সুফিকণিকা (তৃতীয়পর্ব্ব) || আরশাদ সিদ্দিকী

0

ছবি : ইণ্টারনেট থেকে

[শত শত বছর ধরে সুফী সাধকরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে ছোট ছোট গল্প ব্যাবহার করতেন। অল্প কথায় সহজ ভাষায় সুফী সাধকরা তাদের অর্জ্জিত জ্ঞান ও উপলব্ধির কথা জানাতে পারতেন যা হাজার হাজার পৃষ্ঠার বর্ণনায়ও হয়ত দুঃসাধ্য। আমার সংগ্রহের সেইসব জ্ঞান ও উপলব্ধির তৃতীয়পর্ব্ব আপনাদের কাছে হাজির করছি।]

এক—
রুক্ষ এবং মলিন চেহারার এক সুফী একটা রাজপ্রাসাদের দরজায় এসে হাজির হলেন। প্রাসাদে প্রবেশ করতে গিয়ে তাঁকে বাধার মুখোমুখী হতে হল। বাদশাহ ইব্রাহীম বিন আদম তখন সিংহাসনে আসীন। বাদশাহর দরবারে জবরদস্তি এক সুফী প্রাসাদে প্রবেশর চেষ্টা করছেন, এ খবর পৌছুল।

বাদাশাহ ইব্রাহীম সুফীকে দারবারে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন। সুফী দারবারে পৌঁছুলে বাদশাহ জানতে চাইলেন, “এখানে আপনি কেন এসেছেন?” সুফী জবাবে বললেন, “এ সরাইখানায় আমি ঘুমানোর জায়গা চাই।” বাদশাহ বললেন, “এটা কোন সরাইখানা নয়। এটা আমার রাজপ্রাসাদ।”

সুফী সবিনয়ে বললেন, “আমি কি জানতে পারি, আপনার আগে এ প্রাসাদের মালিক কে ছিলেন? বাদশাহ বললেন “আমার পিতা, তিনি মৃত।” সুফী আবার প্রশ্ন করলেন, “আপনার বাবার আগে এটার মালিক কে ছিলেন?” বাদশা বললেন, আমার পিতামহ, তিনিও এখন মৃত।” এবারের সুফী বেশ তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, “তাহলে, এ প্রাসাদে আপনার আগে যারা এসেছেন, তারা চলে গেছেন। অথচ আপনি বলছেন, এটা সরাইখানা নয়?”

দুই—
একবার সুলতান আবু ইয়াজিদ বিস্তামী, তার শিষ্যদের সাথে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ভ্রমণের একপর্য্যায়ে তাঁরা এক অচেনা স্থানে পৌঁছুলেন। যেখানে কেউ তাঁদের চিনত না। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন রাত হয়ে আসছে। এমন সময় একজন শিষ্য তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: “গুরু, আমরা আজ রাত্রী কোথায় যাপন করব”? সুলতান উত্তর দিলেন, “আচ্ছা, দেখা যাক, আল্লাহ একটা ব্যাবস্থা করবেন, আপনারা এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। তিনিই ভাল জানেন, আমাদের কী প্রয়োজন”।

তারপর তারা রাত্রী যাপনের জন্য একটা আস্তানার সন্ধান করতে লাগলেন। তারা একটার পর একটা বাড়ীর দরজায় কড়া নাড়লেন। সর্ব্বত্রই তারা উত্তর পেলেন “না, আপনারা দারবিশ, আমরা আপনাদের চিনি না, আমরা আপনাদের রাত্রী যাপনের ব্যাবস্থা করতে পারব না”। অবশেষে তারা সে গ্রামের শেষ দরজায় কড়া নেড়ে রাত্রী যাপনের ব্যাবস্থা করতে ব্যার্থ হলেন। ঠিক সেই মুহুর্ত্তে প্রবল বৃষ্টি নামল।

শিষ্য আবার সুলতান আবু ইয়াজিদ বিস্তামীর দিকে ফিরে বললেন: “গুরু, আপনি আমাদের বলেছেন, আল্লাহ সর্ব্বদাই আমাদের যত্ন নেন এবং আমাদের যা প্রয়োজন তা ব্যাবস্থা করে দেন? এখন আমাদের রাত কাটানোর জন্য একটা শুকনা নিরাপৎ (নিরাপদ) জায়গায় তীব্র প্রয়োজন!” গুরু শিষ্যের দিকে তাকালেন, চোখেমুখে অনাবিল হাসি ছড়িয়ে বললেন, “আচ্ছা, এটা এখন নিশ্চিত যে আমাদের বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। আমরা এখন যেখানে আছি সেখানেই অবস্থান করতে হবে।”

গুরু বলতে থাকলেন, “আমরা জানি না আমাদের পরবর্ত্তী পদক্ষেপ কী হবে? কারণ, একমাত্র আল্লাহই আমাদের পরবর্ত্তী পদক্ষেপ নির্দ্ধারণ করেন। আমাদের পরবর্ত্তী পদক্ষেপ কী হবে তা আমরা কখনই জানতে পারি না। আজ হয়ত আমাদের গাছ তলায় ঘুমাতে হবে। সেখানে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে আমরা তা জানি না। হয়ত আমাদের জন্য কোন বিপৎ (বিপদ) অপেক্ষা করছে, অথবা আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছুর সন্ধান পাব। যদি আমরা মনে করি যে আমাদের যা কিছু দরকার তা আমরা পাইনি। তাহলে এটা মানতে হবে, আমরা যা পাইনি তা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই তা আমাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়নি। এই সহজ সত্যটা মেনে নিতে পারলে আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে যাবে”।

তিন—
সুফী জামালী ছিলেন ভারতের বাসিন্দা। ভালবাসতেন ভ্রমণ করতে। দীর্ঘ ভ্রমন ছিল তার সব চেয়ে পছন্দের। সুফী জামালী কবী হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন। তাঁর কবী খ্যাতি ভারত ছাড়িয়ে হেরাত পর্য্যন্ত বিস্তৃতি পেয়েছিল। মক্কা ও মদিনা সফরের পর জামালী ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, ইরাণ শেষে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণকালে আদমের পদচিহ্ন দেখতে পান। কথিত রয়েছে, তিনি একজন কালান্দরের* মতই ভ্রমণ করতেন। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে তিনি হেরাতে সুফী জামীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হন।

সুফী জামালীর সাথে জামীর সাক্ষাৎ প্রীতিকর ছিল না। জামী বিরক্তির সাথে জামালীর কাছে জানতে চাইলেন, “তোমার এবং গাধার মধ্যে পার্থক্য কী”? জামালী বেশ রসিকতার সাথে এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন, “আমার ও আপনার মাঝে ঠিকই যতখানি দূরত্ব ততটাই পার্থক্য রয়েছে গাধার সাথে”।

উত্তর শুনে সুফী জামী বেশ মজা পান। তিনি তখন জিজ্ঞাসা করলেন, জামালী কোথাকার বাসিন্দা। উত্তরে জামালী বললেন, তিনি দিল্লীর বাসিন্দা। পরের প্রশ্ন সুফী জামী আগন্তুকের কাছে জানতে চাইলেন, দিল্লীর কবী জামালীর কোন কবিতার পঙক্তি তিনি বলতে পারেন?

জামালী উচ্চারণ করলেন—
তোমার শহরের সড়কের ধুলোয়
আচ্ছাদিত হয়েছে আমার শরীর …

সুফী জামী তখন উপলব্ধি করতে পারলেন, তিনি কবীর সাথেই কথা বলছেন।

* ১. কালান্দর > সন্ত।
২. উত্তর-পূর্ব্ব ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাধক গোষ্ঠী।

চার—
এক ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী একজন দারবিশকে প্রার্থনারত অবস্থায় দেখলেন। দারবিশ নিভৃতে ধ্যান মগ্ন ছিলেন। দৃশ্যটা ব্যাবসায়ীর হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করল। ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী দারবিশকে স্বর্ণমুদ্রা পূর্ণ একটা থলে উপহার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ব্যাবসায়ী দারবিশকে বললেন, “আমি জানি আপনি স্বর্ণমুদ্রা আল্লাহর রাহে ব্যাবহার করবেন। অনুগ্রহ করে আমার এ দান গ্রহণ করে আমাকে আল্লাহর কাছ আরো বেশী কৃপা অর্জ্জনের সুযোগ করে দিন।”

উত্তরে দারবিশ ব্যাবসায়ীকে বললেন, “আমি নিশ্চিত নই, আপনার কাছ থেকে স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করা উচিত হবে কিনা? আপনি কি সত্যিই একজন ধনাঢ্য ব্যাক্তি? আপনার নিজের জন্য কি পর্য্যাপ্ত স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে?” ব্যাবসায়ী বললেন, “হ্যাঁ, আমার নিজের জন্য পর্য্যাপ্ত পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে।” তিনি অত্যন্ত গর্ব্ব নিয়ে দারবিশকে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি আমার কাছে আরো স্বর্ণমুদ্রা চান?” দারবিশ বললেন, “কেন নয়, আপনার কাছে যেহেতু পর্য্যাপ্ত রয়েছে”?

ব্যাবসায়ী দারবিশের প্রতি খানিকটা রুষ্ট হলেন। তিনি দারবিশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “প্রতিদিন আমি আরো বেশী উপার্জ্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করি। প্রতিটা প্রার্থনায় আল্লাহর কাছে আমি মোনাজাত করি, আমি যেন আরো বেশী উপার্জ্জন করতে পারি। আপনি আমাকে আমার কষ্টার্জ্জিত স্বর্ণমুদ্রা থেকে আরও দান করতে বলছেন”? দরবিশ স্বর্ণমুদ্রার থলেটা ব্যাবসায়ীর দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, “আমি দুঃখিত, আমি আপনার স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করতে পারছি না। আমি নিজেই একজন ধনী ব্যাক্তি, একজন ধনাঢ্য ব্যাক্তি ভিক্ষুকের কাছ থেকে কোন দান গ্রহণ করতে পারে না”। ব্যাবসায়ী রাগে-ক্ষোভে-অপমানে ফুঁসে উঠে দারবিশের কাছে জানতে চাইলেন, “আপনি কেন আমাকে ভিক্ষুক বলছেন? কোন যুক্তিতে আপনি নিজেকে একজন ধনী ব্যাক্তি হিসেবে দাবী করছেন?

দারবিশ অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন, “হ্যাঁ, আমি একজন ধনী ব্যাক্তি। আমার যা রয়েছে তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আরো অধিক সম্পৎ (সম্পদ) লাভের আশায় আমি কখনো আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি না। আপনি নেহায়েতই একজন ভিক্ষুক। কারণ, আপনার যতই সম্পৎ (সম্পদ) থাকুক না কেন, আপনি তাতে সন্তুষ্ট নন। তাই প্রতিটা প্রার্থনায় আপনি আল্লাহর কাছে আরো বেশী সম্পদের প্রত্যাশা করেন।”

পাঁচ—
বহুবছর আগের কথা। উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান ইস্তাম্বুলে একজন মহান শায়েখের সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তিনি শায়েখের আতিথেয়তা, আন্তরিকতা এবং প্রজ্ঞায় গভীরভাবে মুগ্ধ হন। তারপর থেকে তিনি শায়েখের মজলিসে নিয়মিত যাতায়াত করতে শুরু করেন।

কিছুদিন যাতায়াতের পর সুলতান একদিন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শায়েখকে বললেন, “আমি আপনাকে এবং আপনার শিক্ষাকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করি। যদি কখনও আপনার কিছু প্রয়োজন হয়, অনুগ্রহ করে দ্বিধাহীনচিত্তে আমার কাছে চাইতে পারেন। যদি আমার সাধ্য এবং ক্ষমতায় থাকে তবে নিশ্চয় আমি তা সবটুকু সরবরাহ করার চেষ্টা করব।”

