় আছেন, তাদের উচ্চ আয়। আমি বল্লাম সমগ্র উন্নত বিশ্বেই এলুমনাইরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ডোনেশন দেয় (Endowment Fund)। আইআইটি খড়গপুরের একজন এলুমনাস বিনোদ গুপ্তা তার বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানকে দুই মিলিয়ন ডলার (seed fund) দান করেন যা দিয়ে তার নামে বিনোদ গুপ্তা স্কুল অব ম্যানেজমেণ্ট এবং রাজীব গান্ধী স্কুল অব ল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৭ সালে খড়গপুর থেকে গ্রাজুয়েশন করা বিনোদ গুপ্তা একজন কৃষিবিদ এবং প্রায় ৫০ বছর আমেরিকার কর্পোরেট জগতে শীর্ষপদে চাকরী করেছেন, ২০০৮ সাল অবধী তিনি ছিলেন ইনফোসিসের মত বিলিয়ন ডলার কোম্পানির সিইও। তার এই মহতী অবদান কেবল যে আইআইটির এলুমনাইদের ভেতর Giving Back সংস্কৃতি চালু করে তাই নয়, মূলত প্রকৌশলবিদ্যা ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান আইআইটি সিস্টেমে ম্যানেজমেণ্ট ও আইনের বিদ্যালয় খুলেছে প্রথমবারের মত। বিনোদ গুপ্তা চেয়েছেন প্রকৌশলীরা কর্পোরেট লিডার হিসেবে গড়ে উঠুক। মহৎহৃদয় মানুষটীর দর্শন হল Learn, Earn and Return। আমার ঐ ফিরিস্তি শোনার পরে চাচা বললেন, ‘আমরা কজন পুরানো বিদ্যাপীঠকে মনে রাখি? ফিরিয়ে দেই ঋণ?’

তিনি ফিরে গেলেন পবিত্র গ্রন্থ কোরাণে। বললেন কোরাণের ত্রিশটী অধ্যায়ে পাঁচটী ডাইমেনশন রয়েছে। এগুলো হল :

আদেশ
নিষেধ
উদাহরণ
কাহিনী
রহস্য

অর্থাৎ কিছু আদেশ, কিছু নিষেধ, কিছু উদাহরণ, কিছু কাহিনী আর কিছু রহস্য রয়েছে। আমরা তো পড়ি, কিন্তু কতটা বুঝি? চাচা গৌতম বুদ্ধের একটী অমর বাণী আমাদের শোনালেন। বুদ্ধ বলেছেন, ‘অজ্ঞতা সকল দুঃখের কারণ।’ অজ্ঞতা তাহলে আশীর্ব্বাদ নয়?

পাঁচ—
চাচার অনেক গল্প আছে যা তিনি বারবার বলেন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর কাছে থাকার কারণে সেসব গল্প আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। যেমন ঢাকা কলেজে তাঁর প্রিয় দুই শিক্ষক, কিংবদন্তী তাঁরা দুজনেই, সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বড় দুই নাম, শওকত ওসমান ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের গল্প। গল্প নয় বাস্তব। চাচার গল্পের সাথে মিশে থাকে প্রচ্ছন্ন কৌতুক ও শ্রোতার জ্ঞানের পরিধি জানার কৌতুহল। তাঁর প্রকৃতির মাঝে মিশে আছে একজন শিক্ষকের অবয়ব, একজন বহুধাবিস্তৃত মননশীল মানুষের গাঢ় উপস্থিতি। আমি নিজে কত যে শিখেছি তাঁর কাছ থেকে তার ইয়ত্তা নেই। আমার জীবনের একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক জনাব জিয়াউল কুদ্দুস।

শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান বলতেন, বিধাতা আমাদের কণ্ঠ দিয়েছেন গান করার জন্য। আমরা শুধু ভাত খাই। ভাত খাওয়া প্রসঙ্গে চাচার বহুবার বলা কৌতুকটী হল—
এক ধনবান ব্যাক্তি তার কর্ম্মচারীকে জিজ্ঞেস করছেন, কেষ্টা, কী করছ? কেষ্টা উত্তর দেয়, কর্ত্তা ভাত খাই। তখন ধনবান ব্যাক্তীটী খেঁকিয়ে ওঠেন। বলেন, খাই কী রে? শুনেছি মহারাণী ভিক্টোরিয়া অন্নগ্রহণ করতেন। রাজারা ভোজন করতেন আর জমিদাররা করতেন আহার। আমি খাই, তুই ব্যাটা গিলস।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাংলা পড়াতেন। শওকত ওসমানও তাই। সায়ীদ স্যার দুবছর ধরে একই গল্প পড়াতেন— রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’। সে গল্প নাকি আর শেষ হত না, কিন্ত ওই এক গল্প পড়াতে গিয়ে তিনি বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য ঘুরে আসতেন। সায়ীদ স্যারের জাদুকরী বক্তৃতা শুনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ছাত্ররা এসে ভীড় জমাত আর ক্লাস উপচে পড়ত। আমার ধারণা প্রিয় শিক্ষকের কাছ থেকে চাচা এই গুণটী পেয়েছেন। তার হৈমন্তী’ গল্পও শেষ হয় না। তিনি কাটিরহাঁট স্কুলে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে গিয়ে কোরাণ-হাদিস, মার্ক্সবাদ, গীতা, মহাভারত, গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ঘুরে এসেছেন। আর কত ঘুরবেন আর আমাদের ঘুরাবেন কে জানে। তখন বেলা বারোটা বাজে।

আমাদের দ্বিতীয় কাপ চা খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। চাচা বুয়াকে ডেকে বললেন, ‘বুয়া সবাই তোমার চায়ের খুব প্রশংসা করছে। অত সুন্দর চা। তারা আরেক কাপ চা খাইতে চায়।’ বুয়া হাসিমুখে গিয়ে হেঁশেলে ঢোকে। আমার তখন ডেল কার্নেগীর বইয়ের একটী ঘটনা মনে পড়ল এক ধনাঢ্য ইংরেজ বাসার কাজকর্ম্মের জন্য একজন পরিচারিকা রাখবেন। যাকে মনোনীত করলেন আগের বাড়ীর কর্ত্তার সাথে রেফারেন্স চেক করতে গিয়ে জানলেন যিনি কাজটী করতে আসছেন তিনি বেশ ভাল পরিচারিকা, ভাল রাঁধে, বিশ্বস্ত, ঘরবাড়ী গুছিয়ে রাখে ইত্যাদি। শুধু তার দুটী দোষ, সে একটু অপরিচ্ছন্ন থাকে আর বেখেয়ালে মাঝেমাঝে বাসনকোসন ভাঙে। সেই পরিচারিকা যেদিন কাজে যোগদান করতে এল এ বাড়ীর কর্ত্তা তাকে বল্ল কাল তোমার পুরানো মনিবের সাথে তোমার ব্যাপারে কথাবার্ত্তা হল। তিনি তোমার খুব প্রশংসা করলেন। বিশেষ করে বললেন, তুমি বেশ পরিচ্ছন্ন থাক আর বাসনকোসনের যত্ন নাও। সে বাড়ীতে কুড়ি বছর কাজ করেছিলেন ভদ্রমহিলা, এই কুড়িবছরে একটা বাসনও ভঙেননি। আর সবসময় ধোপদুরস্ত পোষাক পরে থাকতেন। মনঃস্তত্ত্বে একে বলা হয় Self fulfilling prophecy বা Pygmalion Effect মানুষ তার কাছে অপরের যে প্রত্যাশা, তার সমান হয়ে উঠতে চায়।

যেহেতু আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে কাটিরহাঁট হাই স্কুল তাই চাচা ফিরে আসেন স্কুল প্রসঙ্গে। চাচা বলরেন, ভাল স্কুল গড়ে তুলতে তিনটী জিনিষ দরকার—

১। অবকাঠামো
২। ভাল ছাত্র
৩। নিবেদিত শিক্ষকমণ্ডলী

অবকাঠামো ভাল হলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সে স্কুলে পাঠাতে ইচ্ছুক হবে। অধিক সংখ্যায় ছাত্র পাওয়া গেলে ছাত্র বাছাই করে নেওয়া যায়। নিবেদিত ও যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী তাদের যথোপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারলে ফলাফল ভাল হবে। আর ফলাফল যত ভাল হবে তত স্কুলের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। তখন ভাল ছাত্র পাওয়া যাবে আরও বেশী। ভাল বেতন দিতে পারলে মানসম্পন্ন শিক্ষকও পাওয়া যাবে। এভাবেই কাটিরহাঁট স্কুলকে তার হৃতগৌবর ফিরিয়ে দিতে হবে তাকে করে তুলতে হবে যুগোপযোগী ও আধুনিক। আমি বল্লাম বিপণনের ভাষায় একে বলা হয় ব্র্যান্ডিং (Branding)। একবার ব্র্যাণ্ড ইমেজ গড়ে তুলতে পারলে কাষ্টমারের অভাব হবে না। আমি স্কলাস্টিকা স্কুলের উদাহরণ দেই। স্কুলটীকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি কেননা আমার চারটী সন্তানই ওই স্কুলে পড়াশোনা করেছে। বহুকাল স্কলাস্টিকা ছিল ধানমণ্ডি এলাকায় একটী লো-প্রোফাইল স্কুল। পড়াশোনার মান অক্ষুন্ন রেখে স্কুলটী সুনাম অর্জ্জন করছিল। ঢাকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো হঠাৎই ফুঁলে-ফেঁপে উঠল যখন অভিভাবকেরা ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষার দিকে ঝুঁকল এবং সামর্থবান লোকের সংখ্যা ও আয় দুটোই বেড়ে গেল। স্কলাস্টিকার ম্যানেজমেণ্ট দুটী স্ট্রাটেজিক সিদ্ধান্ত নেয়। একটী হল বিত্তবান এলাকা গুলশানে এসে স্কুল খোলা এবং উত্তরায় প্লট কিনে নিজস্ব ক্যাম্পাস নির্ম্মাণ। চাচা যে বল্লেন অবকাঠামোর কথা তা সত্য স্কলাস্টিকার ক্যাম্পাস অনেক কলেজ তো বটেই, অনেক প্রাইভেট বিশ্বদ্যিালয়ের ক্যাম্পাস থেকে সুন্দর। শিক্ষার ভাল মান, ছাত্রছাত্রীদের ভাল ফলাফরে সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। নব্যধনীরা টাকার বস্তা নিয়ে স্কলাস্টিকা ও অন্যান্য সুনামছড়ানো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোয় নিজ নিজ সন্তানদের ভর্ত্তি করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাজারে চাহিদাবৃদ্ধি (market opportunity), মান ধরে রাখা আর ভাল ফলাফল স্কলাস্টিকাকে একটী ব্র্যাণ্ড হতে সাহায্য করে। ওই জোয়ারেই স্কুলটীর শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি ঘটতে থাকে। স্কলাস্টিকা হয়ে ওঠে একটী পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। তারা কিন্তু তাদের মান ধরে রাখতে পারেনি। স্কুলটী নিষ্ঠা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন মিসেস ইয়াসমিন মোরশেদ। তার ছেলে এসে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যেমন কফি চেইন, রিয়েল এস্টেট, বুক এণ্ড গিফট শপ, ট্রান্সপোর্ট গড়ে তোলে (Unrelated Diversification) সবগুলো ব্যবসাই লোকসান দেয়, স্কুলটী হয়ে ওঠে Cash Cow, এর উদ্ধৃত্ত্ব মুনাফা দিয়ে লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভুর্ত্তকি দেওয়া হয়। চাচা তার ছেলে ঋদ্ধিকে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে স্কলাস্টিকায় এনে ভর্ত্তি করেছিলেন যুগের চাপে। ঋদ্ধি স্কলাস্টিকার পরিবেশ পছন্দ করেনি, ফরে তিনি ছেলেকে ফের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে নিয়ে আসেন।

আপন পড়াশোনা করেছে ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলে, আর ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স কলেজে। আপন মন্তব্য করল, স্কুল হতে হবে স্কুলের মত। এখন বাচ্চারা গাছ চেনে না, ফুল চেনে না। পাখী বলতে কাক আর খেলা বলতে ভিডিও গেম। স্কোয়াড্রন লিডার বললেন, অথচ আমাদের কী দুরন্ত শৈশব, বাল্যকাল আর কৈশোর কেটেছে। আমরা নদীতে গোসল করেছি, খালে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, বনে-বাদাড়ে ঘুরেছি, মাঠে খেলেছি। আজকালকার শহুরে বালক-কিশোররা এসব কিছুই পায় না। শহরে মাঠ নেই, পার্ক নেই। আমার মনে পড়ল এডিনবরা ইউনিভার্সিটিতে এডুকেশনাল সাইকোলজির ক্লাসে শিক্ষক ড. কলিন স্মিথ আমাদের একদিন একটী ভিডিও দেখিয়েছিলেন যেখানে একজন আমেরিকান মনঃস্তত্ত্ববিদ বলেছিলেন, আমাদের আরও বেশী স্কুল দরকার নেই, আমাদের দরকার আরও বেশী খেলার মাঠ।

ছয়—
চাচা আর ভাতিজার মধ্যে অনেকগুলো মিল আছে। এর একটী হল তারা দুজনেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় বোর্ডর মেধাতালিকায় নিজেদের নাম উঠাতে পেরেছিলেন। তারা দুজনেই ছিলেন বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী, একই রাজনৈতিক দলের সদস্য। চাচা নেতৃস্থানীয়, ভাতিজা তরুণ সদস্য। অনেকগুলো বছর চাচা একাডেমিক পড়াশোনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। পরে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হন তার বিষয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়েরই টপ সাবজেক্ট ইকোনমিক্স। মেধাবী মানুষের যা হয়, তিনি প্রথমবর্ষ থেকে দ্বিতীয়বর্ষ উত্তীর্ণ হওয়ার পরীক্ষায় ডিঙ্গিয়ে যান তার ব্যাচের মেধাবী সহপাঠীদের। তিনি ব্যবসা করতেন। এই মানুষটী হয়ে গেলেন ইনভেষ্টমেণ্ট ব্যাংকার। এর পেছনের ঘটনা হল তিনি আইবিএতে ইনভেষ্টমেণ্ট ব্যাংকিংএর ওপর একটী প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে তার বিষয়টী ভাল লেগে যায় আর ভাল লাগে কোর্সের প্রশিক্ষক ফিনান্সের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসাকে। এদেশে যারা ফিনান্স পড়ায় তারা সবাই ড. মোহাম্মদ মুসাকে চেনেন। তাঁর ক্যারিয়ারের বাঁকও অভাবনীয়। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে উচ্চতর কেরানী পদে (চাকরী নিয়েছিলেন। সেসময় ড. মুসার জীবনে যে যুগান্তকারী পরিবর্ত্তনটী হয় তা হল তার আইবিএতে ছাত্র হিসেবে ভর্ত্তি হওয়া এবং ফোর আউট অব ফোর অর্থাৎ পারফেক্ট স্কোর নিয়ে এমবিএ ডিগ্রী অর্জ্জন। বাকিটা ইতিহাস। গোল্ড মেডেলিষ্ট মোহাম্মদ মুসা শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আইবিএতে এবং বৃত্তি নিয়ে চলে যান আমেরিকায়। তার পিএইচডি থিসিস ছিল ক্যাপিটাল মার্কট নিয়ে, যেটাকে আমরা শেয়ারবাজার হিসেবেই চিনি। ড. মুসা হলেন ক্যাপিটাল মার্কেটের বিশেষজ্ঞ এবং একজন অসাধারণ শিক্ষক। তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় আমি যখন ইষ্ট ওয়েষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই, ড. মুসা ছিলেন বিশ্বদ্যিালয়ের প্রোভিসি। ইষ্ট ওয়েষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য্য এবং ড. মুহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের আহবানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সটি ছেড়ে ড. মুসা যোগ দিয়েছেন ইষ্ট ওয়েষ্ট ইউনিভার্সটিতে।

ড. মোহাম্মদ মুসা শিক্ষক, জিয়াউল কুদ্দুস হলেন তার ছাত্র। চাচা গভীর আগ্রহে পুঁজিবাজার সম্পর্ক দীক্ষা নেন ড. মুসার কাছ থেকে। তারা হয়ে গেলেন বন্ধু। চাচার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম হল স্বদেশ গ্রুপ। তিনি স্বদেশ ইনভেষ্টমেণ্ট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করলেন এবং ড. মোহাম্মদ মুসাকে বানালেন এর উপদেষ্টা। সেসময় ফ্রেঞ্চ ভিত্তিক বহুজাতিক ক্যামিক্যাল কোম্পানি লাফার্স, যে কোম্পানী ছাতকে বাংলাদেশের একমাত্র চুনাপাথর থেকে সিমেণ্ট তৈরীর কারখানাটী প্রতিষ্ঠা করেছে, (বাকি সবগুলো সিমেণ্ট কোম্পানিই বিদেশ থেকে ক্লিংকারস আমদানী করে তা গুড়ো করে সিমেণ্ট বানায়) তারা পুঁজিবাজার থেকে ইকুইটি ক্যাপিটাল উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জন্য দরকার পুঁজিবাজারে নিবন্ধন, সরকারের অনুমতি, এবং ইনভেষ্টমেণ্ট ব্যাংকার। লাফার্জর কাজটী পওিয়ার জন্য স্বদেশ ইনভেষ্টমেণ্ট দরখাস্ত করল। তখন লাফার্জর সিইও ছিলেন মিশেল ফলি। তিনি ফরাসী, মূল কোম্পানীর একজন ঊর্ধতন কর্ম্মর্কতা। লাফার্জ কাজটী স্বদেশ ইনভেষ্টমেণ্টকে দিবে না। কেননা তাদের পুঁজিবাজারে কাজ করার তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই। চাচাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কাজটী তিনি নিবেনই।

চাচা মিশেল ফলিকে পাঁচতারা হোটেলে ডিনারের দাওয়াত দিলেন আর সেই ডিনারে উপস্থাপন করলেন স্বদেশ ইনভেষ্টমেণ্ট লিমিটেডের পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা। তুলে ধরা হল লাফার্জ পরিকল্পিত ১৬০০ কোটী টাকা তোলার financial structuring। স্বদেশ ইনভেষ্টমেণ্ট হবে এর আন্ডাররাইটার। পাঁচতারা হোটেলে ডিনার? আমাদের সনিগ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে চাচা বললেন আরে টাকার কাম কি শুধু গল্পে হয়? মিশেল ফলি তবু কনভিনস্ড নন, তিনি চাচ্ছিলেন ফুল প্রুভ। এমনি সময়ে চাচা একদিন গুলশানস্থ লাফার্জ অফিসে গেছেন, দেখলেন, অফিস খুব গরম। কী ব্যাপার? জানলেন এনবিআর থেকে একিটী সার্টিফিকেট আনা দরকার, লাফার্জর দেশী কর্ম্মর্কতারা সেটী করতে পারছেন না। বস তাই রেগে আগুন। তখন ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভেনিউ (এনবিআর) এর চেয়ারম্যান ছিলেন ড. শোয়েব, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চাচার শুধু পরিচিত নন, ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারা একসঙ্গে অনেক রাজাউজির মেরেছেন, আকাশে রঙীন নায়ে ভেসেছেন। পারা তাক ফোন করলেন। বহুদিন পরে পুরানো বন্ধুকে পেয়ে ড. শোয়েব তো মহাখুশী। বল্লেন, ‘ওই ব্যাটাকে (মিশেল ফলি) নিয়ে তুই চলে আয়, আমি কাজটী করে দিচ্ছি। এটা কোন ব্যাপারই না।’ এনবিআরের আরেকজন সদস্য কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন স্বদেশ ইনভেষ্টমেণ্ট লিমিটেডের উপদেষ্টা। তিনিও বললেন, চলে আসুন। চাচা মিশেল ফলিকে নিয়ে এনবিআরে সরাসরি চেয়ারম্যানের কক্ষে নিয়ে গেলেন। পুরনো বন্ধুকে পেয়ে ড. শোয়েব উচ্ছসিত, কীভাবে আপ্যায়ন করবেন তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আর পুরানো দিনের স্মৃতিচারণ করে হো হো হাসিতে ঘর ফাটালেন। মাঝে আবার একরার জিজ্ঞেন করে নিলেন এই ব্যাটা (মিশেল ফলি) আবার বাংলা বোঝে নাকি? অভয় পেয়ে আবার হো হো…। কাজ হয়ে গেল? বিদ্যুৎবেগে, আপ্যায়নও হল প্রচুর। মিশেল ফলি রীতিমত হতবাক। ফেরার পথে তিনি তার বিস্ময় লুকাতে পারলেন না। বললেন, তুমি তো দেখি জাদুকর। চাচা সুযোগটা লুফে নিয়ে বলেলন, তাহলে কাজটী কি তুমি আমাদের দিচ্ছ? ফলি রাজী হলেন। চাচা বললেন তাহলে চল আজই আমরা চুক্তিপত্র সাক্ষর করে ফেলি। ফলি বলেছিলেন, তুমি এত হুড়োহুড়ি করছ কেন, চাচা মুখে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি মত বদলাও’। চাচা গাড়ী থেকেই তাঁর লোকদের চুক্তির কাগজপত্র রেডি রাখতে বললেন। সেদিনই লাফার্জর সাথে স্বদেশ ইনভেষ্টমেণ্ট লিমিটেডের চুক্তি হয়ে গেল।

১৬০০ কোটী টাকা কি পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা গিয়েছিল? আমাদের বেকুব প্রশ্ন। চাচার মুখে প্রজ্ঞার হাসি। আমি বল্লাম সেসময়েই এই সুপরিসর বাড়ীটী, যেখানে আমরা বসে আছি, চাচা কিনে ফেলেন। চাচা বল্লেন এই এপার্মেণ্টটী ছিল তৎকালীন ট্রাষ্ট ব্যাংকের এমডির। চাচা শুনতে পেলেন তিনি এপার্মেণ্টটী বিক্রি করবেন। বাড়ী দেখতে এসে চাচার পছন্দ হল, সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নিলেন, কিনবেন। ‘পছন্দ হয়েচে, লিয়ে লিয়েছি, মাগার দেমাগ করতে জানি না।’ এরকম ‍পরিস্থিতিতে আমার চিররসিক চাচার এটাই প্রতিক্রিয়া। একবার তিনি একটা টকটকে লাল পিকআপ ব্যান কিনলেন। আমি সপ্রশংস তাকাতেই তিনি ওই একই কথা বলেছিলেন ‘পছন্দ হয়েচে, লিয়ে লিয়েছি, মাগার দেমাগ করতে জানি নে।’ এই মানুষটীর মত আপাদমস্তক রসিক লোক আমি আমার জীবনে দেখিনি।

চাচা স্কোয়াড্রন লিডার ও আপনকে বলেন, আমার ভাতিজার লেখার হাতটী চমৎকার। ও যখন আইআইটিতে পড়ত তখন আমাকে চিঠি লিখত। সে ছিল চিঠি লেখার যুগ। ভারী সুন্দর ওর চিঠির ভাষা। ও হয়ত শুনলে মন খারাপ করবে, কিন্তু আমার কাছে কবিতার চেয়ে ওর লেখা গদ্য বেশী ভাল লাগে। সে অবশ্য কবিতাও ভাল লেখে। তিনি বল্লেন, এদেশে মেধার মূণ্যায়ন হয় না। চাচার বড় বোন শিরিন ফুফু আমেরিকা বসবাস করেন দীঘর্কাল ধরে। তাঁর মাত্র দুটী কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ওখানে কবী হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান। আমি বল্লাম এ দেশে রাজনৈতিক পরিচয় হয়ে ওঠেছে সবকিছুর মানদণ্ড নির্ণেয়ের মাপকাঠী, এখানে কম মেধাবী রাজনৈতিক লেজুরদের পুরস্কুত করা হয়। আনুগত্য প্রকাশের এক দীর্ঘ সারি তৈরী হয়েছে যা ইতিহাসে আগে কখনো দেথা যায়নি। কবী-সাতিত্যিক-শিল্পীরা এমন করে আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ সঞ্চয় করেনি।

স্কোয়াড্রন লিডার যখন আমেরিকায় ছিলেন তার ছেলে আমেরিকার নিউ জার্সির একটী স্কুলে পড়ত। সেখানে তিনি দেখেছেন স্কুলের শিক্ষকরা অভিভাবকের কী পরিমাণ সমাদর করেন। আমি বল্লাম, স্কলাস্টিকা স্কুল যে আমাদের কাছ থেকে এত টাকা নিয়েছে, রেজাল্ট প্রকাশের দিনে অভিভাবকদের এক কাপ চাও অফার করত না। এরা শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না।

চাচার পরবর্ত্তী প্রশ্ন ছিল, ‘সমস্যা কী? প্রাথমিক থতমত ভাবটী কাটিয়ে চাকরিপ্রার্থী যা বললেন তা চাচার মনোঃপুত হল না। তিনি আমার দিকে ফিরলেন আমিও থতমত খেলাম। বল্লাম সমস্যা হল প্রগতির বা এগিয়ে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা। চাচা বললের এটা তো প্রতিবন্ধকতা হল, সমস্যা হল না। আমি আমার সংজ্ঞায় কিছুটা জোর লাগাতে বলি, অভাব বা চাহিদা থেকেই সমস্যার সৃষ্টি। বেশী জুতসই হল না, বরং চাচা যে সংজ্ঞা দিলেন তা জুতসই। তিনি বললেন সমস্যা হল আমরা যেখানে আছি (current status) আর আমরা যেখানে যেতে চাই (desired status) তার মধ্যবর্ত্তী ফাঁক (gap)। তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতা টের পেলাম। আমি বল্লাম, আমরা যে সিস্টেম ডেভেলপমেণ্টের কথা বলি, তার সংজ্ঞাও তাই। চাচার উত্তর আমরা সিস্টেম ডেভেলেপমেণ্টের কথা কেন বলি? বলি কেননা, সমস্যা আছে। সমস্যা থাকবে তার সমাধানও করতে হবে।

সিস্টেম ডেভেলেপমেণ্ট প্রসঙ্গ স্কোয়াড্রন লিডার জাপানী ব্যবস্থাপনার কাইজেন (kaizen)-এর কথা বল্লেন, জাপানী ভাষায় যার অর্থ হল উন্নতির লক্ষ্যে পরিবর্ত্তন বা ক্রমাগত উন্নতিসাধন (continuous improvement)। স্কোয়াড্রন লিডার এর ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তিনি এ সম্পর্কে ধারণা রাখেন। আমি বল্লাম, টোটাল কোয়ালিটী ম্যানেজমেণ্টের (TQM) একেটী মূল ধারণা হল continuous improvement । জাপানী সমাজে কাইজেন চালু রয়েছে। যার যতটুকু সাধ্যি সে তার চারিপাশে ততটুকু উন্নতিসাধন করবে। সরকারের জন্য অপেক্ষা করবে না। আমার বাড়ীর সামনের জায়গা যদি অপরিচ্ছন্ন থাকে তবে আমিই তা পরিস্কার করব, মিউনিসিপাল পরিচ্ছন্নতা কর্মীর জন্য বসে থাকব না। চাচা তৎক্ষণাৎ চীনের নেতা মাওসেতুং, যাঁর একটী অতীব চমৎকার ফ্রেমে বাঁধানো, অরিজিনাল চাইনিজ ছবি চাচার বাসায় আছে, তার উদ্ধৃতি দিলেন। মাওসেতুং বলেছিলেন, ‘ধুলো নিজে থেকে সরে যাবে না, ঝাড়ু দিতে হবে।’ এই ধুলো হল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, জনগণের শোষক। আমার তরুণ বয়সে, চাচা তখন যুবক, আমরা মাওসেতুংয়ের ভক্ত ছিলাম, তার ‘লাল বই’ পড়তাম। আমরা ভাবতাম জীবন পাখীর পালকের মত হালকা হতে পারে কিংবা হতে পারে তুর পাহাড়ের মত ভারী। যারা পরার্থে জীবন দেয় তাদের জীবন তুর পাহাড়ের মত ভারী অর্থাৎ মূল্যবান। চাচা হেসে বললেন, ‘A boy of 18 is worried about the future, a man of 40 is worried about promotion.’ তিনি একটী বইয়ের কথা প্রায়শই বলেন। বইটীর নাম হল The Passage। মানুষ যত বয়সী হয়ে পড়ে তত তার জীবনের সমস্যার ধরণ পাল্টে যায়। তার সমস্যা ও সংকট বাড়তে থাকে। ‘দ্য প্যাসেজ’ বইটীতে মানুষের জীবনের এসব মানসিক, শারিরীক ও সম্পর্কগত সমস্যার বিশ্লেষণ বিধৃত।

(চলবে …)

 

 

 

 

কামরুল হাসান
জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায়।

তিনি আশির দশকের কবী। প্রথম কাব্য ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। এরপরে আরও ১১টি কাব্য প্রকাশ করেন। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত কবিতা’। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন এবং বিদেশী সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই ‘প্রহরের প্রস্তাবনা’। ভ্রমণপিপাসু এ কবী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুপ্রচুর ভ্রমণকাহিনী লিখছেন। এপর্য্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে চারটি ভ্রমণকাহিনী। ছাত্রাবস্থায় তার কবিতা সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই। ২০০৩ সালে সমীর রায়চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে সম্পাদনা করেন দুই বাংলার যৌথ সংকলন Post Modern Bangla Poetry 2003। তিনি বেশ কয়েকবার আমন্ত্রিত কবী হিসেবে দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া হায়দ্রাবাদ আন্তর্জাতিক পোয়েট্রি ফেস্টিভাল, ২০১৭ ও কাঠমাণ্ডু আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব, ২০১৯ এ আমন্ত্রিত কবী হিসেবে যোগ দেন।

কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘খড়গপুর বইমেলা সম্মাননা স্মারক (২০০৫), ‘মৈনাক সন্মাননা স্মারক ‘(২০২১), ‘কবিকুল, কক্সবাজার কবিতা সম্মাননা স্মারক’ (২০২১)। ছাত্রজীবনে মেধাবী কামরুল হাসান ভারতের বিখ্যাত আইআইটি খড়গপুর থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্ত্তী পড়াশোনা ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রী অর্জ্জন করেন। পেশাগত জীবনে বহুবার চাকরী বদল করেছেন। কর্পোরেট জগৎ থেকে শিক্ষকতায় যোগ দেন। গত ১৫ বছর ধরে পড়াচ্ছেন ইষ্ট ওয়েষ্ট ইউনিভার্সটিতে। তিনি বিবাহিত ও চার সন্তানের জনক।

প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা
কবিতা
সহস্র কোকিলের গ্রীবা (১৯৯১)
প্রান্তসীমা অনন্তদূর (১৯৯২)
ছুঁলে বিদ্যুল্লতা, না ছুঁলে পাথর (১৯৯৩)
পাখি নই আশ্চর্য মানুষ (১৯৯৪)
দশদিকে উৎসব (১৯৯৭)
বৃক্ষদের শোভা দেখে যাব (২০০০)
রূপচৈত্রের অরণ্যটিলায় (২০০৪)
পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে (২০০৭)
ঈশ্বরের নিজ গ্রহ (২০০৯)
ঘুমপ্রহরের মোমকুহক (২০১০)
নির্বাচিত কবিতা (২০১২)
খিলানের নিচে আলো (২০১৪)
সহস্র চরণের ধ্বনি (২০১৫)
বাছাই ১০০ কবিতা (২০১৭)

ছোটগল্প
মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প (২০০৫)

ভ্রমণকাহিনী
বিলেতের দিনলিপি (২০১৭)
আমির তিমুরের দেশে (২০১৮)
মহাদেশের মতো এক দেশে (২০১৯)
সিমলা মানালির পথে (২০২০)
হায়দ্রাবাদের যাত্রী (২০২১)

প্রবন্ধ
প্রহরের প্রস্তাবনা (২০১৫)
কবিতার মায়াহরিণ ও কবির মঙ্গলযাত্রা (প্রকাশিতব্য)

অনুবাদ
Poems of Mujib Erom (2014)
The Blind God (Poems of Tithi Afroz) (2020)

সম্পাদনা
Postmodern Bangla Poetry 2003
(with Tushar Gayen and Samir Roychowdhury)

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{চাচাকাহিনী [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার