একা একজন স্বচ্ছমানুষ :: স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত

0

একা একজন স্বচ্ছ মানুষ নির্ভুল রৌদ্রের মাঝ দিয়ে হেঁটে গেলো আজ
পৃথিবী কখন তার কাছে আসে, দূরে ফিরে যায়, রৌদ্রের গন্ধে সে এসব খোঁজে না
তবু দৃশ্যের কাছে কিছু প্রত্যাশা থাকে, দৃশ্যের গন্ধ মেখে উড়ে যায় চিল
দূরত্বের কথা ভুলে বহুদূর ছায়া তার দৃশ্যের ভিতরে যেন মিশে যেতে চায়
চলে যায়  শনিবার, যে’ভাবে সন্ধের শেষ দেখে ঘুমোনোর কথা তার মনে পড়ে দিন

শুধু সাবানের ফেনাটুকু নয়, নির্ভুল রৌদ্রের মাঝখানে শাড়িগুলি আজও দুলে যায়
পৃথিবীর অন্ধকারে মুখ ঢেকে তার ছবি, তার পরিজন এতদিনে ঘরে ফিরে আসে,
এই তার অন্ধকার, এই তার শেষবেলা, সাবানের গন্ধজুড়ে গৃহমুখি হাওয়া ফিরে আসে
তবু স্বচ্ছতার পাশে এসে বসে থাকে বিকেলের প্রিয়জন, বিকেলের কথকতাগুলি
নিভৃতির দিকে যেতে যেতে এইসব স্মৃতিগুলি নির্ভুলতা ফিরে পেতে চায়
বৃষ্টিকে চেনা যায়, যেভাবে তুষারমানব চিনে রাখে বৃষ্টির বালিকাবেলাগুলি

২.
একা একজন স্বচ্ছ মানুষ, মানুষের পাশে নিরুপায়, ফসিলের দিকে চেয়ে বসে থাকে
গৃহের গভীরে তার গৃহমুখীনতা, এই ঘর গৃহহীনতার বেশি কিছু দিতে চায় তাকে
তবু রৌদ্রের ভিতরে সে মুক্তি চায়, মিলে দিতে চায় তার ছায়াছায়া ছবির কাহিনি
দৃশ্যের প্রত্যাশা নয়, পাশবিকতার থেকে দূরে মানুষের শৈশব ধুলোবালি খেলে
চিরকাল ধুলো ঘেটে, তুলে নেয় মানুষিক স্মৃতিকথাগুলি, ধুলোর স্বচ্ছতাগুলি একে একে
প্রথামতো চিরকাল ভোর হয়, ঘুমের ভেতর থেকে, ঘুমের ভেতর থেকে…

খুব কাছ থেকে দেখা যায় শূন্যতার ছায়া, রৌদ্র তাকে ঢেকে দিতে চায়
মানুষের পরম্পরা, খুবজোর মানবিকতার আলোটুকু দিয়ে যেতে পারে
গৃহের বিভ্রম থেকে ফিরে এসে, একা একজন মানুষ, ঘরে ফিরে যেতে চায়
যে’ভাবে শষ্যের গভীর থেকে উঠে আসে ভোজনের উপকথাগুলি
তারপরও সভ্যতার আলো এসে উঠোনে পড়েছে, রান্নাঘরের চাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে

৩.
ধুলোর স্থাপত্যগুলি আকাশের কোল ছুঁয়ে ধুঁয়োর মিনারে উঠে গেলে
ঘুমন্তের ছায়া পড়ে একা মানুষের পাশে, সন্ধেযুগের শেষ হয়
শব্দের আদিমতা ভেঙে দিয়ে, সে চলেছে আরও এক ফসিলের দিকে
মৃতপ্রায় কথাগুলি, পৌত্তলিক নগরের মাঝ থেকে উঠে এসে ইতিহাস হয়
মানুষেরা চিরকাল গৃহমুখী, অনুগত ছায়াদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় তারা
পাখিগুলি দীর্ঘ নয়, তবু ছায়ার দীর্ঘতা ভুলে গিয়ে হত্যা করে হলুদাভ কীটের জীবন

আবাসনের বিজ্ঞাপন ভিজে যায়, মেঘ থেকে নেমে আসে ভিজে গন্ধের চিল
দৃশ্যের অনেক ভিতরে, ক্লান্তিতে ক্ষয়ে যাওয়া মানুষেরা একা একা কথা বলে রোজ
তাদের ভাগ্যে আছে অতিকায় রঙের হরিণ, আর রাধুঁনির হলুদ বিছানা
একইভাবে সন্ধে নামে, ছোটোজাগুলিয়ার দিকে বাঁক নেয় অদ্ভুত ট্রেন
সন্ধেও বেঁকে যায়, অন্তত বেঁকে যেতে পারে আজ, এইটুকু জানে সব তুষারমানব

৪.
সকালের কথাগুলি, শুক্রবারের পাশ দিয়ে
রৌদ্রের প্রখর নগরে এসে থামে, শোনা যায়

একইভাবে বৃষ্টির উপকথা মনে আসে,
বিকেলের নীরবতায় এসে বসে ঝরাশ্রাবণের কাক

তাকে কেউ পাখি বলে, কেউ সন্ধের রঙটুকু
ধার করে ফিরে যায় একা সব মানুষের পাশে

বৃষ্টিজুড়ে সন্ধে হয়, একা মানুষের কথাগুলি
ভিজে গেলে, জাগুলিয়া ছেড়ে যায় অদ্ভুত ট্রেন

কাহাকে তুষার বলে, কাহাকে মানব, ভেবে ভেবে
সাবানের গন্ধে তারা, প্রশ্নহীন, ফিরে যেতে চায়

৫.
একদিন শাল্মল দ্বীপের পাখি, নিজের অতীতগুলি
ফেলে রেখে, উড়ে যেত সোমনাথবন্দরের দিকে

উড়ন্তমাছের মতো বিয়স্তানদীর স্মৃতি নিয়ে
বেঁচে থাকে ঈশানের চর, প্রত্নের অনেক গভীরে

প্রজন্মের ইতিহাস টিকে আছে, কথার আদলে
গড়ে ওঠে একা মানুষের মুখ, স্বচ্ছতার পাশে

আদিমস্বরের কাছে নির্ভুলতাও ভেঙে যেতে চায়,
তারপর, শোনা যায়, রৌদ্র এসে ডেকে নেয় তাকে

সেখানে ছায়ার পাশে পাখাগুলি মিলে দেয় তারা,
পাখা মিলে দেয় তারা ছায়াহীনতার পাশে পাশে

৬.
বর্ষার প্রবলনূপুরে এসে বসে আছে একখানি কাক, ভিজে গেছে তার এই বসে থাকাটুকু । অনেক অতীত থেকে তার ডাক মাঠের গভীরে বেজে ওঠে, বৃষ্টি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে । কেউ ভাবে মানুষের অনুভূতি ভিজে গেলে স্বচ্ছ হয়, মাঠগুলি ভিজে যায় মাঠের ভিতরে । তবু বাতাসের গন্ধটুকু রয়ে গেছে, কাকগুলি রয়ে গেছে বিকেলের ভীষণ আকাশে, দেখা যায় । দৃশ্যের গভীর থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা, তাদের অদৃশ্যজুড়ে, বৃষ্টিনূপুরগুলি বেজে বেজে ওঠে ।

শুক্রবারের পাশ দিয়ে, নির্ভুল রৌদ্রের পাশ দিয়ে, ছায়াগুলি উড়ে যাবে আজ । শরীরের থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা, শরীরের ছায়া হয়ে । রৌদ্রের একপাশে পড়ে আছে বেবিফুড, ছায়াখানি উড়ে গেছে কবে । বিজ্ঞাপণের শিশু ঘুমের আবেশে হেসে ওঠে, অনুরোধের আসরে আসরে । কার হাসি কার মুখে ফুটে ওঠে, ঘুম নয়, ঘুমকাক ভোরের স্বপ্নে আজ উড়ে যেতে থাকে ।

৭.
দ্বিপ্রাহরিক কাহিনিগুলি হেঁসেলের দিক থেকে শুরু হয় দিন । হেঁসেলের গন্ধ বেয়ে পেতলের চাঁদখানি আকাশ জুড়েছে, দেখা যায় । রাঁধুনিরা একে একে জ্যোৎস্নার মাঝখানে চুলগুলি খুলে দিলো আজ । দুপুরের পর থেকে তাদের হাসির ঢঙে ধুঁয়ো এসে লাগে । কখনো রাতের মাঝে, হলুদাভ হাত থেকে, তারাগুলি, একে একে ফেলে দেয় তারা । অন্ধত্বের আয়োজন ছিলো, তবু হলুদাভ হাতগুলি রাত্রিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সকালের রাস্তা খুঁজে যায় । স্বচ্ছতার শীর্ষে উঠে, একা সব মানুষের ধারাভাষ্যগুলি, রন্ধনশালার স্বপ্নে যেন মজে যেতে থাকে ।

পিতৃত্বের পরিধিখানি, যতদূর বিস্তৃত আজ, তারও পরে উড়ে যেত ধুলোমলিনের স্মৃতি । আজানের শব্দজুড়ে কতটা বিকেল তার, কাকভোর তার কাছে কতখানি পাখি, এখনও অজানা । পাখির আকাশে যারা চোখ রাখে, শান্ত পরকীয়ার দেশে, ঘুমের দুপুরখানি খসে পড়ে তাদের নূপুরে । তবু বিকেলের সমগ্রতায় ধরা দেয় দৃষ্টির প্রাচীনতাগুলি । বাতাস আজকে বড় একঘেয়ে, পাখিগুলি উড়ে উড়ে পিতৃত্বের সীমানা ছেড়ে যায় ।

৮.
মানুষের ছায়াজুড়ে
পড়ে থাকে
পারিবারিকতার দিনরাত্রিগুলি

একা মানুষের
ছায়াগুলি
রৌদ্রের জীবিকা ছেড়ে
ঘরে ফিরে আসে

দৃশ্যমানতার ঘরে ঘরে
বেড়ে ওঠে
অভিনব দৃশ্যগুলি শুধু

পাখির আঁধার নয়,
পাখির ছায়ায়
তারা বসে আছে,

কুয়াশার সীমানা দেখে,
শীতল ঋতুর ছবি
চিনে নেয় তারা

তারপর
শীতকাল ছুঁয়ে দিয়ে
চলে যায়
তাদের হাসির পথ ধরে…

লেখকবৃত্তান্তঃ
স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্ত । জন্ম ১৯৮১ সালে । থাকেন মেদিনীপুর, পশ্চিমবাংলায় । কবিতা এবং কবিতা বিষয়ক লেখালিখিতে সবিশেষ আগ্রহ । স্কুল কলেজের পত্রিকার কথা বাদ দিলে,কবিসুদেব বক্‌সী সম্পাদিত ‘তিরপূর্ণি’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়, ২০০৩ সালে । প্রথম কবিতার বই, ধানইন্দিরা । প্রকাশক কবিয়াল । বিভিন্ন লিট্‌ল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকে ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার