ছবি ইণ্টারনেট থেকে
অধ্যাপক মহাশয় ভাবছেন, সাহিত্য ও ভাষা একই বিষয় না! …
ইহা
ভুল ভাবনা! …
কারণ, সাহিত্য ও ভাষা পরস্পরের পরিপূরক, না হলে সাহিত্য করার জন্য আপনি ভাষাকে বেছে নিয়েছেন কেন? … মানুষের (উদ্ভাসিত) নৈমিত্তিক জীবন যাপনের যে ভাষ্, সে ভাষ্-এর আধার ভাষা। এই ভাষা/প্রকৃতিই ধারণ করছে, ভাষ্ ক্রিয়া/প্রত্যয়কে। অর্থাৎ আপনি যা বলছেন/করছেন তাহা ধারণ করছে ভাষা/প্রকৃতি।
সবুজপাতা, আমি আপনাকে ভালবাসি!— এই বাক্য ধারণ করেছে সবুজপাতার প্রতি আপনার অনুভুতিমালা!
এখন ‘সবুজপাতা, আমি আপনাকে ভালবাসি!’ এই বাক্যটা লিখতে গিয়ে আপনি যদি বানান ভুল করেন, তাহলে আপনার অনুভূতির প্রকাশ ভুল বার্ত্তা দেবে …
ভাষার রয়েছে প্রাকৃতিক সংগঠন কাঠামো, এই সংগঠন কাঠামো গড়ে ওঠে (উচ্চারিত কথার) অর্থের সংসারের ওপর ভর করে … বর্ণে বর্ণে শব্দের গাঁথায়, গাথায় … বাক্যে …
আমাদের উচ্চারিত বাক্ বাক্যে রূপ পায় শব্দের সাথে শব্দের সম্মিলনে। শব্দ রূপ পায় বর্ণের পর বর্ণের সম্মিলনে … বর্ণ হল অর্থ বরণকারী ধ্বনির রূপাধার! প্রত্যেকটা বর্ণের রয়েছে আলাদা আলাদা ধ্বনির অর্থসমবায়, যাহা (কারীর করণের) প্রাকৃতিক আচরণের ওপর নির্ভরশীল …
যেমন:
‘কাজ’ শব্দটার মাঝে তিনটা ধ্বনি আছে, যাহা হল, ক্ + আ + জ। এই ‘ক্ + আ + জ’ ধ্বনি ধারণ করে ‘করণ’ + ‘অস্তিত্ব’ + ‘জনন’ এই তিনটা অর্থসমবায়কে, এই অর্থ সমবায়কে ধারণ করে ‘কাজ’ শব্দটা।
মানুষের জীবনাচারে ধ্বনিতাত্ত্বিক ভাববিনিময়ের জগৎ থেকে বর্ণের বর্ণীল জগতে উত্তরণে আপনার মুখ থেকে উচ্চারিত ধ্বনির প্রথম ব্যাঞ্জন ‘ক’ হল কারী, মানে আপনি, নিজেকে জানান দিচ্ছেন। আপনি, অর্থাৎ কারী; যখন ক্রিয়া করেন তখন তাহা করণ, অর্থাৎ ক্। [আপনার ব্যাবহারই নির্দ্ধারণ করছে আপনার ক্রিয়ার পরিচয়, ক্ (করণ) করা ক (কারী)]। ক-এর সাথে যখন অস্তিত্ববাচক ধ্বনি ‘আ’ অর্থাৎ যে কাজ করছেন সে কাজের বিষয় বা আধার যুক্ত হয় তখন আপনি আর কারী (অর্থাৎ ‘ক’) থাকেন না, হয়ে যান করণ, অর্থাৎ ক্। করণ হয়ে আধাররূপী আ-এ প্রবেশ করে হন, “কা” অর্থাৎ করণের আধার! এই “কা” হওয়ার জন্য আপনি নিজের ক-এর পূর্ণরূপ ত্যাগ (সেক্রিফাইজ) করে হয়ে গেছেন ক্, আর কাজের বিষয় বা আধাররূপী “আ” পূর্ণরূপ ত্যাগ (সেক্রিফাইজ) করে হয়ে গেছে আ-কার (া), কা-এ আপনার ক-ও আছে, আ-কাররূপীর আ-ও আছে, মিলনমেলায় …
এই মিলনমেলায়, মিলনকলায় আপনার (ক), কাজের আধারের (আ) ও জননের (জ) থাকে যাহাতে, তাহা কাজ। এই কাজ— ক, আ, জ— যেন তিন পাগলের মেলা!
সহজভাবে বললে, কারীর জনন থাকে যাহাতে, তাহা কাজ। …
[ওপরে ব্যাবহারিত বর্ণের অর্থগুলো নেওয়া হয়েছে, (কলিম খান-রবি চক্রবর্তী বিরচিত) ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি থেকে, এবং পরের আলাপে যে সব বর্ণার্থ ব্যাবহার করা হবে, তা-ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি থেকে।]
এই ‘কাজ’ শব্দ-ই বরণ করছে, আমাদের জীবনের ‘কার্য্য’ প্রণালীকে, ‘কার্য্য’ শব্দটা ‘কাজ’ সম্পর্কিত, কেননা, কার্য্যদিবসে কাজ করেন … কায করেন না … কেন? এবং ‘কার্য্য’ সম্পর্কিত শব্দ ‘কায’ না হয়ে ‘কাজ’ হল কেন?
এই প্রশ্ন!
উঁকিঝুঁকিপরায়ণসময়ে আলাপ জমিয়েছিলাম, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাতত্ত্বের অনুরাগী রুবি বিনতে মনোয়ারের সাথে, সে আলাপন থেকে, কিছুটা উপস্থাপন করছি—
{কার্য্য: √কৃ + য (ণ্যৎ) – কর্ম্মবাচ্যে। বঙ্গীয় শব্দকোষ।
যাহা করা হয় বা করা যায় তাহা কার্য্য। কারী রয় যাতে তা হল কর। কর থেকে জাত কার। কার হল করার আধার, করণ থাকে এতে। সেই কার থাকে কার্যে। যাতে কার্য থাকে তাই কার্য্য।
কার্য্যকে চিনতে কর্ম্মকে চিনতে হবে। ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় কর্ম্ম হল কর্ মিতি মিত যাহাতে। কখন কর্ম্ম হয়? যখন কিছু করার উদ্দেশ্য থাকবে, সেই অনুযায়ী মনে মনে ছক কেটে কীভাবে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা যাবে তার একটা রূপরেখা দাঁড় করানো হবে, সেটা বাস্তবায়ন করতে যা যা উপকরণ লাগবে তার যোগান, এবং সেটা করার হাতিয়ার। সব মিলে ‘কর্ম্ম’ ব্যাপক বিষয়, এতে একাধিক মানুষ জড়িত থাকতে পারেন। এই কর্ম্মের একটা অংশ হল কার্য্য।
তাহলে কাজ কী? আমরা জানি কাজ ও কার্য্য একই বিষয়। কজ হতে জাত কাজ, কজ (cause) আমাদের নেই, আমাদের আছে কাজ। কজ হল কারীর জনন, যা cause হিসেবে ইংরেজীতে আছে, যার অর্থ কারণ। কারণ ছাড়া কাজ হয় না। যে কোন কাজ করার পিছনে কারণ থাকা লাগবে। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ মনে করেন, কার্য্য শব্দটার সাথে কাজ-এর উৎপত্তিগত কোন সম্পর্ক নেই, কাজ শব্দটা বাংলায় এসেছে ইংরেজী ভাষা-পরিবারের শব্দ কজ (cause) থেকে, যার অর্থ কারী জনন করে যে।
— রুবি বিনতে মানোয়ার}
‘কাজ’ অথবা ‘কায’, কোন্ বানানে লিখবেন, সে আলাপ এখানে না, ইহা ভবিতব্যে! এর বাহিরে একাডেমীর কার্য্য পরিচালনাকারী (ফার্সী) কার্য্যী (কার্য্যের গতিশীল আধার) বা কাযী (কাযের গতিশীল আধার) থেকে (বিচার করে যে) বিচারক শব্দে রূপ নেওয়া কর্ত্তাদের কোন বক্তব্য থাকলে আমরা শুনতে পারি। …
(কাযী শব্দটাকে এখন লেখা হয় কাজী, একইভাবে অতীতে (cause) কজ শব্দটা কয ছিল কিনা তা-ও ভাবার বিষয়! …)
আপাততঃ
কাজ ও কাযের দ্বৈরথ(!) উস্কানো থাক্ …
এখনকার আলাপ হল, এখন “কাজ” অথবা “কায” শব্দকে লেখার সময় আপনি যদি “কাজ” অথবা “কায” শব্দ থেকে (নির্দ্দিষ্ট) কোন বর্ণ বাদ দিয়ে অন্যকোন বর্ণ দিয়ে লিখেন তাহলে শব্দের অর্থের পরিবর্ত্তন হয়ে যাবে, এবং ধারণ করবে অন্য অর্থ, যাহা আপনার লিখিত শব্দকে ধারণ করবে না, যা আপনার বলাকে প্রতিনিধিত্ব করবে না …
যাহা ভয়াবহ!
কারণ এই যে, শব্দ তার প্রাকৃতিক অর্থ হারিয়ে ফেলবে, হয়ে যাবে (প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণের রঙবিহীন) আরোপিত রঙের সঙসারী, আরোপিত অর্থের সঙসারী। যাহা ভাষাবিজ্ঞানের বিপর্য্যয়ও! কোথায় কারীর জনন … কোথায় কারীর যাওয়ন … (য = যাওয়ন/যাওয়া)
শব্দের অর্থ বিকৃতিকে আরো বিস্তৃতভাবে বোঝার জন্য অর্থ বিকৃত অথচ চলমান এমন কয়েকটা শব্দকে উপস্থাপন করছি, যেমন: ‘নিরাপদ’ ‘বিপদ’ ‘সম্পদ’। প্রাকৃতিক আচরণের ওপর নির্ভরশীলতা সরে গিয়ে ‘নিরাপদ’ ‘বিপদ’ ‘সম্পদ’ এই শব্দগুলির যে বানান বিভ্রাট/অর্থবিভ্রাট হয়েছে তাহার অনুসন্ধানে তথাকথিত আধুনিক বানানবিশারদদের কলমের কোপ থেকে ভাষার গহীন অরণ্যে পালিয়ে বেড়ানো (প্রাথমিকভাবে) ‘নিরাপত্তা’ ‘বিপত্তি’ ‘সম্পত্তি’ এই শব্দগুলোকে সামনে আনা যাক, এবং (তাহাদের উৎসের সন্ধানে) প্রশ্ন করা যাক—
প্রশ্ন— ১
‘নিরাপদ’ শব্দের সাথে কি ‘নিরাপত্তা’ শব্দের সম্পর্ক আছে? যদি থাকে ‘নিরাপত্তা’ শব্দের বানান ‘নিরাপদ্দা’ লেখা হয় না কেন? …
প্রশ্ন— ২
‘বিপদ’ শব্দের সাথে কি ‘বিপত্তি’ শব্দের সম্পর্ক আছে? যদি থাকে ‘বিপত্তি’ শব্দের বানান ‘বিপদ্দি’ লেখা হয় না কেন? …
প্রশ্ন— ৩
‘সম্পদ’ শব্দের সাথে কি ‘সম্পত্তি’ শব্দের সম্পর্ক আছে? যদি থাকে ‘সম্পত্তি’ শব্দের বানান ‘সম্পদ্দি’ লেখা হয় না কেন? …
না কি ‘নিরাপদ’ ‘বিপদ’ ‘সম্পদ’ শব্দগুলোর বানান অন্য রকম ছিল? …
হ্যাঁ। অন্যরকম ছিল। … ছিল, ‘নিরাপৎ’ ‘বিপৎ’ ‘সম্পৎ’। …
নিরাপৎ-এর সাথে ত্ + আ যুক্ত হয়ে ‘নিরাপত্তা’, বিপৎ-এর সাথে ত্ + ই যুক্ত হয়ে ‘বিপত্তি’ ও সম্পৎ-এর সাথে ত্ + ই যুক্ত হয়ে ‘সম্পত্তি’ শব্দগুলো তৈরী হয়েছে।
‘নিরাপদ’ ‘বিপদ’ ‘সম্পদ” না, ‘নিরাপৎ’ ‘বিপৎ’ ‘সম্পৎ’ শব্দগুলোর উৎস, পত্ ক্রিয়ামূল থেকে। পত্ হল পায়ীর ত্বরণ— প + ত্ = পত্ (পায়ী + ত্বরণ = পত্)। ত্বরণজাত তরঙ্গে যখন লম্ফন হয় তখন তাহা হয় ৎ (খণ্ড-ত)। ৎ (খণ্ড-ত)এর ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক মান হল উল্লম্ফন। পৎ হল পায়ীর উল্লম্ফন— প + ৎ = পৎ (পায়ী + উল্লম্ফন = পৎ)।
রূপতত্ত্বের আয়নায় দৃশ্যের আবহে দেখুন, খণ্ড-ত-এর রূপ, (ৎ)— যেন বা লাফানো সাপ, নৃত্যপর— যে কিনা কুণ্ডলী পাঁকিয়ে সাপের মতন শুয়ে থাকা (ত)-এর লাফানো রূপ!
এবার জেনে নেওয়া যাক, ‘নিরাপৎ’ ‘বিপৎ’ ‘সম্পৎ’ শব্দগুলো কী ভাবে সৃজিত হয়েছে—
সম্পৎ >
পৎ-এর সাথে ‘সম্’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে হয়েছে সম্পৎ, যেমন: সম্ + পৎ। (সম্পতে লাফঝাঁপ থাকে। যেমন: বিনিয়োগে ১০ টাকা বেড়ে ২০ টাকা হয়, ২০ টাকা বেড়ে ৬০ টাকা হয় … আবার বিনিয়োগের বিপর্য্যয়ও হয়— গ্রাফের ভাষায় যাহা, ৬০ > ৪০ > ০৫ … আজ আমীর তো কাল ফকীর!)
বিপৎ >
পৎ-এর সাথে ‘বি’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে হয়েছে বিপৎ, যেমন: বি + পৎ। (গতিশীল বহন থাকে যে পৎ-এ। এমনিতেই পায়ীর উল্লম্ফন, তার সাথে যুক্ত হল গতিশীল বহন, যা আরো ভয়াবহ অর্থাৎ বিপৎ!)
নিরাপৎ >
পৎ-এর সাথে ‘আ’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে হয়েছে আপৎ, যেমন: আ + পৎ। আবার আপৎ-এর সাথে ‘নির’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে হয়েছে নিরাপৎ, যেমন: নির্ + আপৎ। (গতিশীল না-করণ/অন-করণ থাকে যে পৎ-এ। অর্থাৎ আধারস্থ পায়ীর উল্লম্ফনকে গতিশীলভাবে না-করণ/অন-করণ হল নিরাপৎ! যার জন্য প্রয়োজন নিরাপৎ ত্বরণের আধার, নিরাপত্তা।)
{Google সার্চ্চ করলে
আপনাকে দেখাবে, সম্পৎ (সংস্কৃত শব্দ)। সম্পদ (বাংলা শব্দ)।}
আচ্ছা! …
এখন প্রশ্ন হল, সম্পৎ যদি সংস্কৃত শব্দ হয় তাহলে সম্পত্তি বাংলা সম্পদ হয় কী ভাবে? কারণ, সম্পৎ থেকেই জাত সম্পত্তি— সম্পত্তি সম্পৎ-এরই গতিশীল রূপ। এবং সম্পৎ সংস্কৃত শব্দ হওয়ার কারণে সম্পৎ থেকে ‘ৎ’ সরিয়ে দিয়ে ‘দ’ প্রতিস্থাপন (Re-place) করা হয় তাহলে তো সম্পত্তি শব্দেও ‘দ’ প্রতিস্থাপন (Re-place) করা প্রয়োজন।
আরো বড় প্রশ্ন, তাহলে বাংলা বর্ণমালায় ৎ কোথা থেকে এল? এবং ৎ-এর কাজ কী? বাংলা বর্ণমালায় যদি ‘ৎ’ না থাকত তাহলে বুঝা যেত, ‘সম্পৎ’ সংস্কৃত শব্দ, ‘সম্পদ’ বাংলা শব্দ!
তবে কি ‘সম্পৎ’ সংস্কৃত শব্দ, ‘সম্পদ’ বাংলা শব্দ! এই ব্যাখ্যা ভুল না? (ধানাইপানাই ব্যাকরণবিদগণের মাথায় কি এইসব প্রশ্ন আসে না?)
নাকি ‘সম্পৎ থেকেই জাত সম্পত্তি’ এবং একটা ক্রিয়ামূল থেকে যে অজস্র শব্দ (মালাময়) সৃজিত হয় তা জানেন না?
এইসব ব্যাকরণবিদগণ! ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতাবাদের মত শব্দস্বাতন্ত্র্যতাবাদে ভুগে শব্দকে শব্দের আত্মীয়তা থেকে মূলোৎপাটন করে শব্দসমাজে বিচ্ছিন্নতাবাদিতার বীজ বপন করে দিচ্ছেন।}
[প = পায়ী। ত্ = ত্বরণ। ৎ (খণ্ড-ত) = উল্লম্ফন।]
বাঙলা ভাষায় ত্বরণের উল্লম্ফন আছে এমন ক্রিয়ামূলক সব শব্দে ৎ (খণ্ড-ত) থাকে, যেমন: হৃৎপিণ্ড, পরিষৎ, আপৎ, ভবিষ্যৎ, উৎপাদন, উৎপাত, বিদ্যুৎ, ইত্যাদি… ইত্যাদি…
তথ্যের সমুদ্র পাড়ি না দিয়ে শব্দের আচরণের ওপর নির্ভর করে (হৃৎপিণ্ড, পরিষৎ, আপৎ, ভবিষ্যৎ, উৎপাদন, উৎপাত, বিদ্যুৎ এই সব শব্দে) উল্লম্ফন কী ভাবে হয়, তাহা দেখা যাক—
হৃৎপিণ্ড >
হৃৎপিণ্ড, যাকে ইংরেজীতে Heart নামে চিনি, যাহার অবস্থান বামবুকে। তো, হাত রাখুন বামবুকে— টের পাবেন, ধুকপুক, ধুকপুকানি … লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে জীবনের ক্রিয়াকাণ্ড…
পরিষৎ >
পরিষৎ হল ইংরেজীতে committee। যা বছরে বছরে পরিবর্ত্তন হয় … এই পরিবর্ত্তনের মাঝে আছে এক পরিষৎ থেকে আরেক পরিষতের লাফ। এখানেও লম্ফন।
আপৎ >
আধারগ্রস্ত পায়ীর লম্ফন। পায়ীর লম্ফনের আধারস্বরুপ লোকটা আপনার সামনে আসল, আর আপনি ভাবলেন, কোত্থেকে আপৎ এসে জুটল! আপৎ আগে ছিল না, এখন এসেছে। এই না থাকা থেকে থাকায় আবির্ভাবসময় লাফিয়েই এসেছে আপনার সামনে … যাহাতে আপনার আপত্তি, কারণ, লোকটা আপত্তিকর …
ভবিষ্যৎ >
জীবন বর্ত্তনশীল। বর্ত্তিতমানের সময়ে ভবিষ্যৎ লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে অনির্দিষ্টকালের গহ্বরে!
উৎপাদন >
পতিত মানবজমিনে ফসল ছিল না, এখন ফলিয়েছেন। অভাব থেকে ভাবের দোকানদার হলেন। তা-ও লাফ, অনুৎপাদন থেকে উৎপাদনে! ভাবের আদানে… প্রদানে…
উৎপাত >
অভাবের দোকানে ভাবের উৎপাদন দেখে শুরু হল দুধেভাতে উৎপাত। নবরূপে উত্তীর্ণন, উল্লম্ফন থাকে যে পাতে। অর্থাৎ, আপনার পাত (দুধেভাত) নবরূপে উত্তীর্ণন, উল্লম্ফনে উৎপাতকারীর হয়ে যাচ্ছে!
সংস্কৃত ও বাংলায় পার্থক্য করতে গিয়ে প্রচলিত ভাষাবিদরা পত্ ও পদ্ ক্রিয়ামূলকে গুলিয়ে ফেলেছেন। (মনে হয় না?)
যে ভাবে উত্(ৎ) ও উদ্ ক্রিয়ামূলকে গুলিয়ে শরবত করে ফেলেছেন!)…
উদ্ভিদে উদ্ (নবরূপে উত্তীর্ণন দান) থাকে। বীজ থেকে নবরূপে উত্তীর্ণন দানের গতিশীল বহনস্থিতি দাতা হল উদ্ভিদ! বীজ, নবরূপে উত্তীর্ণনের দানে মেলছে ডালপালা, সবুজের উৎসবে— উৎসবে উৎযাপনে থাকে উৎ (নবরূপে উত্তীর্ণনের উল্লম্ফন) এবং যাপন।
দান ধীর, লম্ফন ধীর না … উদ্ভিদ ধীরে বাড়ে, লাফিয়ে না … তাই উৎ না, উদ্ … আমরা উৎযাপন করি (নবরূপে উত্তীর্ণনের উল্লম্ফনে) লাফঝাঁপে … তাই উদ্ না, উৎ …
খাবার টেবিলে হরেক পদের খাবার দেখে পত্ পত্ করে খাওয়া শুরু করার পদ ও পত্ যে একই বিষয় না, তাহা আমাদের বলে দিচ্ছে শব্দের প্রাকৃতিক আচরণ ও ভিন্নতা।
এখন আপনি যদি এই পত্-ক্রিয়ামূলজাত কোন শব্দের বানান পরিবর্ত্তন করতে চান, তাহলে আপনাকে প্রথমেই পত্-ক্রিয়ামুলেরই বানান পরিবর্ত্তন করতে হবে, এবং অন্যান্য শব্দগুলোরও— এ-ও ব্যাখ্যা দিতে হবে আগের বানান কেন ভুল, এবং প্রস্তাবিত বানান কেন ফুল!
না হলে পূর্ব্বের সৃজিত শব্দ তার আচরণিক অর্থ হারিয়ে ফেলবে এবং ভাষার প্রাকৃতিক সংগঠনে নেমে আসবে বিভ্রাট, এসেছেও … প্রকৃতিপুরুষশাসিত বাংলা ভাষা হয়ে উঠছে প্রকৃতিবিহীন (আরোপিত) পুরুষশাসিত ভাষা। এই পুরুষশাসিত ভাষাতত্ত্বের ওপর ভর করে চলছে পুরুষশাসিত জীবনকাঠামো ও তার সাহিত্য এবং আমাদের মন ও মনন …
ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাতত্ত্বের জনক খান-চক্রবর্তীর মতে, সংস্কৃত ভাষা হল সংস্কারকৃত ভাষা। (কোন্ ভাষার সংস্কারকৃত?) তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন ভাষার সংস্কারকৃত কিংবা প্রমিতকরণ, বাংলাভাষারও … যাহা ছিল তৎকালীন উচ্চ (আর্য্য) জনগোষ্ঠীর ভাষা, কোন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর না! যার বিকাশসাধন হয়েছিল পাণিনির মত মহানদের হাতে।
বাংলার সম্পৎ-ই সংস্কৃতের সম্পৎ, অতএব আলাদা হতে চাওয়ার কিছু নেই, সংস্কৃতের ব্যাকরণ বাঙলার সম্পৎ! যে ইংরেজী ভাষা আজ শাসন করতে চাইছে, তার ব্যাকরণও ল্যাটিন ভাষার ওপর ভর করা।
পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষা একই উৎসজাত, সুতরাং আত্নীয়তার বন্ধন থেকে অহেতুক বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়া অনাত্মীয়তাসুলভ!!
আত্নীয়তার কিছু সূত্র:
বাঙ্গালীর উমা, দ্রাবিড়ীয় উমি, ব্যাবিলনের উম্মে, ল্যাটিনের উমে (অন্নপূর্ণা/শস্যদেবী)। (সূত্রধর : বাউলতত্ত্ব— ড. আহমদ শরীফ)।
কেবল, এই উমা-উমি-উম্মে-উমে না, উম্ (উম্মুল) ধ্বনিমূল জাত উম্মত, উম্মাহ্, উমাইয়া … এইসব শব্দও আন্তঃসাম্পর্কিক, উম্ কি মজা! তাই না?
আরো দেখুন, সংস্কৃতের নম্ ক্রিয়ামূল নমঃ, নমস্কার সম্পর্কিত, (ফারসী) নমায সম্পর্কিতও … সংস্কৃত রম্ ক্রিয়ামূল রমণ, রমণী, রম্ভা, রমণীয়, রাম, আরাম, হারাম, রামাদি, রামাল্লাহ… সম্পর্কিতও! ধ্বনিতত্ত্ব তাই বলে!
এভাবে চিরুনী অভিযান চালিয়ে দেখতে পারেন, আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিস্ময়ের পর বিস্ময় …
অতএব
বিভেদকরণ না, অভেদের যাত্রায় মনোযোগ দেওয়া যাক, সহিত হওয়ার সাহিত্যে বিভিন্ন ভাষার এই আন্তঃসম্পর্ক মানব জাতির জন্য আন্তর্জাতিকতার দিশারী…
ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে এসে শব্দতত্ত্ব/ভাষাতত্ত্ব নিয়ে বয়াণ করছি দেখে ভাবছেন, ধান ভানতে শিবের গীত কেন? …
শিবের গীত এই কারণে যে, শিব শব্দের উৎস √শব + ই (গতিশীল শব্) থেকে, এই শিব-ই শবের কারবারী, শ্মশানচারী। শব্ + দ (দাতা) = শব্দ। অর্থাৎ শব্ দান করে যে, সেই শব্দ, লিঙ্গুইষ্টিক শিবার লিঙ্গপুরাণ, শব্দপুরাণ!
শব্দের অর্থের ওপর নির্ভরশীল যে ভাষার জগৎ, ভাষার অর্থের ওপর নির্ভরশীল যে সাহিত্যের জগৎ, সে সাহিত্যের ভাষা (আপনার মন ও মননের কথারা) আপনার লেখ্ ও লেখায় বর ও বর্ণের বর্ণনায় বর্ণনায়িত হচ্ছে কিনা, ইহাই প্রধান বিবেচ্য! কারণ, এই শব্দবাহী ভাষার রঙীন জগতের ওপর ভর করে চলমান আমাদের সহিত হওয়ার আখ্যান, সাহিত্য। (সহিত্ + য = সাহিত্য!)
নৃত্যপর… লাফানো সাপের মত (ৎ)-এর ভাষিক রাজনীতি থেকে এবার আলাপ তোলা যাক, (একচোখা ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কলমের কোপে) বাঙলা ভাষার শরীর থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রকরণ ‘দ্বিত্ব’ (কিংবা পরম্পরার যোগসূত্র ও দ্বৈতসত্তার ভাষিক রাজনীতি) নিয়ে—
‘দ্বিত্ব’ কী? …
‘দ্বিত্ব’ হল বাঙলা ভাষার হারিয়ে যাওয়া ভাষিক প্রকরণ। বাঙলা ভাষায় শব্দের গঠন প্রনালীর নিয়মে যখন কোন শব্দে আবর্ত্তন বা রেফ্ চিহ্ন থাকে তখন সে শব্দের যে বর্ণের ওপর আবর্ত্তন বা রেফ্ চিহ্ন থাকে সে বর্ণের নীচে একই বর্ণের আরো একবার ব্যবহার করা হয়।
অর্থাৎ ‘দ্বিত্ব’ হল, একই বর্ণের যুগ্ম অবস্থান, যেমন: র্ম্ম, র্জ্জ, র্ব্ব … বিশেষ করে, কোন শব্দের বানানে বর্ণের ওপরে রেফ্ থাকলে একই বর্ণের দুইবার ব্যবহার হয়। যেমন: কর্ম্ম, ধর্ম্ম, অর্জ্জন, বর্জ্জন, পর্ব্ব, পূর্ব্ব … ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে অনেক শব্দে ‘দ্বিত্ব’ হবে না। যেমন: নির্জন, দুর্গা, বর্গ ইত্যাদি ইত্যাদি …
এখন, কোন্ কোন্ শব্দে দ্বিত্ব হবে, কোন্ কোন্ শব্দে দ্বিত্ব হবে না, তাহা নির্ভর করবে শব্দের স্বভাবের ওপর— এই স্বভাব কী ভাব বহন করে তার শরণ নেওয়া হবে পরে, তারও আগে শরণ নেওয়া যাক, রেফ্ কী, সে বিষয়ের।
রেফ্ হল, আবর্ত্তন।
আবর্ত্তন হল ঘূর্ণায়মান প্রক্রিয়া, যাহা পেছন থেকে প্রবাহিত (রিসাইকেলিং)। এই ঘূর্ণায়মান আবর্ত্তনে প্রবাহিত জীবন। …
রেফ্ = আবর্ত্তণ। অর্থটী আপনার আপনার কাছে উদ্ভট মনে হতে পারে! কিন্তু রেফ্ = আবর্ত্তণ। অর্থটী যে আরবিটারী না, বরং তাহা যে বর্ণের প্রাকৃতিক ক্রিয়া ও আচরণের ওপর নির্ভরশীল; যাহা বোঝার জন্য আমরা কিছু শব্দের ওপর পরীক্ষা নিরিক্ষা চালিয়ে দেখতে পারি, যেহেতু শব্দই ধারণ করে, অর্থ।
রেফ্ মূলতঃ ‘ঋ’ বর্ণ। এই ঋ বর্ণের (আবর্ত্তনমূলক) কহন পাঠ নেওয়া যাক, রুবি বিনতে মনোয়ার থেকে—
[‘ঋ’ বর্ণের অর্থ—
‘‘ঋ: এই বর্ণটির অর্থ অধিকাংশই অব্যক্ত। অনুমিত যে ঘূর্ণায়মানতার বা পুনরাবৃত্তিকরণের বা চক্রগতির ধারকই ঋ-পদবাচ্য। অ = অস্তিত্বলাভ, ই = অস্তিত্বের চলা বা গতিশীলতা, উ = অস্তিত্বের উল্লম্ফন বা নবরূপে উত্তরণ বা উদ্লোকে উঠে পড়া যাতে সত্তার অস্তিত্বের একটা অধ্যায় সম্পূর্ণ হয়, এবং ঋ = অস্তিত্বের নবরূপটিকে পুনরায় ঘুরিয়ে দিয়ে নতুন অধ্যায় বা পর্য্যায়ের সূচনা করা, যেখান থেকে পুনরায় অ-ই-উ পেরিয়ে অস্তিত্ব এগোতে পারে। এভাবেই অস্তিত্বের বিকাশ হয়। এটা হচ্ছে ঘূর্ণন, আবর্ত্তন, বা পুনরাবৃত্তিকরণ। ঋ-এর এই পুনরাবৃত্তিকরণ অর্থটী ল্যাটিন, ইংরেজী প্রভৃতি ভাষায় ‘re’ অর্থে ধরে রাখা আছে। সেজন্য ঋ হল যথেষ্ট গতিমূলক ও উগ্র-তেজ এর আধার।– বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’’।এই ঋ অধঃপতিত হলে ‘র (কেবল পুনরাবৃত্তিকারী, কারণ সে ক্রমাগত ঘূর্ণনে তার তেজ হারায়)’ হয়। এর আরেকটী রূপ হল রেফ্, যাকে নিকৃষ্ট (অমরকোষ) বলা হয়েছে। ইংরেজীতে এই ‘ঋ’ এর একটী অবনমিত রূপ হল re (re-make, re-turn ইত্যাদি।
‘‘ঋ: পূর্ব্বতনের পুনরাবৃত্তি করণ এবং পরবর্ত্তী অধ্যায়ে উত্তরণ করে যে; অথবা, আবর্ত্তন-গতি দান করে যে; কিংবা, পুনরাবৃত্ত করে যে; অথবা, পর্য্যায়গমনের বা আবর্ত্তনের ফল থাকে যাহাতে। জ্ঞান, ধন, স্বর্গ, বাক্য।
— সরল শব্দার্থকোষ’’।সাধারণতঃ এটা রি-র মত উচ্চারিত হয়। ঋ ব্যাঞ্জনবর্ণের সহিত যুক্ত হলে এর আকার (ৃ) এরূপ হয়। যথা— ক্ + ঋ = কৃ, গ্ + ঋ = গৃ। উদাহরণ: কৃষি, গৃহ। এর আরেকটী রূপ এরকম— হ্ + ঋ = হৃ, উদাহরণ: হৃদয়।
কাজেই ঋ আবর্ত্তন করে, পুনরাবৃত্তি করে; এরূপ আবর্ত্তন বা পুনরাবৃত্তির ফলে তার তেজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় সে তখন র হয়। এই র হল ঋ-এর অধঃপতিত বা অবনমিত রূপ, যা কখনও বর্ণের শীর্ষে রেফ্ হয়ে সক্রিয় হয়, যেমন: বর্জ্জন, অর্জ্জন; (রেফ্-কে বুঝতে হলে অর এবং অর-অন বুঝতে হবে। ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় অর অন থাকা মানে কাঁটা বেরিয়ে থাকা। যেমন মাটী ফুঁড়ে গাছ বের হয়, এই গাছগুলি যেন অর-এর মত)। আবার এই র বর্ণের নীচে ফলা হয়ে সক্রিয় হয়, যেমন: গ্ + র = গ্র, উদাহরণ: গ্রহণ, হ্রদ।
ঋ-ক্রিয়ার কাজ হল পুনরাবৃত্তি বা আবর্ত্তন। কোন বিষয়ে বার বার আবর্ত্তিত হলে বা পুনরাবৃত্তি করলে তাতে দক্ষ হওয়া যায়। ঋ পূর্ব্বতনের পুনরাবৃত্তিকরণ করে এবং পরবর্ত্তী অধ্যায়ে উত্তরণ করে, ঋ-তে আবর্ত্তনের ফল থাকে।]
ব্যাকরণিক পাঠ নেওয়া হল— এবার দেখা যাক, আবর্ত্তনমূলক (দ্বিত্বময়) শব্দ ও অর্থের সংসার— কলকলানি হাসির শব্দ ও অর্থে কর্ম্ম, অর্জ্জন, ধর্ম্ম, নির্জন, দুর্গা, বর্গ শব্দের নেপথ্য অর্থ অনুসন্ধান করা যাক—
কর্ম্ম >
ভাবছেন, কর্ম শব্দটী বানান ভুল করে লিখেছি, কর্ম্ম। না। বর্ত্তমানের ‘কর্ম’ শব্দ কিছুকাল আগেও কর্ম্ম লেখা হত। বিশ্বাস না হলে, “কর্ম্ম” লিখে গুগলে সার্চ্চ করতে পারেন, নতুবা, অভিধান দেখতে পারেন। তারচেয়ে ব্যাকরণিক/অভিধানিক উৎসের সন্ধানে সন্ধানিমননে মনে করুন, আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে কর্ম্মরত… এখন, অফিসে বসে যে কাজ করছেন, তাহা হল, আমদানী রপ্তানীর ঘোষণাপত্র (বা ডিক্লেরেশান পেপার) তৈরী।
এই ঘোষণাপত্র তৈরীতে আপনি যে রসদপত্র ব্যবহার করছেন, তাহা তৈরী করেছেন আপনার পূর্ব্বে অন্যজন, এবং তিনি আপনাকে যে রসদপত্র পাঠিয়েছেন, তাহা তৈরী করেছেন তাহার পূর্ব্বে অন্যজনের পাঠানো রসদের ভিত্তিতে … এবং আপনিও (পূর্ব্বের রসদপত্রের ভিত্তিতে) যে রসদপত্র তৈরী করছেন তাহার ভিত্তিতে পরবর্ত্তী রসদপত্রের কর্ম্ম করবেন অন্যজনের পর অন্যজন … এ ভাবে রসদপত্রভিত্তিক কাজটী আবর্ত্তন/ঘূর্ণন/রিসাইকেলিং অর্থাৎ এককভাবে না, সামাজিক/প্রাতিষ্ঠানিক কর্ম্মের ভিত্তিতে প্রক্রিয়াকরণ হতে থাকে … অর্থাৎ আপনার কাজের সাথে আপনার পরিপার্শ্ব জড়িত… ‘আপনি ও আপনার পরিপার্শ্ব’ এই হল দ্বৈত সত্তা, যাহা যৌথতাময় অদ্বৈতমে ধরা দেয়, ভাষিক সমাজতত্ত্বে, যার চিহ্নরূপ আবর্তন (রেফ্) এর নীচে আপনার মিতিকরণের এক ‘ম’ আর অন্যদের মিতিকরণের আরেক ‘ম’, যাহা যুক্ত হয় ‘কর্’ ক্রিয়ামূলের সাথে, যেমন: কর্ + ম্ + ম = কর্ম্ম।
অর্জ্জন >
আপনি যে কোন সূত্রে, অথবা কাজ করে ৫০০ টাকা পেলেন, সে ৫০০ টাকা থেকে খরচাদি বাদ দিয়ে আপনার কাছে থাকল ২০০ টাকা, আপনি করলেন কি, সে ২০০ টাকা বিনিয়োগ করলেন, অন্যকোন কাজে, যার থেকে আপনার আয় হল ৪০০ টাকা। এখন মূলধন ২০০ + ৪০০ = ৬০০ টাকা। এ ভাবে বিনিয়োগ বাড়ছে, সাথে মুনাফাও, চক্রবৃদ্ধিহারে …
এই যে
আপনার পূর্ব্বের ৫০০ টাকা অর্জ্জন বাবদ যে ২০০ টাকা বিনিয়োগ করলেন, সে অর্জ্জনের সাথে বর্ত্তমানের মুনফা/অর্জ্জন বাবদ আরো ৪০০ টাকা অর্জ্জন করলেন অর্থাৎ আপনার বর্ত্তমানের অর্জ্জনের সাথে আপনার পূর্ব্বের অর্জ্জন জড়িত, এবং বর্ত্তমানের অর্জ্জনের সাথে ভবিষ্যতের অর্জ্জন জড়িত … যাহা প্রবাহিত ধারা … আবর্ত্তিত … একবার পূর্ব্বের জনন, যার ‘জ’ আর একবার বর্ত্তমানের ‘জ’ যুক্ত হল আবর্ত্তিনমূলক রেফ্-এর নীচে, যেমন: র্জ্জ। বাঙলা বর্ণমালায় ‘জ’ বর্ণের বরণকৃত অর্থ, জনন।
অন্যভাবে দেখুন, আপনি মাছ ধরলেন পুকুর থেকে, মাছটা আপনার অর্জ্জন, মাছ ধরতে লেগেছিল, বড়শী। অর্থাৎ যে বড়শী দিয়ে আপনি মাছ ধরলেন, সে বড়শী বাজার থেকে কেনা, বিক্রেতা বড়শীর বিনিময়ে আপনার থেকে অর্জ্জন করেছিল টাকা, বিক্রেতা বড়শীটা যার থেকে কিনেছিল, অর্থাৎ যে বানিয়েছিল সে-ও বড়শী বানানোর উপকরণ সংগ্রহ করেছিল, তাহার অন্য উপার্জ্জনের ভিত্তিতে …
এই ভাবে দেখলে, আপনি দেখবেন, একজনের অর্জ্জনের সাথে আরেকজনের অর্জ্জন জড়িত, যাহা প্রবাহিত …
ধর্ম্ম >
মনে করুন, ইসলাম আপনার ধর্ম্ম। আপনি মুসলিম। আপনার বিশ্বাস, ধর্ম্মীয় মূল্যবোধ যা আপনি পালন করছেন, তাহা আপনার জন্মসূত্রে পাওয়া আপনার বাবা-মা থেকে। আপনার বাবা-মা পেয়েছে তাহাদের বাবা-মা থেকে, অর্থাৎ আপনার দাদাদাদী থেকে। এ ভাবে আপনাকে পিছনে যেতে হবে ক্রমশঃ
এবার অন্যভাবে দেখুন, কোরাণে আল্লাহ্ বলেছেন, আমি যুগে যুগে যেসব ধর্ম্মগ্রন্থ পাঠিয়েছি তার সর্ব্বশেষ সংস্করণ আল্ কোরাণ। অর্থাৎ পূর্ব্বজ ধর্ম্মের অস্তিত্ব ছাড়া আল্ কোরাণ অস্তিত্বহীন। (ধারণগত) ধর্ (ক্রিয়ামূল) পূর্ব্বের মিতিকরণে এবং বর্ত্তমানে আবারো আপনার ধর্/ধারণের ফলে মিত … তাই ধর্ + ম্ + ম … অর্থাৎ ধর্ম্ম …
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম্মের বাহিরে দেখুন, আপনি আপনার জীবন ধারণে (ধর্ ক্রিয়ামূলজাত) যে সব উপাত্ত ধারণ করছেন/মিত হচ্ছেন, সে সব উপদান পূর্ব্বে মিত হয়েছে (অন্যের) ধারণের ফলে … এবং পূর্ব্বের সে উপাদানও মিত হয়েছে তারও পূর্ব্বের ধারণের মিতিকরণের ফলে, ক্রমশঃ
অর্থাৎ অতীত বলে কই যাও, আমি আছি সাথে! আমাতে তোমার বিকাশ … তোমাতে আমার বিকাশ …
এইবার
রেফ্-এর নীচে অদ্বিত্বমূলক শব্দের বিন্যাস দেখা যাক—
নির্জন >
জায়গাটা নির্জন। নির্জন এই কারণে, এখানে জনমানব নেই, ফুল আছে, মৌমাছীর গুঞ্জন আছে, পাখীর কাকলি আছে … জনমানব কিছুক্ষণ আগেও ছিল, কোলাহলও। এখন নেই, আবার হতেও পারে …
অর্থাৎ এই নির্জনতার মাঝে কোন পরম্পরা নেই, নেই ধারাবাহিক প্রবাহ! তাই নির্জন শব্দে রেফ্-এর নীচে দ্বিত্ব হবে না, এই আবর্ত্তন একক, দ্বৈত সত্তার না।
দুর্গা >
দুর্গা দুর্গের আধার। দুর্গ লড়াইয়ের ক্ষেত্র।
ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল— এমন গর্জ্জনে বঙ্গবন্ধুর তর্জ্জনীর তর্জ্জনে বাঙ্গালীরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। যার ফলাফল বাংলাদেশ।
যেমনটা করেছিল দেবী দুর্গা। (অস্ ক্রিয়ামূলজাত) অস্ নবরূপে উত্তীর্ণন রহে যে অসুরে, সেই অসুররাজত্বকে পরাজিত করে দেবরাজ ইন্দ্রের রাজত্ব কায়েমে দুর্গের আধার হয়েছিলেন, তাই তিনি দুর্গা, দুর্গের আধার; দেবতাকুলের সহায়ক শক্তি। এই দুর্গ ও দুর্গার আগেপরের কোন পরম্পরা নেই। অর্থাৎ অতীতের কোন দুর্গ ও দুর্গার সাথে মহিষাসুর নিধনকারী দুর্গার সম্পর্ক নেই! তাই ‘দুগ্গা’ না, দূর্গা। (‘দুগ্গা! দুগ্গা!’ উচ্চারণ হল দেবীকে ভক্তের আবেগী ডাকের মুখের পেশীর সঙ্কোচনে শব্দের সঙ্কোচিত উচ্চারণ …)
বর্গ >
জ্যামিতিকজন বলেন—
[“চতুর্ভুজের চারটি বাহু ও চারটি কোণ পরস্পর সমান হলে তাকে বর্গ বলে। বর্গক্ষেত্র একটি সমবাহু চতুর্ভুজ; কারণ এর চারটি বাহু পরস্পর সমান। … আবার এটা একটি সমকোণী চতুর্ভুজ; কারণ এর সবগুলো কোণ পরস্পর সমান এবং প্রত্যেকটা কোণের পরিমাপ সমকোণ বা ৯০ ডিগ্রী।” — ইণ্টারনেট থেকে]
এখন, আপনি বর্গ আঁকবেন চার সমকোণের। এই “বর্গ” আঁকার পিছনে অন্যকোন বর্গের পরম্পরাগত ক্রিয়া নেই, প্রয়োজন হয়েছে, এঁকেছেন। পরে না-ও আঁকতে পারেন, এবং আঁকলেও বর্ত্তমানের বর্গের সাথে যাহা সম্পর্কিত না, তাই দ্বৈত সত্তার দ্বিত্ব “বর্গ” শব্দের বানানে হবে না, ছিলও না। …
এই যে, পিছন থেকে প্রবাহিত/সামগ্রিক আবর্ত্তন ও একক আবর্ত্তনের পার্থক্যমূলক আচরণের ওপর নির্ভর করে শব্দের যে (ব্যাবহারিক) বিজ্ঞান তার ওপর ভিত্তি করে ভাষিককাঠামোর যে শব্দতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব; তাকে বুঝতে না পেরে, অর্থাৎ কোন্ শব্দে দ্বিত্ব হবে এবং কোন্ শব্দে দ্বিত্ব হবে না, (পূর্ব্বপুরুষের) এই ভেদের বিজ্ঞান না জানা কসাইবৃত্তির হাতে রদ হয়েছে, ‘দ্বিত্ব’ অর্থাৎ বাঙলা ভাষার ভাষিক প্রকরণ।
এখন আপনি লিখছেন কর্ম, অর্জন, ধর্ম; কিন্তু করেছেন কর্ম্ম, অর্জ্জন, ধর্ম্ম। আপনার লিখিত কর্ম, অর্জন, ধর্ম শব্দের মাঝে কর্ম্ম, অর্জ্জন, ধর্ম্ম শব্দের অর্থ থাকে না, থাকে না পরম্পরার যোগসূত্র ও দ্বৈতসত্তার ভাষ্। কর্ম, অর্জন, ধর্ম শব্দের মাঝে থাকে একক সত্তার ভাষ্ … যে ক্রিয়া পেছন থেকে প্রবাহিত/একাধিক জনের দ্বারা সম্পাদিত, সে ক্রিয়া/কাজকে ‘বর্ত্তমানের’ একক আপনার বলে চালিয়ে দিচ্ছেন কর্ম, অর্জন, ধর্ম শব্দের মাঝে; যাহা একধরণের চোর্য্যবৃত্তি! …
এই চোর্য্যবৃত্তির ওপর ভর করে চলছে, আজকের মডার্ণ লিঙ্গুইষ্টিকের জগৎ ও মডার্ণিজমশাসিত (দশজনের ধন একজনে লোপাট করা) ধনতান্ত্রিক সমাজকাঠামো, যাহা দৃশ্যমান আমাদের চোখের সামনে, চলচ্চিত্রে … যার শাসনে শাসিত আমরা …
এর থেকে উত্তরণে আপনি পরম্পরাগত জীবনকাঠামোর কথা বলবেন? ঐতিহ্যের বিনির্ম্মানবাদিতার (উত্তর আধুনিক) সাহিত্য করবেন, সমবেত কণ্ঠস্বরের? সম্ভব না! কারণ, সে ভাষা আপনার নেই! ছিল। স্মৃতি করে দিয়েছন … এখন প্রয়োজন, তাহাকে ফিরিয়ে আনা, সেই আপনার দিশারী!
আমাদের ভাষার জগতে যত আবর্ত্তনমূলক শব্দ আছে সে সব শব্দকে ওপরে আলোচিত কর্ম্ম, ধর্ম্ম, অর্জ্জন, নির্জন, দুর্গা, বর্গ শব্দের আলোকে দ্বিত্ব-অদ্বিত্বমূলক ভাবে পরিশোধন করা যেতে পারে, এবং এই সূত্র ধরে আরো নতুন নতুন শব্দ সৃজিত হতে পারে …
ইহা না করে, আপনি এই (অর্থসংগঠন ভেঙ্গে পড়া) শব্দতত্ত্ব/ভাষাতত্ত্বের আলোয় পরম্পরাবাহিত ঐতিহ্যের বিনির্ম্মানবাদিতার যে (উত্তর আধুনিক) সাহিত্য করবেন, সে সাহিত্যের বয়াণ/ভাষ্, ভাষার রূপতত্ত্বে ধরে রাখে যে শব্দের জগৎ তাহা বর্ত্তমানের ভাষায় ধারণশীল না …
কর্ম্ম, অর্জ্জন, ধর্ম্ম শব্দগুলোকে কেন কর্ম, অর্জন, ধর্ম করা হল, তাহা, যাহারা এই বানান পরিবর্ত্তন করেছেন, তাহারা জানতেন না!
যদি তাহারা জানতেন, ‘কর্ম্ম, অর্জ্জন, ধর্ম্ম শব্দগুলোকে কেন কর্ম, অর্জন, ধর্ম করা হল’ এবং রেফ্ এর নীচে দ্বিত্বমূলক শব্দমালা থেকে দ্বিত্ব ফেলে দেওয়া হল তার ব্যাখ্যান আমরা শুনতে চাই, তাহাদের আজকের মানসসন্তানদের কাছ থেকে, একাডেমিক ফলোয়ারদের কাছ থেকে, যেহেতু অগ্রজরা নেই! …
আশাকরি, দায় এড়িয়ে যাবে না! এই চক্রব্যূহ থেকে …
বাঙলা ভাষায় ‘দ্বিত্ব’ কিংবা পরম্পরার যোগসূত্র ও দ্বৈতসত্তার ভাষিক রাজনীতিকে কখন হত্যা করা হল, তাহার সন্ধানে শরণ নেওয়া যাক শিশির ভট্টাচার্য্য রচিত, “নাপিত ও সার্জনের দৃষ্টিতে বাংলা বানান-সংস্কার” প্রবন্ধে। স্মরণে, পাঠ নেওয়া যাক—
[…………………………………………………
যে কোনো ভাষার বানান সংস্কারের ইতিহাসে কমপক্ষে তিনটি দল বা পক্ষ থাকে। প্রথম পক্ষ চায়, বানান হবে উচ্চারণের অনুসারী। সংস্কৃত ‘কর্ণ’ থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘কাণ’ শব্দটি মূর্ধর্ণ (ণ) বর্ণ দিয়ে লেখা যাবে না, কারণ বাংলায় মূর্ধণ্য (ণ) ধ্বনি নেই। রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু প্রমূখ আছেন প্রথম দলে। দ্বিতীয় পক্ষ চায়, শব্দের ব্যুৎপত্তি অর্থাৎ উচ্চারণের বিবর্তনের ইতিহাস ধরে রাখবে এর বানান। দেবপ্রসাদ ঘোষ, সুনীতিকুমারের পিতা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই দলে। শ্রী ঘোষ ‘কাণ’, ‘বাণান’ লেখার পক্ষপাতী ছিলেন। তৃতীয় পক্ষ চায়, বানান যেমন আছে, তেমনই থাকুন, কালের প্রবাহে যা বদলাবার বদলাবে। এই দলে আছেন গোলাম মুরশিদ ও মনসুর মুসা। এই তিন দলের দাবিই কমবেশি মেনে নিয়ে গত শ খানেক বছর ধরে বাংলা বানান বিবর্তিত হচ্ছে।সংস্কারবাদীরা নিদান দিয়েছেন: ‘খ্রীষ্ট’ ও ‘ষ্টেশন’ বিদেশি শব্দ বলে দন্ত্য-স ব্যবহার করে ‘খ্রিস্ট’ এবং ‘স্টেশন’ লেখা উচিত। কোন ভাষার উচ্চারণ অনুসৃত হচ্ছে এসব শব্দে, ইংরেজি, নাকি বাংলার? উচ্চারণানুগতাই যদি লক্ষ্য হবে, তবে ‘খ্রিশ্টো’ নয় কেন? সংস্কারবাদীরা বলেন, ‘কর্ণ’ থেকে ‘কান’ এবং ‘স্বর্ণ’ থেকে ‘সোনা’ হয়; কিন্তু ‘পদ্মা’ থেকে ‘পদ্দা’ বা ‘লক্ষ্মী’ থেকে ‘লোকখি’ হয় না, কারণ তৎসম শব্দে ‘পূর্বের বানান বহাল থাকিবে’। তাহলে ‘কার্ত্তিক’, ‘তর্ক্ক’ ইত্যাদি তৎসম শব্দে কেন ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হবে না, বিশেষত যখন বাংলার একাধিক উপভাষায় ‘কাত্তিক’, ‘তক্ক’ উচ্চারণ শোনা যায়? ‘সূর্য্য’, ‘ভট্টাচার্য্য’ শব্দে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব আছে মনে করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সংস্কারকেরা য-ফলা বাদ দেবার নিদান দিয়েছিলেন যা চোখ-কান বুজে মেনে চলছেন হালের সংস্কারবাদীরা। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সোৎসাহে এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে কলম ধরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এসব শব্দে আছে দুটি আলাদা ধ্বনি: য এবং য়। হায়! ধ্বনি আর বর্ণকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন ত্রিশের দশকের বাঘা বাঘা বৈয়াকরণেরা এবং তাদের (এবং আমাদের সবার) গুরু রবীন্দ্রনাথ। সংস্কারকদের একজন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পরবর্তীকালে এই মহাভুল কবুল করেছিলেন।
একটা শব্দ কত পুরোনো হলে সেটিকে আর ‘বিদেশি’ বলা যাবে না? ‘খ্রিস্ট’ বা ‘স্টেশন’ আরও কত বছর পরে বাংলা শব্দকোষে আত্মীকৃত হবে? একজন সাধারণ ভাষাব্যবহারকারী কীভাবে জানবে কোন শব্দটা তৎসম, কোনটা তদ্ভব, কোনটা বিদেশি? বহু পুরোনো এই প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করেছেন গোলাম মুরশিদ, প্রথম আলোতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রচনায়। প্রকৃতপক্ষে ‘বিদেশি শব্দ’ কথাটাই বিভ্রান্তিকর, কারণ বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম না মেনে কোনো শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হতে পারে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাংলা বা পৃথিবীর কোনো ভাষায় একটিও বিদেশি শব্দ থাকার কথা নয়।]
এই অযাচিত বানান সংস্কারের ফলে শব্দ হারিয়ে ফেলছে অর্থের বিজ্ঞান। যাকে হালাল করার জন্য তত্ত্বীয় প্রলাপ বাক্য ফাঁদছেন, মিনিং ইজ আরবিটারী!
যদি শব্দের নিজস্ব অর্থ না থাকে, তাহলে অর্থের নিজস্ব শব্দের প্রয়োজন কী? ‘আম’ বুঝাতে ‘জাম’ উচ্চারণ করতে পারি এবং লিখতে পারি! পারি না?! …
না। পারি না! …
পারি না এ কারণে যে, শব্দের/ভাষার রয়েছে (প্রাকৃতিক আচরণগত) নিজস্ব অর্থের সংসার। যেখানে সে সংসারী, প্রস্ফুটিত কথার কলকলানি হাসির শব্দ ও অর্থে! …
ভাষা মানুষের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে, মানুষ ভাষিক জীব।
কী ভাবে?
মনে করুন, আপনার সন্তান কবিতা পড়ছে, সে কবিতায় হঠাৎ আবিষ্কার করল, ‘কর্ম্ম’ ‘ধর্ম্ম’ ‘অর্জ্জন’ শব্দকে। অনুসন্ধিৎসু মনে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘কর্ম্ম’ ‘ধর্ম্ম’ ‘অর্জ্জন’ শব্দের বানান এমন করে বানানো হল কেন? …
তখন আপনি তাহাকে ‘কর্ম্ম’ ‘ধর্ম্ম’ ‘অর্জ্জন’ শব্দের একাধিকজনের পরম্পরাগত প্রাকৃতিক আচরণের ভিত্তিতে সৃজিত ভাষার গল্প শোনালেন …
এই শোনা … জানার ভেতর দিয়ে সে আবিষ্কার করবে নিজেকে এবং পরিপার্শ্বকে, দ্বিত্বময় জগৎ সংসারকে … সে একক (ব্যাক্তিক) শরীর সত্তার আমের গতিশীল আধার “আমী” না, সে হল আমি— আমের অংশ, আমজনতার আমি, আম-এর গতিশীল রূপ … এবং (ব্যাক্তিক) শরীর সত্তার আমের গতিশীল রূপও … যাহা প্রত্যয় … প্রকৃতি না … সুতরাং আমিত্ব গ্রহণযোগ্য না!
সে বুঝতে পারত, সমগ্রতায় তার অস্তিত্ব, এককেন্দ্রিকতায় না,
বলত না—
”মানুষ মূলতঃ একা”
অথবা
“আমাকে আমার মত থাকতে দাও
আমি নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছি”
…
এইসব বোধ আধুনিকতাবাদের/ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদিতার/ বিচ্ছিন্নতাবাদের/পুঁজির ব্যক্তিগত বিকাশের … যাহা মানুষের সামাজিকতার, আমতত্ত্বের, একান্নবর্ত্তী-পরিবার-তত্ত্বের (৪০ পরিবার …) প্রতিবেশিতত্ত্বের, (সমাজবাদিতার) ঝাঁকতত্ত্বের নন্দনকে অস্বীকার করে বিকশিত হয়েছে/হচ্ছে…
যার বিকারে দুষিত মানবসমাজ …
এই
একাবোধ/ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা/অধিকারী/আমিত্বকে প্রাচ্যের দর্শন বহু আগেই সন্দেহ করেছে।
অথচ আজকের অনেক সমাজবাদী (সমাজতত্ত্বের পতাকাবাহীরা!)
‘‘মানুষ মূলত একা’’
অথবা
‘‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও
আমি নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছি’’
এইসব বোধের সাহিত্যকে প্রতিক্রিয়াশীল না ভেবে কণ্ঠস্থ করে বেড়ায়… মঞ্চে মঞ্চায়ন করেন … আর লেকচার ঝাড়েন, সমাজবাদিতার …
কি নির্ম্মম স্ববিরোধিতা! তার সাহিত্য করার জন্য ভাষা নেই! সে লিখছে আমি, ভাবছে আমী (individual)।
এই (individual) ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ‘আমী’র সাহিত্যের জন্য যে ‘আমি’ শব্দের বানান ‘আমী’ লেখা উচিৎ ছিল, এই ভাষাজ্ঞানটুকু উদয় হয়নি সে সাহিত্যকলায়!
আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমি শব্দের অর্থ কী? উত্তর পাবেন, আমি শব্দের অর্থ আমি! অথবা কয়েকটা প্রতিশব্দ(!) বলবেন আমির, এর বেশী কিছু না। যদিও প্রতিশব্দ বলে কিছু নেই, একটা অর্থকে ধারণ করতে পারে তাহলে একাধিক শব্দের প্রয়োজন কেন? প্রতিশব্দ বলে যা চালানো হচ্ছে, তাহা আসলে এক সত্তার ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োজনে সৃজিত শব্দ। শব্দ থেকে অর্থ নিষ্কাশন পদ্ধতি যখন আপনি ভুলে যাবেন, তখন আপনার কাছে প্রতিশব্দ বলা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না! …
কিন্তু আপনার অনুসন্ধানী মন যদি আরো প্রশ্ন করে বসে, আমি = আমি হল কেন? ‘আমি’ শব্দ লিখতে আ, ম এবং ই বর্ণের ব্যাবহার করা হয়েছে কেন? তখন আপনার কাছে উত্তর পরিবেশন করবেন, আমিকে আমি বলা হয়েছে বিদায় আমিকে আমি বলছি আমরা, শব্দের নিজস্ব অর্থ নেই। …
অথচ মানুষের উচ্চারিত প্রতিটা ধ্বনির (ধ্বনিতাত্ত্বিক) অর্থ আছে, যাহা বর(ণ) হয়েছে বর্ণের অর্থে, জীবনের ভাষ্, শব্দে, ভাষায় …
আ ধ্বনির অর্থ অস্তিত্ব, ম্ ধ্বনির অর্থ মিতি। আ এবং ম্ ধ্বনির মিলনকলায় হয় আম্। সুতরাং আম্ হল অস্তিত্বের মিতি। ‘ই’ হল গতিশীল বা সক্রিয়ণ।
আমের গতিশীল রূপ হল আমি, যাহা প্রত্যয়রূপে, পুরুষরূপে সাধিত হয়। ‘আমি’ শব্দের কারিগররা আপনাকে আমের আধাররূপে, প্রকৃতিরূপে বিবেচনা করেননি, আমের গতিশীল রূপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন ভাষিক রাজনীতিতে, সামাজিক (আমসত্তার) রাজনীতির মঙ্গল সাধনে!
তাঁহারা জানতেন, আপনার আলাদা প্রকৃতিময় ‘আমী’ সামগ্রিক আমসত্তায় বিভাজন আনতে পারে!
‘আমি’র বন্দনায় আপনি উচ্চারণ করেছেন—
[আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’,
সুন্দর হল সে।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব, এ সত্য,
তাই এ কাব্য।
এ আমার অহংকার,
অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।
মানুষের অহংকার-পটেই
বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।
তত্ত্বজ্ঞানী জপ করছেন নিশ্বাসে প্রশ্বাসে,
না, না, না—
না-পান্না, না-চুনি, না-আলো, না-গোলাপ,
না-আমি, না-তুমি।
ও দিকে, অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা
মানুষের সীমানায়,
তাকেই বলে ‘আমি’।
সেই আমির গহনে আলো-আঁধারের ঘটল সংগম,
দেখা দিল রূপ, জেগে উঠল রস।
‘না’ কখন ফুটে উঠে হল ‘হাঁ’ মায়ার মন্ত্রে,
রেখায় রঙে সুখে দুঃখে।একে বল না তত্ত্ব;
আমার মন হয়েছে পুলকিত
বিশ্ব-আমির রচনার আসরে
………………]— আমি ||রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আবার সংশয়! সন্দেহে উচ্চারণ করেছেন—
[প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে—
কে তুমি?
মেলেনি উত্তর।বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়—
কে তুমি?
পেল না উত্তর।।]— প্রথম দিনের সূর্য || রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই হল, দার্শনিক সঙ্কট! … অথবা, সম্ভাবনা! …
এখন, ‘আমি’ শব্দের অর্থ না-জানা, আমী-ভাবধারী লোকটা সাহিত্য করবেন! কিন্তু কেন?
সে তো একা, মুক্ত! তবে সহিত্ যাহাতে থাকে সে সাহিত্য তো যুক্তাঞ্চলের বয়াণ— আয় তবে ঘুরি ঘুরি হাতে হাত ধরি ধরি …
মুক্ত হতে চাওয়া, আবার যুক্ত হতে চাওয়া, এই যেন হাস্যকর স্ববিরোধিতা! …
এতক্ষণ আমরা আলাপ করলাম, সাহিত্যের নির্ভরতা যে ভাষা, ভাষার নির্ভরতা যে শব্দ ও শব্দের নির্ভরতা যে বর্ণ তাহার প্রাকৃতিক (প্রকৃতিপুরুষময়) আচরণের যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে। …
ওপরি আলোকে দেখা যাচ্ছে, অযথাযথ ব্যাবহারে শব্দ ও অর্থের আন্তঃসাম্পর্কিক সংঘটন ভেঙ্গে পড়ছে … এবং শব্দ হয়ে উঠছে অর্থের সাথে সম্পর্কহীন ক্ষতবিক্ষত প্রকৃতি … হারিয়ে ফেলছে প্রাকৃতিক ধারণ ক্ষমতা …
ফলাফল—
আপনি যাহা বলছেন তাহা লিখছেন না, আপনি যাহা লিখছেন তাহা বলছেন না!
ছবি ইণ্টারনেট থেকে
এবার
মানুষের জীবন আচারের যে সাহিত্য তার শব্দ ও ভাষায় নরতন্ত্র পুরুষত্বকে এককভাবে নিজের করে নিয়ে কী ভাবে নারীকে পুরুষত্বহীন প্রকৃতি করে রেখেছ … তার কিছুটা আলাপ তোলা যাক—
যেমন:
‘‘ছাত্রী” শব্দটা একটা মেয়ের জন্য অপমানকর … যেমন: পাত্রকে গতিশীলভাবে ধারণ করে যে সে হল পাত্রী (পাত্র্ + ঈ)।
তেমনই, ছাত্রকে গতিশীলভাবে ধারণ করে যে সে হল ছাত্রী— (ছাত্র্ + ঈ) …
বিষয় কি তাই? আমার মনে হয়, না! …
কারণ, একটা মেয়ে শিক্ষালয়ে যায় শিক্ষাকে ধারণ করার জন্য, ছাত্রকে না … নর কিংবা নারী যে-ই শিক্ষালয়ে যাক না, সে শিক্ষার্থী।
এমন অজস্র শব্দ আছে,
যেমন:
দেবী = দেব-এর গতিশীল আধার। দেব হল, দিশাগ্রস্তন দান বহন করে যে, দেবীর কোন দেবত্ব নেই, বরং দেবত্ব ও দেবের ধারণশীলতার নাম দেবী— (দেব্ + ঈ)
প্রেমিকা = প্রেমিকের আধার অথবা প্রেম গতিশীল করনের আধার। প্রেম্ + ইক = প্রেমিক। ই + ক = ইক > গতিশীলকারী। যেজন প্রেম গতিশীল করে সেজন প্রেমিক, নর কিংবা নারী যে-ই হোক।
জনাবা = জনাবের আধার— জনাব্ + আ। যে জনাবকে ধারণ করে, নিজে জনাব (জনের অস্তিত্ববাহী) না।
ইত্যাদি… ইত্যাদি…
যা দিয়ে নারীকে (ভাষাভিত্তিক ধর্ষণ) শাসন করছে নরতন্ত্র …
বিকল্প শব্দ ভাববেন? ………….
যদিও বিকল্প শব্দের প্রয়োজন নেই, কারণ সবকিছুর লিঙ্গ বিভাজন প্রয়োজন নেই। সবকিছুতে লিঙ্গভেদ নরনারীর প্রকৃতিপুরুষ/পুরুষপ্রকৃতিময় সমতার জীবন কাঠামোর জন্য ক্ষতিকারক।
লিঙ্গবিভাজনহীন কিছু শব্দের উল্লেখ করছি, যেমন: ধার্ম্মিক, কর্ম্মী …
আমরা জানি, ধর্ম্ম + ইক = ধার্ম্মিক। একজন নর যে ভাবে ধর্ম্মকে গতিশীল করে একজন নারীও সে ভাবে ধর্ম্মকে গতিশীল করে, সুতরাং উভয়ে ধার্ম্মিক। বিপরীতে নর যদি ধার্ম্মিক হয়, আর নারী ধার্ম্মিকা হয়, তাহলে নারী আর ধার্ম্মিক থাকবে না, হয়ে যাবে ধার্ম্মিকের আধারস্বরুপ। বিষয় তাহা না, তাই নরনারী উভয়ের ক্ষেত্রে ধার্ম্মিক শব্দটা নির্দ্ধারণ করেছে ভাষাবিজ্ঞান। তেমনি কর্ম্মের গতিশীল আধার কর্ম্মী, কর্ম্মকে যে ধারণ করে, সে কর্ম্মী। …
তথাকথিত আধুনিক বানানবিশারদদের কলমের কোপ থেকে ভাষার গহীন অরণ্যে এই শব্দগুলো এখনো অক্ষত আছে, যাদেরকে অনুসরণ করে, আমরা পোঁছাতে পারি, (প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন ভিত্তিক) সমাজতত্ত্বের নতুন দিগন্তে— যে দিগন্তের শিল্পসাহিত্য হয়ে ওঠবে, বহুরৈখিক। বহুরৈখিক সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন বহুরৈখিক ভাষার বিন্যাস। একরৈখিক (তথাকথিত আধুনিক) ভাষাতত্ত্বের কলকব্জা দিয়ে বহুরৈখিক সাহিত্য করা সম্ভব না।
ক্ষমতা কাঠামোর ভাষিক রাজনীতি ইয়োরোপের ফেমিনিষ্টরা বুঝে ফেলেছিল বহু আগে, বর্ত্তমানের পুরুষশাসিত ভাষায় ফেমেনিষ্ট সাহিত্য করা সম্ভব না, ভাষিক কাঠামোর মৌলিক পরিবর্ত্তন ছাড়া।
এই বিষয়ে পাঠ নেওয়া যাক, রাশিদ আসকারী প্রণীত, ‘উত্তরাধুনিক সাহিত্য ও সমালোচনা তত্ত্ব’ গ্রন্থের নিবন্ধ “নারী ভাবনা : লৈঙ্গিক বিতর্কের প্রতিপাদ্য” (পৃষ্ঠা – ১১৬) থেকে—
“ভার্জিনিয়া উল্ফ তাঁর বীজগর্ভ রচনা A Room of One’s Own-এর চতুর্থ এবং পঞ্চম অধ্যায়ে বলেছেন যে, ভাষা-ব্যাবহার লৈঙ্গিকীকৃত হয়েছে, সে জন্য যখন কোন নারী উপন্যাস রচনায় প্রবৃত্ত হয় তখন দেখে যে, তার ব্যাবহারের জন্য কোন বাক্য নেই। মহান পুরুষ উপন্যাসিকেরা তাঁদের নিজের মত করে ইতোমধ্যেই একটি স্বাভাবিক গদ্য সৃষ্টি করেছেন যা দ্রুত কিন্তু সমর্থ নয়, অভিব্যাক্তিপূর্ণ কিন্তু মূল্যবান নয়।” …
পুরুষশাসিত ভাষায় ফেমেনিষ্ট সাহিত্য করা কী ভাবে সম্ভব না, তাহা ব্যাখ্যা করা যাক—
ধরুন, আপনি পড়ছেন, নারী-বাদের উপন্যাস “চিলেকোঠার ঈশ্বরী”। এই উপন্যাসের বিষয়ী আলোচনায় না গিয়ে শিরোনামের “ঈশ্বরী” শব্দটার দিকে আলোকপাত করা যাক— ঈশ্বরী শব্দের উদ্ভব ঈশ্বর শব্দ থেকে। ঈশ্বরী শব্দে ঈশ্বরত্ব নেই, আছে ঈশ্বরকে ধারণশীলতা। অর্থাৎ ঈশ্বরের গতিশীল আধার হল ঈশ্বরী। চিলেকোঠার ঈশ্বরী ঈশ্বর না, চিলেকোঠার ঈশ্বরের গতিশীলের আধার।
ভাবছেন, চিলেকোঠায় থেকে ঈশ্বরী রাজত্ব করছেন, ব্যাপার তাহা না, বরং চিলেকোঠায় থেকে যে ঈশ্বর রাজত্ব করছেন, ঈশ্বরী সে ঈশ্বরের আধারস্বরুপ! ভাষা তাহাই বলে। এখন আপনি যদি ভাবেন, ঈশ্বরী-ই রাজত্ব করছেন, সে ভাবনা শব্দের প্রাকৃতিক আচরণের বাহিরে, আরোপিত…
যদি নারীকে সেই চিলেকোঠার ক্ষমতাধর ভাবতে চান, তবে নারীকেও ঈশ্বররূপে ভাবতে হবে এবং ঈশ্বর ও ঈশ্বরী কেন্দ্রিক বিভাজিত ভাষারও পরিশোধন করতে হবে।
এখানেই সঙ্কট! অথবা সম্ভাবনা!
সঙ্কট এ কারণে যে, আপনি যে কথা বলতে চাচ্ছেন, তাহা বলার জন্য ভাষ্ আছে, ভাষা নেই! ভাষার সামাজিক/রাজনৈতিক দখল নরতন্ত্র (…) হাজার বছরের পথচলায় (এককভাবে) নিজের করে নিয়েছে। ভাষার সামাজিক/রাজনৈতিক ব্যাবহারে সে নারীকে শাসন করেছে, করছে …
আর এর থেকে উত্তরণের যে কোন প্রক্রিয়াকে নরতন্ত্র প্রতিহত করার জন্য, ধেইধেই করে আসবে! সুতরাং সংঘাত অনিবার্য্য!
আর সম্ভাবনা হল, এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে ভাষার নতুন বিন্যাস সৃজন করা! যেখানে থাকবে না নর-নারীর বৈষম্য!
নর একাধারে পুরুষ না, প্রকৃতিও। নারী একাধারে প্রকৃতি না, পুরুষও!
পুরুষ কী ভাবে প্রকৃতি হয়ে ওঠে আবার প্রকৃতি কী ভাবে পুরুষ হয়ে ওঠে! তাহা বোঝার জন্য (নর/নারী) লোকটার গতি ও প্রকৃতি বুঝতে হবে, বুঝতে হবে তার ভাষ্ ও ভাষা এবং তাহার সহিত হওয়ার সাহিত্য!
নারী-বাদী অভিমত না, প্রকৃতিপুরুষবাদী অভিমতে, ভাষার (নরনারী কেন্দ্রিক) অযাচিত ব্যাবহার নরনারীর অর্দ্ধনারীশ্বরময় মানবসমাজের জন্য অকল্যাণকর।
তবে
সাম্প্রতিক সময়ের কিছু পদক্ষেপ সে সম্ভাবনার পথে আশা-জাগানিয়া। যেমন: যেখানে একসময়, বাংলাদেশের সংসদে বিরোধী দলের প্রধান নারী হলে মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী বলা হত এখন সেখানে বলা হচ্ছে মাননীয় বিরোধী দলীয় নেতা, যে কোন সরকারী মন্ত্রণালয়ের নারী কর্ম্মকর্ত্তাকে (Madam) জনাবা না বলে (Sir) জনাব বলা হচ্ছে। …
কর্ম্মই নির্দ্ধারণ করছে আপনার পরিচয়, শরীর না!
এইসব
হয়ত আগামীর (নরনারীর লৈঙ্গিক বিভাজনের বিপরীতে) অর্দ্ধনারীশ্বরময় মানবসমাজ গঠনের ইংগিতবহ!
সহিত হওয়ার যে সাহিত্য, তাহা কেমন হবে, তা আপনার ভাষাই বলে দেবে! অতএব নযর দেওয়া যাক, ভাষিক পরিশোধনের দিকে …
না হলে, কোথায় চলছে জীবন? …-এর প্রকৃতিপুরুষময় ভাষ্ (পুরুষ) ও ভাষার (প্রকৃতির) আচারিক সাহিত্যের প্রস্তাবনা কেবলই বাহাস ও বাহ্! …
স্মরণ করা যাক—
বাঙ্গালী কথাসাহিত্যিক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বয়াণ— শিল্পসাহিত্য বিপ্লবকে দিক ভাষা, বিপ্লব শিল্পসাহিত্যকে দেবে মুক্তি। …
অতএব, সহিত হওয়ার সাহিত্যে (পিনাকপাণির ডমরু ত্রিশূলে নিনাদিত) শব্দই পরম ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়া যাক, প্রকৃতিপুরুষভাষাতত্ত্ব বিরোধীদের ভাষাতত্বের দুর্গে! …
মাভৈঃ … মাভৈঃ …
আরণ্যক টিটো
জন্ম—
জুন, ০৬, ১৯৭৭।
জন্মস্থান—
উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
[(শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে।]
প্রকাশিত কবিতার বই—
ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)।
প্রকাশিতব্য বই—
অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়াণ (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)।
সম্পাদক— চারবাক।
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
{ভাষা ও সাহিত্য [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}