ক্লাইভের চেয়ারের নীচের রাইত ও অন্যান্য কবিতা || ফয়েজ আলম

0

 

🌺

ক্লাইভের চেয়ারের নীচের রাইত

ক্লাইভের চেয়ারের নীচে জমছিল যেই রাইত
দু্ইশত চৌষট্টি বছর আগে
তার কতক আন্ধাইর আইজো আমাদের একাডেমিক চেয়ারের পাছায়
কলাভবনের খাঁজে লাইব্রেরীর সেলফে ঝুল্লু খায়
সে এক দেশী বিলাইর কালা মুখ
নিরাকার ইঁদুর বিলাই খেলে সে চতুর
আমাদের আম জাম কাঁঠালের উঠতি চারাগুলার লগে

সোনারইদে ঝলঝলা ফিরিঙ্গী শিকলের দাগ হাতে পায়ে
মহামাতা ভিক্টোরিয়ার করপোরেট সিল বুঝি
কয়জন আবাল অধ্যাপক লেখক রাখে দেলের ভিতর।
তারা পার হইতে চায় বুক পকেটের তাড়াহুড়াগুলি
আর বহুজাতিক সকালের মোড়
বোধের ভিতর ঘোলা পানি ‘বিশ্বায়ন’ হরফের মালা
সে কি আর জানে ফিরিঙ্গীর সাজানোর গুণে হরফও খেলতে জানে
তিনশ বছরের পুরানা খেইল।

বিশ্ববাজারের মোকামের পায়ের তলা পার হইয়া
যেখানে পৌঁছবে এই আবালের দল
তারা তো জানে না সেইখানে হরফেরা লিইখা রাখছে ‘দাসের বাজার’।

 

🌺🌺

পড়ে থাকা পাতা

পড়ে থাকা পাতা
দেখে গাছ
হলুদ শরীর
কিছু পতনের চিহ্ন
দুঃখের নিরালা এক ফোঁটা
দীর্ঘশ্বাস
বাকী সবুজ পাতার
আগাম শুন্যের গান
পাতাদের ডাক
বেদনার ঘুমের আউলিতে
কিছু কুঁড়ি
মুছতেছে পতনের
আহাজারি
বিচ্ছেদী টান
ছিঁড়াবিড়া পাতা পইড়া থাকতেছে
উড়তেছে, পুড়তেছে না-দেখা আগুনে
গাছ ফিরে গাছের ভিতর।

 

🌺🌺🌺

নিজের তিরাসের কাছে

নিজের তিরাসের কাছে আমি তো নগন্য মানুষ একটা
বুঝি বা না বুঝি তারই ইবাদত করি
সকাল বিকাল মনে মনে বানানো সুরতের আদলে
নিরাকার পাথর ভাঙ্গি চাইরদিকে উড়াই

কার ছায়ারে কে ফালায়া যাইতেছে পথে
দূরে যাইতে যাইতে ফসলের বাঁসে ফিরে যারা
তারারেও দেখি চায়ের দোকানে বসি
কতদিন চায়ে চুমুকের আগেই
পাতার হলুদ হয়া ঝইরা যাই মনের গভীরে।

অজানা বাসনাগুলি সব এইখানে আসে
মেল বান্ধে তিরাসের তলে
যেন সে কোন নিরাকার বট গাছ
তার কাছে পুরা হইতে আসতেছে
জগতের যতসব আফলা কামনা
আমি তো হাতে নিছি তার বিষ
ডুবি ভাসি দুনিয়ার আরো আরো মানুষের বিষের গহীনে।

বাওড়ের পাতার মত আমারে উড়াইল কত অযতনে
আমার তিরাস! আইজো তবু
নিজের মনের মধ্যে দুইজনে বাউনির হাওয়া হয়া ঘুরি!

 

🌺🌺🌺🌺

মউতার খবর

আমি মরি না
তবু মউতার খবরে
কিছু পথে পাওয়া ছায়ার আউলিতে
লুকাই প্রতিবার।

রাইতের আগেই ফেরত আসা চান—
অন্ধকারে আমার চোখের গভীরে তার রঙ
যেন এইসব চান, ফুরফুরা রাইত,
আমার হায়াত দরাজ নিয়া ফিরত আসতাছে

বাস্তবে প্রতিবার মাঝপথে কয়েকটা দু:স্বপ্ন আইসা
গিলে ফেলে এইসব পলকা সুখেরে
আর আমি উদাম মউতের পিছেই মাথা গুইজা
এক জীবনে কতবার লুকাই!

 

🌺🌺🌺🌺🌺

বেশুমার উঁশের দিকে

বেশুমার উঁশের দিকে হাটতোছি
যতটুক যাওয়া হয় ততখানি দেখা
আর পেছনের যত ঘাস, পক্ষী, মাটীর পুতলা সকল

ছায়ারা ছাইড়া যায় একে একে
পথে পথে থাকতেছে কায়ার বদলিত
এইখানে আমার আর কোন লেনদেন নাই।

আদতে কি হইতে পারছি রশি ছাড়া প্রাণ
তবে আরো দূর হাঁটার প্রস্তাবে
কদম ছায়াদের কথাই কেন ভাসে মনে!

যতবার ভাবি এরপরই হয়তো চেনা মনে হয় কোন দৃশ্যের জঙ্গল
ততবার দেখি অনন্ত উঁশের পায়েই সেজদা দিয়া আছি।

 

🌺🌺🌺🌺🌺🌺

উড়নের আগে

আমি তো জিরাতি পাখী
কত কত উড়নের পর
বসছি তোমার ডালে কতক সময়
তাতে কি আসছি কাছে
দূর কেন দূরই থাকাতেছে
তোমাদের উঁসারা উঠান্যে!

এই যে আমার কোন কোন দিন গোপনে নামতেছে
গোপনে ফুটতে চাইতেছে অন্য কোন দিন হয়া
তোমাদের সকাল ও সন্ধ্যার ভিতরে
তারাও তো শেষমেশ ফিরতই আসতেছে নিরিবিলি!

যেন এরা জানে আবার উড়নের কালে
যেইসব পাঁখ পিছে পইড়া থেকে
তারা কোনদিন পাখী হয়া উড়বে না তোমাদের মনে।

 

 

 


ফয়েজ আলম
কবী, প্রাবন্ধিক, গবেষক। জন্ম ১৯৬৮, নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার যোগীরনগুয়া গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে সম্মান সহ এম করার পর প্রাচীন বাঙালী সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণার জন্য এমফিল ডিগ্রী লাভ করেন। নব্বই দশকের কবী ফয়েজ আলম উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিক হিসাবেই অধিক পরিচিত। তার কবিতায় আছে আমাদের মননে জারী থাকা উপনিবেশী প্রভাব চিহ্নিত করা এবং তা কাটিয়ে ওঠার সক্রিয় উসকানি। বৃহত্তর বাঙালী জনগোষ্ঠীর যা কিছু ঐতিহ্যিকভাবে নিজস্ব সেই সব উপাদান নিয়েই কায়া পায় তার কবিতা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের মুখের ভাষা ছেনে তৈরী তার কাব্যভাষা, যার মধ্যে ঐতিহ্যিকভাবে সঞ্চিত হয়ে আছে বাঙালী সত্তার হাজার বছরের জীবনাভিজ্ঞা।

প্রকাশিত বই : উত্তর-উপনিবেশী মন (প্রবন্ধ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (২০০৮), এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫), ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপখাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৮), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২০) ।

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{ক্লাইভের চেয়ারের নীচের রাইত ও অন্যান্য কবিতা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।

— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার