ছবি : ইণ্টারনেট থেকে
পথ চলতে কারো সঙ্গে দেখা হলে আমরা বলি, “কেমন আছেন?”
ফোনকলে সালাম বিনিময়ের পর আমরা কুশলাদি জানতে বলি, “শরীর কেমন?” আমরা আলাদা করে জানতে চাই না মনটা কেমন আছে। তবে হুমায়ুন আহমেদ-এর এক নাটকে একটা সংলাপ ছিল এমন, ‘মনডা ভালা?’ দেহের খবর নিলে মনের খবর নেওয়া হয়ে যায়, মনের খবর তাই আলাদা করে কেউ নেয় না। দেহের তাপ মনকে উত্তপ্ত করে, মনের তাপ দেহকে বিব্রত করে। এ যেন এক যুগলবন্দী রূপ, দেহ ও মন। আমরা দেহ বলতে শরীরকেই বুঝি, শরীর বলতে দেহ। কিন্তু বিষয়টা একটু ভিন্ন। …
জীবিত মানুষের কেবল শরীর থাকে না, তার মনও থাকে। কেবল দেহ দিয়ে জীবন ধারণ হবে না, যদি না তাতে মন (আত্মা) থাকে। দেহ হল এখানে একটী খাঁচা, যে খাঁচায় মন থাকে। দেহ তাই আধার বা প্রকৃতি আর মন হল আধেয় বা পুরুষ।
মানুষ দেহ ও মন ধারণ করে। দেহতে মন আশ্রয় লাভ করে। অর্থাৎ মন হচ্ছে পুরুষ, দেহ হচ্ছে প্রকৃতি (স্ত্রীবাচক)। মন সর্ব্বদাই চঞ্চল, মনের গতি নিয়তই সক্রিয়, গতিশীল। আবার দেহ সকল সময় গতিশীল নাও থাকতে পারে, গতির বৈশিষ্ট্য আছে, তবু সবসময় গতিশীল নয়, দেহ বিশ্রাম করে, স্থির থাকে, আবার কখনো চলে।
কার প্রাধান্য বেশী এটা বলা যাবে না, কারণ একে অন্যের পরিপূরক। দেহ মরে গেলে মন কোথায় বাস করবে? আর মন যদি মরে যায় তবে শরীরে কে সঞ্জীবনী রস প্রদান করে বাঁচিয়ে রাখবে? বিভিন্ন কারণে মন মরে যায়, এর প্রভাব শরীরে পড়ে, তখন শরীরও জরাগ্রস্ত হয়, রোগেতাপে ভোগে ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যায়।
ইংরেজী ভাষায় যাকে body বোঝায় বাংলায় তাকে দেহ বলে, শরীর বলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে body প্রতিশব্দ দিয়ে দেহ ও শরীর একাকার করে ফেলেছি আমরা, আমরা বুঝি এখন, শরীর যা, দেহ-ও তাই। আমাদের প্রাচীন শব্দজ্ঞানীরা সেরকম ভাবতেন না। ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণে শরীর ও দেহ দুটো পৃথক ভাবে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়।
দেহ— দিহ্ ধাতুমূল থেকে জাত শব্দ, যার অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, যা বাড়তে থাকে। আমাদের জীবন নামক সত্তা একটী নির্দ্দিষ্ট বয়স অবধী বাড়তে থাকে, এরপর বৃদ্ধি থেমে যায়, এই জীবন সত্তার নাম দেহ। এরপর আর বাড়ে না, আসে ক্ষয়ের পালা। এ যেন চাঁদের দুই পক্ষ, কিংবা রাত্রী-দিনের খেলা।
শৃ নামক ধাতুমূল থেকে শরীর শব্দটী জাত— যার অর্থ শীর্ণ হওয়া। শীর্ণ হতে হতে শেষ পরিণতি মৃত্যু। কেউ মারা গেলে আমরা দেহত্যাগ শব্দটী ব্যবহার করি, কারণ শরীর তো এমনিতেই ত্যাগের বিষয়, ওটা-তো ত্যাগের পালায়ই আছে।
ঃ, স্, হ্ এই তিনটী বর্ণ একই ক্রিয়ার তিনরকম শাব্দিক প্রকাশ, সেই ক্রিয়াটী হল নির্য্যাসত্যাগ। দিগ্ধ [√দিহ্ + ত (ক্ত)] — দিহ্ তারিত যাহাতে। দিগ্ধ শব্দটীতে নির্য্যাসত্যাগের স্বরূপ বুঝতে আমরা দোহন শব্দটীতে যেতে পারি। গাভীকে দোহন করলে একপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে দগ্ধ হয়; অন্যপক্ষ পায় দুগ্ধ যা থেকে সে শক্তি বা তেজ পায়। কাজেই দিহ-অন হলে একপক্ষ বাড়ে, অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শৈশবে মানুষ যতটুকু খাবার খেয়ে হজম করে তার থেকে শক্তি বা তেজ গ্রহণ করতে পারে, বার্দ্ধক্য তা পারে না। শৈশবে গ্রহণ থাকে বেশী, খাবারের বেশীটাই বৃদ্ধির কাজে লাগে; ত্যাগের পরিমাণ কম থাকে কারণ তখন বাড়ন্ত বয়স। প্রৌঢ় বয়সে বাড়তি খাবার দূরে থাক, প্রয়োজনীয় খাবারটুকুও হজম হয় না, অনেক সময় তা শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলে, কারণ তখন শরীরে ত্যাগের পাকা শুরু হয়, বৃদ্ধি থেমে যায়। ফলে দেহ আর দেহ থাকে না, সে হয়ে যায় শরীর। যার বৈশিষ্ট্য হল শীর্ণ হতে থাকা। সমান দিহ্ থাকে সন্দেহ শব্দটীতে। যে মানুষের মন সুন্দর, সে সমস্ত পৃথিবীটাকেই সুন্দর ভাবে দেখে। মনের ভিতরে যে রঙ থাকে, তার বাইরে কোন রঙ পৃথিবীতে দেখা যায় না। এজন্য যে মানুষের মন যেমন, সে পৃথিবীকে তেমনই ভেবে সন্দেহ করে। তবে সন্দেহ অনেক সময় বাস্তব প্রেক্ষাপটের ওপরও নির্ভর করে। যাই হোক, দেহ ও শরীর নিয়ে আমরা যে আলোচনা করলাম তার প্রেক্ষিতে বলতে পারি দেহ ও শরীর আদৌ একই বিষয় নয়।
আবার
দেহ ও মন
বড় জটিল বড় রহস্যময় মানুষের মন।
কিছুতেই মানব মনের যে রহস্য তার নাগাল পাওয়া যাবে না। আর পাওয়া যায় না বলেই মানুষ মানুষকে ভুল বোঝে।
আমরা যে কোনও বিষয়ের বিচার করি আমাদের নিজের মন দিয়ে।
শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ এই পাঁচটী ইন্দ্রিয় আমাদের যে কোন বিষয় সম্পর্কে ভুল কিংবা সঠিক বার্ত্তা দেয়। সেই অনুযায়ী আমরা নিজেদের বিচার বিশ্লেষণের সক্ষমতার স্তর অনুযায়ী কোনও কিছু সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছি। এজন্যই দেখা যায় একই বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্নরকম বোঝে।
মন : √মন্ + অল্ কর্ম্মবাচ্যে। (ছাত্রবোধ অভিধান)।
মন = পরিমিত-করণ বা পরিমাপন অনকৃত যাহাতে; (পরিপার্শ্বের প্রতিটী সত্তাকে) পরিমাপ করে যে; যাহা পরিমিত বা পরিমাপিত হইয়া প্রাপ্ত হইয়াছে।
ম্ বর্ণের ক্রিয়াটী হল মিতকরণ বা পরিমিতকরণ।
চারপাশের সবকিছুকে যে মেপে ফেলে তাকে মন বলে, আবার মাপার ফলে যা পাওয়া যায় তাকেও মন বলে; এরকম মাপা হল মন্-করণ।
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সবকিছুই বিকাশমান, কোন কিছুই স্থির নেই, সবকিছুই চলছে, গতিশীল। মন এই সবকিছুকে পঞ্চ-ইন্দ্রিয় দ্বারা পরিমাপ করতে থাকে, এই ক্রিয়াটী ঘুমের সময় ছাড়া অবিরাম চলতে থাকে।
মানবাস্তিত্বের দুটী ভাগ, মন ও দেহ।
মানুষ মাত্রই মন ও দেহের দ্বৈরাজ্যে বাস করে, অর্থাৎ মানুষ মাত্রেই এক দ্বৈতাদ্বৈত সত্তা যাকে two in one বলা যায়।
মানবাস্তিত্বের মন ও দেহ এই দুটীর মধ্যে প্রধান ও পুরুষ হল মন, আর তার দেহ হল প্রকৃতি। কারণ মন মরে গেলে বেঁচে থাকার আর অর্থ থাকে না। আবার জীবিত থাকার বিচারে দেহ বা প্রকৃতির স্থান প্রথমে, মনের স্থান পরে। কারণ দেহ না বাঁচলে দেহ মন কোনটাই আর বাঁচে না।
বঙ্গীয় শব্দকোষ বেদান্তসার উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন যে মন হল লিঙ্গশরীরের অবয়ব। তার মানে, মানুষ বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হয় যে লিঙ্গ-এর (লীন হওয়ার জন্য গমন করে যে) মাধ্যমে, সেগুলিরই অংশ মন।
* প্রত্যেক মানুষ একজন আমি।
সেই আমি-ই তার আত্মা। প্রত্যেকটী আমি-ই তার নিজস্ব রাজত্বে বাস করে। সেই ‘আমি’র মন সবসময়েই মন কর্ম্মে ব্যস্ত থাকে, সীমায়ন কর্ম্মে ব্যস্ত থাকে।
সে মন্ (পরিমাপ) করে মন (পরিমাপফল) পায় বলে তাকে মন (পরিমাপক) বলে। Greek/গ্রীক ভাষায় মন = menos, Latin/ল্যাটিন ভাষায় মন = mens, English/ইংরেজী ভাষায় মন = mind, mental ইত্যাদি।
তথ্যসূত্র : বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ — কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী
রুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে।
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারি চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{শব্দের ইন্দ্রজাল : দেহ ও শরীর, দেহ ও মন [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}