প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এবং সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যাক্তির কাছ থেকে শায়েখের কাছে একটা প্রাণখোলা প্রস্তাব। শায়েখ সুলতানের প্রস্তাব শুনে উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আপনি আমার জন্য একটা সর্ব্বোত্তম কাজ করতে পারেন— দয়া করে আপনি আর এখানে ফিরে আসবেন না।”

সুলতান এ কথায় অত্যন্ত বিস্মিত হলেন, বিনয়ের সাথে তিনি শায়েককে প্রশ্ন করলেন “আমি কি আপনাকে বিরক্ত করার মত কথা বলেছি? যদি তাই হয়, তবে আমায় ক্ষমা করুন।” উত্তরে শায়েখ বললেন, “না, সমস্যাটা আপনার নয় সুলতান; আপনি এখানে আসার আগে আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তা আমরা কেবল আল্লাহর কাছ থেকে চাইতাম। আমাদের সাধনা হল পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে নিজেদের সমর্পিত করা। আপনার উপস্থিতি আমাদের মনকে বিক্ষিপ্ত করবে। আমরা আপনাকে তুষ্ট করার জন্য, আপনার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায়, আপনাকে খুশি করার চেষ্টা করব। যা আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পিত করার কাজকে বাধাগ্রস্থ করবে। আমি আপনাকে এখানে আর ফিরে না আসতে বলছি। কারণ, আমরা এখানে আপনার উপস্থিতিকে ধারণ করার জন্য নিজেদের আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে এখনো পরিপূর্ণ করে তুলতে পারিনি।”

ছয়—
শাহ্ শামস তাবরিজী একবার মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর পাঠকক্ষে ঢুকে পড়েছিলেন। তিনি কক্ষের বইগুলোর দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব কী?’ রুমী উত্তর দিলেন, ‘এসব এমন কিছু যা তুমি বুঝবে না’।

মুহূর্ত্তের মধ্যে তাবরিজী বইগুলো তুলে ঝর্ণার পানীতে ফেলে দিলেন। রুমী বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন ‘আপনি কি করছেন জনাব?!’ রুমীর ছাত্ররা আর্ত্তস্বরে বললেন, ‘আমাদের বই! ওগুলো ছাড়া আমরা কিভাবে জ্ঞান অর্জ্জন করব?!’

তাবরিজী খুব শান্ত ভাবে বললেন, ‘জ্ঞান বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা কি উত্তম?’ তারপর, ঝর্ণার কাছে গিয়ে এক এক করে পানীর ভেতর থেকে বইগুলো বের করে আনলেন। রুমী এবং তার ছাত্ররা অবাক হয়ে দেখলেন, বইগুলো এতটাই শুকনা যেন মনে হচ্ছে এক ফোঁটা পানী বইগুলোকে স্পর্শ করেনি।

রুমী জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই বইগুলো পানীর ভেতর এমন শুকনা রইল কেমন করে?’ তাবরিজী জবাব দিলেন, ‘এটা এমন একটা বিষয়, যা তুমি জান না!’ তারপর চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেলেন।

সাত—
এক দরবিশ তাঁর ষাটজন শিষ্যকে যথাসাধ্য শিক্ষা দিয়েছিলেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের নতুন অভিজ্ঞতা লাভের সময় এসেছে। তিনি শিষ্যদের বললেন, দীর্ঘ সফরে যেতে হবে। যারা এ সফরে যাবার জন্য প্রস্তুত, সফরের শেষ পর্য্যন্ত তাঁর সঙ্গী হিসেবে থাকতে হবে।

তিনি তাদের সকলকে স্মরণ রাখার নির্দ্দেশ দিলেন, “দরবিশের পরিবর্ত্তে নিজে মরতে হবে”। যখনই দারবিশ তার হাত উঁচু করে ধরবেন তখন চিৎকার করতে হবে। এই কথা শুনে শিষ্যরা দারবিশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠলেন। নিজেদের মধ্যে তাদের সন্দেহ নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।

অবশেষে শিষ্যদের মধ্যে ঊনষাটজন দারবিশকে ত্যাগ করলেন। তাদের সন্দেহ ছিল, দারবিশ বিপতে (বিপদে) পড়বেন। তারপর নিজেকে উদ্ধারের জন্য যে কোন শিষ্যের জান কোরবান করবেন। তারা দারবিশের কঠিন শর্ত্তগুলোকে মানতে নারাজি জানিয়ে বললেন, সফরকালে দারবিশ কোন অপরাধ করতে পারেন— এমনকি হত্যা, যার দায় শিষ্যদের বহন করতে হবে। এমন শর্ত্ত মেনে তারা তাঁর সফরসঙ্গী হতে পারেন না।

অগত্যা দারবিশ তার একমাত্র অবশিষ্ট শিষ্যকে নিয়ে সফরে রওনা হলেন। যেইমাত্র একটা শহরে প্রবেশ করলেন। তারা জানতে পারলেন, এই শহরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ আগেই, একজন দুষ্ট অত্যাচারী রাজা এটা দখল করেছে।

সেই অত্যাচারী রাজা তার নাটকীয় শক্তি প্রদর্শন করে শহরের ওপর তার নিয়ন্ত্রণকে পোক্ত করতে চাইছিল। সে সৈন্যদের নির্দ্দেশ দিলো, শহরের মধ্য থেকে একজন নিরীহ পথচারীকে ধরে নিয়ে আসতে। যাকে দুর্বৃত্ত হিসেবে শাস্তি দেয়া হবে।

সৈন্যরা তার কথা মত রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা দারবিশের শিষ্যকে নিরীহ পথচারী হিসেবে চিহ্নিত করল। তাকে বন্দী করে সেই দখলদার রাজার কাছে কাছে নিয়ে গেল। দারবিশ‌ তাদের অনুসরণ করলেন।

দারবিশের শিষ্যকে দখলদার রাজার সামনে হাজির করা হল। রাজা অসংলগ্ন ভাবে ঘোরাফেরা করার দায়ে দারবিশের শিষ্যকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করল। এই আদেশ শুনে দারবিশ রাজাকে বললেন, তাঁর শিষ্যের পরিবর্ত্তে যেন দারবিশকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কারণ তিনি তাঁর শিষ্যকে এ শহরে প্রবেশ করার জন্য প্ররোচিত করেছেন। এটুকু বলে দারবিশ তার দুই হাত মাথার ওপর তুললেন। সাথে সাথে শিষ্য চিৎকার করে দারবিশের পরিবর্ত্তে নিজের মৃত্যুদণ্ড কার্য্যকর করার প্রার্থনা করলেন। রাজা হতবাক। দারবিশ এবং তার শিষ্য কী ধরনের লোক, যারা একে অপরের পরিবর্ত্তে নিজের মৃত্যুদণ্ড চাইছে। দখলদার রাজা একইসাথে উদ্বিগ্ন হল। জনগণ যদি তার সিদ্ধান্তকে বীরত্ব হিসাবে গ্রহণ না করে, তবে তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে।

দখলদার রাজা মনে মনে ভাবল, কেন সে নিজে অমর না হয়ে অন্য কাউকে অমর হওয়ার সুযোগ করে দেবে। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর দারবিশ বা তার শিষ্যের পরিবর্ত্তে নিজেই নিজের মৃত্যুদণ্ড অবিলম্বে কার্য্যকর করার নির্দ্দেশ দিল। দখলদার রাজা ও তাঁর পরিষৎ-বর্গের মধ্যে এক চরম বিভ্রান্তি তৈরী হল, সেই বিভ্রান্তির মধ্যে দারবিশ ও তার শিষ্য সে সহর (শহর) ত্যাগ করলেন।

আট—
কাফুর নামে এক ব্যাক্তি একবার নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কাছে গিয়ে বললেন, “সুলতান গিয়াসুদ্দিন বালবানের আত্মার শান্তির জন্য প্রতি শুক্রবার দান করার আদেশ রয়েছে”। যদি শায়েখ অনুমতি করেন তাহলে প্রতি শুক্রবার সেই অর্থ তাঁর কাছে পাঠানো হবে। শায়েখ রাজি হলেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শুক্রবার তাঁর কাছে টাকা এল।

এরপর সামা* বৈঠকে হজরত নিজামুদ্দিন অতি উচ্ছ্বাসে কিছু বলার জন্য হাত তুললেন। শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারলেন, নিশ্চয়তাযুক্ত অর্থ গ্রহণকারীর এইভাবে হাত তোলার কোন অধিকার নেই। সম্ভবত তখন তিনি শায়েখ সাদীর উক্তিগুলো স্মরণ করে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেছিলেন। সাদী বলেছেন, “আল্লাহর শানে যখন তুমি নেচে ওঠবে, কেবল তখনই তোমার হাত ওপরের দিকে ওঠবে। তোমার জোব্বার ঘের তখন ইহ-পর-জগৎ থেকে বহুদূরে চলে যাবে”।

সাদীর কথাগুলো মনে পড়ার পর তিনি অনুতপ্ত হলেন। কাফুরের প্রতিশ্রুত প্রতি শুক্রবারের অর্থ তিনি প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর তিনি আর কখনও কোন নিশ্চয়তাযুক্ত অর্থ গ্রহণ করেননি। ঘটনাটা ঘটেছিল হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া ‘আধ্যাত্বিক খালিফা’ নিযুক্ত হাওয়ার শুরুর দিকে।

* সামা > সাধকদের সান্ধ্যকালীন নিয়মিত সভা

নয়—
একজন রাজা একবার মহান সুফী সাধক ফরিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। রাজা সুফী ফরিদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন একটা সুন্দর কাঁচী। সোনালী বর্ণের কাঁচীটা ছিল হীরা জড়ানো, মূল্যবান এবং অসাধারণ।

রাজা ফরিদের পা ছুঁয়ে কাঁচীটা তাঁর সামনে পেশ করলেন। ফরিদ রাজার দিকে নির্মোহভাবে তাকিয়ে বললেন, “মহাত্মা, আপনি যে উপহার এনেছেন তার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এটা একটি আনন্য সুন্দর উপহার। কিন্তু আমার জন্য একেবারে অকেজো। এই কাঁচীটার বদলে যদি আপনি একটা সুঁচ উপহার দিতে পারেন, তা আমার খুবই কাজে লাগবে”।

রাজা বেশ দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। এই মরমী সাধক কাঁচীর বদলে সুঁচ কেন চাইছেন? সুঁচ যদি তার প্রয়োজন হয় তবে তো মূল্যবান কাঁচীটাও তাঁর কাজে লাগার কথা। রাজা সংসয় নিয়ে ফরিদের কাছে প্রশ্ন করলেন, “বুঝলাম না জনাব। আপনার যদি সুঁচের প্রয়োজন হয় তবে কাঁচীও আপনার কাজে লাগবে।”

ফরিদ খুব শান্তভাবে বললেন বললেন, “কাঁচী আমার প্রয়োজন নেই। কারণ কাঁচী কোন কিছু কেটে আলাদা করে দেয়। কিন্তু সুঁচ আমার প্রয়োজন, কারণ একটা সুঁচ কোন জিনিসকে জোড়া দিতে কাজে লাগে”।

ফরিদ একটু থেমে আবার বললেন, “আমি মানুষকে ভালবাসার পাঠ শেখাই। আমার পুরা শিক্ষাটাই প্রেমনির্ভর— মানুষকে একত্রিত করা। মানুষে মানুষে সংযোগ তৈরী। আমার একটা সুঁচ দরকার, যাতে আমি মানুষকে এক সুতায় গাঁথতে পারি। কাঁচী আমার জন্য অকেজো। কাঁচীর কাজ কাটাকাটি করা, সংযোগ তৈরী নয়। পরেরবার আপনি যখন আসবেন, শুধুমাত্র একটা সাধারণ সুঁচ নিয়ে আসবেন”।

দশ—
একদিন আসরের নামাজ আদায়ের পর শায়েখ নাসিরুদ্দিন বিশ্রামের জন্য নিজ কক্ষে এলেন। সেদিন দরজায় কোন অভ্যর্থনাকারী ছিল না। এমনকি মাওলানা জয়নুদ্দিন আলী, সাধারণত উপস্থিত থাকতেন, তিনিও সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন।

এই ফাঁকে তুরাব নামের একজন কালান্দার* ঘরে ঢুকে শায়েখকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। তার শরীরে এগারোটা আঘাত করে। ছুরীর আঘাতে শায়খের হাতের তালু মারাত্মকভাবে আহত হয়। তাঁর আঙ্গুলগুলো এতটাই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়, তিনি সারাজীবন হাতে কলম ধরতে বা নামাজের পর দোয়ার সময় আঙুল সোজা করতে পারতেন না।

যখন তুরাব শায়খকে ছুরীর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করছিল তখন শায়েখের কিছু মুরিদ হতবিহ্বল হয়ে কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁরা কালান্দরের ওপর প্রতিশোধ নিতে চড়াও হন। কিন্তু শায়েখ খুব শান্ত ভাবে তাদের নিরস্ত করলেন। মাওলানা আব্দুল মাকতাদির থানসারী এবং মাওলানা জয়নুদ্দিন আলীকে শপথ নিতে বললেন, যেন তাঁরা আক্রমণকারীকে কোন আঘাত না করে।

আর আক্রমণকারীকে বললেন, “আমি আশা করি, তোমার ছুরী তোমার হাতে কোন আঘাত করেনি”। তারপর তিনি কালান্দার তুরাবের হাতে কিছু টাকা দিয়ে খবরটি ছড়িয়ে পড়ার আগেই পালিয়ে যেতে বললেন।

* ১. কালান্দার > সন্ত।
২. উত্তর-পূর্ব্ব ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাধক গোষ্ঠী।

 

 

 


আরশাদ সিদ্দিকী
সম্পন্ন করে চলছেন এমন এক জীবন-পরিক্রমা, যেখানে আলো আছে সত্য; তবে বিষ-কণ্টকই অশেষ সেইখানে! ভারতভাগের আঘাতে বিপর্য্যস্ত হয়েছে তাঁর পিতৃপুরুষের জীবনের ভেতর-বাহির! সেই আঘাতের অপরিমেয় দংশন তাঁকেও সইতে হয়েছে! পেতে হয়েছে বিষ-জরজর শৈশব ও কৈশোর! এমনকী এই যে এখন জীবনের মধ্যাহ্নে তিনি— এখনও প্রতি কদমে তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়ে আছে কেবলই কাঁটার মুকুট! প্রচল-প্রথা-প্রতিযোগিতার প্রতি তুমুল অনীহ তিনি! এইসবকিছু তাঁকে ক্রমে নির্জন থেকে নির্জনতম করে তুলেছে ঠিকই; তবে সমষ্টির কল্যাণ বিমুখ করে তুলতে পারেনি কখনো! সমাজ-বিপ্লবের স্বপ্নতাড়িত আরশাদ সিদ্দিকী— প্রথম তারুণ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছেন সক্রিয় রাজনীতিতে। দেখেছেন সেই বিশ্বেও কত রকমের ক্রুর নির্ম্মমতা বিরাজ করে! এবং সেই ক্রূরতা কত রকমে তাঁকে আক্রান্ত করার শক্তি রাখে!

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{সুফিকনিকা (তৃতীয়পর্ব্ব) || আরশাদ সিদ্দিকী [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার