গরু কাহিনী || সাকিব শাকিল

0

চিত্রকর্ম্ম : অলকানন্দা সেনগুপ্ত

শেষবার যখন গরুর মালাটী গরুর ব্যাপারীকে পরানো হল তখন মহল্লাজুড়ে একটা হুলস্থুল কাণ্ড ঘটতে শুরু করল। ঘুমের ভেতর শিশুরা শিংঅলা গরু দেখতে থাকল কিছুদিন।

যে লোকটী রোজ গরুর দুধ দিয়ে যেত তার আসা যাওয়া বন্ধ হল হঠাৎ। পাড়ায় মহল্লায় মন্দিরে মসজিদে স্কুল খেলার মাঠ থেকে হাম্বা হাম্বা আওয়াজ আসল। সবাই দিবারাত্রী স্বপ্নে শুধু গরু দেখতে পায়। এত গরু কই থেকে আসে? শিশুদের ঘুমে, জোয়ানদের, বয়স্কদের, যুবতীদের ঘুমে শুধু গরু আর গরু।

সেদিন ছিল শুক্রবার। মসজিদে মসজিদে জিলাপী দেয়া হল, মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি, বড় বাজারে ঢোল বাজিয়ে ঘোষণা দেয়া হল দুধওয়ালা লোকজন যেন তাদের দুধের বালতী নিয়ে আবার ফিরে আসে মহল্লায়। দূরের গ্রাম হুজুগপুর থেকে কবিরাজ আনা হল শিশুদের ঘুমের ভেতর যেন শিংঅলা গরু আর তাড়া না করে।

গরু মেরে কেউ জুতা দান করে গেছে এই তথ্য পেয়ে মোক্তারপাড়ার বাসিন্দারা সমবেত হয়েছে গরুতলা গাছের নীচে। পূর্ব্বে এই গাছটীর নাম ছিল বকুলতলা। কিন্তু যেদিন গরুর মালাটী গরুর ব্যাপারীকে পরানো হলো, যেদিন রাতে কানা দোকানদার কোন ক্রেতা আসবেনা জেনেও তার দোকান খুলে বসেছিল, যেদিন মানুষের নামে গরুকে কুরবানী দেয়ার প্রচলন শুরু হল কিংবা গরুর নামে মানুষকে কুরবানী দেয়া শুরু হল ঠিক তেমনই একদিন বকুলতলা গাছটীর নাম হয়েছিল গরুতলা।

তারপর অনেকবছর পর শরৎচন্দ্র ফিরে আসলেন। হাতে বকুলের মালা নিয়ে। বকুলের মালা কোনদিনও দেখেনি মোক্তারপাড়ার বাসিন্দারা। শুধু তারা তাদের পিতামহীদের কাছে বকুল মালার গল্প শুনেছে বারবার। এবং যখন পিতামহীরা রেডিওতে গান বাজাত সেখানেও বাজতে থাকত বকুলফুলের গান। বকুলের মালা যখন সাবিনা ইয়াসমিনের গানের ভেতর শুকিয়ে যেত তেমন একদিন দুপুর বেলায় তারা দেখতে পায় আক্তার কমিশনারের মেয়ে সুরভী সৌরভী ছাদ থেকে লাফ দিচ্ছে। মহল্লার লোকজন মুছে যাওয়া কোন এক ছবির কসম দেয় তাকে যেন সে ছাদ থেকে লাফ না দিয়ে দিনেরবেলা থেকে রাতের বেলা লুকিয়ে যায়। না, কিন্তু সেইদিন সেই দুপুরে সুরভী ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। আর তারপর থেকেই আক্তার কমিশনার দুপুরবেলায় ন্যাংটা হয়ে ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আজকেও সুরভীর আত্মহত্যার মত একটা দুপুর মোক্তারপাড়ার বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে নেমেছে। চকচকে নোটের মত মচমচা রোদের দুপুরে মোক্তারপাড়ার বাসিন্দারা কেউ-ই দুপুরের ভাতঘুমে যায়নি আজ। তাদের মনে মনে শঙ্কা সুরভী হয়ত আজকেও সেই ছাদ থেকে লাফ দিতে যাচ্ছে আর মানুষজন মুছে যাওয়া ছবির কসম দিয়ে তাকে না না করছে। …

কিন্তু না এমন দুপুরে অনেকবছর পর যখন শরৎচন্দ্র হাতে বকুলের মালা নিয়ে মহল্লায় প্রবেশ করল মহল্লার মানুষজন কিশোর কিশোরী ঝি বৌয়েরা শরৎচন্দ্রের পিছু নিতে লাগল।

যেন শরৎচন্দ্রের হাতে বকুলের মালা স্বর্গের কোন চাবি, তার মোহনীয় স্পর্শ পেতে মহল্লার শিশু জোয়ান বয়স্ক যুবতী, ঝি, বৌয়েরা পিছু ছুটছে। মহল্লার বৌদের কেউ কোন নিষেধ করছে না। সকল বৌয়েরা দুপুরের ভাতঘুমের আগে যে যেমন অবস্থায় ছিল (কারো কারো শরীরে কোন কাপড় ছিল না, কেউ কেউ তার শিশু সন্তানকে দুধ খাওয়াচ্ছিল) ঠিক তেমন অবস্থাতেই বের হয়ে পড়েছে।

দ্রুত এই খবর ছড়িয়ে পড়ে মহল্লা থেকে মহল্লাতে। অন্য অন্য মহল্লা থেকে লোকজন মোক্তারপাড়ার গরুতলা গাছের নীচে আসতে শুরু করে। দেখা যায় তাদের মধ্য কেউ কেউ ন্যাংটা হয়ে স্লোগান দিতে দিতে আসে। কেউ মাঝ নদীর স্রোতের পানী নিয়ে আসে গরুর পায়ে ঢালবে বলে আবার কেউ কেউ পরিধান করে আসে বিভিন্ন রঙের গরুর মুখোশ।

সবাই শরৎচন্দ্রের কাছে গরুর ব্যাপারীর বিচার চায়। এই বিচারে মহল্লাবাসী নিজেরাও তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি। কিন্তু পাপ বিষয়ে তাদের বর্ত্তমানে কোন ধারণা নেই। তাদের পূর্ব্বপুরুষের মতই তলের গর্তে হারিয়ে গেছে পাপ ও প্রায়শ্চিত্ত বিষয়ক ধারণা। তারপরও তাদের বোধ হয় যে গরুর মালাটী গরুর ব্যাপারীকে এই মহল্লারই কেউ কেউ পরাতে বাধ্য করেছিল। উপস্থিত কিছু কিছু বৌঝির মনে মনে সন্দেহ জাগে। শরৎচন্দ্র এই বিচার করতে পারবে না। এবং তারা বিশ্বাস করেন সুরভীর আত্মহত্যার পেছনে শরৎচন্দ্রই দায়ী। তা না হলে কেন অনেকবছর পর সে বকুলের মালা নিয়ে মহল্লায় প্রবেশ করবে!

 

 

 


সাকিব শাকিল
জন্ম ও বেড়ে ওঠা (বাঙলাদেশের) সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনাপাড়ের গ্রাম রান্ধুনী বাড়ীতে। রসায়ন বিষয়ে স্নাতক শেষবর্ষে অধ্যায়নরত। সম্পাদনা করছেন লিটলম্যাগ শব্দ মিছিল।

প্রকাশিত কবিতার বই:
আঙুলের ডগায় শীত (২০২০), দেহ পালিত সাপ (২০২১)

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{গরু কাহিনী || সাকিব শাকিলের গল্প [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার