যুদ্ধ কোন সহজ ঘটনা না। অস্ত্রকারবারীদের নির্ম্মম খেলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাদের ওপর।
কর্ণফুলী পেপার ও রেওয়ান মিল অবাঙালী দাউদ কোম্পানীর সম্পত্তি হওয়ায় যুদ্ধের শুরুতে সেনাবাহিনী চন্দ্রঘোনায় ঘাঁটী গাড়ে।
মিলগেটের তল্লাশি এড়ানোর জন্য মা আমাদের নিয়ে স্কুলের পিছনের পাহাড় ডিঙিয়ে নিস্তব্ধ বনপথে দোভাষী বাজারের দিকে এগোয়।
স্বচ্ছ জলের ছড়ির ভেজা বালুকায় পা ফেলে আমরা হাটতে থাকি। বসন্তের বাতাসে বুনোগন্ধ বহে আর হাজারো প্রজাপতী ওড়ে, ফড়িং লাফঝাঁপ দেয়।
মিশন হাসপাতালের পিছন দিয়ে যখন নার্সদের কোয়ার্টার অতিক্রম করি তখন দেখি, চারপা বেঁধে বাঁশের ভাড়ে ঝুলিয়ে কয়েকজন পাহাড়ী একটা বুনো শুয়োর নিয়ে যাচ্ছে। আর প্রাণীটা বিকট শব্দ তুলে চরাচরের স্তব্ধতা এমন করুণভাবে ভেঙে দেয়, বুক কেঁপে ওঠে।
আমাদের দেখে সাদা পোষাক পরা পরীদের মতন কয়েকজন এ্যংলো নার্স এগিয়ে এসে জানতে চায়— তোমরা কোথায় চলিয়াছ?
মা বলে— জানি না। দেশের বাড়ী যাব বলে বের হইছি।
নার্সরা বলে— ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোক।
একজন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যীশুর নামজপ করে। …
পাহাড়ঘেরা চন্দ্রঘোনা এক আশ্চর্য্য ছোট্ট শহর। শুধু ছবির মতন দেখতে নয়; এখানে ইংরেজ, এ্যাংলো, চাকমা, মার্মা, নানান জেলার বাঙালী; ধর্ম্ম-বর্ণ নির্ব্বিশেষে অভেদ-জ্ঞানে আপনজনের মত বসবাস করছিলাম।
যুদ্ধ এসে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
যেপথ দিয়ে আমরা স্কুলে যেতাম; সাইরেণ শুনে শ্রমিক কর্ম্মচারীরা মিলের দিকে ছুটত; সেইসব পথঘাট দখলে নেয় পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনী।
যুদ্ধের শুরুতে ওরা মিলের অনেক কর্ম্মী ধরে নিয়ে যায়। শুনি, লিচুবাগানের দোকানপাট পুড়িয়ে দিয়েছে।
যুদ্ধের ভিতর জনজীবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া ছিল হানাদারদের মোক্ষম কৌশল। এই ভয় থেকে আমরা যখন হাসপাতালের মাঠ পেরিয়ে দোভাষী বাজারে প্রবেশ করি, তখন চৈত্রের আকাশ কালোমেঘে ঢেকে গিয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়।
বড়বড় ফোটার এমন তুমুল বর্ষণ! বৃষ্টিকেই মনে হয় হানাদার। পাঞ্জাবীদের ভয়ে শুনশান নির্জন বাজার বৃষ্টির তোড়ে আরো বিষন্ন হয়ে যায়। ইলেকট্রিক তারে কয়েকটি কাক ভিজে চুপসে থাকে। জনহীন কাঁচা বাজারের আটচালালায় কয়েকটী কুকুর বৃষ্টির মধ্যে হুহু বিলাপ জুড়ে দেয়।
আমরা একটু এগিয়ে বাবার এক বন্ধুর কাপড়ের দোকানে ঢুকে পড়ি। কর্ণফুলীর তীরঘেঁষে বড়বড় খুঁটীর ওপর একসারি দোকান। পেছনের ঘরে হিন্দু কাকুটার বসতঘর। ওনার একটা ছেলে আমার বয়সী। কাকীটা মিষ্টি দেখতে। কপালে লেপ্টানো সিঁদুর। কাকী আমাদের পেছনের ঘরে নিয়ে গিয়ে গুড়মুড়ি খেতে দেয়।
স্মৃতি এত প্রতারক, আজ আর কারো নামধাম মনে পড়ে না।
পেছনের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখি, বৃষ্টি থেমে গিয়ে কর্ণফুলীর বুকে রোদ চিকচিক করছে।
ওপাড়ে রায়খালি বাজার। ……….
মনির জামান
কথাসাহিত্যিক। জন্ম: ১৯৬৬ সালের ১লা আগস্ট। পৈত্রিক নিবাস পিরোজপুর জেলার জোলাগাতী গ্রামে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ সম্পন্ন করেন। প্রবন্ধ-নিবন্ধ শাখায়ও সমান বিচরণ। আশির দশকের সেনাশাসন বিরোধী আন্দোলনের সম্মুখসারির সাংস্কৃতিক কর্ম্মী। তিনি নাট্যকার ও নির্ম্মাতা। বৈচিত্রপুর্ণ জীবনের প্রতি তার প্রবল ঝোঁক। বিশ্বব্যাপি বৈষম্যমুক্ত প্রগতিশীল মানবসমাজ গড়ে তোলার সমস্ত সংগ্রামের তিনি একনিষ্ঠ সমর্থক। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা কুড়ির অধিক।
অলঙ্করণ : হিম ঋতব্রত
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{বৃষ্টিকে মনে হয় হানাদার || মনির জামানের গল্প [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}