আসা যাওয়ার পথের ধারে!
কলিম খানের নাম শুনেছি মাত্র বছর কয়েক আগে। ওঁর লেখার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল প্রায় ক্ষীণ। প্রিণ্ট পত্রপত্রিকা, ওয়েব ম্যাগাজিনে কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী সম্পর্কে মাঝে মধ্যে উচ্ছ্বসিত কিছু লেখা পড়তাম। অই পর্য্যন্ত।
জ্ঞান সমুদ্রের ধূলিকণার চাইতেও আমি তুচ্ছ, অজ্ঞান। তুচ্ছতার লজ্জা আর অজ্ঞনতার সংকোচ ছিল আমার প্রাণে। তা থাকুক। নগণ্য বলে তো আমি নিস্ফল নিস্কর্ম্মা নই। আমার তৃষ্ণা আছে। কোন কিছুর পাঠোদ্ধার করতে না পারলে আমার দিনরাত অস্থির হয়ে যায়। আমি জ্ঞানের তৃষ্ণা নিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ি পাঠমগ্নতায়। কলিম খানের লেখার ধরণধারণে তাই চমকিত হয়ে ওঠতাম। অন্যরকমের গুণিজন উনি। অন্য ধারার। গল্প, উপন্যাস কিম্বা কবিতা নয়। শব্দ দিয়ে শব্দের ভেতরের আগুণ ঘষে সত্য ও শুদ্ধকে খুঁজে বের করার আমরণ প্রচেষ্টারত অক্লান্ত ঋষি প্রাণ ছিল তাঁর।
আমার ভোগী অন্তর কিন্তু পিয়াসী মন। দূরে থাকা শ্রেয় ভেবে বুকশপে দাঁড়িয়ে ওনাদের বইগুলো প্রথম ধাপে উল্টেপাল্টে দেখতাম। ফ্ল্যাপি পড়তাম কয়েকবার করে। প্রকাশকাল পড়ে প্রকাশক কে তাও জেনে নিতাম। আরেকটু এগিয়ে ভূমিকাও পড়ে ফেলতাম। আমার অভিনিবেশের গভীরতা দেখে বই বিক্রেতা অন্য ক্রেতাদের সাথে গলা নামিয়ে কথা বলত। এরপর বুঝতাম, বইটা নিতে হবে। হবেই। অতঃপর গভীর পাঠপ্রবণ আকর্ষণে বইটা আমি কিনে ফেলতাম।
বইগুলো যতবার পড়েছি ততোবার গভীর শ্রদ্ধার সাথে বিস্ময় জন্মেছ। অনুভব করেছি, লিখতে গেলে পড়তে হয়। পড়লে শুদ্ধ সঠিক বানান, শব্দ ব্যবহারের কৌশল, ইতিহাস, অনুমান, উপপাদ্যের শক্যতা, সম্ভাবনা, সত্য আর অসত্যের বিড়ম্বিত অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। সেগুলো ধারণ করতে পারলে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলা যায় নির্মেদ পাঠক হিসেবে। এভাবে একদিন পেয়ে যাই কলিম খানের ‘পরমাভাষার সংকেত’ বইটী।
বইটী পড়ি। অনেক বার। চেষ্টা করি বুঝতে। আবার পড়ি। পড়তে পড়তে দুলে ওঠে আমার অন্তরাত্মা।
পরমাভাষার সংকেত!
বইটী পড়ে বর্ত্তমান বিশ্বেকে ঘিরে ভূবনীকরণের বাস্তব রূপের সহজ সমীকরণটী পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম। মানুষ এখন ছুটছে। ছুটছে একাকারের অসীম মহাসমুদ্রের পানে একই বৃত্তে শতফুল হয়ে ফোটার ইচ্ছামানসে। ব্যতিক্রম নেই কোথাও। ব্যক্তি আমিও ছুটছি এবং ছুটন্তের নিত্য ধারাতেই সদা সর্ব্বদা সক্রিয় হয়ে আছি। বুঝতে পারি আমার পেছনে যে অজস্র পদসঞ্চারের শব্দধ্বনি তা আমার পূর্ব্বপুরুষের। ইতিহাস সাক্ষী, তারাও ছুটেছিলেন। মহামিলনের মানবতীর্থে এক হয়ে মিশে যাওয়ার মানস ছিল আমার পূর্ব্বপুরুষেরও। জীবন ত এক রিলে রেস।
ভাষার গুরুমস্তানী
পরমাভাষার সংকেত পড়তে পড়তে জানতে পারলাম, বর্ত্তমান বিশ্বে দুর্দ্দান্তভাবে ব্যবহৃত এবং প্রচলিত কিছু ভাষাকে অদূর ভবিষ্যতে গুরুমস্তানের ভূমিকায় দেখা যাবে। এই মস্তান ভাষাগুলো আসছে আগামী দিনগুলোতে পৃথিবীর অন্য ভাষাগুলোকে লুপ্ত করে ফেলবে। অর্থাৎ বিশ্বে কিছু কিছু ভাষা মানুষের নিত্য কাজে ব্যবহারের জন্যে প্রয়োজনভিত্তিতে সাদরে গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠবে। গ্রহণকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাবে। যার ফলে কিছু কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত জাতি বা জনগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে বা লুপ্ত হয়ে যাবে।
এ বক্তব্যটী কিছুতেই বিশ্বাস হল না আমার। কী করে সম্ভব কোন জাতির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে সেখানে অন্য ভাষা তুলে দেওয়া! বাস্তবে দেখলাম এই মস্তানরা খুব যে দূরে বসে মস্তানী করছে তা নয়। আমাদের বাঙ্গাল ঘরেও গুরুমস্তানরা ঢুকে পড়েছে। মীরপুর ডিএইচএসের এক ফ্ল্যাটবাড়ীতে আট বছরের এক বাঙ্গালী মেয়ে তার বাঙ্গালিনী মাকে বলছে, লেকিন কিউ মাম্মা? আই লাইক ইট। কিতনা ছুন্দর বিল্লি হ্যায়। রাখ দিজিয়ে না প্লিজ!
কী চমক দেওয়া ভাষা! দেখে শুনে কলিম খানের বক্তব্যের সারাংশ কিছুটা বুঝতে পারলাম। যদিও বাংলা হচ্ছে বর্ত্তমান বিশ্বে গুরুমস্তান পর্য্যায়ের একটী ভাষা। এত সহজে বাংলা ভাষাকে লুপ্ত করা সহজ হবে বলে হয় না। সারা বিশ্বে কয়েক কোটী বাঙ্গালী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদের বঙ্গজ ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে। তারপরেও দেখলাম চলতি ফিল্মি হিন্দি আর ইংরেজী ভাষার সহজ সাবলীল মস্তানী!
বইটী পড়ে আরও জানতে পারলাম, গুরুমস্তানী করতে পারে এমন কিছু ভাষাদের ব্যাপক হাল হকিকত, তত্ত্ব তালাস এবং তাদের হদিস। মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। যদিও পড়তে পড়তে কিছুদূর এসে, সূত্র খুঁজতে আবার পুরানো পাতায় ফিরে যাচ্ছি। আর ভাবছি, ভাষার ওপর মস্তানী করা কি আদৌ সম্ভব!
আমার ভয়, আমার দুঃসাহস!
এমন নয় যে আমি কলিম খানের লেখা খুব বুঝেছি। তবু সংগ্রহে রাখি। ভাল করেই জানি আমি একজন গান্ডু পাঠক। আদতে অর্ব্বাচীন। তবু কোথাও না কোথাও আমি দুঃসাহসী! সত্য হচ্ছে, এই বই পড়ে বোঝার মত জ্ঞান গম্যি আমার না-ই-থাকল! আনন্দ ত পাচ্ছি! বিমলানান্দ অনুভবে ডুবে আমি পড়ছি আর পড়ছি। পড়ে যাচ্ছি অসীম অতুল কৌতূহলে!
তাই বলে বইটী নিয়ে বিশাল কিছু লিখে ফেলব সে সাধ্যও আমার নেই। তবু আনন্দিত ও পরিতুষ্ট একজন পাঠক হিসেবে অন্য পাঠকদের দরবারে, এই বই নিয়ে কিছু জানানোর জন্যে লিখতে বসেছি।
আত্মায় রেখেছি আনন্দ!
লেখালেখির জগতে মাঝে মাঝে আসি। যাই। কিছু লিখি। বেশিটা পড়ি। সেই সূত্রে আমেরিকা প্রবাসী এক বন্ধু লেখক কলিম খান এবং রবি চক্রবর্ত্তীর কথা জানিয়েছিল। সেই প্রথম। আমাকে অবাক করে দিয়ে বন্ধুটী ওদের লেখা বইও উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেগুলো পড়তে গিয়ে যা বুঝলাম, কলিম খান আমার মত সাধারণ পাঠকদের কাছে, যারা কিনা কথাবার্ত্তা, চলাফেরা, খাওয়া এবং খাওয়ানোতে, অন্যের সমালোচনা করতে এবং নিজেকে সর্ব্বসেরা ভাবতে ইচ্ছুক তাদের কাছে একেবারেই অসহজ। আমাদের বোধগম্যের অনেকটা বাইরে। বার ক্লাশের পর বাংলা ভাষা, শব্দ, শব্দের ভেতরের ছন্দ, অর্থ নিয়ে আমরা কি আর কখনো পড়েছি না ভেবেছি নাকি আলোচনায় বসেছি বা আলোচনা শুনেছি! এমন কি কোথাও এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে শুনলে চটপট ভেগে পড়েছি।
শুধু গৎ বাঁধা পড়া পড়তে পড়তে এটুকু জেনেছি, বাংলা ভাষার মা হচ্ছে সংস্কৃত। বাংলা মিশ্র ভাষা। যুগে যুগে ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশী ভাষার শব্দ এসে মিশে গেছে বাংলা ভাষার সাথে। আমাদের রাঁধুনী মা বলত “নিফিস” করে বাটছি গো। এই “নিফিস” কি ইংরেজী “ফিনিস”-এর বিকৃত রূপ নয়!
আর তখুনি মনে হল, হ্যা সম্ভব। মস্তান ভাষাগুলো ঠিক পেড়ে ফেলতে পারবে অতি দুর্ব্বল, ক্ষীণ উচ্চারিত ও সংখ্যায় ক্ষুদ্র এই পৃথিবীতে অপ্রচারিত অতি সাধারণ ভাষাগুলোকে।
এক আশ্চর্য্য রকমের বিশ্লেষণ করেছেন পণ্ডিত কলিম খান! ভাষা মহামারীর প্রকোপে আগামী শতাব্দীতেই মানব জাতির মধ্যে প্রচলিত মোট প্রায় পাঁচ হাজার ভাষার মধ্যে ৪৫০০টী ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বলছেন কী? তাই কি সম্ভব কখনো!
কিন্তু সম্পূর্ণ বইটী পড়ে আবারো প্রত্যয় হল সম্ভব। ঘটনা মোটেও অসত্য এবং অসম্ভব নয়।
বর্ত্তমানের চলাচলে ভুবনীকরণের মহাচক্রে পড়ে সত্যি সত্যি হারিয়ে যাবে অনেক ভাষা। হারিয়ে কি যাচ্ছে না? প্রায় উনিশ কোটী জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের একটী অতি ক্ষুদ্র অংশ ইংরেজী ছাড়া কথাই বলে না। এক চিমটি ইংরেজীতে আধা চামচ বাংলা ফেলে জব্বর ঘোঁটা দিয়ে কি আমরা প্রতিদিন কথা বলছি না? আমাদের রেডিও, টিভি বা অন্যান্য মিডিয়াতে নাটক বা বিজ্ঞাপন রচিত হচ্ছে না?
এভাবেই পশ্চিম বাংলায় হিন্দি তোড়ের কাছে মার খেয়ে গেছে বাংলা ভাষা। পশ্চিম বাংলার রাস্তাঘাট দোকান জুড়ে হিন্দি ভাষার জয় জয়কার। এমনকি বাঙ্গালী বুঝেও বাঙ্গালী দোকানদার জানতে চায়, কুছ চাহিয়ে ম্যাম! দমদম এয়ারপোর্টে হিন্দী জানা নেই বলে হরহামেশা বাংলাদেশীদের হয়রানি করে মস্তানী ধাঁচে! অতি সম্প্রতি দিল্লীর মসনদ থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীদের ওপর সরাসরি হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে বাংলাপক্ষ। চলছে বাংলা বাঁচাও কর্ম্মসূচী।
আশা ফুলে ছেয়ে আছে প্রাণ!
কিন্তু মোদের গরব, মোদের আশা, বাংলা মোদের মস্তান ভাষা। বাংলা ভাষা হারাবে বা লুপ্ত হবে না। মহান একুশে ফেব্রুয়ারী এখন নিখিল ভুবন মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এটা হয়ত ঠিক, বাংলা ভুবনজয়ী ভাষা হতে পারবে না কিন্তু ইতোমধ্যে প্রমাণ করে ছেড়েছে যে, কেবলমাত্র বাংলা ভাষার জোরে একটী স্বাধীন সার্ব্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। তা বাদে সিয়রা লিয়নের একটী দেশ বাংলা ভাষাকে কথ্য ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে প্রকাশ। তবে ভয় কি হে, বাংলা ভাষা বাঙ্গালীর আশা, বাঙ্গালীর গর্ব্ব, বাঙ্গালীর প্রাণ!
কত অজানা রে!
কলিম খানের পরমাভাষার সংকেত বইটী পড়ে এই প্রথম জানলাম, পাশ্চাত্যেও খুঁজে খুঁজে আবার খুঁজি করে শব্দের অর্থ জানার দীর্ঘ অনুসন্ধান চলেছে।
শব্দের কি নিজস্ব অর্থ আছে, নাকি সে আরোপিত! চমস্কি বলেছেন, শব্দের নিজস্ব অর্থ আছে, আছে একটী “মগ্নগঠন” বা “অন্তরঙ্গগঠন” এবং একটী “বহিরঙ্গ গঠন”। আমরা বহিরঙ্গ শব্দের ব্যবহার করি আর তা নিয়ন্ত্রণ করে “সম্পর্কতন্ত্র”।
চমস্কির এই বক্তব্য নিয়ে পাশ্চাত্যে শুরু হয়ে গেছিল তুমুল বিরোধিতা। চমস্কিপন্থীরা “শব্দের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক” (বা “সিনট্যাক্টিক রিলেশন”)কে যে “অটোনমাস” বলেছিলেন তা উড়িয়ে দিলেন চমস্কিবিরোধী সঞ্জাননী শব্দার্থবাদীরা। তারা জানালেন, শব্দ গঠনের কাজে কেবল সিনট্যাক্টিক একাই রাজামহারাজা নন। তার সাথের সারথী হিসেবে সেমানটিক (নিরুক্তসম্মত)ও কাজ করে। কারণ মানুষের মনের ভেতরে যে সকল বাক্যগঠন ব্যবস্থা বা “মানসিক সংগঠন” (সাইকোলোজিক্যাল অর্গানাইজেশন) বিদ্যমান বা সক্রিয় রয়েছে , তারা অনেকেই সিনট্যাক্স এর শাসন থেকে মুক্ত (দ্র, জনসন ও লেয়ার্ড-১৯৭৪)।
পথ থেকে পথে পথে!
শব্দ গঠন এবং তার অন্তর্নিহিত অর্থ খোঁজার কি অপরূপ পথচলা! পাশ্চাত্যের হাল যদি এই হয় ত মহাবিশ্বে আমাদের পূর্ব্বদিগন্ত বা ভারতবর্ষে কি অনন্ত এই খোঁজ পর্ব্ব চলেনি?
চলেছে। পাঠক সুজন! সেটী জানতে হলে যে পরমাভাষার সংকেত বইটীর নিমগ্ন পাঠ করতে হবে! বন্ধুর পরামর্শে পাঠক হিসেবে নিজেকে আরো বেশী ঋদ্ধ করে তোলার এই সুযোগ আমি ছাড়িনি। এমন রত্নগর্ভে প্রতীতিতে সমিধ রেখে আমি পড়ে যাচ্ছি পণ্ডিত কলিম খানের বইটী।
কে না জানে বাংলা ভাষা হচ্ছে সংস্কৃত শব্দের দুহিতা! উপমহাদেশের মানুষরা প্রায় ১৫০০টী ভাষায় কথাবার্ত্তা বলে থাকে। যার মধ্যে শতকরা ৯৫ জন মাত্র ১৫টী ভাষাকে মুখ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বাংলা ভাষা অন্যতম একটী মুখ্য ভাষা। প্রায় চব্বিশ কোটীর বেশী মানুষ নিত্য ব্যবহার করছে এই বাংলা ভাষা। সংস্কৃত শব্দটীর সংস্কার রূপ হচ্ছে বাংলা। সুদূর আদিমকালে এশিয়াবাসীদের মুখনিঃসৃত, স্বভাবত বিকশিত, তৎকালের প্রচলিত ভাষাকে বা ভাষাগুলিকে সংস্কার করেই সৃষ্টি হয়েছিল সংস্কৃত ভাষা।
ধরে নিলাম বাংলা ভাষার পূর্ব্বপুরুষকে আমরা সনাক্ত করতে পেরেছি। এবার তাহলে বাংলা ভাষার উত্তরাধীকার হিসেবে আমরা কাদের সনাক্ত করব? কারা পাবে বাংলা ভাষার উত্তরাধীকারের সনদ?
ভারতীয় উপমহাদেশের সর্ব্ববিষয়ক জ্ঞানের আদি পুস্তক বেদ। এরপর আসে বেদবিরোধী ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রবক্তাগণ। সামাজিক অবস্থার পরিবর্ত্তনের প্রেক্ষিতে আসে হিন্দুধর্ম্ম নামের বৈদিক মৌলবাদীরা। বৈদিক যুগের শেষ দিকে আসে ন্যায়বাদী গৌতমগণ (আনুমানিক ৭০০ খ্রী; পূর্ব্বাব্দ)। এদের পরে আসেন বেদবিরোধী সাংখ্যকারগণ ও যোগদর্শনকারগন (আনুমানিক ৪০০ খ্রীঃ পূর্ব্বাব্দ)। আনুমানিক ১৫০ খ্রীঃ পূর্ব্বাব্দ বৈশেষিকগণ এবং বেদ বিরোধী নৈরাজ্যবাদী চার্ব্বাকগণ।
অবাক খুঁজে পাওয়া। অবাকিত আমি!
আজ পর্য্যন্ত মুসলমানদের “ন্যাড়া” বলে তাচ্ছিল্য করণের কারণ আমি খুঁজে পাইনি। এই বইটী পড়ে আশ্চর্য্য শিহরণ পেলাম “ন্যাড়া” শব্দটীর উত্থানের ইতিহাস জেনে। ভারতবর্ষের ইতিহাস মূলত শিবপন্থী ও দক্ষপন্থী ব্রাম্মণ্যবাদের মধ্যে ক্রমাগত যুদ্ধের ইতিহাস। শিবপন্থীরা লাগাতার পরাজিত হয়ে ম্লেচ্ছরূপে ঘোষিত হয়। তারা পালিয়ে বনে জংগলে থেকে থেকে আদিবাসী হয়ে যায়। এই ম্লেচ্ছরাই অতঃপর হয়ে যায় ঘৃণ্য, অর্হৎ বা ন্যাড়া বৌদ্ধ এবং তান্ত্রিক। তাদেরই বিরাট অংশ পরে নেড়ে মুসলমান হয়ে যায়। আর এরাই প্রথমে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয় এবং পরে অকংগ্রসী কমিউনিস্ট হয়ে যায়। (পৃঃ ৩৮— পরমাভাষার সংকেত)।
অহো! এই লভিনু সঙ্গ তব, সত্য হে মহাসুন্দরও!
আমি ধর্ম্মে মুসলিম। কর্ম্মে মানুষ। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার সতত প্রতিবাদী চরিত্রের মূল কারণ। আমি নিশ্চিত আমার পূর্ব্বপুরুষ ছিলেন শিবপন্থী। ব্রাম্মণ্যবাদের প্রতিপক্ষ। পরাজিত। পলায়নপর। বৌদ্ধ। তান্ত্রিক। অবশেষে মুসলিম এবং কম্যুনিস্টবাদী। যদিও এখানে আমার একটু সন্দেহ রয়েছে। তবু প্রাক সন্ধ্যার আলোতে, বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ফনীর চাপে বাতাসহীন উষ্ণ গরম আর মেঘহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে আমার আত্মপরিচয়ের কিছুটা খুঁজে পেয়ে মিনিটে ত্রিশ মাইল বেগে হো হো করে ছুটতে ইচ্ছে করছে।
এমন বই আমি কেন আরো আগে পড়ে উঠতে পারিনি!
