সাত—
দুপুর গড়িয়ে যায়, কোন প্রকার খাবারের এন্তেজাম দেখি না। চাচা নিজে দুপুরে কিছু খান না, তাই বলে কি আমাদেরও না খেয়ে থাকতে হবে? চাচা জানালেন আপন সাধারণত খাবার নিয়ে আসে। আজ ভুলে গেছে। শুনে আপন বলে, ‘বলেন কী খাবেন? এখন তো অর্ডার করলেই খাবার চলে আসে।’ ওই বলাই সার, অর্ডার আর করে না, আমরা কী খাব তা বলতে হবে কেন? অভুক্তের আবার চয়েস আছে নাকি? আমরা খাব লাঞ্চ, তা যেরকম লাঞ্চই হোক নেব। ওদিকে সেই যে দ্বিতীয় কাপ চা বানিয়ে দিয়ে বুয়া চলে গেছে এরপরে আর কোন আাশাজাগানো আগুন চাচার রান্নাঘরের দুই চুলার কোনটীতে জ্বলে ওঠেনি, এদিকে ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। সদস্যদের মাঝে বিদ্রোহের আভাস টের পেয়ে চাচা তার মাস্টারশেফ বুয়াকে জরুরী তলব করেন।
আহারের বন্দোবস্ত দেখে আমরা শান্ত হই। চাচার কাছে অনেক খুচরা তথ্য পাই। যেমন আল কাপিনো অন্ধ ছিলেন, আহমদ ছফা ভাল বাঁশী বাজাতেন, রাওয়া ক্লাবে ভাল লাইব্রেরী আছে ইত্যাদি। চাচা পরেছেন বুকের জমিনে বিবিধ নকশা আঁকা সবুজ গেঞ্জি। আমার পরনে নীল হাফ শার্ট, আপনের পরনে কেবল স্কোয়াড্রন লিডারের পোষাকই কিছুটা ফর্মাল। ইন্টারভ্যু যিনি দিবেন তাকে ফর্মাল হতেই হয়, আর যারা ইন্টারভ্যু নেন, তারা বোধকরি ইনফর্মাল থাকতে পারেন। আপন পড়াশোনা করেছে ব্যাঙ্গালোরে, যাকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহর। সারাবছর ধরেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত ব্যাঙ্গালোরে একটী আরামপ্রদ আবহাওয়া (২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস) বিরাজ করায় ভারতের ধনীরা ব্যাঙ্গালোরে বাড়ী বানায়, দিল্লী বা মুম্বাই, কলকাতা বা চেন্নাইয়ে তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করলে তারা চলে আসে চিরবসন্তের ব্যাঙ্গালোরে। আমি একবারই গিয়েছিলাম কর্ণাটকের রাজধানী, রাহুল দ্রাবিড়ের শহর ব্যাঙ্গালোরে। সেটা ১৯৮৪ সাল। নগরটীর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আপন সে শহরে পড়তে গেছে অনেক বছর পরে। সে জানাল শহরের সে রূপ নেই। প্রচুর গাছ কাটা পড়েছে একদার উদ্যান নগরীটীতে। জনস্ফীতি সকল নিভৃতিকেই ধ্বংস করে, কোলাহল আর আবর্জ্জনা বাড়ায়। উন্নয়নের নামে চলে বৃক্ষনিধন আর প্রকৃতিবিনাশ। ব্যাঙ্গালোর শহরটী আরেক কারণে বিখ্যাত। ব্যাঙ্গালোর শহরের প্রধান সড়ক দেবতার নামে। সে সড়কের নাম ক্যাম্পে গাওডা। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে একসময় দেখেছি এই ক্যাম্পে গাওডা সড়কে সিনেমা হল আছে ২৫০টী, যা দুনিয়ার আর কোন শহরের আর কোন সড়কে নেই। দক্ষিণ ভারতের মানুষেরা কতটা সিনেমাপাগল তা এই পরিসংখ্যানে পরিস্ফুট। অবশ্য এখন আর মানুষ সিনেমাহলে ছোটে না, তার হাতের মুঠোয় সিনেমাহল।
ইতিহাসের প্রান্তর থেকে চাচা ফিরে এলেন মহাবিশ্বের দার্শনিকতায়। তার দার্শনিক উক্তি, এই মহাবিশ্বের বিপুল রহস্যের কতটুকু জানি আমরা? তিনি জ্ঞানী আর নির্ব্বোধের সীমারেখা টানতে সেই জ্ঞাত উদ্ধৃতি আওড়ালেন। জ্ঞানী জানে যে সে জানে না, নির্ব্বোধ জানে না যে জানে না (I know that I know not, but you know not that you know not)। আমি বল্লাম, বিজ্ঞান কিন্তু অনেককিছু জেনেছে। যেমন মহাবিশ্বের বয়স ১৩৫০ কোটী বছর আর পৃথিবী গ্রহটীর বয়স ৪৬০ কোটী বছর। মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে বিগ ব্যাংগ (Big Bang) থিওরীই এখন পর্য্যন্ত সর্ব্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা। একটী অসীম ভর ও শক্তির সিঙ্গুলারিটির (Singularity) মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের উৎপত্তি। মহাবিশ্ব ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে (Expanding Universe)। কত বিপুল আমাদের মহাবিশ্ব? আমি একটা পরিসংখ্যান দিলাম। পদার্থবিদরা হিসাব করে দেখেছেন, আমাদের যে গ্যালাক্সী মিল্কিওয়ে তাতে সূর্য্যের মত, সূর্য্যের সমান, কিংবা সূর্য্যের চেয়ে বড় কিংবা ছোট নক্ষত্র রয়েছে দশ হাজার কোটী। আর মহাবিশ্বে মিল্কিওয়ের মত গ্যালাক্সী আছে দশ হাজার কোটী। মহাবিশ্ব সত্যি আমাদের অনুধাবনের বাইরে। এজন্যই পৃথিবী নামক গ্রহটীকে বলা হয় ‘Speck of a speck of a speck’ অর্থাৎ বালুকণার বালুকণার বালুকণা।
এই বালুকণার বালুকণার বালুকণার ভেতর সাড়ে সাতশ কোটী মানুষের একজন হলাম আমি বা আপনি। আমার বা আপনার ব্যক্তিগত সমস্যা কত নগণ্য কত তুচ্ছ। এজন্যই ডেল কার্নেগি তার বেষ্টসেলার বই ‘দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন’-এর একটী অধ্যায়ে দুশ্চিন্তাপীড়িত মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন অন্ধকার রাতে খোলা জায়গায় গিয়ে মহাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকাতে। তাহলে মানুষ উপলব্ধি করবে নিজের ক্ষুদ্রত্ব।
মহাবিশ্ব নিয়ে ভাবনা আমাদের পুরোপুরি দার্শনিক করে তুলবার আগে আমরা বাস্তবে ফিরে আসি বুয়ার পরিবেশিত দু স্লাইস পাউরুটী টোষ্ট আর ডিম পোচ প্লেটে প্লেটে সাজানো দেখে। দেখি লাঞ্চ স্কিপ করা চাচাও যোগ দিয়েছেন আহারে। মনে মনে বলি, আহা রে, পান না, তাই তিনি খান না। খেতে খেতে চাচা গল্প করেন পুরনো দিনের তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য কাজী আনোয়ার হোসেনের কথা বললেন, যিনি টেনিস খেলতেন। তার সহধর্ম্মিণী সুলতানা নাহার একজন লেখক। আমার মনে পড়ল চাচাও একসময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের টেনিস কোর্টে গিয়ে টেনিস খেলতেন। তখন তার ছিল একটী হারলে ডেভিডসন মার্কা মোটরবাইক, চড়লে মনে হত গিরিশৃঙ্গে চড়ে আছেন, আর কী ভটভট আওয়াজ তার, খাটী বাঘের বাচ্চা। তো প্রতিদিন বিকেলে শার্দুলের পিঠে চেপে টেনিস খেলতে যেতেন। তার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বন্ধুরা বলত, এই যে হেলিকপ্টারে চড়ে জিয়া এসেছে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের কথা যখন লিখছি তখন মনে পড়ল চাচার সাথে ভাতিজার আরেকটী মিল। ভাতিজাও একই হলের অনাবাসিক বোর্ডার ছিল। বহুবছর আগে চাচা বন্ধুদের সাথে ব্যাডমিণ্টন খেলতেন। তার স্মৃতিতে ফিরে এল খিলগাঁওয়ের ফাকা মাঠ। স্কোয়াড্রন লিডারের স্মৃতিতে এল কোসা নৌকায় চড়ে মেরান্দা বাজার যাওয়া। নৌকার ভাড়া ছিল দু’পয়সা। তখন শাহাজানপুরে জঙ্গল ছিল। চাচা বললেন শহর যখন পত্তন হয় তখন আদি অধিবাসীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
আপনের একটী ট্রাভেল এজেন্সী আছে। আমি দেখেছি যারা ভ্রমণ ভালবাসে তারা ট্রাভেল এজেন্সী নেয়। এতে রথ দেখা আর কলা বেচা দু’টাই হয়। আপন অনেক দেশ ঘুরেছে। আমি তখন তাকে বলি আপনি একদিন ভ্রামণিকদের ব্রেকফাষ্ট আড্ডায় আসুন আর ভ্রমণের গল্পগুলো বলুন, আমরা লিপিবদ্ধ করে রাখব। আমি সম্প্রতি আমার দেখা বলিউডি সিনেমা ‘কেদারনাথ’ দেখার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। ২০১২ সালে উত্তরখণ্ডের পাহাড়ী অঞ্চলে হিন্দুদের এক তীর্থস্থান কেদারনাথে ভয়াবহ পাহাড়ী ঢল সৃষ্ট বন্যা হয়। এতে মৃত্যুবরণ করে মানুষ। এই প্রাকৃতিক বিপর্য্যয়কে কেন্দ্রে রেখে দু’টী ভিন্ন ধর্ম্মের নরনারীর তীব্র প্রেম ও তা সৃষ্ট দুই সম্প্রদায়ের সংঘাতকে উপজীব্য করে চলচ্চিত্রটী নির্ম্মিত। আমাকে যা মুগ্ধ করেছে তা হল ছবির টেকনিকাল fineness। মনে হল বলিউড নয়, হলিউডের সিনেমা দেখছি, বিশেষ করে পাহাড়ী ঢলের দৃশ্যায়ন। আপন জানাল, বলিউডের সমগ্র টার্নওভার হলিউডের চেয়ে বেশী। আপনের আরেকটী মন্তব্য হলিউড সিনেমা নিয়ে গবেষণা করে, বলিউড মশলা বানায়। তবে টেকনিকালি ওরা অনেক এগিয়েছে। আমি বল্লাম, কেদারনাথ ছবির স্পেশাল ইফেক্ট তৈরীর জন্য হলিউড থেকে এক্সপার্ট আনা হয়েছিল।
আট—
চাচার ঝুলীতে যে কত রহস্যময় রুমাল আছে তা ভেবে বিস্মিত হই। তিনি সেসব রুমালকে অনবদ্য পরিবেশনায় কবুতর বানিয়ে উড়িয়ে দেন শ্রোতাদের মাথার ওপর। শ্রোতৃকুল বিমুগ্ধ হয়ে শোনে। স্কোয়াড্রন লিডার তো বলেই ফেললেন, এখানে আমি কাজ করি আর না করি, এই মানুষটীর যে দেখা পেলাম, সেটা এক বড় প্রাপ্তী। আমি কাটিরহাঁট উচ্চ বিদ্যালয়েও দেখেছি লোকেরা কাজ ফেলে, খাবার পাতে রেখে চাচার কথা শোনে।
শিখ ধর্ম্মে গুরু নানকের পরে সর্ব্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয় কবীরকে— যিনি ছিলেন ষোড়শ শতকের কবী ও দার্শনিক। আধ্যাত্মিক নেতা তো বটেই। কবীর মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর গুরু রামানন্দ দ্বারা প্রভাবিত হয় হিন্দুধর্ম্মের আধ্যাত্মিক দর্শনে দীক্ষিত হন। তাঁর কবিতা শিখদের পবিত্রগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহেব’-এ সংকলিত। তিনি হিন্দুধর্ম্মে যে ভক্তিবাদী আন্দোলন আছে তাকে প্রভাবিত করেন। একবার তাঁর এক অনুরাগী এসে জানায় একজন সাধু ৩০ বছর সাধনা করে পায়ে হেঁটে নদী পার হওয়ার শক্তি অর্জ্জন করেছে। কবীর জিজ্ঞেস করলেন, ‘নদী পার হতে নৌকায় কত লাগে?’ শিষ্য উত্তর দিল, ‘এক পয়সা।’ কবীরের জবাব ছিল, ‘ত্রিশ বছর সাধনা করে সে তাহলে এক পয়সা বাঁচাল?’ এ কাহিনীর মর্ম্মার্থ হল পরিশ্রম করলেই হবে না, তা করতে হবে বিচক্ষণতার সাথে। লক্ষ্য যেন সঠিক হয়। সাধুর হেঁটে নদী পার হওয়ার মীথটী আমাদের অঞ্চলেও আছে। আমার একটী কবিতায় তা তুলে এনেছি—
‘নদীর কিনারে, কী জানি, মৃদুমন্দ ঢেউ হবে, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
ঘুমিয়ে সেই সাধুকে দেখলাম যে খড়ম পায়ে নদী পার হয়েছিল।’
চাচা বললেন, আমরা তো পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করতে পারব না। এমনকি বিল গেটসও বলেছেন, ‘The World is not fair.’ দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী মানুষটী যদি একথা বলতে পারেন, তবে আমরা কী বলব?
তিনি বললেন ট্রেন নিয়ে অসংখ্য সিনেমা নির্ম্মিত হয়েছে। এর একটী হল The Train। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর হাতে ফ্রান্সের পতন ঘটলে শিল্পপ্রেমী এক জার্মান সেনা অফিসারের প্যারিসের চিত্রশালাগুলো থেকে ট্রেন বোঝাই ফরাসী চিত্রকর্ম্ম জার্মানী নিয়ে যাওয়ার আয়োজন আর তা ঠেকাতে ফরাসী দেশপ্রেমিক গেরিলাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ও প্রতিরোধ। দ্বিতীয় চলচ্চিত্রটীর নামও The Train। সাম্প্রতিক করোনা মহামারীর দুনিয়ায় চলচ্চিত্রটী খুবই প্রাসঙ্গিক। একটী ট্রেনে এমন একটী মারাত্মক সংক্রামক ভাইরাস ধরা পড়ল যে তা বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ে ট্রেনের সবাইকে সংক্রমিত করে। এখন হুমকি হল এই যাত্রীরা যদি জনপ্রবাহে এসে মিশে তবে সকলেই সংক্রমিত হবে। কর্ত্তৃপক্ষ তাই সিদ্ধান্ত নেয়, সকল যাত্রীসহ গোটা ট্রেনটীকে উড়িয়ে দিবে বা কোন রেলসেতু থেকে ফেলে দিবে নদীতে।
চাচা বললেন, প্রফেশনাল কাজ করতে professional mindset দরকার। এটা আমরা এখন শিখছি, এটা আমাদের মাঝে আগে ছিল না। তিনি বললেন, ৬০ থেকে ৮০ মানবজীবনে সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ লাইভ। কারণ তখন এক জীবনের অভিজ্ঞান এসে জড় হয়। তিনি জার্মানীর চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল, মার্কিন প্রেসিডেণ্ট জো বাইডেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাহরন দিলেন। তারা বেশী বয়সে বেশী সক্রিয়। আমি বল্লাম, আমাদের সৌভাগ্য আমরা শেখ হাসিনাকে নেতা হিসেবে পেয়েছি। শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তিনি দেশকে ভালবাসেন, নির্লোভ দেশপ্রমিক। তিনি উপলব্ধি করেছেন, You cannot take a paisa from this mortal world। আহা, প্রতিটী বিত্তবান মানুষ, আমলা, রাজনৈতিক নেতা যদি এটা উপলব্ধি করত। চাচা বললেন, ভাল কাজ করতে গেলে সমালোচনা আসবেই। যে কাজ করে না, তার সমালোচনাও হয় না।
এ প্রসঙ্গে চাচা একটী গল্প বললেন। ব্যাঙের গল্প। একবার ব্যাঙদের মাঝে একটী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, খাড়া বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা। কোনো ব্যাঙই আর পারে না বাঁশের মাথায় গিয়ে বসতে। কারণ সকলে বিভিন্ন সমালোচনা করছিল, ‘এ পারবে না’, ‘ওর কি ওই ক্ষমতা আছে’, ‘ইস কী কুশ্রী’ ‘পাগুলো দেখ, কী নোংরা’, ‘এর তো শরীরে মাংসই নেই,’ ইত্যাদি। এর মাঝে একটী ব্যাঙ ঠিকই বাঁশ বেয়ে ওপরে উঠে চূড়ায় গিয়ে বসল। সবাই অবাক! পরে জানা গেল ওই ব্যাঙটী ছিল বধির। সে কারো সমালোচনা শুনতে পায়নি।
আমরা এই যে চাচার ছুঁড়ে দেওয়া বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নে নাস্তানাবুদ হই এ প্রসঙ্গে আমাদের স্কুল বা কলেজ লেভেল ইংলিশ টেক্সটে Three Questions প্রবন্ধটীর কথা মনে পড়ল। এক দেশে এক রাজা ছিল, তার মনে তিনটী মৌলিক প্রশ্নের উদয় হল। প্রশ্ন তিনটী হল, ১। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কোনটী? ২। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোক কে? ৩। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী? রাজা তার উজিরকে জিজ্ঞেস করেন, নাজিরকে জিজ্ঞেস করেন, অমাত্যবর্গকে জিজ্ঞেস করেন। তারা বিভিন্ন উত্তর দেন, রাজার মনোঃপূত হয় না। সেসময় রাজা শুনতে পেলেন, তার রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় একজন জ্ঞানী মানুষ বাস করেন। রাজা সৈন্য পাঠিয়ে ঘোড়ায় চড়িয়ে তাকে রাজদরবারে আনলেন। জ্ঞানী মানুষটী বললেন, ১। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হল ‘এই মুহূর্ত্ত’ বা বর্ত্তমান সময়। কারণ এটাই একমাত্র সময় যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আমরা গতকালে ফিরে যেতে পারব না, পারব না আাগামিকালে লাফ দিয়ে যেতে। ২। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হচ্ছেন সেই মানুষটী যার সাথে আপনি এই মুহূর্ত্তে আছেন। দার্শনিক রাজাকে বললেন, এই মুহূর্ত্তে আপনি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তদ্রুপ এই মুহূর্ত্তে আমি হলাম আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। ৩। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল যার সাথে আপনি এইমুহূর্ত্তে আছেন, তার প্রতি সদয় আচরণ করা, তার মঙ্গলসাধন।
আমার মনে পড়ল আমেরিকার মোটিভেশনাল রাইটার ডেল কার্নেগির মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রিত বই How to Stop Worrying and Start Living (বাংলা অনুবাদটীর নাম ‘দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন’) এর প্রথম অনুচ্ছেদই হচ্ছে ‘আজকের জন্য বাঁচুন’। ডেল কার্নেগি বলেছেন, আজকের দিনটীকে যদি আপনি সফল করে তুলতে পারেন তবে আপনার অতীত সফলতার শস্যে ভরে ওঠবে আর ভবিষ্যতে সফল হবার ক্ষেত্র তৈরী হবে। বর্ত্তমান হল সেই সেতু যা অতীত ও বর্ত্তমানের মাঝে সংযোগ রঁচে দেয়।
চাচা বললেন, আমাদের লোকেরা বর্ত্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকে। এতে উন্নতি হয় না। উন্নতির জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। তিনি পৃথিবীর আরেক ধনকুবের ওয়ারেন বাফেটের কথা উদ্ধৃত করলেন, ‘An idiot with a plan can defeat any intelligent person without a plan.’ ওয়ারেন বাফেট ছাত্রাবস্থায় ষ্টক মার্কেট নিয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। নিউ ইয়র্ক ষ্টক একচেঞ্জে বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ার মূল্যের ওঠানামা লক্ষ করতেন। নিজের সামান্য উপার্জ্জন শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে বেরুবার আগেই তিনি মিলিওনার হয়েছিলেন।
কী প্রসঙ্গে যেন চাচার কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের কথা মনে পড়ল। মোঘল সম্রাটদের মাঝে চাচার পছন্দ হল সম্রাট হুমায়ূন। এর কারণ বাদশাহ হুমায়ূনের জ্ঞানতৃষ্ণা। আমরা সকলেই জানি লাইব্রেরীর ঘোরানো সিঁড়ী বেয়ে নামতে গিয়ে হুমায়ূন পড়ে গিয়ে আহত হন, যা থেকে তাঁর মৃত্যু ঘটে। দিল্লীর পুরানো কেল্লায় আমি সেই ষড়ভুজ লাল ইটের দোতালা লাইব্রেরী ভবন ও বৃত্তাকার সিঁড়ী দেখেছি, যার কাছেই মসজিদ, যেখানে হুমায়ুন নামাজ পড়তেন। বাদশাহ হুমায়ূনকে নিয়ে হমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’ ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসটীর প্রশংসা করলেন জিয়াউল কুদ্দুস চাচা। হুমায়ূন আহমেদের সংক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া জীবনের শেষের দিককার রচনা এ’টী। তাঁর আর একটী উৎকৃষ্ট, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থ হল ‘জোসনা ও জননীর গল্প’। হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল জোসনা। জোৎস্না নিয়ে হুমায়ুন আহমেদের একটী চমৎকার উদ্ধৃতি চাচা আমাদের শোনালেন। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, ‘জ্যোৎস্না এমন এক ঘোরের ভেতর নিয়ে যায় যে আমাদের গৃহত্যাগী গৌতম করে তোলে।’ এক জ্যোৎস্নাবিধৌত রাতেই কপিলাবস্তুর রাজপুত্র সিদ্ধার্থ সুন্দরী স্ত্রী, প্রাণাধিক পুত্র, রাজপ্রাসাদ ও রাজা হবার অভিলাষ ছেড়ে জগৎ ও জীবনের গভীর প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তিনিই গৌতম বুদ্ধ।
গৌতম বুদ্ধ থেকে চাচা ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথে। বল্লেন, পূর্ব্ববাংলায় আটটী জেলার জমিদার ছিল ঠাকুর পরিবার। তাঁর অনেক বিখ্যাত রচনা পূর্ব্ববঙ্গে রচিত। এটা স্বস্তির যে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় নির্ম্মিত হয়েছে। উয়ারিতে চাচা একটী বাড়ীতে বেশ কিছুদিন বসবাস করেছিলেন, যে বাড়ীটী ছিল অমর্ত্য সেনের পরিবারের। ঢাকায় স্কুলজীবনের কয়েকটী বছর অমর্ত্য সেন এ বাড়ীতে কাটিয়েছিলেন। চাচা বললেন, বারান্দাই ছিল ১৭০০ বর্গফুট। তিনদিকে টানা বারান্দার সেই অপরূপ বাড়ীটীর ছবি আমার মনের পর্দ্দায় ভেসে ওঠল। সে বাড়ীটী এখন আর নেই। সেখানে ওঠেছে, এখন যেমন ওঠে, বহুতলবিশিষ্ট এপার্টমেণ্ট হাউজ। আমরা ভেবেছিলাম বাঙালীর গর্ব্ব নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বাড়ীটী সরকার সংরক্ষণ করবে। ‘আমরা হলাম ঐতিহ্যবিমুখ, ঐতিহ্যবিস্মৃত জাতি’, চাচার আক্ষেপ।
চাচা আমাকে একটী ফাইল দেখালেন যাতে তাঁর নানা জাতীয় মঙ্গলের কবী মোজাম্মেল হক, তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী বন্ধু মাজহারুল কুদ্দুস এবং চাচার নিজের ডায়েরী সংগৃহীত। তিন পুরুষের কাহিনী নানা, বাবা ও ছেলে। আমি বল্লাম, দাদা, বাবা, পুত্র হলে সিকোয়েন্স মিলত ভাল। চাচাও স্বীকার করলেন। কিন্তু তাঁর দাদা কাটিরহাঁট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রব সেরেস্তাদারের কোন লেখা উদ্ধার করতে পারেননি, অথচ তিনিও লিখতেন। সময় উইয়ের দাঁতে কাটা পড়ে কত মেধাবী লেখকের বিনিদ্র রাতের ফসল, তাই ভাবি।
চাচা বললেন, মস্তিষ্কের সামান্যই আমরা ব্যবহার করি। নিউরোসায়েন্সও তাই বলে। তার একটী প্রিয় কবিতা হল নীচের কবিতাটী, যার ভেতরে প্রাণ ও অপ্রাণের বহুমাত্রিকতা প্রকাশিত।
‘মেটাতে আমার তৃষ্ণা
আমাকেই করে সে মন্থন,
তবে বলো হতে হবে আর কতকাল
একাধারে দ্রাক্ষাকুঞ্জ, বকযন্ত্র, শুরী ও মাতাল।’
কামরুল হাসান
জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায়।তিনি আশির দশকের কবী। প্রথম কাব্য ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। এরপরে আরও ১১টি কাব্য প্রকাশ করেন। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত কবিতা’। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন এবং বিদেশী সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই ‘প্রহরের প্রস্তাবনা’। ভ্রমণপিপাসু এ কবী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুপ্রচুর ভ্রমণকাহিনী লিখছেন। এপর্য্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে চারটি ভ্রমণকাহিনী। ছাত্রাবস্থায় তার কবিতা সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই। ২০০৩ সালে সমীর রায়চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে সম্পাদনা করেন দুই বাংলার যৌথ সংকলন Post Modern Bangla Poetry 2003। তিনি বেশ কয়েকবার আমন্ত্রিত কবী হিসেবে দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া হায়দ্রাবাদ আন্তর্জাতিক পোয়েট্রি ফেস্টিভাল, ২০১৭ ও কাঠমাণ্ডু আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব, ২০১৯ এ আমন্ত্রিত কবী হিসেবে যোগ দেন।
কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘খড়গপুর বইমেলা সম্মাননা স্মারক (২০০৫), ‘মৈনাক সন্মাননা স্মারক ‘(২০২১), ‘কবিকুল, কক্সবাজার কবিতা সম্মাননা স্মারক’ (২০২১)। ছাত্রজীবনে মেধাবী কামরুল হাসান ভারতের বিখ্যাত আইআইটি খড়গপুর থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্ত্তী পড়াশোনা ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রী অর্জ্জন করেন। পেশাগত জীবনে বহুবার চাকরী বদল করেছেন। কর্পোরেট জগৎ থেকে শিক্ষকতায় যোগ দেন। গত ১৫ বছর ধরে পড়াচ্ছেন ইষ্ট ওয়েষ্ট ইউনিভার্সটিতে। তিনি বিবাহিত ও চার সন্তানের জনক।
প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা :
কবিতা
সহস্র কোকিলের গ্রীবা (১৯৯১)
প্রান্তসীমা অনন্তদূর (১৯৯২)
ছুঁলে বিদ্যুল্লতা, না ছুঁলে পাথর (১৯৯৩)
পাখি নই আশ্চর্য মানুষ (১৯৯৪)
দশদিকে উৎসব (১৯৯৭)
বৃক্ষদের শোভা দেখে যাব (২০০০)
রূপচৈত্রের অরণ্যটিলায় (২০০৪)
পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি আমার গ্রামে (২০০৭)
ঈশ্বরের নিজ গ্রহ (২০০৯)
ঘুমপ্রহরের মোমকুহক (২০১০)
নির্বাচিত কবিতা (২০১২)
খিলানের নিচে আলো (২০১৪)
সহস্র চরণের ধ্বনি (২০১৫)
বাছাই ১০০ কবিতা (২০১৭)ছোটগল্প
মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প (২০০৫)ভ্রমণকাহিনী
বিলেতের দিনলিপি (২০১৭)
আমির তিমুরের দেশে (২০১৮)
মহাদেশের মতো এক দেশে (২০১৯)
সিমলা মানালির পথে (২০২০)
হায়দ্রাবাদের যাত্রী (২০২১)প্রবন্ধ
প্রহরের প্রস্তাবনা (২০১৫)
কবিতার মায়াহরিণ ও কবির মঙ্গলযাত্রা (প্রকাশিতব্য)অনুবাদ
Poems of Mujib Erom (2014)
The Blind God (Poems of Tithi Afroz) (2020)সম্পাদনা
Postmodern Bangla Poetry 2003
(with Tushar Gayen and Samir Roychowdhury)
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{চাচাকাহিনী [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}