অলঙ্করণ : হিম ঋতব্রত
গ্রহণ
ছয় ছয় শতাব্দী চলে যায় …
ঘুম শহরে আজ দীর্ঘতম গ্রহণ!
চাঁদের গায়ে পৃথিবীর ছায়া!
গাড়ী পুল ওভার কর, মুগ্ধ মায়া!
‘হ্যালো, ব্যাকইয়ার্ডে যাও, এখুনি!’
ঘুমচোখ, পাইন ঝোপে শিরশির হাওয়া
আকাশে গ্রহণের অর্দ্ধেক পূর্ণিমা …
গ্রহণে ছায়াময়ী চাঁদ, সুবহেসাদেক!
তুমি কি গ্রহণ আমার
নাকি সূর্য ফোটা ভোর?
মায়াবী নরম ভোরের সীমানায়
জাস্ট আ ফোন কল এ্যাওয়ে
যাপনে উৎযাপনে, আলোয়, গ্রহণে!
যেমনটা তুমি আমি, বহমান রাত্রী-দিনে!
শীত আসছে
জানালায় মেঘ জমেছে
স্মৃতি বরষা
জাতিস্মর সময়
আমি, নাকি আমি নই?
অথবা তুমি, নাকি অন্য কেউ?
আয়নায় অচেনা চোখ!
পলকে চলকায় পলাতক জল!
জানালা কত কী খুঁজে আনে!
তন্ন তন্ন করে ভূ-সমুদ্দুর!
কিশোরী নির্জনতা
সাবলীল ডানায় উড়ে আসে
এক একটা দশক, খুব কি অন্য রকম?
পর্দ্দা চুপচাপ, আপাতত সেন্ট্রাল হিটিং
জানালা এক স্বচ্ছতোয়া জলজ প্রশ্বাস!
চুপচাপ নিভৃতে একটানা ঝরে যায়
রাতের শিশির, হিম হিম হৈমন্তী অন্ধকারে
বাতাসে সুবাসিত স্প্রিং ফ্লাওয়ার
নিশ্চিত বিভ্রম, কে না জানে!
শীতের প্রাক্কালে সুগন্ধী অপেক্ষা তবুও
ওম খুঁজে খুঁজে ব্ল্যাংকেট বুট জুতায়
তোমার দিকেই ফিরে ফিরে যাওয়ায়!
বুলেট ও বাগান
অস্ত্র ব্যবসায়ীদের বল
হাওয়াই মিঠাই-এর কারখানা দিতে
সন্ত্রাসের হুংকার বন্ধ, নিমেষেই
ভাবা যায়, এখনও লিঞ্চিং
দিনের আলোয়?
কেবল ওদের রঙ কাল বলেই
উল্লাসে মেতে ওঠ মারণ খেলায়
এইবার তোমাদের অস্ত্র আইন বদলাও
গালভরা মানবতাবাদী বিবৃতি দিলেই
সম্পূর্ণ হয় না মানবতার পক্ষে সাফাই!
মাত্র তিন মাস দুই দিন
আহমাড আরবেরি থেকে জর্জ ফ্লয়েড
নামের প্যারেড, অথবা নামহীন ভিকটিম!
অস্ত্র কারখানাগুলো গুঁড়িয়ে নার্সারি বসাও
ফুল ফুটুক, বুলেটের বিনাশ আবিনাশী মরিচায়!
শাহজাদী রাত্রী
রাত্রী ঘুম ঘুম সান্দ্র হয়ে এলে
নিজেকে শাহজাদী মনে হয়
ঢেউ তোলে মায়াবী মসলিন
মিয়া তানসেন সুর ধরেছেন
মধ্যরাতের দরবারী কানাড়া!
আলোটা নিভিয়ে দাও
জেগে থাক নক্ষত্রের পাহারা!
অন্ধকার চোখে সয়ে গেলে
খুঁজে নেব হারিয়েছে যা কিছু
প্যান্ডোরার বাক্স যেদিন হাত ফসকে …
প্রথম গোলাপ, পাপড়িগুলো
তেমনি সতেজ, টকটকে লাল
খামবিহীন প্রথম চিঠিটা
সুবাসিত তুলোট কাগজে
প্রথম ‘ভালবাসি’ এই রাত্রীর রাগে!
নস্টালজিয়া
ধ্রুপদ মুদ্রায় ঘুরে আসে নস্টালজিয়া
হাত ধরলেই সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠা
গনগনে ভর দুপুর, ছায়া শিকার
চুরি চুরি লুকোচুরি, মানিপ্ল্যান্ট লতায়
তুমিও এক একদিন, ক্লান্তিহীন
ঊর্ধ্বমুখ ব্যগ্র বাইসাইকেল,
সময়ের ডাকনাম ছিল ‘অফুরান’
আকাশে স্থির একটা ভুবন চিল
শ্যাওলা জমেছে ঐ কোণাটায়
ঐখানটায় ছায়া দিনমান, শীতল
একটা বটের চারা, তুলে এনে বনসাই
পাশেই ধীরস্থির ক্যাকটাস, ‘ডোন্ট কিস মি’!
উড়োজাহাজ আকাশ পেরুলেই
কৌতুহল, একদিন আমিও কি?
পাড়ি দিয়ে মহাদেশ, অতলান্ত জল
মোড়ক খুলে দেখি সময় আটক সেখানেই!
তোমার জন্যে
আজ সবাইকে ছুটি দিলাম যাও
বিশ্বাস না হয় দেখ, পথে তাকিয়ে?
একটা মাত্র গাড়ী, হোম ডেলিভারী
বাকি সবাই ব্ল্যাংকেটের তলায়
বাড়ী বাড়ী বাজাতে পার ডোরবেল,
দরজা খুললে আমায় দেখিয়ে দিও।
সত্যি বলছি, সবাইকেই ছুটি দিয়েছি
আজ পথগুলো সব কেবল আমাদের
বল, কোনদিকে যাবে, পূব পশ্চিম?
নাকি উত্তুরে নিবিড় এভারগ্রীন?
দক্ষিণে জল, ছলছল, যেতেও পার
আজ পূর্ণিমা, চাঁদকে বলেছি খুব সাজতে
আজ শহরের সবগুলো ট্র্যাফিক আলো
শুধু তোমার জন্যে জ্বলবে নিভবে, দেখ!
কেন যে চোখে কৌতুক নিয়ে তাকাও অমন
বিশ্বাস করলেই সব অসম্ভব নিমেষেই সম্ভাবনায়!
প্রথম তুষার
আকাশ ভেঙে রূপার গুঁড়ো, দিনভর
শ্রবণাতীত তরঙ্গে অবিশ্রান্ত রূপা বৃষ্টি
জমে উঠছে একটা রূপালী রূপকথা
জানালায় তুষারবৃক্ষ, কী নামে ডাকি তোমায়?
হিমাঙ্ককে পেরোয় অভিলাষী উল্টোরথ
জলের ওপর অপরূপ ক্রিস্টাল ফুল!
দূরে হ্রদের জলে সূর্য্যের প্রতিশ্রুতি,
উষ্ণতার খোঁজে ডলফিনেরা জটলায় …
দলছুট মীনশিশু সাঁতরায় সূর্য্য বরাবর
পোর্ট ক্রেডিটের জলসীমা ছুঁয়ে আছে
প্রাগৈতিহাসিক জাহাজটার নোঙ্গর
অতিকায় এক সী-ড্রাগনের মত …
বাতাসে ভেসে আসে প্রাচীন নাবিকের গান
পেছনে একলা বাতিঘর
প্রিজমের পিরামিডে ক্রিস্টাল মুহূর্ত্ত
থমকে আছে বিশাল কাঁচের বুদ্বুদে!
দূরভাষ
মৌতাত তোমার ফিকে হয়ে আসে
ভোরের উজ্জ্বল রশ্মি চোখ ছুঁতেই
সন্ধ্যে রাতের ঝুমঝুম মগ্নতার ভেতর
ততোধিক মগ্ন স্মৃতিভ্রমণে
কতটা মাখামাখি হয়েছিল
ইচ্ছে পদক্ষেপগুলো, ভুলে গেছ বেমালুম!
দূরভাষে দূরবর্ত্তিনী, বলে গেছ
অতীত ছেঁকে এনে এক একটা উপকথা,
নেশাঘোরে এক একটা কলি, চেনা সুর
যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে, বলে বস,
জানো, আজ এক কান্ড হয়েছে …
আমি শ্রুতিকে বলি, নৈর্ব্যক্তিক হও!
শুনতে ইচ্ছে করে না নতুন গল্পগুলো
আমায় কেন তুমি এতটা বল,
তোমার যাপিত সময়, অভিসার অভিযাত্রা!
একটু থেমে প্রশ্ন, তুমি কি আমায় কোনদিন?
হয়ত আমিও, কবেই তো তামাদি সেসব দিন
দূরভাষ কি পেরুতে পারে দূরত্বের ব্যবধান?
এরোমা থেরাপী
ঐ বরাবর দূরের হুইসেল, রঙীন পপলার
অদেখা স্টেশন ছোঁয়া ঝাপসা রেললাইন
সুখী মেঘেদের ক্লান্তিহীন নিঃসরণ…
ডাক পাঠিয়েছিলে কাল, আজ ডুবসাঁতার
এপাশে হাইরাইজের কাঁচে আকাশের আহাজারি
কালকের চিরকুট আজ ঝড়ো হাওয়ায় ফেরার!
সান্ত্বনা, পাইন অনুরাগমাখা পথ পুরাতনী,
ফরাসী সৌরভ ছাপিয়ে প্রশ্বাস টুইটুম্বুর
ফিরে আসি মন্থর পায়ে ফাইলের অরণ্যে
বাগে পেয়ে আমায়, নথীদের স্বেচ্ছাচার!
ইঁদুর বিড়াল খেলা চলছে ক্রমাগত
কম্পিউটার স্ক্রিন, মাউস আর আঙুলের!
দূরালাপণে ডাক পাঠালে অসময়ে আবার …
দেখা হতে হতেও হল না
পাইনের সুরভী রয়ে গেল কেবলই আমার
তুমি শুধু শ্রুতিতে হয়ত বা পেলে কিছু তার!
বলো কেউ কি শুনেছে কখনো
সৌরভ সংক্রমণ ঘটেছে ছুঁয়ে দূরালাপণের ইথার?
অগ্নিতমা
তবুও মোমবাতীর কম্পমান শিখায়
জ্বালি আতশী প্রাণ, আইরিশ রোজ সুঘ্রাণ!
রাতভর আলো-ছায়া কোলাজ সূফিনাচ ঘূর্ণনে!
চেনা চিরকুট পাঠিয়ে সন্ধ্যে নেমেছিল …
নাগরিক অরণ্যে একফালি কৃষ্ণচূড়া আগুণ
ছটফটে কার্ডিনাল পাখিটার কমলা ঝিলিক ডানায়!
জাদুকরী আঙুলে আগুণ ছুঁয়ে অগ্নিতমা তুমি!
সন্ধ্যের রং বদলে যেতে যেতে ফিকে অন্ধকারে
পুরানো ছায়াদের খুঁজে গেছে স্মৃতি লণ্ঠন দুলিয়ে …
তোমার চোখের সঘন ছায়ারা গাঢ়তর হতে হতে
আলো ঘুম মেখে গহন যাত্রায় … রাত্রী গভীরতমা!
মোম গলে গলে শিশিরের গান, বল, শুভরাত্রী!
এস স্বপ্ন ঘুম, এস সৌম্য সুদূর সকাল!
আলো হয়ে, ছায়াদের পেরিয়ে, প্রগাঢ় মায়ায়!
লুবনা ইয়াসমিন
কবিতা লেখা হয়ত কখনো কখনো নিজের সাথে কথা বলা, হৃদয়ের কথা বলা, আর কখনো কখনো শব্দ, ছন্দের বিন্যাসে একটা সৃষ্টিশীল ভাষার কোলাজ বোনা। কবিতা যাপন কিছুটা এরকম। সাম্প্রতিক এক যুগ বাদ দিলে জীবনের প্রায় পুরাটাই কেটেছে ঢাকা শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বাংলা এবং ইংরেজী দুই ভাষাতেই লেখেন। প্রিয় কবী আবুল হাসান, প্রিয় লেখক পাওলো কোয়েলো। বর্ত্তমান আবাস কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সের টরণ্টো শহরে। সবচে’ প্রিয় বন্ধু প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্য্য প্রাণ ভরে উপভোগ করেন, উৎযাপন করেন নিয়ত। …………
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা || লুবনা ইয়াসমিন [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}