ছবি ইণ্টারনেট থেকে
ক্যাম্পাসে গেলাম। সহপাঠী ইসরাত জাহান তানিয়ার সাথে দেখা হল। বলল, তুই তো ক্যাম্পাসের বিরাট তারকা, প্রথম আলোতে দেখলাম।
— তাই নাকি?
— হুঁ।
— আমিও দেখেছি।
গান-বাজনা করে ক্যাম্পাসে পৌঁছলাম। ঝুপড়ীতে হায়দায় ভাইয়ের দোকানে বসলাম। (ব্রিটিশ কাউন্সিলের দেয়া) ব্যাগটা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করল। ব্যাগটা কাঁধে আসার গল্পটা সবাইকে জানাতে হল। বামঘরানার ছাত্র সংগঠনের ছাত্রছাত্রীরা নাক সিঁটকালো বেশী। ক্লাসরুমে গেলাম। পরপর দু’টা ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম। ক্লাসে তানিয়া বলল, ‘”তুই যে ‘মানবসভ্যতার পরম বন্ধু’-এর ওপর লিখে দিলি, তা দিয়ে আমার মামাত বোন উপস্থিত বক্তৃতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। তোকে ধন্যবাদ জানিয়েছে”।
— আচ্ছা। তাকেও ধন্যবাদ।
আবার ঝুপড়ীতে গেলাম। ফজলুল কবিরী ও কন্থৌজম সুরঞ্জিতের সাথে দেখা। কবিতা-গল্প নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললাম। সৈয়দ সাখাওয়াৎ আসল। তাকেও সময় দিলাম। তিনজনই সাহিত্যচর্চ্চার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। সাখাওয়াতের কবিতা ভাল, মানবিক। ছাত্র ইউনিয়নের বলিষ্ঠ নেতা ও। দূরে দাঁড়িয়ে অথবা দাঁড়ানো রিক্সায় বসে তার বক্তব্য প্রায়ই শুনতাম। ল’ ফ্যাকাল্টির দিকে গেলাম। দেখলাম, বোর্ডে ওয়েটিং লিস্ট টাঙ্গানো। তাতে ছোটভাইয়ের ভর্ত্তি পরীক্ষার নম্বরটা পেলাম এবং উৎফুল্ল মনে স্টেশনে চলে আসলাম। ট্রেনে বসলাম। আমার মুখোমুখী বসল দুই ডালিয়া। একজন বাংলার ডালিয়া, সে সাহিত্যকাগজ ‘ধূপছায়া’র সম্পাদক মাহমুদ মনির ক্লাসমেট। আরেকজন চারুকলার ডালিয়া, সে ছড়াকার ও শিশু সাহিত্যিক সৈয়দা সেলিমা আক্তারের ছোটবোন। বাংলার ডালিয়াকে আমার ভালো লাগত। সে সাহিত্যের ছাত্রী এবং লিটলম্যাগ তথা সাহিত্যচর্চ্চার সাথে যুক্ত ছিল। দু’টার কারণেই পছন্দ হল তাকে। আর চারুকলার ডালিয়াকে নিয়ে কল্পনায় ডিঙী বাইত আইনের আবদুর রব সোহাগ।
খালি সিট পেয়ে জার্নালিজমের ছাত্র রিয়াদ এসে পাশে বসল। বলল, আপনি তো ক্যাম্পাসের উজ্জ্বল তারকা। গান লেখেন?
— লিখব, এখনও ঐচ্ছিকভাবে শুরু করিনি।
— ইসলামী গান লিখবেন?
— না। ইসলাম নিয়ে যাদের কাজকারবার, তারা লিখুক। হুজুররা লিখলে ভালো লিখবেন, বিতর্ক থাকবে না।
— কী বলেন, নজরুলও তো লিখেছেন!
— বিতর্কও আছে।
— কীসের বিতর্ক?
— ‘নবী মোর পরশমণি’ গানটা শুনেছ?
— হ্যাঁ, শুনেছি।
— ‘নবী নাম জপে যেজন সে তো দোজাহানের ধনী’। মুসলমানরা আল্লাহর নাম জিকির করে নাকি নবীর নাম জিকির করে?
— আল্লাহর নাম।
— ‘নবী নাম জপা’ মানে কি নবীর নামে জিকির করা নয়?
— ও আচ্ছা! বাংলাদেশে কেন যে দর্শন পড়ানো হয়! এটা ধর্মের জন্য হুমকিস্বরূপ।
— দর্শন ধর্মের জন্য হুমকি— ফালতু কথা। শোন কোন এক দার্শনিক বলেছেন, ‘দর্শনছাড়া ধর্ম্ম অন্ধ, আর ধর্ম্মছাড়া দর্শন পঙ্গু’। কী বুঝলে?
— একটু বুঝিয়ে বলেন।
— ধর্ম্মচর্চ্চার সময় দর্শন মাথায় না-থাকলে অন্ধবিশ্বাস চর্চ্চিত হবে, আর ধর্ম্ম না-থাকলে দর্শনচর্চ্চা থেমে যাবে।
— নবিজী সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
— আবারও তুমি…! হুজুররা ভাল বলতে পারবেন। তাদের কাছে সওয়াবের কথা পাবে। আমাদের জন্য রিস্ক থাকে। রিস্ক নিয়ে মানুষ ব্যবসা করে, ধর্ম্ম করে না। লালন নিয়ে কথা বললে কোন রিস্ক থাকে না, উপযুক্তভাবে লালনকে বর্ণনা করতে না পারলে গুনাহেরও বিধান নেই। যা নিয়ে কথা বললে কোন রিস্ক থাকে না, তা নিয়েই বলি।
— আচ্ছা, লালনকে নিয়ে বলেন।
— লালন যত কালাম লিখেছেন সবগুলোতেই নিজের নাম যুক্ত করেছেন। ফলে এগুলো গানাকারে গাওয়ার সময় বিনয়ের সাথে তাকে স্মরণ করা হয়। এটাই স্বাভাবিক। অতীতে মহাপুরুষরা অনেকেই স্মরণীয় হওয়ার জন্য নিজের রচিত গ্রন্থে লাইনে-লাইনে নিজের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
— লালন ‘কালাম’ লিখেছেন না ‘গান’ লিখেছেন?
— লালন কোন গান লিখেন নাই, যা লিখেছেন— কালাম, গানাকারে গাওয়া হয়।
— আপনার সাথে সময় নিয়ে বসব। আপনার কাছ থেকে কিছু শেখা যাবে। ধন্যবাদ।
— তোমাকেও ধন্যবাদ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে আমাদের সময়ে কেউ কেউ বড় মাদরাসা বলত। কাগজে-কলমে ঠিকই আছে, আদতে এটা মাদরাসাই। গুটিকয়েক শিক্ষকছাড়া বেশীরভাগই শুধু চাকরী করেন, তাদের আলোকিত ও নিজেকে-জানা মানুষ তৈরীর এজেণ্ডা বা মোটো নেই। গ্রাম থেকে আসা ছাত্রের পাঠশেষে কোথাও-না-কোথাও চাকরী জোটে, কিন্তু গ্রাম্যই থেকে যায়। শহরের ছেলেরা— তারাও পাঠশেষে চাকরী বা কিছু একটা করেন। বউ-বাচ্চা, মা-বাবা এইসব নিয়ে পশুর সংসার চালিয়ে যায় (মানুষের স্তর তিনটী— শিশু, পশু ও যিশু)। তাদেরও নিজেকে-জানা বা আত্মসাধনায় সত্যসন্ধান করার মানসিকতা শূন্য থেকে যায়। ফলে সবার মাথায় পুরাতন রেকর্ডই বাজে। সেই জায়গা থেকেই প্রশ্ন করে এবং অনুকূল জবাব আশা করে। জবাবটা যদি তৈরী করা আদর্শের বিপরীতে যায়, হইচই শুরু করে দেয়।
যা হোক, ষোলশহর স্টেশনে নেমে গেলাম। বাসায় চলে আসলাম।
[১২ মার্চ, ২০০৬ | রোববার
সল্টঘোলা-রেলক্রসিং, বন্দর, চট্টগ্রাম।]
সবুজ তাপস
প্রকাশিত বই : সবুজ তাপস (কাব্যগ্রন্থ)।
সম্পাদনা : সাহিত্যকাগজ ‘ঢেউ’, ‘চেরাগী আড্ডা’।
দর্শনচিন্তা : দৃষ্টান্তবাদ।
জন্ম : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭।
শিক্ষা : সবুজ মিয়া নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দর্শন’ বিষয়ে অনার্সসহ মাষ্টার্স।
পেশা : শিক্ষকতা। প্রভাষক (দর্শন), ভাষা শহীদ সালাম মেমোরিয়াল কলেজ, দাগনভূঞা, ফেনী।
প্রচ্ছদ: মেহেরাজ হাসান শিশির
{সবুজ ডায়েরী || সবুজ তাপস [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}