অফিস থেকে এসে পুরনো চৌকির পরে ক্লান্ত শরীরটা মেলে শুয়ে পড়লো সুবন্ত। ক্লান্তির ছাঁপ স্পষ্ট হয়ে আছে তার চোখে মুখে, তাই অন্যদিনের মতো আজ আর শার্ট-প্যান্টগুলো পরিবর্তন করলো না। এমনকি ময়লা জুতোটাও পা থেকে খোলার সুযোগ হলো না তার। সেই সকাল আট’টায় অফিসে যেতে হয়, আর ছুটি হয় বেলা পাঁচটায়। সুবন্ত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করে, চাকরির বয়সটা প্রায় দু’মাস বা আড়াই মাস হবে। এর বেশী নয়। তার পরিবারে উপার্জনাক্ষম একমাত্র সেই ছিলো, তাই মা আর ছোটো বোনকে দেখাশোনা করতে হয় তারই। চাকরিটা পাওয়াই আগের থেকে দুশ্চিন্তা অনেকাংশ কমে গেছে সুবন্তের।
বাবা ছিলো পোস্টমাস্টার,তাই বাবা মারা যাওয়ার পর সঙসারের হালটা তকেই ধরতে হয়। চাকরির টানে এই প্রথম তার বাড়ি ছেড়ে পরিবার ছেড়ে শহরে থাকা। এখানে থাকতে অনেক কষ্ট হয় সুবন্তের; কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে মনকে শান্তনা দেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
বেশী ক্লান্ত হয়ে পড়লে নিজের বাড়ির কথা অনেক বেশি মনে পড়ে তার। মায়ের সারাদিন একাজ সেকাজ করে বেড়ানো, ছোট বোনটার জেদ আর কান্নাকাটি। সুবন্ত একবার ভাবে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে যাবে, আবার ভাবে চাকরিটা আর কিছুদিন গেলে সে একটা বিয়ে করে ফেলবে, তাহলে তার মায়ের একটু সহযোগিতা করা হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে তার ক্লান্ত শরীরে ঘুম নেমে আসে। তবে বেশীক্ষন স্থায়ী হল না তার ঘুমটা।
হঠাৎ করে টেবিলে রাখা স্মার্টফোনের রিঙ বেজে উঠলো। সুবন্তের ঘুমটা কেবল গভীর ঘুমে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছে, এরই ভিতর ঘুমটা আবার ভেঙ্গে দিলো তার স্মার্টফোন। চোখটা না খুলেই বিরক্তিভাবে ফোনটি তুলে রিসিভ করলো সে।
ওপাশ থেকে এক অপরিচিত পুরুষকণ্ঠ…
-হ্যালো!
-কে বলছেন ভাই?
-আপনি কি সুবন্ত?
-জ্বি, কে আপনি? আমি সুবন্ত।
-আপনার বন্ধু তাহসিন এ্যাকসিডেন্ট করেছে। তার অবস্থা বেশী ভালো না। দেখতে হলে তাড়তাড়ি বাড়িতে চলে আসুন।
তারপর ফোনটা কেটে গেলো-
ফোনে কথা শেষ হওয়ার পর সুবন্তের হাত পা কেমন যেন শীতল হয়ে আসছিলো। এই মাত্র ফোনে যার কথা বলা হলো, সে সুবন্তের বাল্যবন্ধু তাহসিন। সেই ছোটকাল থেকে একসাথে পড়েছে তারা। কিন্তু সুবন্তের চাকরির কিছুদিন আগেই তাহসিন একটা বড় চাকরি পেয়ে যায়। যার কারণে এই প্রথম তারা দু’জন পৃথক হয়েছিলো।
এইতো সেদিন যখন সুবন্ত ঢাকায় আসছিলো, সেদিন তাহসিন আর তার ছোট বোন বাসস্টান্ড পর্যন্ত এসেছিলো তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। বাবা-মা হারা দুই ভাইবোনকে ছেড়ে আসতে খুব খারাপ লাগছিলো সুবন্তের।
আর এই অসময়ে দুঃসঙবাদ পেয়ে সুবন্তের সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেছে। সব দুশ্চিন্তা যেন ঘিরে ধরেছে তার মাথায়। একদিকে তার চাকরিটা একেবারে নতুন, চাকরি ছেড়ে যাবে কীভাবে? আবার চাকরির সাথে সম্পৃক্ত পরিবার। অন্যদিকে তার বন্ধু তাহসিনের এ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু তাহসিনকে দেখার জন্য ক্রমশই অস্থির হতে লাগলো তার মন। অবশেষে বাড়ি যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো সে।
দুই.
দুদিকের লম্বা লম্বা গাছপালাগুলো হু হু করে ছুটে যাচ্ছে পিছন দিকে, সুবন্ত বাসের জানালা দিয়ে একমনে দেখছে সেগুলো। চাকরি ছেড়ে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে সে, এইখানে আর আসা হবে কিনা এ ব্যপারেও সে নিশ্চিত নয়। সুবন্তের কাছে রাস্তার দৈর্ঘ্যটা অন্যদিনের চে’ বেশী মনে হতে লাগলো আজ। রাস্তা যেন মোটেই শেষ হতে চাচ্ছেনা এখন।
হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল তাহসিনের ছোট বোনটার কথা, ছায়া। খুব চঞ্চল টাইপের একটা মেয়ে, ইন্টার মিডিয়েট শেষ করেছে, অনার্সের ছাত্রী এবার। এক ভাই ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই তার। ভাইয়ের এ্যাকসিডেন্টে কী অবস্থা হয়েছে তার কে জানে?
দু’বছর আগের কথা, একদিন ভোরের হাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে ছায়া নিজেই বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে বসেছিলো সুবন্তকে। কিন্তু সুবন্ত তখন হ্যাঁ বা না কিছু বলেনি। পরে অবশ্য একবার বিয়ের বিষয়টা মাথায় এনেছিলো সুবন্ত। যদিও বন্ধুর বোনকে বিয়ে করা একটা সমাজ-বিপরীত কাজ বলে মনে করে লোকেরা, শেষমেষ এই সেই
ভেবে কাউকে আর বিষয়টি জানানো হয়নি। কারণ সুবন্ত একটা শংশয়ে পড়েছিল তখন, হয়ত তাহসিন এমন কথাটা জানতে পেরে মনে আঘাত পাবে, আর তাদের অনেক দিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরতে পারে। সুবন্তের এমনভাবে এড়িয়ে যাওয়াটা ছায়া বুঝতে পেরে খুব অভিমান করেছিল। শেষের দিকে যখন সুবন্ত ওদের
বাড়িতে যেতো, ছায়া ওর সাথে বেশ কম কথা বলত -পারলে সামনে থেকেই চলে যেতো।
সুবন্ত এসব বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে কথা বলার চেষ্টা অব্যাহত রাখত।
—এসব সৃতি গুলো সুবন্তের চোখের কোণে জল জমিয়ে দিলো একমুহূর্তে।
তিন.
খুব ভোরেই গ্রামে পৌছে গেলো সুবন্ত। সরু মাটির রাস্তা ধরে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। বাড়ি পৌছাতে এখনো প্রায় দশ পনের মিনিট লাগবে। এতো ভোরে রাস্তা-ঘাট পুরোপুরি ফাঁকা, ভ্যান গাড়ি এবং মানুষশূণ্য হয়ে পড়ে আছে সব জায়গা। নিজ গ্রামের চিরচেনা সেই পথ-ঘাট গুলো ভালো করে
দেখে নিচ্ছে সে। গ্রাম ছেড়ে তার বাইরে থাকা মাত্র তিন চার মাস, অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে কত বছরই না সে গ্রামে আসেনি, গ্রামের সবকিছুতেই যেন অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
তাহসিন কেমন অবস্থায় আছে, সুবন্ত জানেনা। মনে হয় ভালো আছে। সুবন্ত খবর নেওয়ার জন্য আসার পথে অনেকবারই ফোন করেছে, কিন্তু সবার কথা প্রায় একই। ‘তাড়াতাড়ি আসতে হবে,তাহসিন অনেক অসুস্থ’
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে তাহসিনদের বাড়ির সামনে অনেক মানুষের সমাগম। বেশকিছু সাইকেল মোটর সাইকেলও রাখা আছে বাড়ির বাইরে,এসব দেখে সুবন্তের মনে অজানা কিছু শঙকায় এসে ভর করেছে মৌমাছির মতো। আসলে কী হয়েছে তাহসিনের! কেউ তেমন কিছু তো বলেনি। সুবন্ত মাথায় কোন নেতিবাচক চিন্তা আনতে চায়না এখন। তাহসিন সুস্থই আছে। হয়ত অনেক বেশী অসুস্থ হয়েছে; তাই মানুষের সমাগম। সে মন শক্ত করে দ্রুত পায়ে হেটে গেলো বাড়ির কাছে, বাড়ির পরিস্থিতি পুরো থমথমে।
অপরিচিত কিছু পাড়ার মহিলা সুবন্তের আগমনের দিকে তাকিয়ে আছে। অকস্মাৎ তার দৃষ্টি বাড়ির উঠোনে পড়লো। তখন সুবন্তের আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। তার বন্ধু তাহসিন আর বেঁচে নেই; পরপারে বিদায় নিয়ে গেছে। সাদা কাপড়ে পেচানো শরীরটা খাটিয়ার উপরে রাখা আছে, পাশে বসে কাঁদছে তার বোন ছায়া। সুবন্তকে দেখে দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘ভাইয়া তোমাকে অনেকবার দেখতে চেয়েছিলো
কিন্তু তোমাকে আর দেখতে পেলো না’ ছায়াকে ধরে দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো সুবন্তের।
বন্ধুকে হারানোর ব্যথায় সেদিন থেকে সুবন্ত যেন চরম অসহায় হয়ে পড়লো, এমনকি চাকরিতে যাওয়ার ভাগ্যটুকু আর হলো না তার।
চার.
তাহসিনের মৃত্যুর পর পাঁচটি বছর কেটে গেলো। আজ তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একটা দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছরের মতো এবারও তাহসিনের অনেক আত্বীয়-স্বজন এসেছে এ অনুষ্ঠানে। বাড়ি ভরা মানুষ, তার মধ্যে ছোট্ট রাইয়ানও খুব দুষ্টুমি আর ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। রাইয়ান হলো ছায়ার একমাত্র ছেলে। তিন চার বছরে ভালোই বেড়ে উঠেছে সে। আজ ছায়ার একজন দুরসম্পর্কের মামাও এসেছে, এদিকে রাইয়ান লাফালাফি করতে করতে হঠাৎ গিয়ে পড়লো সেই মামার সামনে; আধা বয়স্ক একটা লোক, সাদাকালো চাঁপদাড়ির সংমিশ্রন। সে আগে কখনো তাকে দেখেনি, তাই অপরিচিত একটা লোক দেখে ভয় পেয়ে এক দৌড়ে ছায়ার কোলের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো। হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
-আম্মু! দেখো একটা অচেনা লোক আমাকে ধরতে এসেছে।
ছায়া পিছনে তাকিয়ে তার মামাকে দেখে চিনে ফেললো। তারপর ছায়ার মামা বললো,
-ও, এটা তোমার ছেলে নাকি? নাম কী তোমার? বাবু।
রাইয়ান এবার কিছুটা সাহস নিয়ে বললো,
-আমার নাম রাইয়ান হাসান।
-আব্বুর নাম কী? বলতে পারো?
-হ্যাঁ! পারি, আমার আব্বুর নাম সুবন্ত হাসান।
এর ভিতরে সুবন্ত এসে দাড়ালো তাদের সামনে। রাইয়ান তার বাবাকে দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো
-এই তো আমার আব্বু এসে গেছে।
আবু উবাইদাহ তামিম
গল্পকার
খুলনার খানজাহান আলি থানাধীন মিরেরডাঙ্গা গ্রামে ১৯৯৫ সালের ২৯ অাগস্ট জন্মগ্রহন করেন৷