অবিশুদ্ধ চিন্তার এক কবিতাঅলা

1

কবিতা মূলত কবির অনুবাদকৃত সত্ত্বা; যা অক্ষরে অক্ষরে প্রকাশিত হয়। কবি তার স্বপ্ন ছাড়া ভিন্ন কোনো সত্ত্বা নয়। তাই কবিতাগুলো কবির স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন আকঙ্খা-অনাকাঙ্খা প্রেম-অপ্রেম বাঁচা-নাবাঁচা সবকিছুকেই প্রকাশ করে। একই সাথে নিজেকে চিনতে গিয়ে কবি তখন প্রশ্ন করে সবকিছুকে। তখন কবি ধর্মের ভিতর খুঁজে পায় অধর্মকে ইতিহাসের ভিতরে খুঁজে পায় মিথ্যাচারকে, আইনের ভিতরে খুঁজে পায় আইনবহির্ভূত ব্যবস্থাকে। তাই সবগুলো বিষয়ে কবি নিজের ভিতরে নতুন এক সংঙ্গা ধারণ করে। এবং লালনও করে।

কবিতা তখন আর আগের মতন কবিতা থাকে না; হয়ে উঠে অকবিতা নাকবিতা অথবা অকাব্যিক কবিতা। এরকম চিন্তার ফলে পাবলো নেরুদা লেখেন “অবিশুদ্ধ কবিতার দিকে” কবিতাটি। এবং এ কারণেরই জীবনানন্দের কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারে না। বলে, তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে। যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো।

কবি তখন সমাজে থেকেও অসামাজিক রাজনীতিতে থেকেও অরাজনৈতিক জাতিসত্ত্বার কথা বলেও অজাতীয়তাবাদি। কবি তখন বাঙালি হয়েও হয়ে উঠেন চাকমা গারো কিংবা রাখাইন। বাঙলাদেশের নাগরিক হয়েও হয়ে উঠেন কুর্দি অথবা প্যালেস্টানিয়ান। রেড গাজা হোয়াইট হাউজ কবিতাপর্ব নিয়ে বলে উঠি:

এতো রক্ত গুয়েতেমালায় ভিয়েতনামে
ইরাকে আফগানিস্তানে পাকিস্তানে লিবিয়ায় সিরিয়ায়…
ছিঃ এই পুছকো গাজায় এসে রক্তের দাগ লাগবে !

কতোটা রক্ত লাগলে লাল হবে ?
লাল হবে না, তোর বাল হবে !

টুইন বেবি: ইউনাইটেড স্টাটস এন্ড ইউনাইটেড ন্যাশন । তারা হোয়াইট হাউজ খায় হোয়াইট হাউজ মাথায় দেয় হোয়াইট হাউজ খায় হোয়াইট হাউজ হাগে হোয়াইট হাউজ চোদে । হা হা হা । ইউনাইটেড বাস্টার্ডস !

আঞ্চলিকতা নিয়েই আন্তর্জাতিকতাবাদ; হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটা কথাটা আমাকে খুব নাড়া দেয়। আমার সত্ত্বা আমার ঠিকানা আমার ইতিহাস আমার ঐতিহ্য ফেলে আন্তর্জাতিকতা সম্ভব নয়। নিজেকে জানাটা খুব সহজ কাজ নয়। কারণ ইতোমধ্যে অন্য কারো মাধ্যমে তুমি পরিচয় প্রাপ্ত। সেই অন্য কারো ইচ্ছা ও দৃষ্টিভঙি দিয়ে সে হয়তো চিনিয়েছে কিঙবা না চিনেই ধারণাবশত প্রচারণা চালিয়েছে।

অন্যের লেখা ইতিহাস সাহত্যি কিংবা পরিচিতি দিয়ে নয়, নিজেকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে খুঁজে বের করতে হবে, হু অ্যাম আই! আর সেখান থেকেই খুঁজে পাওয়া যাবে এই আমার ঠিকানা আমার ইতিহাস অথবা ঐতিহ্য। তখন দেখা যায় অন্যের দেখানো পথটা আর আমার পথ থাকে না, ভিন্ন পথের পথিক হয়ে উঠে সে। এভাবে কবিকে প্রথম তার নিজের পথ খুঁজে নিতে হয় এবং নিজের গন্তব্য নিজেই ঠিক করে নিতে হয়।

নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে:

আমি ভিক্টোরিয়ান মোরালিটিটাকে সম্মান করি না। তাই আমি অনেক কম রাবীন্দ্রিক; কিছুটা নাজরুলিক কিছুটা জীবনানন্দিক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফলে, সমাজে সুশিলতা বজায় রাখার ফলে যতোটুকু রবীন্দ্রনাথ রয়ে গেছে আমার ভিতরে। রবীন্দ্রনাথকে জানতে জানতেই কবিতার প্রচলিত কাঠামোটা চিন্তার কাঠামোটা রবীন্দ্রনাথ ধারণ করার কাঠামোটা বিনির্মাণ করা।

আমার আত্মজ মাটির ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে লালনের মনের মানুষের বিজ খুঁজতে খুঁজতে সুফি কবিতা সুফি গান আমার অনেক দিনের ভালো লাগা বিষয়। সেখান থেকে পেয়ে যাই রবীন্দ্রনাথের ইংরেজিতে অনুবাদ করা সং অব কবীর। এর আগেই তার গীতাঞ্জলির ইংরেজি কপিটা পাই। অবাক হই যে বাঙলা আর ইংরেজি গীতাঞ্জলির মধ্যে কী বিস্তর তফাৎ! এতো বছর ধরে কবিতাচর্চা করে এতো এতো সাহত্যসভা এতো এতো কবিতাউতসবে গিয়েও আমি জানতে পারলাম না। সেই সময় আমি মূলত প্রোজ পয়েট্রি নিয়ে বেশ পড়াশোনা শুরু করি। তারপর একদিন চোখ হঠাত আটকে যায় পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাতে।

গীতাঞ্জলির গানগুলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলেম। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কি না। মনে আছে সত্যেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেম, তিনি স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু, চেষ্টা করেন নি। তখন আমি নিজেই পরীক্ষা করেছি, ‘লিপিকা’র অল্প কয়েকটি লেখায় সেগুলি আছে। ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয় নি— বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ।

পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা আর লিপিকা গল্পগ্রন্থের কিছু ছোটগল্প যেখানে এক ও অভিন্ন ফর্ম ধাঁধা খাওয়ার মতোন। আগে থেকেই আমার শহিদুল জহিরের গল্পগুলো ভালো লাগতো মামুন হুসাইনের গল্পগুলোও। সেগুলোতে আমি কবিতার স্বাদ পেতাম। এবং বুঝতে পারলাম রবীন্দ্রনাথের ভীরুতাই আর্তো র‌্যাবোর মতোন টানাগদ্যে কবিতা লিখেও সেগুলো ঠাঁই দিয়েছেন গল্পগ্রন্থের মধ্যে; আর সেই কবিতাস্বাদের ছোটগল্পগুলো মামুন হুসাইন কিংবা শহিদুল জহিরের হাত ধরে বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।

নিজের পিরন থিক্যা বাইরইয়া আইতে পারি না:

উপনিবেশিকতা একটা ব্যাধি; শত শত বছর আগে সেই ‍আলেক্সেজেন্ডার সেই আকবর সেই রবার্ট ক্লাইভ ছড়িয়ে দিছে আমাদের মাটিতে আমাদের রীতিতে আমাদের মগজে। আমরা শ্লোগান দেই, সাদা মনের মানুষ চাই; শ্লোগান দেই, শামীম ওসমানের কালো হাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও। বলি, তারা চরিত্রে কোনো দাগ নাই একেবারে সাদা। আবার বলি, তোর মতোন তোর মনটাও কালো। আমরা কালো বলতে অমঙ্গল অসুন্দর অপবিত্র বুঝি আর সাদা বলতে বুঝি মঙ্গল সুন্দর পবিত্র। এই চিন্তার উপনিবেশিকতার পাশাপাশি ভাষার উপনিবেশিকতাও আমাদের কবিতায় বেশ ঝেঁকে বসেছে। বাঙলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বিশাল রাজত্ব এর মূল কারণ। শান্তিনিকেতনে যাওয়া সময় দেখা যায় বর্ধমানের দূরত্ব ট্রেনে মাত্র আধা ঘন্টার রাস্তা। তাই তারা যে ভাষাটা চর্চা করে গেছেন সেটা থেকে ভিন্ন কোনো ভাষার কথা আমরা চিন্তা করতে পারি নি। আমার মনে পড়ে যায় কুরানের ভাষার কথা যেটা মূলত কোরাইশি ভাষা। প্রচলিত আরবি ভাষা থেকে যে এই ভাষা অনেক ভিন্ন সেটা যারা বাঙলাদেশ থেকে আরবি জানা মানুষগুলো সৌদি আরবে চাকরি করতে যায় তাদের থেকে জানা।

রাঢ়ি বাঙালি বরেন্দ্রি ঝাড়খন্ডি ও কামরূপি এই তিনটি ভাষারূপকে বাঙলা ভাষার উপভাষা বলা হয়। এর মধ্যে রাঢ়ি হলো পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান থেকে নদীয়া জেলায় প্রচলিত ভাষা। আর সেই ভাষাটাই আমরা বাঙলাভাষা হিসেবে মূলত চর্চা করে আসছি বছরের পর বছর। নন্দনতত্ত্বে যেমন রবীন্দ্রনাথের ভিক্টোরিয়ান মোরালিটিটা আমি সম্মান করি না, এই রাঢ়িভাষাটাকে আমি নিজের বলে মানতে পারছি না। তাই আমি আমার বাঙালিভাষাটা, যেটা আমরা বাঙলাদেশের ঢাকা ময়মনসিঙহ কুমিল্লা যশোর খুলনা ফরিদপুর বরিশাল নোয়াখালির বিশাল জনগোষ্টি ব্যবহার করি সেটাকে স্রেফ উপভাষা বলে নেগলেক্ট করে যাচ্ছি। অনেক বছর ধরে আমি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার উপায় খুঁজছিলাম। একদিন হঠাত হাংরি জেনারেশরনের কবি সুবিমল বসাকের কিছু কবিতা পড়লাম।

নিত্যি আমি একই লেহান আকাশ দেহি
কুনোকিচ্ছুতে হেরফের হয় না এক্কেরে
নিজের গতর থিক্যা বেবাক কুসংস্কারের ধুলা ঝাইর‌্যা ফেলছি
তবও হায়,

নিজের পিরন থিক্যা বাইরইয়া আইতে পারি না
আমি জানি, স্বাধীনতা বেজায় মাঙ্গা—
আর কিচ্ছু না— স্বাধীনতা মাইনষের শরীলের চাম—
                                           বংশ মজুদ রাখনের গাদ

পড়ে আমি তো থ খেয়ে গেলাম। হাবিজাবি নামের পুরাটা কাব্যগ্রন্থই আমাদের প্রচলিতভাষায় লেখা; মানে বাঙালি(উপ)ভাষায় লেখা। এমন কি ছাতামাতা তার উপন্যাসটাও। একজন কবি যিনি সেই পাটনায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবঙ এতো আগে অর্থাত ৬৪/৬৫ সালেই এভাবে লিখছেন। আমি সাহস খুঁজে পেলাম। কিছু কিছু কবিতায় পুরুটাই আমার ভাষায় এবঙ অনেক কবিতায় প্রায় আমি গেঁথে দিতে থাকলাম আমাদের বাগান থেকে তুলে আনা বাঙালিভাষাফুল। ভাষাবিষয়ে আরও আগে থেকেই বিচিন্তা কাজ করেছে লোকগানগুলো শুনে। অনেক লোককবিই সেটা করেছেন, করে যাচ্ছেন।

সাহিত্য সৃষ্টির শুরু থেকে এর ভাষা নিয়ে বহু পরীক্ষা করেছেন সাহিত্যিকরা। বাংলা সাহিত্যের সেই চেষ্টার ফল হিসেবে শুধু পদ্যে লেখার পরিবর্তে পদ্য গদ্য দু’টাতেই লেখা শুরু হলো। তারপর পদ্যের ভাষা গদ্যের ভাষা নিয়ে শুরু হলো অন্য একরকম নিরীক্ষা। কেউ কেউ মুখের গদ্যের মতোন বাংলা গদ্যকে সাজাতে চাইলেন। মুখের গদ্যের কাছাকাছি করে গদ্যের ভাষা যারা তৈরি করতে চেয়েছেন তাদের সংখ্যা কম হলেও এখনকার গদ্য থেকে আমরা আমরা বুঝতে পারি না যে, তারাই আমাদেরকে আধুনিক গদ্য দেয়ার চেষ্টা করেছেন? বাংলা ভাষার ইতিহাসে প্রমথচৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ গোষ্ঠি এবং ’ঘরে-বাইরে’ লেখার সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গদ্যের ভাষা হিসেবে চলিত ভাষাকে গ্রহণ করার কারণে বাংলা গদ্যের আরোপিত ভাষা রীতি সাধু (যা একমাত্র ’বোদ্ধা পন্ডিতদের’ ভাষা) থেকে মুক্ত করে মুখের ভাষা (বা বাচন) থেকে এর দূরত্ব কমিয়ে এর খুব কাছাকাছি নিয়ে আসা।

এ চেষ্টা বিভিন্ন সময়েই হয়েছে। কখনো শব্দের কাঠামোতে, কখনো বাক্যের গঠনে। প্রমথ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথের কাজ তখন কিছুটা হলেও সফল হয়ে ছিলো। যদিও তারা তখন শুধু ক্রিয়া পদের ও সর্বনামের কোনো কোনো রূপে মুখের ভাষার কাছাকাছি করতে পেরেছেন। তাহারা, যাহার-এর পরিবর্তে তারা, যারা এবং করিয়া ছিলাম, করিতে ছিল- এর পরিবর্তে করে ছিল, কর ছিল ব্যবহারে বাংলা গদ্যে মুখের ভাষা বা বচনের দিকে আসতে শুরু করলো। রবীন্দ্রনাথ এক সময় দেখতে পেলেন যে কবিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত হতে চলেছে এবং এই গদ্যেই সম্ভব এই ’বাস্তব জগত্ এবং রসের জগতের সমন্বয় সাধন’।

প্রমথ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথের এ কাজ শুরু করার আগেই একই উদ্বেগে টেক চাঁদঠাকুর লিখে ছিলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’। এর ভাষাকে তখন মাইকেল মধুসুদন দত্ত ফিশারম্যানদের ভাষা বলেছেন। সেখানেও গদ্যের ভাষাকে বচনের কাছাকাছি করার একটা চেষ্টা তিনি করে ছিলেন। মাইকেলের কথাটা অন্য ভাবে সাজালে- ঐ ফিশারম্যানদের বুঝাতে হলে এর ভাষা তাদের মুখের ভাষার (বচনের) কাছাকাছি হতে হবে। এক্ষেত্রে মাইকেলের মন্তব্য যথার্থই ছিলো।

আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি:

ফিরে এসো চাকা কবিতাটা যেমোন বিনয় মজুমদারকে উতসর্গ করা, তেমনি কবিতায় কামকে তুলে আনাও বিনয় মজুমদারের কবিতা পড়তে পড়তে শেখা। তারপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় স্তন যেনি শব্দগুলোর রোমান্টিক ব্যবহারও কবিতার শব্দ চয়নে এক চিন্তা মাথায় ঢুকে, যে সব শব্দগুলো, শব্দের এমোন চমতকার ব্যবহার আমি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ কারো লেখায়ই পেতাম না।

তারপর একদিন হাতে পেলাম নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বই, কামকানন। কাম ও প্রেম নিয়ে কবিতা এতোগুলো কবিতা এক সাথে এর আগে কখনো পাইনি। হঠাত একদিন খুঁজে পেলাম হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস এবঙ সেই আন্দোলনের সময় প্রকাশিত বুলেটিন, হাংরি আন্দোলনের সাথে জড়িত মলয় রায়চৌধুরী সমীর রায়চৌধুরী ফাল্গুনী রায় সুবো আচার‌য শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুবিমল বসাকের কবিতা আলোচনা সাক্ষাতকার । প্রথমেই আমাকে খুব আসক্ত করে ফেলে সুবিমল বসাকের কবিতা। আমাদের ঢাকা অঞ্চলের ভাষায় লেখা তার কবিতা পড়ে রীতিমত আমি হতভম্ব: একজন মানুষ যিনি ভারতের পাটনায় জন্ম এবং সেখানে বড়ো হওয়া, তিনি আমার ভাষায় কবিতা লেখেন! সুবিমল বসাকের লেখাই আমাকে সাহস যোগালো আমার নিজের ভাষায় যেটাকে অন্যরা নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষাও বলে সেই ভাষায় কবিতা লেখা। হাংরি মুভমেন্ট নামেই একটা কবিতা লেখলাম এবঙ উতসর্গ করলাম সুবিমল বসাককে।

কিন্তু তখনও আমি যোনি স্তন শিশ্ন নিতম্ব এই সব শব্দগুলো শুধু কামকলার অংশ হিসেবেই কবিতায় প্রকাশ করার ব্যপারটা বুঝতাম। সেই ঘোর কাটে সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত বাইশে শ্রাবণ ছবিটা দেখে। ছবিটিতে হাংরি কবির ভুমিকায় অভিনয় করেন গৌতম ঘোষ। সেখানে ব্যবহৃত কবিতাগুলো এক বিশেষ মাত্রা বহন করে। রাজনৈতিকভাবে ওই সব শব্দের ব্যবহার আমাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। তারপরে মলয় রায়চৌধুরীসহ আরো কয়েকজনের হাংরি আন্দোলনের সময় লেখা কবিতা, অর্থাৎ হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত কবিতা আর হাংরি আন্দোলনের পরে শৈলেশ্বর রায়দের সম্পাদনায় প্রকাশিত ক্ষুধার্ত সংকলনের কবিতার মধ্যে পার্থক্যটা মোটা দাগে চোখে পড়ে। এবং সুবিমল বসাকের সাথে একদিন ফোনে আলাপচারিতায় সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মর্গের ঠান্ডায় জমে গেছে আমার শহর কবিতাগ্রন্থে ফালগুনী রায়ের টেলিভিশন কবিতায় এক অংশে আমি লেখি:

কলজে পচে গেছে বলে, আমি মদ খাইনি কোনোদিন। ভাঙ গাঁজা কিছুই খাই না। মাঝরাত্তিরে মাঝরাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ভাবতে পারি না বেশ্যার স্তনের মতোন ঝুলে থাকা রাষ্ট্রের কথা, উত্তেজিত শিশ্নের মতন উচিয়ে থাকা রাইফেলের কথা। সংসারচর্চা করে দিনে দিনে হয়ে ওঠেছি দুধ দেয়া গাভি। স্রেফ একটা কালচে বাদামি গাভি। বানে টান লাগলেও আমি উহ আহ করে কাঁদতে পারি না। চারাপাশ থেকে শক্ত শেকলে বান্ধা আমার চতুষ্পদি জীবন। তোমার বিমুক্ত কলম তবু আমাকে ডাক দেয়। বহু দূর থেকে ডাক দেয় বারবার। ডাক দেয় আমার মতন আরও মগজবেশ্যাদের । পরস্পর তাই একত্রিত হয়েছি পবিত্র যাত্রায়। আমরা আজ এক সাথে ঢুকে পড়ব তোমার টেলিভিসনে।

হাংরি আন্দোলনের প্রভাব দুই রকম। একটা পাওয়া যায় হাংরি বুলেটিনে, যেখানে যোনি স্তন শিশ্ন বেশ্যা প্রভৃতি শব্দগুলো রাজনৈতিক ঘৃণা প্রতিবাদ প্রকাশ করার জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে, ময়ল রায়চৌধুরীর কবিতা প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-সহ অন্য হাংরি কবিতা পড়লে সহজেই বুঝা যায়। পেনিস ফেস্টিভাল, ধর্মের দোকান ৫, পেট্রোলবোমা, ভি-চিহ্ন, শিশ্ন, ধর্ষকচিহ্ন সহ বেশ অনেকগুলো কবিতায় এই শব্দগুলোর রাজনৈতিক ব্যবহার করেছি। আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ম, যিনি মলয় রায়চৌধুরীদের হাংরি আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন; শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিনয় মজুমদার, যারা প্রথম কিছুটা সময় এই আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন; এবং শৈলেশ্বর ঘোষ, যিনি মূল হাংরি আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর নতুন করে নতুন মাত্রায় হাংরি আন্দোলন চালিয়ে গেছেন; তাদের কবিতায় সেই শব্দগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাম ও প্রেমের উপায় হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি আন্দোলনের মূল আন্দোলন এবঙ পরবর্তি আন্দোলনেও জড়িত থাকায় তার লেখাতে শব্দগুলোর ব্যবহারে ভিন্ন মাত্রা আশে। আমি এই শব্দগুলোর দুই ধরনের ব্যবহারেই আনন্দ পাই। যা অনেকের চোখে অশ্লীল অশ্লীল মনে হয়।

তিনশ’টি লাশ ঠাণ্ডা হিম যাদের গুম করে ফেলা হবে:

আমি হয়তো সুররিয়ালিজম পছন্দ করি হয়তো বিটিজম হয়তো পোস্টমর্ডানিজম কিংবা পোস্টকলিনিয়ালিজম; কিন্তু রোমান্টিসিজম না। রোমান্টিসিজম আমার কাছে সাহিত্যবিলাসিতা মনে হয়; বাস্তবতার শিকর কেটে কাল্পনিক/স্বাপ্নিক ভাষাভঙ্গি দিয়ে সাহিত্যচর্চা হাস্যকর বলে মনে হয়।

সাফদার হাসমিকে নিয়ে একটা কবিতা লেখলাম; নামও দিলাম সাফদার হাসমি।দিল্লির জন নাট্যমঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। হাল্লা বোল নামের একটা পথনাটক করার সময় তাকে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে রাস্তায়। গোল হয়ে দর্শকরা বসতো/দাঁড়াতো, আর তার ভিতরে তারা নাটক করে গান করে কথা বলতেন শ্রমিক অধিকারের পক্ষে কিঙবা মালিকশ্রেণি/রাষ্ট্রিয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। লেখাটা আমি ভিজুয়াল পয়েট্রির ফর্ম নিলেও, বাস্তবে বেশ গোল হয়ে বাসে নাটক দেখাটাকে আমি ফর্মে ইচ্ছে করেই দেখাইনি। একপাশে দৃশ্যকাব্য অন্যপাশে সাধারণ মানুষের তালিকা দিয়ে কিছুটা গোল কিছুটা আঁকাবাঁকা রেখেই তা মাঝখানে লিখেছি, একজন সাফদার হাসমি। পুরাপুরি গোল করার মতোন রোমান্টিসিজমকে আমি মেনে নিতে পারি না।

আমি মনে করি কবিতা নিটোল না-হয়ে একটু আউদা-খাউদা হবে। নাইকা শুধু শ্বেতবর্ণ, নাক-খাড়া, দারুণ ফিগার হবে এটা তো হলিউডবলিউড মুভির কথা। জিবনের নাইকারা কালোবর্ণ বোঁচা বেটে কথা কয় গেরামের ভাষায়, তাই কবিতায় যদি সেই রোমান্টিসিজম অস্বিকার করতে চাই তার মধ্যেও কিছু খাপ-ছাড়া কথা/বাক্য/শব্দ থাকতে হবে। স্টুডিওতে রেকর্ড করা গান না-শুনে কোনো পথ-বাউলের রেকর্ড করা গান শুনলে বুঝা যায়, গানের মাঝখানে হঠাত অন্যজন কথা বলে উঠে, হঠাত একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। এটাই আমাদের বাস্তবতা। এখানে আমাদের কবিতা হওয়া উচিত।

অথবা যেমন এখোন আমি আমার বন্ধুর সাথে কথা বলছি চা খাচ্ছি। আমাদেরে থেকে একটু দূরে পাশের টেবিলে আরও কয়েকজন চা খাচ্ছেন কথা বলছেন। মাথার উপরে একটা টিভি চলছে। কতোক্ষণ সঙবাদ কতোক্ষণ নাচ-গান। সবকিছু ফেলে আমার মাথায় আগামিকালকে নতুন জায়গায় ডিউটিতে যাবার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। একজন জিবনঅলা মানুষের যাপন এই-ই। একই সাথে সে-ও ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যস্ত / চিন্তিত / জড়িত।

তার দেহ বহির্ভূত (কিন্তু তা চিন্তা/মগজ বহির্ভূত নয়) অনেক বিষয় যেমন সমাজ বিজ্ঞান ইতিহাস রাষ্ট্রব্যবস্থা ধর্মতন্ত্র তাকে ঘিরে রাখে। কবিকে তাদের ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। এই প্রবেশটাকে অন্য কেউ অস্বিকার করলেও কবি তা স্বীকার করে প্রকাশও করে। লেখালেখির প্রতি সততা থাকলে তার সত্ত্বার প্রতি সততা থাকলে কবি এ প্রবেশকে অস্বিকার করতে পারে না। এই মাধ্যমগুলোর মধ্যে প্রবেশপথ কিন্তু এক নয়। তাই কবিদের দৃষ্টিভঙ্গিও এক থাকে না। আর দৃষ্টিভঙ্গির যেখানে ফাঁরাক কবিতা লেখার কৌশল কাঠামো ভাষাভঙ্গিও এক থাকে না। এই দৃষ্টিভঙিই মূলত কবির দর্শন। আবার এই দর্শন যাদের সাথে মিলে যায় তাদের কাছেই এই কবিতাগুলো গুরুত্ব পায় তাদেরকে আনন্দ দেয় কবিতা পাঠের পরে।

কবিতাতে এই অবস্থার প্রকাশটা উত্তরআধুনিক ফর্মেই সুন্দর ও সাবলিল। কিন্তু সহজবোধ্য নয়। বহুমাত্রিক পরিস্থিতিকে প্রকাশ করার জন্যে সেই সহজবোধ্যতাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি ঠাঁই নেই নাটিকা / সংলাপটাইপের লেখার মধ্যে। সেখানে হঠাত একটা গান ঢুকে যেতে পারে। তৃত্বিয়পক্ষের কোনো সংলাপ ঢুকে যেতে পারে। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রসঙ্গ এসে কবিতাকে মোচড়ে দিতে পারে। প্রতিবাদের কবিতা লেখতে বেশ কয়েক বছর ধরে আমি এই ফর্মটাই বেছে নিয়েছি। এটা শুরু হয়েছিলো আমার দ্বিতীয় বই যেদিন আমরা বৃষ্টি নামাবো কবিতাগ্রন্থের কয়লা নামের কবিতাটা থেকে। চূড়ান্তভাবে প্রকাশ পায় আমার তৃতিয় বইটায়। লেখার এ ফর্মটা আমার মাথায় আসে মঞ্চ নাটক দেখে, কিছু মুভি দেখে, বিমূর্ত ছবিগুলো দেখে এবং কিছু কিছ গান শুনে। যার মধ্যে সঞ্জীব চৌধুরীর বাড়ি ফেরা হলো না গান খুব বেশি দাগ কেটে ছিলো। ও কল্পনা তুই আইনা, ‍হুদু গেলে কবিতার একাংশ:

মুসলমানগো গুজরাটে মারে আসামে মারে ওরাই তো। বার্মায় পুইড়া পুইড়া মারে। এটা জিহাদের ওয়াক্ত। ওগো মাইয়াছেলে হইলো গনিমতের মাল।
স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমরা অতন্ত্র প্রহরী। লেফট রাইট লেফট লেফট রাইট লেফট লেফট রাইট লেফট লেফট রাইট লেফট
আগুন লাগবে আগুন আগুন লাগবে আগুন বাঙালি আগুন বাঙলাদেশি আগুন আগুন লাগবে আগুন ইসলামি আগুন খাস জিহাদি আগুন
।। নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ।। নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ।।
শুনুন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। এসব হলো ইহুদি নাসারাগো চাল। হিন্দুস্তানের চাল।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

1 Comment

  1. Pingback: চারবাক । নবপর্যায়ে প্রথম সংখ্যা । জুলাই ২০১৬ | চারবাক

Leave A Reply

শেয়ার