কোন এক পাগলের কাছে শুনেছিলাম গল্পটী— একদা এক রাজা স্বপ্নে দৈববাণী পেল— ভোরে রাজ্যজুড়ে বৃষ্টি হতে চলছে আর সে বৃষ্টির জল পান করলেই লোকে পাগল হবে। রাজার ঘুম ভাঙল— হায় হায়, এ দেখি ভোর হয়ে এল! … আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মূহুর্ত্তেই বুঝি বৃষ্টি নামে! পুকুরগুলোই রাজ্যের খাবার পানীর উৎস, এইমাত্র সেগুলো অভিশপ্ত বৃষ্টির জলে সয়লাব হবে। রাজা মন্ত্রীকে ডাকল— মন্ত্রণা হল, প্রাসাদ সংলগ্ন পুকুরটায় কোন রকম ছাউনী দেওয়া হল। কিন্তু প্রজাদের কাছে এলান পৌছানোর আগেই বৃষ্টি নামল। আর ততক্ষণে প্রজারা বৃষ্টির জল পানও করে ফেলল। প্রজাদের যখন রাজপ্রাসাদে ডাকা হল, রাজার কথা শুনে সবাই তিরস্কার করল। রাজাকে সবাই পাগল বলে গালি দিল। রাজাও এত সহজ পাত্র নয়, প্রজাদের পাগল বলে রাজাও অনেক শাসাল। এভাবে চলতে থাকল, একে অপরকে পাগল প্রমাণের প্রতিযোগিতা। রাজা-প্রজার এ পাল্টপাল্টি অভিযোগ কত দিন কতকাল চলেছিল গল্পকার পাগল তা আমাকে বলে যাননি। সুতরাং এখানেই গল্পের আখের। …
আমার এক বন্ধু আছে, কোন এক মারেফতী ফকীরের কাছে দীক্ষা নেওয়ার পর যার আচার আচরণ স্বাভাবিক মানুষ থেকে অনেকটা আলাদা হয়ে যায়। মুর্শিদ নির্দ্দেশিত পন্থায় সে আরোপিত জ্ঞান বিদ্যা/আলি কালি থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে মুক্ত করছিল। তার অন্তর চোখের সত্তর হাজার পর্দ্দা একে একে সরে যাচ্ছিল। … আমার এ বন্ধুকে সবাই পাগল বলে জানে; তাকে নিয়ে অনেকেই বেশ হাসি ঠাট্টাও করে। …
কোন একজন রমজানের ঈদের আগের দিন তাকে বলেছিল, আফছার কাইলকা তো ঈদের দিন, চুল দাড়ি কামাইবি না? আফছার উত্তর না দিয়ে উল্টা প্রশ্ন করে, ঈদের দিন এক্কান আছে নিহি আবার? কাইলকা কি দিনের পিঠে ঈদ লেখা থাইকবে নাকি, লেখা থাইকবে নাকি সূর্য্য বা বেইলের পিঠে? আফছারের এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে দোকানভর্ত্তি লোকের সে কি উপচে পড়া হাসি! …
আরেক দিন একজন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বিয়ে তা একটা করবানি আফছার? করলে কও, মাইয়া এক্কান দেহি। জবাবে আফছার বলে, তাই নিহি মিয়া? তো, তোমারেও তো আমার মাইয়া লোকের মতন লাগে। … আফছারকে ঝাড়ফুঁক করার জন্য তার বড় ভাই একদিন এক ওঁঝা নিয়ে আসে। আফছারের বিশেষ আকুতি উপেক্ষা করে একসময় সত্যি সত্যি ওঁঝা ঝাড়ফুঁক আরম্ভ করে। তার সারা শরীরে বিকট দুর্গন্ধী কোন তরল মালিশ করা হয়, চোখে মরিচগুঁড়া মেশানো জল ঢালা হয়। সে একটু প্রতিবাদ করে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে, ওঁঝার নির্দ্দেশে কয়েকজন প্রতিবেশী জোয়ান তাকে আরো জোরে চেপে রাখে। সবার ভাবনা— তাড়া খেয়ে, আছর করা জ্বিনটার উপদ্রব বাড়ছে।
এসব কথা পরদিন আফছার আমাকে যখন বলছিল, তখন হাসতে হাসতে সে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। বলে, পাগলরে নিয়া কি পাগলামিই না অরা করল, দিদু!
আমার এক রুমমেট ছিল, যে উদ্ভট কিছু চিন্তা করত। তার আজগুবি কথাবার্ত্তা শুনে অনেকেই জিব কামড়াত, তওবা পড়ত। সে বলে বেড়াত, মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণীদের কিছুটা বৈশিষ্ট্যগত তফাৎ থাকলেও, মানুষ কিছুতেই শ্রেষ্ট জীব নয়। জন্ম আর মৃত্যু সম্পর্কিত ধারণা মানুষের কল্পনা মাত্র— এমন আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। … মাঝে মাঝে সে মানুষের বিকল্প সম্পর্ক, বিকল্প পরিবার, বিকল্প সমাজ ও বিকল্প রাষ্ট্রের নিজস্ব ধারণাও ব্যক্ত করত। (…)
একসময় সে তার এসব আজগুবি চিন্তা নিয়ে নিজেই বিব্রত হওয়ায় চিকিৎসার জন্য আমি তাকে একজন মনের ডাক্তারের নাম প্রস্তাব করি। …
একদিন সে আমার হাতে একটা ঔষধের পুটলী তুলে দিয়ে বলল, কী এক পাগল ডাক্তারের কাছে পাঠাইলেন, ভাই! বলে আমার কি না হ্যালিসুনেশন, আরও আজেবাজে কী কী! … ঐ ডাক্তার হালায় কি চায়, দুনিয়ার আর সব মানুষগুলার মতন আমিও পাগল হয়ে যাই? …
একদা আমি এক পত্রিকা অফিসে খণ্ডকালীন কাজ করতাম। ওখানে মাঝেমধ্যে এক ভদ্দরলোক আসতেন একটী পুরাতন ফাইল বগলে নিয়ে। লোকটীর উপস্থিতি অফিসের সবার জন্য বিরক্তিকর ছিল। কিন্তু তা প্রকাশ করার সাহস কারোর ছিল না। অফিসের কার সঙ্গে লোকটীর কী প্রকার সম্বন্ধ তাও কেউ জানতাম না। একটু সুযোগ পেলেই লোকটী যে কাউকে বগলের ফাইলটী খুলে কিছু গদ্য-পদ্য পড়ে শুনাতেন— এ নিয়ে আমাদের বিরক্তির সীমা ছিল না। … অফিসে শহরের নামকরা অনেক কবী সাহিত্যিকও আসতেন। এমন কাউকে পেলেই লোকটী নিজের নামের সাথে আরো কিছু বিশেষণ জুড়ে পরিচিত হতেন এবং ফাইল খুলে কিছু না কিছু পড়ে শুনাতেন। … এমন কি অনেক বড় বড় সাহিত্যিকদের রচনার সাথে লেখাগুলোর তুলনাও করে দেখাতেন। … আগত কবী সাহিত্যিকদের কাউকে লোকটার লেখার ওপর কোন মন্তব্য করতে শুনিনি কখনো। তবে অনেকেই যাওয়ার সময় সম্পাদকের কানে কানে বলে যেতেন, এ পাগল কোত্থেকে আমদানি হে! লোকটার লেখা সম্পর্কে কবী সাহিত্যিক ও আমাদের নীরবতা তাকে কিছুটা হতাশ ও ক্ষিপ্ত করত। তিনি বিড়বিড় করে বলতেন, সব মূর্খ, উন্মাদের দল! …
আমাদের ওদিকে এক সাবেক ছাত্রনেতা ছিলেন, যিনি কোন এক সময় বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি দেশবিদেশের অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতারও সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করতেন। কখনো কখনো দেশের সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের পাগল আখ্যা দিয়ে অশ্রাব্য গালমন্দ করতেন (…), আমরা সবাই তাকে পাগল বলতাম, এমন কী তার সাবেক সহকর্ম্মীরাও।
জীবনে বড় শখ ছিল পাগল সাজবার। একদিন তাই করে বসলাম— অমাবস্যার রাত, সাগরপাড়ে নির্জন চরে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, অনেক্ষণ পর বন্ধুদের আগমন টের পেয়ে শুরু করে দিলাম পাগলপাগলখেলা। … সাধ্যমত নিখুঁত পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বন্ধুরা নিশ্চিত হল, সত্যি পাগল হয়েছি। … একজন মন্তব্য করল, আমার যে আজেবাজে চিন্তা ভাবনা তাতে পাগল হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক। আমাকে এক হুজুরের কাছে নিয়ে গেল; হুজুর কিছুটা ঝাড়ফুঁক করলেন এবং আমার চোখ-মুখ দেখে আশঙ্কাও প্রকাশ করলেন। আমাদের বাড়ীর অদূরে আলাদা কাছারী ঘরে আমি থাকতাম। বন্ধুরা আমাকে সেখানে রেখে দিল। একজন বাড়ীর লোকজনকে খবর দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। অন্যজন বাড়ীর লোকজন কর্ত্তৃক পরিস্থিতির জন্য নিজেরাই দায়ী হওয়ার আশঙ্কা জানায়। একজন কাউকে আমার সাথে অন্তত রাতটা থাকতে বলে। যে ভূতের ভয়ে নিজের ঘরে না শুয়ে আমার সাথে শুইত, সে জবাব দেয়, না না, আমি পারুম না ভাই! আমারে চেপেটেপে ধরলে আমি কী করমু?
একসময় বন্ধুরা আমাকে একা ছেড়ে যে যার বাড়ী যেতে বাধ্য হয়। ভেবেছিলাম নাটকটা কিছুদিন চালিয়ে যাব। কিন্তু এ কয়েক ঘণ্টার অভিনয়ে বুঝলাম, এটা আর দীর্ঘায়িত করলে আমাকে সারা জীবনের জন্যই পাগল বনে থাকতে হবে। তখন হয়ত, আমি নিজেকে যতই সুস্থ দাবী করব ততই পাগল ভাববে লোকে! …
এখন পাঠ নেয়া যাক, ‘‘পাগলের পাগলদর্শন’’ —
পাগল,
পথের মোড়ে বসে থাকে, বসায় পাহারা, পাগল দেখবে বলে!
দৃষ্টির নন্দনে, লোকটা পাগল,
আমাদের চেনাজানা,
দেখার পরিধি থেকে দূরে; পলক আড়ালে ……..
পাগলের
দৃষ্টির নন্দন, চেনাজানা, দেখার পরিধি থেকে দূরে…
আমরা সবাই আজব পাগল!
লোকটা হাসছে একা একা, আমাদের দেখে,
লোকটাকে দেখে আমরাও…
জগতের সকল পাগল সুখী হোক!
আমি ও আপনি, কে কার পাগল, কে কার অতিথি, বলছি অথচ,
আসুন,
অতিথি নারায়ণ, পথের পাগল, ভাঁটফুল ফোটা পথের হৃদয়ে বসে একটু মনের কথা কই…………— পাগলের পাগলদর্শন || আরণ্যক টিটো
দেখি— একে অপরের চেনাজানা দেখার পরিধি থেকে কে কতটা দূরে, কে কতটা পাগল একে অপরের কাছে। লক্ষ্য করি, আমাদের পানে তাকিয়ে হাসছে কি না কোন পাগলবোধক চিহ্ন! …
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা ভালবেসে আদর করেও একে অপরকে পাগল বলে ডাকি। প্রিয় মানুষটীকে পাগলের মত ভালবাসি, প্রিয় মানুষটীর প্রতীক্ষায় থাকি পাগলের মত। জগতে আমরা প্রত্যেকেই যেন কারো না কারোর পাগল, প্রত্যেকের জন্যই যেন কেউ না কেউ পাগল/মজ্জুব/অতিথি/নারায়ণ। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পাগল বিদ্রোহ (…) যেমন আছে, তেমনি আমাদের লোকসমাজে পাগল নিয়ে নানা রকম বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যেমন পাগল আল্লাওয়ালা/পাগল খোদার অতিথি— এমন আরো কত কথা। … গুরুজন বলেন, পাগলকে হিংসা করতে নেই, পাগলকে আঘাত করতে নেই। গুরুজন জানেন মজনু পাগলার কথা, শামসেত তাবরিজের কথা। এ-ও জানেন, আমাদের চেনাজানা পরিধির বাইরে পাগল এক পরমার্থিক গুণে গুণান্বিত চরিত্র! …
অতএব, জগতের সকল পাগল সুখী হোক! …
আমেন! …
দ্বীপ দিদার
জন্ম: ০৭ ডিসেম্বর ১৯৯১, মাতারবাড়ী, মহেশখালী, কক্সবাজার। প্রকাশিত গ্রন্থ: সহপাঠ গুপী গাইন, বাঘা বাইন…
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{পাগলের পাগলদর্শন : পাগলের পরমার্থিক চরিতমানস [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}