ছবি ইণ্টারনেট থেকে
দিনরাত একাকার হয়ে গেছে। জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে সময়। ঘড়ীর বুকের খাঁচায় ঘণ্টা মিনিট সেকেণ্ডের কাঁটাগুলো একগুঁয়ের মত ঠুসে গেঁথে আছে। প্রায় অচল। এগুচ্ছে কি! মনে হয় না। রুগ্ন নিথর আর সন্ত্রস্ত সময়ের উদ্বাহু যাপন চলছে পৃথিবীতে।
কিন্তু আর কতদিন! আর কবে এ বনসাই সময়ের কাল কাটবে?
লুনা ভেবেছিল শীতের রূঢ়তা, গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষার ধারাজলে স্নাত হয়ে রুগ্ন পৃথিবী আবার সুস্থ হয়ে ওঠবে। চেনা ছন্দের পৃথিবীকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে নতুন উদ্যমে ছুটে যাবে প্রকৃতির কাছে। কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসায় হাত রাখবে সতত ক্ষমাশীল ধরিত্রীর বুকে। আদতে তার কিছুই হচ্ছে না। দু একমাস চুপ থেকে তেড়েফুঁড়ে আসছে কোভিড বাবাজীর নতুন নতুন ঢেউ। তাতে বেশুমার মানুষ রুগ্ন হচ্ছে। মৃত্যু হারও বেড়ে যাচ্ছে মানুষের ধারণার বাইরে। বিজ্ঞানীদের থোঁতা মুখ ভেচরে ভোঁতা হয়ে গেছে। সব প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে নতুন ভ্যারিয়েন্ট এসে নাজেহাল করে দিচ্ছে তাঁদের। দেশে দেশে রাষ্ট্রনায়করাও দিশেহারা। পারলে লৌহবর্ম দিয়ে ঘিরে রাখত নিজ নিজ রাষ্ট্র। কিন্তু সে তো সম্ভব নয়!
এরকম অসুখের মধ্যেই সাজনীন চলে গেল আমেরিকা। মৃদু আপত্তি করায় মেয়ে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, মা প্লেন কেবল তোমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে না। আরও মানুষ যাচ্ছে। পৃথিবীকে নিয়ে একটু ভাবতে শেখ।
মোবাইলে সময় দেখে লুনা। রাত তিনটা বেজে দশ মিনিট। বারান্দায় সখ করে একটা বেতের দোলনা ঝুলিয়েছিল সাজনীন। সারাক্ষণ ঝুলে ঝুলে মোবাইল করত। আমেরিকা যাওয়ার আগের রাতেও ওখানে বসে আসিফের সাথে কথা বলেছিল। বারান্দা লাগোয়া রুমে কাপড় ভাঁজ করতে করতে আঁতকে ওঠেছিল লুনা। কি ধুরন্ধর হয়ে ওঠেছে তার মেয়ে! কত অনায়াসে বলে যাচ্ছে, মিস ইউ আসিফ। তোমাকে খুব মিস করব। নেক্সট ইয়ারে তুমি কিন্তু চলে আসবে। প্রমিজ? লাভ ইয়ু বেবস্। টেক্ কেয়ার।
আসিফকে বিয়ে করবে বলে জানিয়েছিল সাজনীন। সন্দ হচ্ছে এখন। আসলে কি করবে! খানিক আগেই রুপনের সাথে কথা পাকা করেছে লুনা। ওর কাছে গিয়ে ওঠবে। ভাল লাগলে ওর সাথেই থেকে যাবে। রুপনের ডিভোর্স হয়ে গেছে ওর মেক্সিকান বৌ-এর সাথে। বাচ্চার খোরপোষসহ অর্দ্ধেক খরচ রুপনকে দিতে হয়। ইনফ্যাক্ট আমেরিকান নিয়মে এটা দিতেই হবে। চোখ সরু করে ফর্কে চিকেন টুকরাটাকে বাগে এনে সাজনীন লুনাকে বলেছিল, ওদের ডিভোর্সের নিয়ম বাংলাদেশের মত না। সব সমান সমান। ডিভোর্সের পর বাচ্চারা বাবামা দুজনের কাছে আসবে যাবে। ঘুরবে ফিরবে। নতুন বাবা বা মায়ের সাথেও থাকবে, যাবে। খালামনি যেমন আয়মনকে নিয়ে আত্মীয়স্বজন থেকে পালিয়ে পালিয়ে থেকেছে সেরম না। ওদেশে মানুষের মূল্য আছে।
লুনা একবার বলেছিল, অফিসের কাজেই ত যাচ্ছিস। একাও ত থাকতে পারিস। মাঝে মাঝে আমরাও ঘুরতে যেতাম!
খ্যাচ করে ওঠেছিল মেয়ে, সে দেখা যাবে। সব কিছুতে জাজমেন্ট দিও না ত মা। ভাল্লাগে না।
লুনা আর কিছুই বলেনি। এ সময়ের মা হয়ে লুনাকে পেছনে তাকানো চলবে না। থাই গ্লাসের জানালা হয়ে থাকতে হবে। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে যাওয়া। না দেখতে চাইলে সময় সময় পর্দ্দা টেনে দাও। বেশ ফুইরে গেল গার্জেনশিপ। আর মাতৃত্ব পিতৃত্ব? ওটা রাখতে হবে আধপাকা কলার মত। দেখতে শক্ত ভেতরেটা নরম। বছর কয়েক আগে ডান ব্রেস্টের ঠিক ওপরে আজগুবি এক ট্যাটু এঁকে এসেছিল সাজনীন। ট্যাটুরও নাকি অর্থ থাকে। এ ট্যাটুর অর্থ হচ্ছে, খোল যা সিম্ সিম্। তাই শুনে আব্বাস ফ্যা ফ্যা করে হেসেছিল। যেন তার মেয়ে বিশ্বের সব রহস্য খুলে ফেলেছে। বিশ্রী লেগেছিল লুনার। প্রচুর ডিসগাটিং ট্যাটু। অশ্লীল কদর্য্য অর্থ। লুনা তবু আধপাকা কলা হয়ে চুপ মেরে গেছিল। নইলে মেয়ে বলে বসবে, ফাক য়ুর সোসাইটি মাম্। তোমার অসুবিধে হলে বল চলে যাই বাসা থেকে।
তা চলে যেতে পারে। ওর বন্ধুদের অনেকেই চাকরী পেয়ে নিজেদের বাসা ছেড়ে আলাদা থাকছে। বাসায় থাকলে বিড়ী সিগ্রেট গাঁজাফাজা মদমুদ খাওয়ার বেজায় অসুবিধা। গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে ডোর লক্ করলে ভূমিকম্প হয়ে যায়! তাছাড়া দুদিনের উইকলী ছুটীর রাতে মস্তি শেষে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমানো যায় না। সকাল হলেই লাগাতার নক করে করে দরজা প্রায় ভেঙ্গে ফেলে মায়েরা চেঁচায়, কই রে ওঠ্, নাস্তা করতে আয়- আরে এবার ও্— ওঠে পড়—শরীর খারাপ করবে যে!
ব্যাক্তিস্বাধীনতার প্রপাত ভুলুন্ঠন।
এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে এক বিকেলে কফীর ওপর ক্রিম ঢেলে সাজনীন বলেছিল, মা তোমরা কি ভাব জন্ম দিয়েছ বলেই আমরা তোমাদের কৃতদাস? ওঠা-পড়া-খাওয়া-ঘুম সবকিছুতে কৈফিয়ত দিতে হবে! আমরা যদি এতই খারাপ তাহলে অফিসে এত এত কাজ কী করে করি? ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট উই হেইট দিস প্যারেন্টিং!
সেদিন লুনাও মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিল। কড়া করে বলেছিল, ইচ্ছে করলে তুমি আলাদা বাসা নিতে পার সাজু। বাবা মা হয়ে আমরাও এমন কিছু অপরাধ করে বসিনি। তাছাড়া তোমার টাকায় আমরা খেয়ে পরে থাকি না।
সাজনীন ক্রিম মাখা ঠোঁটে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলেছিল, সেইম টু মি। আমিও আমার টাকায় চলি ফিরি খাই। আমারও আলাদা থাকার গাট্স আছে। এটুকু বুঝলে খুশি হব মা—
গুম মেরে গেছিল লুনা। এরপর বাবামাদের নিয়ে নানারকমের মজার মজার ভিডিও পাঠিয়ে সাজনীনই নর্ম্মাল করে নিয়েছিল পরিবেশ। লুনা বোঝে বাবামা হিসেবে ওরা আধুনিক কিন্তু সে অর্থে এ যুগের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। ওরা যেমন বরাবর জেনে এসেছে, সকালে নাস্তা না করে একবারে ব্রাঞ্চ করলে শরীর ক্ষয়ে যায়! মদ খেলেই মাতাল হয়। গাঁজা খেলে সবাই গাঁজাখোর বলে। অথচ পৃথিবীর বহু দেশে গাঁজা এখন আইনত সিদ্ধ। ওপেনলি বিক্রি হচ্ছে। সাজনীন নেট ঘেঁটে এগুলো সেন্ড করে লুনাকে লিখে জানায়, বুদ্ধিটা খানিক বাড়াও মা। সারাক্ষণ ফেসবুক আর ফেসপ্রেম না করে গুগল দেখ। সার্চ্চ দাও। পড়। জান। নিজেকে আপ টু ডেট কর হে বালিকা!
লুনা খাবি খেতে খেতে দেখে আর ভাবে অহো স্বাধীনতা। তোমার কতশত রঙিলা পাখনা গো! কোথায় ছিলে আমাদের সময়ে! চারুকলার বন্ধ্যা পুকুরের তলে বন্ধুদের সাথে একবার সিগ্রেট টেনেছিল লুনা। সে খবর কি করে যেন পৌঁছে গেছিল বাসায়। ঘরে ফিরতেই মা রেগেমেগে জুতিয়ে লম্বা দাগ করে দিয়েছিল ওর পিঠে।
সাজনীন দেশে থাকতে কালেভদ্রে দোলনায় এসে বসেছে লুনা। চলে যাওয়ার পর দোলনাটা একা একাই দুলে যেত বাতাসে। মলিন হয়ে গেছিল গদির কভার। দুনুর মা ঘর মুছতে এসে আহ্হা করে দুঃখ করত। আন্তরিক দুঃখ। এটা ঠিক, সাজনীন কখনও গৃহকর্ম্মীদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করত না। লুনার কি কখনও মায়া লাগত শূন্য দোলনা দেখে?
না ঠিক সেভাবে লাগত না। মেয়েকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা ছিল ওর। একা শুধু ওর মেয়েকে নিয়ে যে তা নয়। সাজনীনের গোটা বন্ধুদল নিয়েই ও অবাক হয়ে যেত। এ কেমন বন্ধুতা ওদের! ছ’জন ছেলেমেয়ে ছ’জনই একে অন্যের সাথে সর্ব্বোতভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ!
খাওয়া-পরা-শোওয়া থেকে অফিস বাইরে ঘুরাঘুরি কোন কিছুতেই ওদের কারও ওপর কোন কর্ত্তৃত্ব, দায়ভার বা জেলাসী ছিল না। সে ত ভাল কথা। কিন্তু ফিজিক্যাল রিলেশনের ক্ষেত্রে? সেও কি সমানভাবে সবার সাথে একভাবে হয়? হলেও সে বন্ধুত্ব কি টিকে থাকে?
টিকে যে থাকে সে ত ফাতেমা আর নূরকে দেখেই বুঝতে পারছ মা। বিয়ে করে দিব্যি আছে। আর দেখছ ত ওরা কত হ্যাপী।
কোন সন্দেহ জাগে না?
লিপ পাউট করে সাজনীন, পার্টনার চুজ করা পার্সোলাল ম্যাটার মাম। তুমি খাবি খাচ্ছ কারণ ইয়ু হ্যাভ নো চয়েস। অই যে কি যেন বলে না, থোড় বড়ী টড়ী জাতীয় কি যেন— বাবা আর তুমি বিশ্বাস কর, গত জন্মে তোমরা হংসমিথুন ছিলে, এজন্মে লুনাব্বাস হয়েছ, সামনে জন্মেও—
হেসে ফেলে লুনা। বলিউডের সিনে সাংবাদিকদের মত আব্বাস আর ওর নামকে লুনাব্বাস বলায় মজা পায়। মেয়ের ত সবকিছুই ঠিক আছে। পড়াশুনায় বরাবর ব্রিলিয়ান্ট ছিল। চাকরী-বাকরী, বন্ধু বান্ধব, এমনকি মাসের বেতন পেলে অনেকগুলো টাকা লুনার হাতে দিয়ে ভারিক্কী একটা হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে যায়। তবে কেন ও অযথা ভেবে মরে! আব্বাস তাহলে ঠিকই বলে। লুনা ছিদ্রান্বেষী! আরে ভাই ছেড়ে দাও না। ওদের জীবন ওরা অনেক ভাল বোঝে।
হয়ত বোঝে কিন্তু লুনা যে ওদের ভাল করে বুঝতে পারে না! বোঝা না বোঝার ট্রমায় আটকে ছটফট করে। চলে গিয়ে ভাল করেছে সাজনীন। অন্তত চোখের আড়ালে যা করে করুক, দেখতে ত হচ্ছে না!
লুনার দু বছরের বড় বোন বুলা ডাক্তার। একটা ছেলেবাচ্চা নিয়ে ডিভোর্সী। ছেলে আয়মানও ডাক্তার হয়েছে। কিন্তু পেশাদারিত্ব বলে কিছু নেই। ইচ্ছে হলে চেম্বারে আসে। আবার সব ছেড়ে কিছুদিনের জন্যে বন বাদাড় পাহাড় জঙ্গলে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বিয়েতে আগ্রহ নেই। তবে চমৎকার একটা মেয়ের সাথে লিভ টুগেদার করছে। সে মেয়েও পঙ্খী। হাফপ্যান্টের সাথে গেঞ্জী কামিজ হাতের কাছে আয়মানের শার্ট ফাট যা পায় তাই পরে আয়মানের সাথে সমানতালে পাহাড় পর্ব্বত নদী জনপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছবি তুলছে। পোষ্টাচ্ছে। কমেন্টে যাচ্ছেতাই গালী খেয়েও আরও বেশী ছবি পোষ্ট করছে।
হাসপাতালের ক্যাণ্টিনে লুনাকে নিয়ে কফী খাচ্ছিল বুলা। তোর খারাপ লাগে না বুলাপ্পী?
না, লাগে না। ওরা সামলাতে পারলে আমাদের কী! তাছাড়া ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে মাবাবার গুরুত্ব কমে যায়। ইনফ্যাক্ট নিজেদেরই কমিয়ে ফেলতে হয়।
আমার যে ভয় লাগে। ওরা কি নর্ম্মাল তুইই বল! আমার মেয়েটা— আচ্ছা নামাজ রোজা শেখাইনি বলে কি মেয়েটা এমন হল?
মাদ্রাসার খবর জানিস? হুজুরদের কায়কারবার কি অজানা তোর? হুজুররাও তোরচে দশ পা আগিয়ে আছে গাধা। আল্লামা মামুনুল হকের কথা ভুলে গেলি!
কফী হাতে ভাবনায় ডুবে থাকা ছোটবোনকে দেখে বুলা সান্ত্বনা দেয়, তুই একটু বেশী ভাবিস। ছেড়ে দে না লু! ওদের জীবন ওদেরকেই না হয় বুঝে নিতে দে।
লুনা ছেড়ে দিতে গিয়েও পারে না। বুকের ভেতর ভয় ঢুকে গেছে। শেষ পর্য্যন্ত মেয়েটা পলিগামাস হল! শুধু কি তার মেয়ে? কী হচ্ছে চারদিকে! তারা স্বামী স্ত্রী ত— মাথাটা নুয়ে আসে লুনার। না সে আর আব্বাস কেউই পিওর মনোগোমাস নয়। তাই বলে এমন বারোয়ারী শরীর বিলাস! সেও সর্ব্বসম্মতভাবে!
আজকাল দোলনায় এসে বসে থাকে লুনা। আব্বাস ফেসবুকে বরাবরই এক্টিভ। আটষট্টির পুরুষ হয়েও বয়সে ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে খুবই বন্ধু বৎসল। বুকের ছাতি খুলে হাসে। না দেখা বন্ধুদের সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলে যেন আব্বাসের কতকালের চেনা! মাঝে মাঝে লং ড্রাইভ বা শর্ট ডেটিংএ চলে যায়। স্থুল পেট, চুপসানো বেলুনের মত ঝুলন্ত গাল, টাক মাথার আব্বাসের সাথে দিব্যি ডেটিং করছে মেয়েরা। লুনা পারে না। কয়েকবার খুব গোপনে একেবারে নিশ্ছিদ্র অজ্ঞাতে সাহসী হতে পারলেও অসংখ্যা দ্বিধা, সংকোচ, পাপপূণ্যের ভয় আর শুচী অশুচীতার কনসেপ্ট ওকে ছেঁকে ধরেছে। ফেসবুকে লুনাও এক্টিভ। নিজের যৌবনকালের আর ফুল ফল রান্নাসহ নানা কিছুর ছবিটবি দিলেও ইহকালের পাপপূণ্যের জন্যে পরকালের বিচার আর শাস্তির ট্যাবু থেকে কিছুতেই বেরুতে পারে না। তাই ভাবনাটা লেগেই থাকে।
সাজনীন এখন রুপনের সাথে থাকছে। আসিফ জানে। ছেলেটা নিয়মিত ওদের খবরটবর নেয়। দরকারে যে কোন সময় ডাকলেই চলে আসবে বলে জানিয়ে গেছে। দুদিন আগে নাবিলাকে সাথে নিয়ে এসেছিল বাসায়। লুনা এমনিতেই খুব একটা ওদের সামনে যায়-টায় না। আব্বাসই বকবক করে মাতিয়ে রাখে। সেদিন তিনতলার বারান্দা থেকে সন্তর্পনে আসিফ আর নাবিলাকে ভাল করে দেখেছে। বসুন্ধরায় ছোট একটা ফ্ল্যাটে অফিস কলিগ শাব্বার সাথে শেয়ার করে থাকে নাবিলা। ইস্কুল টিচার বাবামায়ের অসম্ভব মেধাবী মেয়ে। যে কোন মুহুর্ত্তে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে চলে যেতে পারে। যাচ্ছে না। কারণ ছোট ভাইটাকে গাইড দিচ্ছে। ছোটু ইউনিভার্সিটীতে ঢুকলেই চলে যাবে। আব্বাসকে সালাম দিয়ে হাত মিলিয়ে গাড়ীতে উঠে চলে গেল ওরা। এমন দায়িত্বশীল মেয়েকে কী করে খারাপ বলে লুনা!
তবু ভাবনাটা কুরে যায়, সাজনীন কি বিয়ে করবে এ ছেলেটাকে? কিম্বা আসিফ? হয়ত করবে অথবা করবে না। লুনা বোঝে, বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
রাতের অর্দ্ধেক সময় এখন দোলনাতেই কাটিয়ে দেয় সে। অন্ধকার ফিকে হয়ে ভোরের গন্ধ ভেসে আসে। আজানের আগে মুয়াজ্জিনের নিঃশ্বাসের শব্দে মসজিদের মাইকটা খড়মড় করে কড় কড় শব্দ করে বেজে ওঠে। লুনা তখন বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে, আবার আসে না। ওদিকে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে আব্বাস। ঘুম যদি বেলা এগারোটাতেও ভাঙ্গে আব্বাস ঠিকই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে যায়। প্রথম প্রথম ঠাট্টা করলেও লুনা বোঝে আব্বাস ওর অবসর জীবনটাকে সাজিয়ে নিয়েছে। লুনা পারছে না। মাত্র একষট্টি বছর বয়সে বাসী ফুলের মত লুনা জুবুথুবু হয়ে যাচ্ছে।
ইশকুলকালের বান্ধবী টাটুম ডেকেছিল বহুবার, লুনা আয়। আমরা ইয়োগা ক্লাশ করছি আর কোভিড হারামজাদার জন্য বেকার হয়ে পড়া পরিবারগুলোতে রান্না খাবার দিয়ে সাহায্য করছি। ছাদের ওপর নিজেরাই রান্ধিবাড়ি। আয় আমাদের সাথে।
ইচ্ছা করে ছুটে যায়। কিন্তু কি যে আলস্য ওর মনে। কোন দিন মন নড়ে ত শরীর নড়ে না। আবার শরীর নড়লে মন সায় দেয় না। তাই মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে অংশ নিচ্ছে ওদের সাথে।
টাটুম মুখ খারাপ করে গালী দিয়েছিল, কয়লাখাকী আলসে রাক্ষুসী দেখিসনে তোর হাড়মুচমুচে ব্যারাম হবেনে। ঘুণে খাবেনে তোর শরীর। মরবি যখন সবার আগে পোকা ধরবেনে তোর ডাঁট দেখানো দুই বুকে। শোন শূয়ারনী তোর উন্নত বুক আছে বটে কিন্তু উন্নত বোধ নাই। যা তুই আফগানিস্তানে চলে যা হারামজাদী।
মাঝে মাঝে ধড়ফড় করে উঠে বসে বিছানায়। আব্বাস বিরক্ত হয়। রাগে গর্গর্ করে, আর কত পাহারা দিবি লুনা? পারলি আটকাতে? না আমাকে না তোর মেয়েকে!
আপেলের খোসার মত ধীরে ধীরে পচে যাচ্ছে ওর মন। আব্বাসের বন্ধু জুবেরী ভাই আর ভাবী প্রবাস থেকে নাতীকে নিয়ে ছবি দিয়েছে ফেসবুকে। ওদের মেয়ে সিঙ্গল মাদার। বিয়ের কথা বলায় মেয়ে নাকি জুবেরী ভাইকে বলেছে, আদম হাওয়া যে বিয়ে করেছিল তার প্রমাণ দেখাতে পারলে তখন ভেবে দেখব। এখন যাও ত বাবা। কাজ করতে দাও।
সাজনীনও কথায় কথায় বলত, কাজ আছে মা। তোমার মত আরামের পুষ্যি হয়ে বসে থাকলে ত চলবে না।
লুনা আহত হয়ে ফিরে আসৎ। সাজনীনকে যা বলতে চেয়েছিল, তা আর বলা হত না। কী বলতে চেয়েছিল, সেই ত পুরনো গীত, একত্রিশ হতে চললো, বিয়ে কর বিয়ে কর। …
রুখসানা কাজল
শৈশব কৈশোর মধুমতী নদী বাহিত গোপালগঞ্জ শহরে।
পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। পেশায় শিক্ষক।
প্রকাশিত বইঃ
কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ (ইত্যাদি প্রকাশনী), রুখসানা কাজলের অণুগল্প (অণুপ্রাণন প্রকাশনী), আহা জীবন (চিত্রা প্রকাশনী), জলের অক্ষর (নালন্দা প্রকাশনী), নুনফল গল্পগুলো (রসেবশে প্রকাশনী, পরিবেশক— খোয়াবনামা, প্রান্তজনের কথা, কলিকেতা)
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{রুখসানা কাজলের গল্প ‘‘নিউ নর্ম্মাল ধরিত্রী’’ [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}