গান্ধর্ব
বিবাহবিশেষে আজ নেমেছে ঘোরতর ঘনঘটা
মৃদুমন্দ আশ্বিনে তাই;
রাশি-রাশি ভিড় ঠেলে প্রকাশ্যে পাত্রী নিয়েছে
গোপনে আত্মসাতে ঠাঁই।
মাছির উপরে মাছ, মাংসও হাঁড়ি-হাঁড়ি
দধিতে লেগেছে তাপ, পোড়া-পোড়া মিষ্টিতে
মাতোয়ারা বিয়েবাড়ি।
বরের বেদনা- এইখানে গাফলতি, অনবধানতা
ত্রুটি আর বিচ্যুতি
লোক আসে গলি-গলি ভরিয়া প্রচুর
মরদ, মাতা আর ঝিয়ে
হাসে তারা অগভীর মনোযোগ দিয়ে।
ওদিকে পিতামহ গুলিতে বারুদ ঠেসে
পানে-পানে চাপাচাপি ঠোঁটেভরা রক্ত রসে
গাধায় চড়িয়া বসে- মারিবে মারার মতো ঠাসাঠাস
শেষ দৃশ্যে কী জানি কী হবে! কেউ কী বলিতে পারে
এ-গাধার মালিক চলতি ও অতীতে
কতটা গর্ধব ছিল এ-হেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে!
চিহ্নমেলা : দ্বিতীয় দিন
করো স্নান, পরে- শাড়ি ও সাধের টিপ
অগ্নির আঁচে ছুটে আসো সব কবি
আনন্দে আজ গেঁথে রাখো দুই হাত;
পথিকের পথে- বন্ধুকে বান্ধবী।
গ্রন্থিত হয়ে রুধিরের দাবানলে
পলাশের রঙে শ্যাওলায় এলে ভেসে
বনের মধ্যে হাজারো উন্মাদিনী
আমার জন্মে মৃত্যুকে ডাকো হেসে।
বর্ণের ভাঁজে বর্ণালী শত শত
লুকানো কিংবা বাহিরে দৃশ্যমান
মাদক-অন্ত মাতালের প্রলোভনে
সুর হয়ে বাঁজি তোমারই কণ্ঠে গান।
নীতির পাত্রে প্রীতিকে যুক্ত ক’রে
লক্ষণে চাও তোমাকেই দেখি খুলে
সু-পথে এমন বিনীত ভগ্নী তুমি
আগলে দাঁড়ালে হঠাৎ প্রশ্ন তুলে।
কী করি তখন, চিত্তে চড়েছে ভয়
সীমার মধ্যে সীমিত ধর্মে দেবী
কর্মে কর্মে কর্মকারকী হও-
বিনাশেই নাশ, লুণ্ঠিত হোক সব-ই।
নাড়ুয়ামালা
চিন্তা, চেতনা ও ইত্যাদি সাধন শেষে বহু কষ্টে কায়দা করে বসে আছে লোকটি আঞ্চলিক হাটের মূল মেরুদণ্ডের পাশে
হাট তো নয় যেন এক কারবালা! কঞ্জুষ, কিংবদন্তীর কিয়ামতখানা
কারণে, ধরনে হাজারো কারচুপির কৌশলে ছিটাচ্ছে কেবলই কায়া আর মায়া।
এই দেশে কাল আছে। যথা হেমন্ত ধরি যদি তারে
শীতেসিক্ত জানি সকলেই বসন্ত আসে তারপরে
এমনই হুকুমসিদ্ধ দিনের বর্গফলে
কোথা হতে ছুটে আসে একফালি কালাচাঁদ আগুনে বাতাস জ্বেলে
দুই হাতে কালোজাম খায় আর হাসে, মৃদু মস্করাতে
আমি তো হাটের মাঝি। ঘাটে ঘাটে দেখি, চলি ঘড়িতে সময়সূচি
এখন গোধূলিকাল। জাফরানে জাতিষ্মরে হলুদী হত্যায় ছেয়ে আছে মাঠ
ঘাটে থাকে সংশয়, সাবিত্রী, মাঠে থাকে মুগ্ধ সম্প্রদয়
কেউবা কিনেছে তারা হাতি একজোড়া। সাদা আর চকচকে। কাগজী কয়েন দিয়ে
ওপাশে বৈশাখে হারিয়েছে নাকফুল গোফুরের কোলে ওঠা মেয়ে
গরুর দামে কিনছে ছাগল হাজি আশরাফ মিঞে
মামার হাতেই মামীর মরণ মগজ ভাঁজতে গিয়ে
আজকে নগদ কালকে নগদ সপ্তাহান্তে কেবল বাকি রবি, মাইকে বলছে সব-ই
এই নিয়ে কুৎসা রটছে খুব। বেগুন দেখলেই ফুলে উঠছে গাল
মরিচে তো মাত্রাছাড়া পিত্তি হচ্ছে লাল
কবুতর বেঁচে লাঙল কিনবে এমনই সম্ভ্রমে
পকেট তো তার ফাঁকা আর ফালি ফালি মাথায় পড়েছে তাল
আমি গেছি নৌকা বেয়ে ইছামতির খাল
হাট ওঠে নিত্যদিন নদীর কিনারে ভেসে
এইঋতু হেমন্ত আজ কাহাতক ভোলা যায়!
যেহেতু বৈঠা আছে আমের, জামের হিজল কাঠের হায়!
ভুল হচ্ছে, ভিড় হচ্ছে, যুক্তিশূন্য যাদুর যাত্রাকালে
মাছ হাসছে জালের উচ্চদরে, শাকাহারী দেখে মাংস হতাশ চাকুর নিম্নস্বরে
কলা মুগ্ধ কোহিনূরের হাতে, তেল ক্ষিপ্ত তিলক জ্যাঠার ঠাপে
আরও আরও খয়ের খাতির, খাদ্য মিলছে কুতুবখানার র্যাকে
বাজির মধ্যে বাজ পড়ছে হাটুরে সব বৃষ্টিতে হয় স্নাত
কালান্তরের ঐ কালাচাঁদ মুচকি হেসে আগুনে ঢালছে আতর !
গানের কবিতা
তোমার দেশে যাচ্ছি আমি বন্ধু বিরামহীন
বন্ধ দুয়ার খুলে তুমি
ডাক পাঠালে অগ্নি-ভূমি
ঘুরতে ঘুরতে স্বপ্নে, জেগে রাতের পরে দিন।
যাচ্ছি আমি তোমার দেশে বন্ধু বিরামহীন ॥
ঝড়ের পরে ঝরণা যথা
আগুন হয়ে আলোকলতা
পাহাড় বনো পথের পাশে অবাক করা দিন
যাচ্ছি আমি তোমার দেশে বন্ধু বিরামহীন।
স্বপ্নে ঘোরা তোমার প্রেমে রাতের পরে দিন ॥
ফিরতি পথে অন্ধকারে
দেখছি ফিরে বারেবারে
আলোয় দেখা তোমার সে মুখ তিলেই উদ্ভাসিত
রঙের মাঝে অবাক করা অল্প অভিনীত।
অভিমানের আঁচল ঢাকা
মনহীনা রও মানুষ ফাঁকা
আঁকা-বাঁকা আকার দিয়ে দৃশ্যে আচ্ছাদিত
আলোয় ভরা তোমার সে মুখ নিত্য ধরা দিতো।
রঙের মাঝে অবাক করা অল্প অভিনীত ॥
অবশেষে তোমার দেহে বাজতে থাকা বীণ
টানছে আমায় শ্যাওলা পড়া খাতার মতো ঋণ
স্বপ্ন দেখে ঘুরতে ঘুরতে রাতের পরে দিন
যাচ্ছি আমি তোমার দেশে বন্ধু বিরামহীন ॥
কানকথা
নেমে আসছে চাঁদ হরণ করতে জ্যোৎস্নাকে
আমি বলছি, তুমি বলছো তাকে।
আমাদের কিছু বাতিক আছে ব্যাধির সমরূপে
আমি মানছি, তুমি ঢাকছো চুপে।
দেশের মধ্যে মহাদেশ আছে এই নিয়া হুলুস্থুল
আমি কাটছি, তুমি ছিঁড়ছো চুল।
বলে পণ্ডিত মাসের মধ্যে ঋতুরে দাও ভাগ
আমি টানছি, তোমার দড়িতে ছাগ।
খতিয়ান
খতিয়ানখণ্ড বগলে চেপে চলেছো কোথায়- হে বিদ্রুপ,
হে অন্ধকুমার; তৎপর এখনই
আমি তো জানি, যত হস্তের প্রসারিত অভিমান
কী করে যুক্ত করেছো সেথা; ফন্দী ও ফাত্নার রসায়নে।
এই যে মাটি আর মানুষ, ঘর ও ঘরণী- ধরো আরও
যতসব পরিত্যক্ত রন্ধনশালার অব্যক্ত কাহিনীর প্রবেশন
ফুটে আছে সেথা; দেশে-প্রদেশে বিবিধ তাম্রের তামাশায়।
কতসব আলতার উপকথা ভাসতে ভাসতে মিশে যাচ্ছে
মৃদুলা জলের মাঝে- কত না রুধিনীর আবেশে, এইবেলা
তুমি তো দ্রাক্ষাদায়িত- হে কর্মকারক, ওহে উচ্চ, হে বট
শ্রেণি ও শাসনের মহুরী।
তোমারই নিদ্রায় দেখো, জেগে উঠছে আজ কত মহাভূত
তাদের তর্ক ও তর্জনী- আজি তমালপত্রের ছায়ে বাহিত
কত কর্ম আর কলোনি!
একটি জীবন
বহনে- ভারের ব্যাখ্যায় কী মত পোষণ কর তুমি?
জানতে, সাধুসন্তের সান্নিধ্য ছেড়ে
আজ আমি ফাল্গুনী রাতের বিবিধ কোলাহল থেকে দূরে
স্তবকের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি;
একা, ধর্মীয় অবতার রূপে।
চারপাশে আমার চিত্রিত তরল,
পক্ষে-বিপক্ষে নানান সব টালবাহানার বরেন্দ্রভাষার উপকথা
তাদের রাগ আর রাগিনী, বাদ আর বাবরীর হুংকারে
ধুলোর বিচিত্রা হয়ে আছে প্রভূত অঞ্চল- মূলত এখন।
অথচ বাকলের ন্যায় গাছের গরবিনী হয়ে আছো
কণার কলঙ্ক হয়ে ডুবে আছো পদার্থে তুমি।
আয়ুর মধ্যে আয়োজন করা প্রাণ,
পারদ-তুল্য প্রেমিকার অভিমান
শুরুর সূচিতে, সমাপ্তির বিস্তারে আচ্ছাদিত হয়ে আছো
অতীব কৌশলে, বহনবাগিচায় ভিন্ন ভারের মুকুলিত ডালে;
পাতায়, প্রথাগত মুচকি হাসির তলে…
সমগ্র রচনাবলী
তোমাকে গোপন করি- আনুবাদে, সেহেতু বর্ষায়
প্রকাশিত করি- শ্রাবণে সরলরেখাগুলি
দু’হাতে আঁকড়ে ধ’রে নির্দেশিত লৌহধারাবলী।
আর তাকে যৌথ ভয়ে;
কিছু ভুল বন্যস্বাদে-
শিকারীর ন্যায় ভেবেছি অধিক।
শিবিরের তিনদিকে যদি আজ ভেসে ওঠো তুমি
বাঘিনীর রূপ ধ’রে- সীমাহীন শান্ত-স্বরে, বিনীত বাস্তবে।
ওগো বায়ু, মাতাল মৌসুমী ওগো পলাতক;
সেথা আমি অস্ত্রবিনা, ইতিহাসে শূন্য-সেনা
কী-দিয়ে রচিব ঘটনা- যদি না বাঁকের ব্যঞ্জনা
পথিকের গুণে ধেয়ে আসে ফের;
সেতুর সততা দিয়ে,
বালিকার পিছু পিছু- পথের রচনাবলী।
উত্তরাধিকার
( পথে-পথে ঘুরে, চাকা হয়ে যাওয়া সেই ছেলে : দ্বীপান্ত রায়হান )
তারও যে অন্ত দূর হতে গভীরে
হাওয়া করে হাহাকার; আমি তা জেনেছি
আজ ঘুরে, যথা- শহরের এই তীরে
কাহিনী ও কায়ায় সেথা কী করে বাঁচি!
বলেছো বালক, কোথা হতে তারপরে
কতটা রক্তে, কতটা সিঁদুরে ভর
ক’রে, এই যোগে যোগিনীর হাত ধ’রে
গেঁথেছো গৃহ, মিলনের তরে ঘর।
এপারে শহর মধু ও মন্ত্রে ভাসে
ওপাশে তোমার দীর্ঘ অন্ধকার
মাঝখানে শুধু অবারিত যায় আসে
কাহিনীর ন্যায় রেলের কথা ও তার।
ভূমির উপরে ভুবন রয়েছে সেথা
পাখির পরশে প্রবাহিত পাঠশালা
ঝরে পড়ে ঝড়, পাতা, হায়রে! অযথা
বাহিরে নয়ন, অন্তরে দিয়ে তালা।
তবুও তোমার বাসনার ব্যাধি শুনে
আমরা এসেছি ব্যাখ্যা বহির্ভূত
বোধের মধ্যে লুকানো একটি কোণে
রেখেছো চিত্র, বেলুনের রঙে সুতো।
বাতাসে তখন দুপুরের মৌনতা
এপাশে হিন্দু ওপাশে মুসলমান
হামলা মামলার পরিশেষে যৌনতা
কেন্দ্রে প্রেমিকার বাক্যে পড়ে টান।
এত-যে ঘটনা পাশকেটে উঁচুনিচু
পরিচিত সব প্রথা আর পরিবার
তোমারই মাঝে ঈশ্বর থাকে কিছু
বাকিটা চালায়- মৃত্যুতে সৎকার।
চক্রে-চক্রে আমাদের কথা বলা
তাহাদের প্রেম ফাঁসির স্বরূপে বাঁধা
সন্ধ্যার ন্যায় সীমিত আলোর ফলা
দৃশ্যে তখন জীবনে প্রথম কাঁদা।
এভাবে বিকেল সন্ধ্যার জলে মিশে
আকাশে তুলেছে সম্পাদিত ঐ চাঁদ
রুটি ও রুজির পথ খোলা আছে কীসে
চারিপাশে দেখি রাষ্ট্রের চোরা-ফাঁদ।
বুঝি না আমরা, তুমি ও আমার হিয়ে
তবু রাখি হাত গোপনে একটিবার
নতুনের টানে পূর্বেই ভেসে গিয়ে
পশ্চিমে আনি, ফিরে উত্তরাধিকার।
রাজা ব্যক্তিগত
রাজা ব্যক্তিগত, নিরোধক, প্রজা ও প্রথায় বিভাজিত
ফিকে যে প্রেমিক, তুমি তার মৌলিক সংক্রান্ত
রাজা সিদ্ধান্তের, শোকে ও সংকেতে, রাগে প্রজ্জ্বলিত।
লঘু সমর্থনে, আঁধারে রঙিন, ইতিহাসে যুগে যুগে
রাজা নির্বাচনে, গ্রহণে-বর্জনে, কাহিনীকেন্দ্রিক দৃশ্যে নিবেদিত
দিবসের সমাগমে মাত্র নিচু মদে বিনীত বাঁকের বিশেষণে
রাজা মনোনীত, প্রাচীন-প্রবীণ, চিরদিন আর নিদ্রাহত।
সমাহারে উচ্চাবচ, ব্যক্ত সারা দলে- জেগে থাকা ছিন্ন নকশালে
রাজা আরোপিত, সমগ্র জনকে, বহু ধর্মে সহজাত।
সমকালে ভাসা-ভাসা ছত্রে, নিরাপদে, বামে ও বাতিল ধারাতলে
অনুজ-অগ্রজ দুইতীরে আঁকাবাঁকা উদ্ভাসিত দীর্ঘ বাকশালে
রাজা বরাবর, রেখাচিত্রে, দেহের দ্রবণে নিয়োজিত।
সমবেত ভ্রান্তি, যুক্তি, যথা- আগামী আলোর বিকশিত টাকশালে
যেন ঊর্ধ্ব দিয়ে নিম্নে গড়া ধাতুর ধরণে নীতিগত।
বিশেষ্য-বিশেষণে তিনি সর্বহারা, স্থানে ও প্রস্থানে সবিনয়ে আন্দোলিত
রাজা সূত্রমতে, সময়-সূচিতে, মুখে মুখে আংশিক রঞ্জিত।
লেখকবৃত্তান্তঃ
শিবলী মোকতাদির
জন্মঃ ১১ জুন ১৯৬৯ বগুড়া, বাংলাদেশপ্রকাশিত গ্রন্থঃ
ধানের রচনা দিলে পত্রে (কাব্যগ্রন্থ)
ছন্দের নান্দনিক পাঠ (প্রবন্ধগ্রন্থ)
নিষিদ্ধ পুষ্টির কোলাহল (কাব্যগ্রন্থ )
সোনার কার্তুজ (কাব্যগ্রন্থ )
রৌদ্রবঞ্চিত লোক (মুক্তগদ্য)ফোনঃ ০১৭৫১-৫৮০৬২২
e-mail: kobi.shiblymoktadir@gmail.com