ভারতের সব বিদ্যার স্রস্টা হচ্ছেন সনাতন শিব। “মাহেস্বর সূত্র” অবলম্বন করে পাণিনি তার “অষ্টাধ্যায়” এবং “শিক্ষা” গ্রন্থ রচনা করেন। আদিতে ভারতীয় শব্দগুলো ছিল বহুরৈখিক এবং ক্রিয়াভিত্তিক। শব্দের সাথে শব্দের অর্থের সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক, যেনো দেহের সাথে আত্মার সম্পর্কের মত।
যেমন “আম” বা ‘‘তেঁতুল’’ শব্দটা উচ্চারণ করলেই জিভের নীচে লোভের জল জমে ওঠে অনেকটা সেরকম।
এই উপলব্ধি কিন্তু আগে হয়নি আমার। বইটী পড়ছি আর একেকটী শব্দ উচ্চারণ করে নিজেই পরীক্ষা করে দেখছি।
পাশের ছাদে গন্ধরাজ ফুটেছে। এখনো ভোর। ফুলগুলো সতেজ চোখ মেলে বাতাসে দুলছে। রোদ ওঠলেই ফুলগুলো হলুদ হয়ে যাবে। আমার মন আর দেহ তাজা ফুলের উন্মাদনায় ভাল লাগায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠছে এই সকালে।
দুপুরে ম্রিয়মাণ হলুদ ফুল দেখে মন খারাপ হবে। দেহও কিন্তু একটু ধীর শ্লথ অনুভব করবে। মহা তেলেসমাতি কাণ্ড। আমি সত্যি সত্যি প্রাচীন পণ্ডিতদের অনুভূতি অনুভব করতে পারছি। শব্দ এবং শব্দের অর্থ ও তাদের সম্পর্ক নিয়ে যুগে যুগে তাদের খোঁজতল্লাসের তড়াস কিছুটা বুঝতে পারছি।
আধুনিক যুগে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় বহুরৈখিক এবং ক্রিয়ারৈখিকতার সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রচলিত সমস্ত ভাষা একরৈখিক এবং প্রতীকী শব্দার্থ দ্বারা শাসিত। আমাদের বাংলা ভাষাও। তবে “ফিরে চল মাটির ঘরে”র মত বাংলা ভাষা আজকের দিনে খুঁজে নিচ্ছে প্রাচীনতাকে। এ বইটী এক অনন্ত খনি।
বিজ্ঞানের অজ্ঞান অবস্থা!
মধ্যযুগে বিজ্ঞানের সূত্রপাত হয়েছিল পরিমাপ দিয়ে। বিজ্ঞান যুক্তি ও গণিতের প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করে না। কিন্তু যুক্তি এবং গণিতের হাত ধরে বিজ্ঞান একদিন পৌঁছে গেল পরিমিতির শেষ সীমায়। কি কাণ্ড! মহাশক্তি (HIGH ENERGY PHYSICS)র আরাধনা করতে করতে বিজ্ঞান উপস্থিত হয়ে গেল অনিশ্চয়তা-তত্বে (UNCERTAINTY PRINCIPLE)-এ।
অর্থাৎ বিজ্ঞানকে মানতেই হল, প্রকৃতির (ঈশ্বরের!) সংসার পরিমেয় এবং অপরিমেয় উভয়কে নিয়েই সৃষ্ট। বিজ্ঞানীরা প্রাচ্যে ফিরলেন। প্রাচীন যৌথ মানবসমাজে একটী মহাভাষা ছিল এবং এই মহাভাষার স্বভাব ছিল ক্রিয়াভিত্তিক। আর সেই ঐতিহ্যের ধারক বা উত্তরাধিকার রয়ে গেছে হিব্রু এবং বাংলা ভাষায়।
শেষ করছি কিন্তু এইই শেষ নয়!
ভাষা, শব্দ, শব্দের অর্থ ও ইতিহাস জানতে গিয়ে কতকটা বিজ্ঞানও জানা হল আমার। জানা হল বাংলা ভাষার জিন কালচার করে প্রবহমান বংশধারাগুলিকে চিনে নেওয়ার প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের কথা। সুপ্রিয় পাঠক আপনাদের জন্যে বাকী আলোচনা রেখে গেলাম। বইটীর অনিন্দ্য পাঠ প্রক্রিয়া রয়েছে। পড়ে দেখতে পারেন। শুভেচ্ছা নিবিড় পাঠকদের জন্যে।
রুখসানা কাজল
শৈশব কৈশোর মধুমতী নদী বাহিত গোপালগঞ্জ শহরে।
পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। পেশায় শিক্ষক।
প্রকাশিত বইঃ
কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ (ইত্যাদি প্রকাশনী), রুখসানা কাজলের অণুগল্প (অণুপ্রাণন প্রকাশনী), আহা জীবন (চিত্রা প্রকাশনী), জলের অক্ষর (নালন্দা প্রকাশনী), নুনফল গল্পগুলো (রসেবশে প্রকাশনী, পরিবেশক— খোয়াবনামা, প্রান্তজনের কথা, কলিকেতা)
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
অলঙ্করণ : হিম ঋতব্রত
{পরমাভাষার সংকেত এবং পাঠ উত্তর ভাবনা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}