হেমাঙ্গসঙ্গীত
বাঁশপাতার ভারিক্কী গানের লগে তুমিময় বৃষ্টি প্রত্যুষে জেগে ওঠার গান গায় । করাতকলের উন্মাদ সঙ্গীত খণ্ড কার্বন মেঘের গর্জনমুখর ক্যানভাসে ডিস্কো বাজায় । সাইবারপথে আগুয়ান দূরের স্বপ্ন-মেঘের বন্দরে ফেলেছে নোঙর । ভাটিয়াল কন্যা দেখে মেঘের সীমানা ভেঙ্গে বরিষণ নামে, গান গায়-কতদূর নাবিক, পথের তলানি
ভাটিকন্যাগণ ছিলেন মশগুল পালতোলা নায়ের গান ও গল্পে । মেঘের কক্ষপথে দূরের স্বপ্নগানে আমরা তাদের পলল কপোলে এঁকে দেই রঙচঙ দিন । সন্যাসী চার্বাক মন মজাই দুর্বাবন বিছানায় । নাক ডুবিয়ে স্বেদস্বাধ মহুয়াগন্ধ গায়ে মেখে মেঘের ধারাপাত গুণি, কবিতাসুন্দর মেঘগুলো আমাদের কৈশরের জলজাঙালে গজিয়ে ওঠা সবুজ হিছা হাগের মতন নেশাতুর, স্বপ্নযাজক আমাদের দূরন্ত রাখালেরা গরুবারি রেখে পলাতক, বেদনার পালে তন্ময় রাত চিক চিক করে রূপালি দেখার হাওরে
ছনবিন্নার বন লাগোয়া হাইলখেতে এখন আর হেত্তেইত্তেই বাজেনা পাজুনের গুতায়, উড়াল বেগে মাতেনা বান্দা দামা
ট্রাক্টর কেড়ে নিয়েছে আমাদের হেমাঙ্গসঙ্গীত, পাজুন হেমইত আর ওকন চিনেনা সাইবার প্রজন্ম!
রুমালে বাঁধা কথাপ্রহেলিকা
বধুয়া রুমালে ফুল গাঁথে না, চৌকোণ ক্যনভাসে সুঁই-সুতোয় বুনেনা আবেগী কথা, তার চোখ আজ জলহীন জলের কান্তার, ‘কাছে থাকুন’ তাকে ঠেলে দিয়েছে দিগন্তদূর, খইফোটানো কথায় সে তবু কথাহীন একাকী আগুন ।
হাজার বছর দূর বধুয়ার চোখ; ধূসর স্মৃতি ঝিলিক দেয়-কৈশরের দুপুরে, ছায়াঘেরা হাসখেলা পুকুরে, অলস বারান্দায় ঝিমায় মনমুনিয়া । আহারে মন; উড়িগাছের বাইছনায় যুগল চড়ুইয়ের নাচে দোলে উঠে; আকদের পানের বাটায় ঢাকা চিত্রল রুমালে খুঁজে ফিরে নিজের মুখ ।
অবেলায় বৃষ্টি ঝরলে বধুয়ার চোখে ভাসে জয়নাখালিখালে আষাঢ়মাইয়া লাইখেলা দিন, অলস বিকেলে চ্যানেল ডুব দেওয়া মুহুর্তে তার হাপিত্যিস ওঠে আজ, জাবর কাটে নিষাদ; বধুয়ার মনে পড়ে ষোলঘুটির শিল্প, পাহাড়, নদী, দিগন্ত, মেঘ, ফুল ফল আর বিগত পৃথিবীর সবুজ সঙ্গীত ।
পাঠশালার বন্ধুর জন্য পাখি আর নদীময় আবেগী কথার ঢেউ একদিন এঁকেছিল বধু । বিজ্ঞাপন বিহীন সেইসব রুমালি দিন ছিল বড়ো রঙিন । কুয়াশার পাখায় উড়ানো কথার ঘরপালানো দুনিয়ার কথাপ্রহেলিকার ছিল না ধনুক টান ।
বধুয়া দেখে, বদ্বীপে নকল টাইগারের বেশে হানা দেয়া মুখ, বখা বাঙালবধুর শান্ত কপোলে বসিয়েছে বিনাশি কামড় ‘ভালবাসার টানে পাশে আনে’ ‘যেখানেই দিনবদলের চেষ্ঠা সেখানেই’…। নকল সূর্য মগ্ন বধুকে ডাকে ‘জ্বলে ওঠুন আপন শক্তিতে’…।
নবতর সওদাগরের বৈঠার টানে ভাঙছে নদী । মেঘরাঙ্গা রুমাল উড়ছে হাওয়ায় হাওয়ায় ।
দুঃখগীত
শষ্যবতী আমাকে গায়ে মাখো
ঠোঁটের সড়কধরে উড়াও
ভেজাও রোদ ও জোছনায়
তৃষ্ণায় কাতর পথিক
কতকাল খুঁজেনি পলল তীর ।
তীরের বেগে ছুটছে বিকেল
তোমার ধনুক শরির হয়ে-
বাঁকা নদীর মতো ঘুরে ঘুরে
নামছে গহীন রাত তোমার গানে
তোমার নামের গীতে উজালা
শারপিনের ওরস
ফকির-সাধকের ধ্যানপাঠ
নতজানু তোমার কায়ায়-
দিনের সীমান্তে দাঁড়িয়ে
ছায়া কুড়াই মেঘালয় পাহাড়ে
দীঘল ছায়ায় পাহাড় ঢেকে দেয়
সোনালি রোদের দুঃখ ।
উজানভাটির গান
ভাটিবতী, বুঝেনা প্রেমের সঙগীত
উজানের নাইয়া তারে কই লইয়া যায়-
সখিলো, আয় উজানের গান গেয়ে যাই
গাঙ্গেয় বদ্বীপে নাচে-গায় রঙিন রূপবান
তোলে ঢেউয়ের কাঁপন, খরায় খরায়-
রঙচঙ শাড়ি পড়ে ঘাসকন্যা ডাকে তুমুল ইশারায়
সবুজে লেগেছে বাহারি রঙ
ভাঙছে সুশোভিত শস্যময় তীর
সখিলো বিসখা আয়, শস্যঘ্রাণে মাতি-
হলুদের আভায়, গোধুলির মায়ায় করি সখাসখি
আয়, বিভূই প্রেমিকের লগে ধামাইলগীত গাই!
ভাটিবতি জানে কলিকালে
কারা লেনদেন ভাগাভাগি করে
কারা, পাথর ঘুম গরিমায় করে উজ্জ্বল?
হাওরের জাঙ্গালে গীত হয় রাধার ধামাইল
জানতাম শাওনবৃষ্টি হবে না আজও
ছইঅলা গস্তিনাওয়ের ভেতর পৌরাণিক বাউল
মজবে না করুণ মরমী সুরে
পাতালের মেয়েরা গাইবে না বাতাসের গান
দূরন্ত মেঘের মেয়েরা সব, শার্টের-
বোতামের ফোড়ে আঁকে সবুজ পৃথিবী
নতুন নাগর শোনায় পৃথিবীর ভুল সঙ্গীত
তারা ওড়ে তারায় তারায়-
বুক পকেটে বন্দি, বালিকাদের ঘুম
কামের গন্ধে নাক ডুবিয়ে তুমিও
হয়েছো দিশাহীন নৌকার মাঝি
মাতাল মদিরায় বর্ষার জলথৈথৈ
টাঙ্গুয়ার হাওরে তারাদের লগে
কার লাগি জাগিয়ো রাখো গোলঠাণ্ডা চাঁদ-
জানতাম তোমার নোনা কপোল ছুঁয়ে
অঝোর ঝরবেনা শ্রাবণ; শান্ত বরিষন শেষে
মদির ঘুম ঢেকে দেবে মেঘের শবদেহ
জেগে থাকি তবু, কাম ও ঘামে-
শোনি-
হাওরের জাঙ্গালে গীত হয় রাধার ধামাইল।
লেখকবৃত্তান্তঃ
১৯৮৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের মোহনপুর গ্রামে শামস শামীমের জন্ম । বাবা তৈয়ব উল্লাহ, মাতা মিসেস ফটিকজান বিবি । তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি ।
কবিতার সঙ্গে শামস শামীমের গেরস্থলি শৈশবেই । ২০০৭ থেকে বের করছেন ছোট কাগজ ‘জাঙ্গাল’ ।
শৈশবে বাবার কণ্ঠে শোনা পৌরাণিক পুঁথিকাহিনী এবং গ্রামীণ চারণ কবিদের পুঁথির ঢঙে লেখা গীতিকবিতার মাধ্যমেই কবিতার প্রতি মুগ্ধতা গড়ে ওঠে । আঞ্চলিক শব্দকে নতুন ব্যঞ্জনায় কবিতায় উপস্থাপন করে তিনি কবিতায় নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন । ঐতিহ্য আশ্রয়ী তার কবিতায় দ্রোহের স্রোত বয়ে যায় নিরন্তর । বাণিজ্যপ্রভু নয়া সাম্রাজ্যবাদের মুখে দ্রোহের লাগাম টেনে তিনি তার কবিতায় শানান চলমান সময়কে ।
একুশে বইমেলা ২০১০-এ প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই ‘পাতার পুঁথিঘর’ । বর্তমানে কবিতার পাশাপাশি তিনি হাওর ভাটির লোক উৎসব-পার্বণ বিষয়ে লিখছেন ।
ফোনঃ ০১৭১২৩২৯৯৯৭