এক
তোমার সামনে দাড়াতে চাই সমস্ত আবরন ছিড়ে
তোমাকে পেতে চাই সকল গোপন প্রকাশ করে
গুয়াহাটিতে আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনালে শিলচরগামী ডেসুপার বাসে উঠে সুমিত যখন দেখল আগে থেকেই সেখানে তার পাশের সীটে বসে আছে একটি তরুনী মেয়ে ,মুহুর্তেই সে আবিষ্কার করে ফেলল মেয়েটির সিথিতে সিদুর নেই, হাতে সাদা শংখ অনুপস্থিত। টিভি সিরিয়ালের শিল্প প্রতিভায় আধুনিক মহিলারা যদিও পরিধানে বেশ কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন ,তবু সে নিশ্চিত হল, মেয়েটি অবিবাহিত।গুয়াহাটী থেকে শিলচর আনুমানিক বারো ঘন্টার জার্নি হলেও রাস্তাঘাটের দৌলতে সে সংখ্যার বৃদ্ধি অতি স্বাভাবিক সহনীয় ব্যাপার এতদঞ্চলের লোকদের কাছে। এই দীর্ঘ বাসযাত্রায় পাশের আসনে একজন যুবক যখন পেয়ে যায় তার সমবয়সী বা বয়সে দু এক বছরের ছোট কোন তরুনীকে , তখন আশেপাশে মৃদুমন্দ বাতাস বইল কি না সে নিশ্চিত নয়, তবে পুনে থেকে বয়ে নিয়ে আসা উৎকন্ঠা আরেকটু বেড়ে গেল।
বাসের ডেকে ব্যাগটা রেখে মগজে বয়ে চলা অনিশ্চয়তার ডেকচিতে আবার একটু হাতাটা চালায় ।যে কোম্পানীতে গত তিন বৎসর ধরে লেগে আছে সেখানে মড়ক লেগেছে গত এক বৎসর থেকে ।কোম্পানী হয়ত তার ব্যাবসা একেবারে বন্ধ করবে না,কিন্তু কোন সময় যে কাকে ডেকে থ্যাঙ্ক ইউ বলা হবে, বুঝা
মুশকিল।কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানীর নতুন কান্ট্রি ম্যানেজার আসবে ।আর এতসবের মধ্যেই সুমিতের বাৎসরিক ছুটিটা মঞ্জুর হল।
কিন্তু সুমিত এক ধরনের সংকোচতা ও ভাললাগার দোটানায় পড়ে গেল।মুখশ্রী বা লাবন্য শব্দগুলো মনে পড়ে গেল,হয়ত হাইস্কুল পর্যন্ত বাংলা মিডিয়ামে পড়েছিল বলেই। সে ভেবেছিল বাসে টানা ঘুমাবে ,আর ঘুমালে অন্য বাসযাত্রীদের মত তার মাথাটাও যে কখন পাশের যাত্রীর কাধে ঝুকে পরে তা সে বলতে পারে না।এখন সারাটা যাত্রাপথ সচেতন থাকতে হবে ব্যাপারটা নিয়ে। এমনকী সিগারেট খাওয়ার অভ্যাসও তার আছে।যদি মেয়েটি সিগারেটের গন্ধ পেয়ে অভিযোগ করে বসে?
মেয়েটি সুমিতের দিকে চেয়ে কোনো কথা বলল না বরঙ আরেকটু গুছিয়ে বসল। প্রায় অর্ধশতক সুমিত যখন মেট্র সিটিতে কাটিয়ে ফেলেছে, তখন মেয়েঘটিত সমস্যা হচ্ছে কেন?কারন এই কি যে মেয়েটিকে যেন চেনা চেনা লাগছে, বাঙ্গালী চেহারার মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে ওর বাড়ী শিলচরও হতে পারে। পুনেতে দিন কাটে হিন্দি আর ইংলিশ,কখনো তাদের অপভ্রংশ ,কখনো তাদের মিক্সচার দিয়ে ।মেয়েটি নিশ্চই বাংলাতে কথা বলবে ? তার জন্যই কি মেয়েটির সাথে কথা বলতে মন আকুলি বিকুলি করছে?
একটি বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল একটি ফোন কলে। কলটা এসেছে মেয়েটীর মোবাইলে।সে ফোনটা রিসিভ করল,হ্যালো,কে?হ্যা, আমি নন্দিতা দত্তরায় বলছি।
ফোনটা কেটে গেল ,কিন্তু মেয়েটি মানে নন্দিতা, ফোনটা ঘুরাল না। এত লম্বা সময়ের জার্নিতে পাশাপাশি দুজন যাত্রী কি একটুও কথা বলবে না? মধ্যবিত্ত মানসিকতা যে মেয়েদের শুধু নম্র,ভদ্র হতেই শেখায়! তবে কি পুনেতে চাকুরিরত সুমিতকেই নিজেকে একটু আধুনিক ও আত্মবিশ্বাসী প্রমান করে নীরবতাটা ভাংতে হবে?
দুই
পুনেতে যখন সময় কাটত কর্মজীবনের দাসত্বে সুমিত সব সময় এই প্ল্যান করত যে ছুটিতে বাসায় গেলে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কাজ হবে ঘুমানো। বিশেষ করে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার কোনো টাইম টেবিল থাকবে না।যতক্ষন না নিদ্রা দেবীর ভাড়াঁর শেষ হচ্ছে , ততক্ষণ পর্যন্ত সে ঘুমাতেই থাকবে ।দুপুর বেলা খেয়ে সে আবার ঘুমাবে।বাসায় আসার পর দেখা যাচ্ছে এসব ভাবনাগুলো অর্থহীন । বরং সকাল সকাল ঘুম ভেংগে যাচ্ছে। এই বাসায় এখনো সবার আগে ঘুম থেকে উঠেন মা । সংসারে তার কত কাজ ! সে মা’কে বলতে চায় , তুমি অবসর নাও।
বাসা থেকে বেরিয়ে পরে হাটঁতে চলে যায় । এই ছোট্ট শহরে ভাল একটা পার্ক নেই যেখানে মর্নিং ওয়াক করা যাবে। এমনকী ভাল ফুটপাথ পর্যন্ত নেই । কিন্তু প্রতিবার শিলচর আসলেই মনে হয় সবকিছুর সাথ সাথে এই শহরও পাল্টাচ্ছে। চৌরঙ্গী , চার্চ রোডে অনেক আসাম প্যাটার্ন , একতলা বাড়ী ছিল। বেশীর ভাগই এখন রুপকথা । সেখানে দাঁড়িয়ে আছে চারতলা ফ্ল্যাট।
বড়ভাই এসেছে, অথচ রুপমের কোন হেলদোল নেই। সে তার চাকরিতে পারফরম্যান্স নিয়ে ব্যাস্ত ।বাবারও শুধু মতলবের কথা। চাকরিতে বেতন আবার কখন বাড়বে?টাকা পেয়ে শুধু খরচ করে উড়িয়ে দিও না,সঞ্চয় না করতে পারলে উপার্জনের কোনো মুল্য নাই।
ছোটবোন পুতুলের বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক। সেই থেকে কথা চলছে বড় ছেলেকে বিয়ে করানোর। এমনকী ছোট ছেলেরও তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে । যাই হোক আপাতত একজনকে বিয়ে করানো হোক । কিন্তু সুমিত এক কথাই বলে যাচ্ছে, আরো কিছু দিন যাক।
সুমিত যে বাড়ীতে এসেছে সে সংবাদ পুতুল পেয়েছে। যদিও সুমিতই ফোন করল। বিশেষ উতসাহের কারন বোনের ছেলে বাবাই।জানতে চাইল, পিচ্চি কি করে?
কি আর করবে? নাচানাচি ছাড়া কোনো কাজ আছে? ওকে সামলাতে গিয়েই আমাদের একাকার অবস্থা। পুতুল বলল।
নাচানাচি যখন করছে,তাহলে ভাল।
ভাল?
তার মানে মনে অযথা ডর নাই।মন্তব্যের তাৎপর্যকে বর্ননা করে। স্মার্ট হবে।ডান্স করতে পারবে, ডান্সের স্টেপগুলো সহজেই শিখে নিবে।
ধুর! ওপাশে যেন হালকা হাসির ঝিলিক।সন্তানের প্রশংসা প্রতিটি মায়েরই শুনতে ভাল লাগে।
একটু থামে সুমিত। লাইফ স্কিলস,সেলস স্কিলস ইত্যাদি বেস্টসেলার বইয়ের টিপস কি বোনের সাথেও ফলাচ্ছে?বাবাই যে একটু বেশীই দুষ্টূ, আর তাকে নিয়ে তার মা জেরবার,সে জিনিসটা গত বারও দেখে গেছে সে । পুতুলের শ্বাশুরি বলছিলেন , আজকালকার মেয়েরা কি আর এসব পারে? এখন বুঝি আমাদের মা মাসী আমাদের জন্য কত কষ্ট করেছেন।
তবে পুতুলের শ্বাশুরী থাকায় পুতুলের অনেক সাহায্য হচ্ছিল। তিনি যে খুব মাটির মানুষ তা নয় । কিন্তু নাতি পেয়ে , যে কিনা বংশের প্রদীপ , তিনি অনেক খুশী ।অতএব বাচ্ছাকে লালন পালনের অনেক দায়িত্ব তিনি হাসি মুখে সামলে নিচ্ছেন ।
পুতুল বলল, আচ্ছা , এসেছো ভাল কথা। এখন সংসারের দায়িত্ব নাও।
সুমিত কিছুক্ষন চুপ থাকে । সংসারের দায়িত্ব নেওয়া বলতে ছোটবোন কি বুঝাতে চাইছে?
পুতুল অপর প্রান্ত থেকে বলতে থাকে,বাবা মার তো এখন বয়স হইছে। তারা আর কত করবেন? আর আমার পক্ষে সম্ভব না সার্ভিস দেওয়া।
এ বাড়ীতে সুবিধা অসুবিধায় মেয়েকেই খবর দেওয়া হয়।তাই সুমিত মুখে কোন কথা না বললেও মনের ভেতর অনেক কথা মুখ তোলে। বুঝতে পারে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী পরিবারের বড় ছেলের প্রতি প্রত্যাশা।পড়াশোনা করে ভাল চাকরি করবে।তারপর একটা ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে করবে।তারপর একটা বা দুইটা বাচ্চা হবে, যারা আবার বিভিন্ন বিষয়ে ভাল হবে।তারপর একটা বাড়ী বানাবে,ভাল সুন্দর বাড়ী।তারপর আরো ভাল হবে যখন নিজেদের পরিবারের গাড়ী হবে।একসাথে ঘুরতে যেতে সুবিধা হবে।যেমনটি বিজ্ঞাপনে হয়।
সুমিত আয়নার সামনে দাড়ালে প্রতিবিম্বটি বলে,আমি হয়ত ভাল ছেলে হবার সমস্ত শর্ত পূরন করতে পারিনি।
তিন
অতএব মেজাজটা সে মার সাথেই দেখাল । তোমাদের শুধু একই গান। বিয়ে কর , বিয়ে কর । যেন বিয়েই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কাজ ।
তোর সাথের ওরা কি কেউ বিয়ে করেনি?ঠান্ডা মাথায় মা’র উত্তর।
কথা ঠিক। তবে বন্ধু বান্ধব যারা ছিল , বেশীর ভাগই রুটী রুজীর তাগিদে দেশান্তরী হয়েছে । কয়েকজন আছে যদিও এখানেই,ভাঙ্গা রাস্তা আর লোড শেডীংযের সাথে এডজাস্ট করে নিয়েছে।চাকরি পেয়েছে ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে,ফার্মা কোম্পানীতে , কয়েকজন শিক্ষকতায় যুক্ত হয়েছে। রাস্তায় পেরোলে পরিচিতদের সাথে দেখা হয় । যত দিন যাচ্ছে পরিচিত লোকের সংখ্যাও কমছে ,আর পরিচিত লোকেরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। বাবার আড্ডার প্রাক্তন সহপাঠী উল্টো দিকের গলির বাসিন্দা বিভাস কাকুকে দেখে মনে হল এ যে প্রমোশন পেয়ে দাদু চরিত্র হয়ে গেছে। রাস্তায় পেয়ে জানতে চাইলেন , কবে এসেছো?
হয়েছে কয়েকদিন।
তুমি তো এখন হায়দ্রাবাদে আছো ?
না কাকু , হায়দ্রাবাদে দুই বছর আগে থাকতাম । এখন পুনে আছি।
বার্ধক্যে এই এক বড় সমস্যা । স্মৃতি শুধু শয়তানি করে। পুনে আছো নাকি এখন?
হ্যা। গতবার যখন দেখা হল তখনও তো বলেছিলাম ।
ও।
ভাল আছেন তো?
আছি আর কি।উত্তর দেওয়ার চেয়ে প্রশ্ন করাটাই যেন বেশী গুরুত্বপূর্ন। তা বেতন কত পাও এখন?
সুমিত হাসল। কি বলবে সে? এই প্রশ্নটা বিরক্তির উদ্রেক করে। তবু বয়সের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে পরিবারের শুভাকাংখী ভেবে একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, কাকু আপনি এসব বোঝবেন না। শুধু বেতন দিয়ে সব চাকরি জাজ করা যায় না। আরো অনেক ব্যাপার আছে।
এতসব কথা হজম করার শক্তি থাকার কথা নয় বৃদ্ধ মগজে। তিনি তার কথাই বলে চলছেন , দাস কলোনীর কমলেশ বাবুর ছেলে থাকে দিল্লীতে। দিল্লীর গুরগাওতে। মাসিক বেতন এখনই প্রায় এক লাখ। বাচ্ছা পুলা।
সুমিত আবার অসহায় নিঃসংগ হয়ে হয়ে পড়ে।ফোন দেয় একাউন্টস ম্যানেজারকে,যে কাজটা আসার পর থেকে প্রতিদিনই করছে।
একাউন্টস ম্যানেজার জবাব দেয় দীর্ঘশ্বাসে।আউর ক্যায়া খবর?সব লোগ দিন গিনতি কর রহা হ্যায়।ম্যায় তো দুসরা জায়গা সিভি ভেজনা স্টার্ট কর দিয়া।
অজানা সমুদ্রে জীবন জাহাজকে টানতে একটু হলেও দিশা মিলে আরেকজন ভুক্তভোগীর কাছে।
কিন্তু সুমিত দেখল বাবা আনন্দে আছেন। কথা তিনি আগে থেকেই পরিচিত মহলে বলে আসছিলেন । এবার ভলিউম আরো বারালেন। ছেলে বিকম পাশ। কম্পিঊটারে ডিপ্লোমাও আছে । পুনে একটা কম্পানীতে একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে আছে।
সুমিত দেখল বাবার বয়সী আরো কয়েকজনের মনে বিয়ের বিষয়টা খুব মনে ধরেছে। তারা বাসায় আসতে লাগল। চা পানও দেদারসে বনতে লাগল। অন্যসময় কাজের ঠীকে ঝি ময়না বাসায় আসলে যাওয়ার জন্য হাসফাস শুরু হয়ে যায়, সেও আনন্দ সহকারে পান পুরছে মুখে।
অভ্যাগতরা যারা আসে তারা এক ফাঁকে সুমিতকে দেখেও নেয় । প্রবাসীর সাথে দু চারটা কথাও বলতে চায়।ওদের সাথে কথা না বলাটা বেয়াদবি হবে, তাই সে হাসে , জানে কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত লজ্জা আর বিনয়ের প্রকাশ হতে হবে পরিমিত । মাঝে মধ্যে শুনেও নেয় কি কথা বার্তা হচ্ছে।
-পুনে , হায়দ্রাবাদ এই সব শহরের লাইফস্টাইলই আলাদা।আমাদের মত কাচড়া না!
-এসব জায়গায় একবার গেলে কেউ আর আসতে চায় না।আসতে চাইবেই বা কেন?সেখানের তুলনায় বরাক ভ্যালী তো গাঁও বা জঙ্গল।
এতগুলো লোক যখন তাকে নিয়ে কিছু একটা আলোচনা করছে তার মানে তারা ওকে নিয়ে ভাবে। পুনেতে তো এক দঙ্গল অতি আত্নকেন্দ্রিক মানুষের জঙ্গলে বাস ,কেউ নেই একটু খেয়াল করার। আর জীবনে যখন প্রেম থেকে পরিনয় জাতীয় কিছু হলই না তখন কারো না কারো সাথে মালাবদল তো করতেই হবে। একটু একটু লজ্জা লজ্জাও লাগছে।
এর মধ্যে একজন লোক দুই দিন এসে পরিমলবাবুকে না পেয়ে তিন নম্বর দিন অপেক্ষা করতে লাগল। লোকটার পান খাওয়ার অভ্যাস বেশ আছে । এবং তার আগে বিস্কুট খেয়েছে চায়ে ডুবিয়ে ।তারপর বাকী চা টা শেষ করল।
পরিমলবাবুকে ফোন দেওয়া হল আসার জন্য। সেই ফাঁকে সময় কাটাতে সাহায্য করার জন্য সুমিত একটু কথা বলল।ঘটক শব্দটার মধ্যে কেমন একটা গ্রাম্য ভাব আছে ,ভদ্রলোক তাই বলছিলেন, ম্যাচম্যাকারের কাজও করি।
বিয়া তো বিয়াল্লিশ কথা না বললে হয় না । তবু এখন শর্টকাটে শেষ করি।সব মেয়ে পার্টির এক দাবী , ছেলে যেন ভাল চাকরি করে।
আরো অনেক কথা হল।ঘটক পেশাটা বেশ ইন্টারেস্টিং , আগে গ্রামাঞ্চলে তাদের নাকি উকিলও বলা হত!সুমিত প্রশ্ন করে বসে , আপনার সাকসেস রেট কেমন?
ম্যাচমেকার বললেন,কিছু বিয়া তো করিয়েছি।নাইলে লোকে কি আর ডাকত?
কথা বলতে বলতে ম্যাচমেকার অন্যপ্রসঙ্গে চলে যায়।একটা মেয়ের যখন বিয়ের প্রস্তাব আসে তখন মেয়েটির মনেও অনেক কল্পনা শুরু হয়ে যায়।মেয়েটা ভাবতে থাকে ওর স্বামী কি রকম হবে , ওই স্বামীটিকে নিয়ে ওর সংসার কি রকম হবে। এর পর যদি বিয়ে না হয় …
ঘটকের কথাগুলো হয়ত কাজকামের তুলনায় উচ্চমার্গের।কিন্তু সুমিতের মনে ভাবনা ছড়িয়ে দেয়।
পরিমলবাবুর মনেও বোধহয় এই কথাগুলোই সুপ্ত ছিল,বাসায় এসে ম্যাচমেকারকে দেখে মুখটা একটু সুখী সুখী হল। বললেন, আমার ছেলেকে আপনি দেখেছেন , এবং তার সম্বন্ধে জেনেছেন। এখন তার সাথে মানাবে এমন মেয়ে হলেই হল।
আলোচনায় মা ঢুকলেন,তাই বলে আবার কাউকে উদ্ধার করার জন্য এখান সেখান থেকে ধরে নিয়ে আসবেন না!
লোকটা হাসল।পরিমলবাবুকে উপলক্ষ্য করে তাকে আবার দ্বিতীয়বারে চায়ে আপ্যায়িত করা হল।
সন্ধ্যার দিকে পার্থ শহরে বেরোয়। সেদিনের কথাগুলো এখন গল্প, আগাম কিছু না জানিয়েই চলে যাওয়া যেত বন্ধুর বাড়ী ।গান্ধী ভবনে এসে দেখে একটা সংস্থার সাংস্কৃতিক অনুষ্টান চলছে। নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি মানুষের অনুরাগ সহজাত,সে দর্শকদের মাঝখানে ঢুকে চুপচাপ একটা সীট নিয়ে নিল।
কিন্তু যখন ঘোষনা হল,রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করবেন নন্দিতা দত্তরায় , সুমিতের অন্তরাত্না যেন কেঁপে উঠল।সেই মেয়েটি যে বাসে পাশের সীটে বসেছিল!
না, পৃথিবীতে ভূমিকম্প আসেনি।নন্দিতা দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করল।রবীন্দ্রনাথ আজো কত সমসাময়িক, আজো কত প্রাসঙ্গিক।তবে ঘটনাগুলো কি নিতান্তই কাকতালীয়?বাসায় আসার পরও ভাবছিল,শিলচর শহর আর কতই বা বড়?বাসের মেয়েটির সাথে আবার দেখা হলেও হতে পারে।
কোন সূত্রে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে নিয়ে ভাবে?আরেকজন মানুষের কাছে আসতে চায়?প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজছিল না পার্থ,কিন্তু তার মনের কুঠরীতে সে একজনকে নিয়ে অন্তহীন ভাবনা ভাবছিল।
এক দুবার ভাবছিল,মেয়েটির সাথে কি আবার কথা বলার চেষ্টা করবে?
কিন্তু এই যে নিজের ভাষা বাংলাভাষায় গান,কবিতা হচ্ছে সেখানে কি মিথ্যায় অন্যকে ভুলানো যায় ?
চার
একটা বিয়ের আলাপ এসেছে। যদিও ম্যাচম্যাকারের মাধ্যমে এসেছে পরে অনেক পরিচয় বেরিয়ে গেল।ছেলের বাবা যেমন সুমিতকে দূর থেকে দেখেছে , তেমনি পরিমলও ওদের বাসায় একবার বেরিয়ে এসেছেন। তিনি পজিটিভ মতামত দিয়েছেন । আর সুমিতের মা তো স্বামীর মতেই মত।কিন্তু বাসায় একটা স্ট্র্যাটেজী নেওয়া হয়েছে।আগে থেকে ছেলেকে কিছু জানানোর দরকার নেই।সুমিত এও জানলো,সকলের মতামত,এবার যদি দুপক্ষে দেখাশোনাটা হয়ে যায় তাহলে বাকী কথাগুলো ধীরে সুস্থে সেরে নেওয়া যাবে।আর সুমিতও পরে ছুটি নিয়ে এসে ছাদনাতলায় বসতে পারবে।
খুব জোরালো প্রতিবাদ করে না সে।কোন নারীর সাথে তার এমন কোন সম্পর্ক নেই যা মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী পরিবারের সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।তারও মন চায় জীবনে নারী আসুক, নারীকে নিয়ে কবিতা আসুক।কিন্তু মনের ভেতর যে অন্য গদ্যের শাসন।
পনের দিনের ছুটির পাচ দিন চলে যায় আসতে যেতে।বাকী দশ দিন চোখের পলকে কেটে যাবে। এর মধ্যে বাবা পাগল হয়ে গেছেন বিয়ে নিয়ে।কোম্পানীতে নতুন কান্ট্রি ম্যানেজার আসার পর ট্যুরিজমের পাশাপাশি এক্সপোর্ট ইমপোর্টও শুরু করবে বলে কথা শোনা যাচ্ছে। তাই তখন কিছু লোক ছাটাই হতে পারে আবার নতুন রিক্র্যুটমেন্টও হতে পারে। অন্য সময়ে ছুটির কথা বললে মনে হয় ছুটি দিলে কোম্পানীর মা মরে যাবে । কিন্তু এবার চাকরির ব্যাপারে ইসপার উসপার না করেই ছুটি মেনে নিয়েছে।খারাপ লাগে এসব উপমা ব্যবহার করতে। কিন্তু করা লাগে। মাসিক বেতনের বিনিময়ে কর্মচারীরা সবাই ওর ক্রীতদাস হয়ে আছে। তবে কোম্পানীতে একটা জিনিস ভাল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন জিনিস যেটা । বেতন। আর তাই সকলেই চাইছে যতদন টিকা যায়।
এই অবস্থার মধ্যে কে সাহস করবে বিয়ে করার? বর্তমান কান্ট্রি ম্যানেজার এসবের মধ্যেও স্টাফদের আটকে রাখতে চায়,মোটিভেট করতে চায়,যেটা দিনে দিনে তার নিজেরই কমছে ।বলে, কি করবে অন্য কোম্পানীতে গিয়ে ?সেই তো বেতনের জন্য খাটবে। এখানে টেনশন আছে, কিন্তু বেতন তো আসছে। দেখো না কি হয়। আর এর মধ্যে যা পারো জমিয়ে নাও।
এসব কথা বুঝবে না কেউ ,বুঝতে চায় না কেউ।বিছানায় শুয়ে শুয়ে কোন এক কাল্পনিক চরিত্রের কাছে সুমিত ক্ষোভগুলো উগরে দিচ্ছিল।
সন্ধ্যার সময় বাবা বললেন , কালকে বিকেলে ঘরে থাকিস। কয়েকজন লোক আসবে।
সুমিত বিষয়টা অনুমান করতে পেরে বাবার উৎসাহকে প্রশ্ন করল, কয়েক জন লোক আসবে তো আমি কি করব?
বাবা রাগছেন না। আরে ওরা আসুক না। তোর মতামত ও নেওয়া হবে।
কিন্তু সুমিত বুঝতে পারছে তার মতামতের পরোয়া করছে না কেউ। কারা আসবে সে ব্যাপারে আরেকটু খোজ নিতে গেলে টেলিভিশনের ঘরে একটী পোস্ট কার্ড সাইজ ছবি পেয়ে গেল সে। কিন্তু একী?নন্দিতা দত্তরায় মেয়েটি বারেবারে তার জীবনে ফিরে আসছে কেন?
পাঁচ
অফিসে নতুন কান্ট্রি ম্যানেজার চলে এসেছে।ওর রুমে ডাক পড়ল সুমিতের।কি বলতে চায় নতুন কান্ট্রি ম্যানেজার?
একটা ঝাকুনি দিয়ে ভাতঘুমের দখলে থাকা শরীরটাকে মুক্ত করে আশে পাশে নতুন বসকে দেখতে না পেয়ে নিশ্চিত হল।এখনো সে শিলচরের বাড়ীতেই আছে।
ওদের কি জানানো হয়েছে সবকিছু ?ওরা কি বুঝে বড় শহরের জীবন সংগ্রাম। দিল্লী ব্যাংগালোর যারা থাকে সবাই যে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ম্যানেজার নয়।সবাই ইনফোসিসে চাকরি করে না।তবে সুমিতদের কোম্পানীতেও যে সবকিছুই নেগেটিভ এমন নয়।একটা সময় কোম্পানীর খুব ভাল অবস্থা ছিল।টু নাইট থ্রি ডেইজের গোয়া ট্রিপ,দুবাই ট্রিপও দিয়েছিল।হতে পারে আবার সে অবস্থা ফিরে আসবে।কিন্তু একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে আরেকজনকে সাথী করা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
ঘটকের সাথে যেদিন বাসায় দেখা হয়েছিল সেদিনই ওর ফোন নাম্বার রেখেছিল।ঘটকের হাসি বড় বিচিত্র,এবার,হেঃ হেঃ।
ঘটককে বলল, আপনি তো আমাদের জিগ্যেস করেননি আমার কি রকম মেয়ে পছন্দ?
সব ছেলে পার্টির একই দাবী । মেয়ে যেন দেখতে সুন্দর হয় আর টাইটেলটা ভাল হয় ।
সুমিত বলে, যেকথাগুলো বলেছেন সেগুলো আপনার, এমনকী আমার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও হতে পারে ।কিন্তু এই দুইটা বিষয় নিয়ে আমার কোন অবসেশন নেই।
ঘটকের ভয়টা যেন কাটলো।সেটা তো ভাল কথা।
আমি চাই আমার লাইফ পার্টনার আমার পাশে থাকবে। আমি যদি রেস্টুরেন্টে যাই সে তো আমার সাথে যাবেই , কিন্তু আমার ভাগ্যে ডালভাত থাকলে সেও যেন ডালভাত খেতে প্রস্তুত থাকে।
ঘটক হাসল।আজকাল সব মেয়েই চায় রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে!
আসল কথাটা সরাসরি বলে দিয়েছেন ভাল কথা।সব রাগ গিয়ে পড়ে ঘটকের উপর আর সন্দেহ জাগল, শিলচরের যে মেয়েটী জড়িত আছে শিল্প ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সেও কি এরকমই বলেছে?আচ্ছা , ওদের ফোন নাম্বারটা দিন তো।
কার? মেয়ের না ওদের পরিবারের? ঘটক কোন সংঘাতে যেতে চায় না।
ওদের পরিবারেরটাই দিন।সুমিত বলল।
মেয়েটির পরিবার ফোন দেবে কি না ভাবতে ভাবতে সে ফোন পেয়ে গেল পুনের অফিসের এক কলিগের কাছে থেকে।নয়া কান্ট্রি ম্যানেজার জয়েন কর লিয়া।
ক্যায়সা হ্যায় আদমী?
ঠিকই হ্যায়!
আচ্ছা!
লেকিন সবলোগ বল রহা হ্যায়,অলরেডী লিস্ট বন গিয়া কিসকো কিসকো ছুট্টি মিলেগা।পেহেলা তো মেরাই হোগা। একটু রসিকতা করে বিপদ কাটাতে চায়।
একই রসিকতা সুমিতও করতে চাইছে। এতদিন বাইরে থেকে নিজের ভেতর তৈরী হয়ে গেছে এক আলাদা জগত যেখানে সে ভীষন একা।সুমিত চাইছিল সেখানে কেউ এসে জানুক অর্ন্তনিহিত তাকে, তার নিঃশব্দ যন্ত্রনা ও অনুভবকে।
কোন একটা তাড়নায় একটা সময় বেরিয়ে পরে বাসা থেকে।কাগজে লিখে রাখা ম্যাচমেকারের দেওয়া নাম্বার প্যান্টের পকেটেই ছিল। শিষ্টাচারজনিত প্রাথমিক কথাবার্তার পর সুমিতই মূল প্রসংগে এল ভয় ভয় কন্ঠে।
আসলে একটা বিষয় জানানোর জন্য ফোন করলাম আংকেল। যে বিষয়টা শুধু আমিই জানি।
কি?
আসলে কি,বায়োডাটায় তো আমার চাকরি সম্বন্ধে লিখা ছিল।তবে কি,যে কোম্পানীতে আমি বর্তমানে কাজ করি সেটাতে কিছু সমস্যা আছে ।
কি সমস্যা? ওপাশের গলার স্বরে পরিবর্তন।
আসলে এসব আপনি ঠিক বুঝবেন না। আল্টিমেট কথা হল ঐ কোম্পানীর অবস্থা এখন বেশ খারাপ। ডাউনসাইজিং চলছে।
ফোনের দুপাশে একটু নীরবতা।
আর আমি নিজেও ভাবছি অন্য কোম্পানীতে মুভ করার।সুমিত বলল ।
ও। বুঝেছি , তোমার চাকরি পার্মানেন্ট না।
এরকমই বলা যায়।সুমিত বলল,যদিও প্রাইভেট কোম্পানীতে পার্মানেন্ট শব্দটার মানে কি,বোঝানোর চেষ্টা করা যেত।
কথা শেষ হলে ফোন করাটা ঠিক হয়েছে না ভুল বুঝতে না পারলেও এক ধরনের মুক্তির আনন্দ অনুভব হল ।কিন্তু এ আনন্দ যেন এক বিয়োগ ব্যথার বিনিময়ে পাওয়া।
সুমিতের ধারনামতেই নন্দিতাদের পরিবার আর আসল না। অপরেশবাবু ঘরে জানালেন,মেয়েপক্ষ কয়েকটা দিন সময় নিয়েছে।ছুটির বাকী দুই তিনটা দিন চোখের পলকেই কেটে গেল।
আসতে সময় গুয়াহাটী পর্যন্ত ফ্লাইটে এসেছিল সুমিত।ফিরতে সময় ট্রেনে যাবে বাজেট এডজাস্ট করতে,শিলচর থেকে গুয়াহাটী যদিও বাসেই যেতে হবে। এবারে পাশের সীটে অপরিচিত এক ভদ্রলোক।পিছনে থেকে যায় শিলচর শহর।বাস এগিয়ে চললে জানালা দিয়ে দেখা যায় কখনো ধানজমি , কখনো চা বাগান , কখনো পাহাড়ের অবিন্যস্ত সবুজ ।অন্য প্রিয়জনদের সাথে নতুন একটি মুখও বারে বারে ভেসে উঠে।
লেখকবৃত্তান্তঃ
দেবরাজ দাশগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন ২৫ মার্চ ১৯৮১ আসামের শিলচরে ।লেখালেখি শুরু ছাত্রজীবনে; কবিতা দিয়ে শুরু হলেও এখন গল্প লিখছেন ।ফোনঃ ০০ ৯১ ৮৭২৩০ ১৩৪৫০
ইমেইলঃ deborajdasgupta@yahoo.com