জীবন, বিষন্ন রোদের ডানা :: সৈয়দ সাখাওয়াৎ

0

মগজের কোষে কোষে সেসব নিঃশব্দ শিকার খেলা করে
যারা চলে গ্যাছে স্মৃতিময় ভোর হাতে করে নিয়ে দূরে
দীর্ঘবাহু ছড়িয়ে আছে যে তুমি ধরতে পারো আঙৃলবন
বেদনার হাত থেকে বেঁচে যাবে ছুঁয়ে সারসের ডানারোদ

২.
মৃত্যুর অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছ মুখোমুখি
মাঝে খেলা করে বানভাসি আর্তনাদ আর শেষ দীর্ঘশ্বাস
দেহের শিৎকার জানে সেসব ভাষা আর রঙকরা প্রেম
পাখি উড়ে চলে গেলে শেষাবধি পায়ের ছাপেরা থাকে জলে

৩.
দৃশ্যগুলো থেমে যায়, জীবন দাঁড়িয়ে থাকে আগুনের কাছে
সেখানে লেখা মৃতের এপিটাফ, আমি লিখে যাই শোকগাথা
গানগুলো ঝরে পড়ে, উড়ে যায় সেসব শোকাকূল কান্নারা
কণ্ঠের আর্তনাদ জানে শিরঃচ্ছেদের গোপন কণ্ঠস্বর

৪.
তোমার হাতে শোকের মতো গুঁজে দেওয়া নিষেধ গুচ্ছগান
যারা হারিয়েছ স্রোতের সাথে তাদের নামে নেই কোনো কথা
মগজে এখনো খেলা করছে রোদ, করিডোরে দাঁড়িয়ে মৃত্যু
ভাঁজখোলা আঙুলে থাকে বুঝি প্রতারক বন্ধুর ব্যাথাচিহ্ন

৫.
পরস্পর হেঁটে চলে গ্যাছি, ভেতরে ছায়ার শরীর শুধুই
অকারণ কথা বলেছে বিষ প্রহরের সাথে, বিষন্ন রোগ
দৃশ্য ধুয়েমুছে গ্যাছে বৃষ্টি আর সেসব স্মৃতিময় শরীর
হাড়ের ভেতর এখনও শ্যাঁওলার গন্ধ লেগে আছে যেন

৬.
সুরের ভেতর হাত ধরে চলে যায় অনেকগুলো শরীর
কেউ আছে, কেউ নেই-এ ইতিকথা লিখেছে পাখিসব সুরে
তাই সে স্নেহপুরাণ হাতে নিয়ে কথা বলে গভীর বিশ্বাস
পরস্পর ডুব দিয়েছে ঠোঁটের গভীর স্রোতে ক্ষুব্ধ, জীবন্ত

৭.
কতটুকু জল পড়ে, শিরা-ধমনীতে কতটুকু আর্তনাদ
শুনেছি পাহাড়-বন নাকি মাঝে মাঝে হয়েছে খুব উন্মাদ
মসৃন শরীর তাই ভেঙে যায় কখনো ফিরে আসে না বলে
উন্মাদ, সারা শহরময় ধূলোর আকাশ নিয়ে চলে গ্যাছে

৮.
আমাদের খোলসগুলো কান পেতে রাখি, শুনি-কোথাও বন
কোথাও সাগরের মতো ভীষণ হিংসার স্বর-ভয়ঙ্কর
গান নেই, কেবল নীরবতা-ভেতরে মর্মে মরণ নিজের
সেসব কথার ছায়ারা এখন লেগে আছে হাতের ভেতর

৯.
নিয়ত ডুব দিয়েছি তৃষ্ণায়, শরীরে-শহরে ঘুম বালিশে
চোখের ভেতর থেকে উড়ে এসে বসেছে শিথিল জলধারা
তৃষ্ণার পথ থেমে গেছে, ক্লেশ এসে বাসা বাধে-সন্দেহডানা
উড়ছে স্মৃতিহীন, থাকে শূধূ ক্রোধরেখা পরস্পরের মুখে

১০.
অবাধ্য হাত জেনেছে তুলে নিতে হয় কীভাবে মাটির মায়া
প্রগাঢ় মিথ্যের ভেতর নিয়ত শাণ দেওয়া দীর্ঘ এ’ছোড়া
তবুও অন্ধচোখ, পাতা সাজিয়ে বসে থাকে মৃত্যুপথযাত্রী
ক্রমশ ভেঙে ভেঙে পড়ে এইসব বহুবর্ণিল কোলাহল

১১.
কেউ কেউ চোখ রাখে নিয়ত প্রবহমান হাতের রেখায়
বাক্যের আড়াল থেকে উঠে এসেছে সন্ধানী মনের চাওয়া
নিঃসাড় চোখ জানে শুধু মৃতবৎ হাত ও পায়ের কান্না
রাইজল মুখে নিয়ে হেঁটে গেছে শতাব্দী পুরনো পথে পথে

১২.
আমার শরীরেও সেসব দাগ পড়েছে, দীর্ঘস্থায়ী রোগের
মাটির ভেতর-বাহিরে খুঁড়বে আর কত দীর্ঘনিঃশ্বাস
শস্য ও নদীর নিবিড় চাষাবাদ চায় শুধু ক্ষুধার দেহ
শরীরের শেকড় খুলে দেখে নিয়েছে আদিম চোখের জ্বালা

১৩.
রঙীণ ব্যাথার ফানুস শুণ্যে হাত বাড়িয়ে বলে চলো যাই
ওখানে মৃত্যুফাঁদ পাতা, এই হাত ধরো-চলো উড়ি আকাশে
অন্ধকার ছুঁয়ে বসে থাকে নীল মথ, ডানায় তখনো বীর্য
নিভে যাওয়া আগুনের আঁচ বড় হয়ে আছে কপালজুড়ে

১৪.
কতবার বলেছি, এসব পাতাগুল্ম হিসেবের কথা বলে
আর কত বাড়াবে এই বাস্তুভার, আমি জলমগ্ন শীতার্ত
নিভন্ত বিকেলের আলো, জানে এসব ছল ডিঙানোর কলা
বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণে ধানগুলো দেখো নত, সেজদায়

১৫.
আমাকে গ্রহণ করো, দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হেঁটে গেছে কতজন
নিয়ত বন্ধুর হাত হয়ে ওঠে নির্ভেজাল ছুরি, আচানক
কোথাও কোনো আস্থা নেই, নেই বিশ্বাসী একফোঁটা রোদচিহ্ন
যেদিকে তাকাই থাকে শূধু ভয়কালো অন্ধকার-মৃত্যুনীল

১৬.
এসব আর্তনাদ শুনি, শুনি বিভেদ-বেড়াজাল পাতে কেউ
কোনোএক বীজগন্ধ শরীরে আসবে বুঝি নতুন পাঁজর
ব্যাথামুখ পাড়ি দেবে সূর্য্যের সাথে-উড়বে যুদ্ধের পতাকা
শরীরে বিষবাস্প নিয়ে উড়বে কী করে এ দীর্ঘ বায়ুপথ

১৭.
কার হাতে তুলে দেবো ব্যথাতুর চোখের জলজ বস্তুভার
কোথাও নেই কোনো গান, ঝরে পড়ছে সমূহ পাতা-বল্কল
নিঃশঙ্ক আঙুলের কাছে নেই বিশ্বাসের এতটুকু ছায়া
সিঁড়ির শেষধাপ বুঝি ভাঙছে ঢেউয়ের অনাবাদী ভোর

১৮.
কত কত ভূল, শোধরানোর এই ছলাকলা জানে না মন
নিষিদ্ধ প্রতিপদ শুধু লিখে যায় আত্মরতির ইতিহাস
এতটা বিপরীত স্রোত ভেঙে পৃথিবী যাবে আর কতদূর
মুখোশের মানচিত্র থেকে উঠে আসে না কোনো স্বজনতারা

১৯.
তবুও সীমানা পার হয়ে শরীর মিশে গেছে শরীরে-গানে
মসৃণ শিকারির মতো সেসব পাতাঝরা গান বুকে নিয়ে
দু’হাতে খূলে গেছে রাত্রির নিষেধ সামিয়ানা, রতি কোমল
আমাকে গ্রহণ করো, নাও তবু এই উত্তঙ্গ ব্যথার নৃত্য

২০.
এই ভিজে মাটি, এই পিচ্ছিল সন্দেহ-মনে বাসা বেঁধে আছে
আমিতো খুলেছি দুয়ার, সমস্ত দিনরাত্রি অপেক্ষার কোলে
এই হাত ধরেনি কেউ,কেউ এসে বলেনি-দাঁড়াও, আসছি
সিঁথানে বিপরীত আঙুলস্রোতে ভাসছে চুলের বন্যগান

২১.
পুড়ে যাচ্ছে মাটির উষ্ণ শরীর, ধানখেত, কৃষকের বীজ
সূর্য়ের গাঢ় আবরণ যেন জ্বালিয়ে দিয়েছে এ’মনভূমি
কার হাতে তুলে দেবে এই বাস্তুভার, বোঝেনি বানভাসিরা
মৃত চড়াইয়ের ছায়া দেখে বুঝে যায় এ’ইতিহাসকাল

২২.
এসব উষ্ণ গান, প্রেমের আকুতি-চুলের বিন্যাসী আঙুল
জানে শুধু ছলাকলা, বিচ্ছেদের মলিনরেখার মতো শুণ্য
সর্বস্ব লুটে যাবার কালে, কেউ আঁকে চোখে পাপড়ি কাজল
পৃখিবীর দেহ ভেদ করে চলে যায় বর্শা এফোঁড়-ওফোঁড়

২৩.
বিশ্বাসের রোদ তাই চলে গেছে, তুলে নিয়ে গেছে সন্ধ্যাগান
স্মৃতির মরণ যেন হয়, কেননা স্মৃতিরা মৃতরূপ শোক
খাঁচার অচিনপাখি ডানা ঝাপটে ঝরে যায় সব পালক
কারা যেন পাখিনাম ডেকে ডেকে ভোরলগ্ন মেঘ হয়ে গেছে

২৪.
কোথাও বুঝি হারিয়ে গেছে , কোথাও বুঝি এই তীব্র অন্যায়
নিয়ত বৃন্ত থেকে ঝরে পড়ছে পাতা, রক্তাক্ত শরীর কাটছে
তীব্র কুঠার হাতে কারা ছুটে আসে, রাষ্ট্রের বন্দী প্রজাগণ
শিল্পের আকর ভাঙছে, যেন কোনোকিছূ ঘটেনি কোনোকালে

২৫.
কতদূরে যাবো? কোথায় আর এসে দাঁড়াতে পারি পরস্পর?
মুখোশের ছায়ার ভেতর মুখগুলো কাঁপে ঈর্ষার আলোকে
একই বৃত্তের ভেতর-মুখোমুখি শুণ্যতা খেলা করে শুধু
অন্ধকার বীর্যাধার জানে না মৃত্যুর মর্মরধ্বনি,করুণ!

২৬.
মিহি বালির ভেতর ডুবে যায় শরীর, যেভাবে ডুবে সব
বিছানা-বালিশ ডুবে, মৃত্যুশিখা জেগে থাকে চোখে, শরীরে
ব্যথার প্রহর শুধু মনে রাখে সেসব পেয়ে হারানো গল্প
কোথাও নামলিপি দেখে মনে পড়ে যাবে বিগত পথদের

২৭.
বিভেদের মানচিত্র থেকে উঠে আসে প্রিয় পোষাকের ছায়া
কোথাও খুঁজে নেবে বিশ্বস্ত হাত, আশাবাদী ভোরের ঠিকানা
এখনও সে উঠে আসে, ভোর হলে কথা বলে পরস্পরের-
ক্লেদমাখা জীবনের অমীমাংসিত বেদনার রোদ খুঁজে

২৮.
এই প্রবহমান নদীর কথা, জীবন খেয়ালি হয়ে ওঠে
কতদূর যাবো? এ’কথা বলি শুধু-জানি না কিছুই অখণ্ড
কেবলই ভেঙেছি, জলের ভেতর খুঁজেছি অফুরন্ত কৈশোর
হৃদয়, আঁধার থেকে আলোর উৎস খুঁজে খুঁজে দিকভ্রান্ত

২৯.
আমাকে গ্রহণ করো, মৃতচোখ থেকে উঠে আসুক পাতারা
স্মৃতির অভিজ্ঞান মুছে যাক, কেননা ব্যর্থ এই আনাগোনা
সুর ভেঙে তুমিও চলে গেছো দূরে, মেঘমল্লার রাগধ্বণি-
থেকে থেকে শুনি আর ভাবি মৃত জোনাকের গল্পগুচ্ছগান

৩০.
নিঃসঙ্ক বায়ুর মেঘ, চলে যায় পরিযায়ী পাখির বেশে
সেখানে কেউ থাকে না আর, এই শঙ্খনীল মৃতচোখ ছাড়া
পুড়ছে ,শুধু পুড়ছেই-আকাশে জমে থাকে ধোঁয়ার চাদর
নিঃশ্বাসে অর্গল ভেঙে গেলে, তুমি হও নিষিদ্ধ চরাচর

৩১.
কিছু নেই, কেউ ছিলো না কোনোকালে-থাকে শুধু কালের কণ্ঠ
আমাকে রক্ষা করো, নিয়ে যাও এই মৃত্যুনীল আতঙ্ক থেকে
যেখানে খেলা করে খেয়ালি পাখির দল, বিস্তৃত নদী বয়-
আমাকে গ্রহণ করো হে বিষন্ন সৌরভভরা চিরহরিৎ

৩২.
ওখানে ব্যথার চাদর বিছিয়ে বসে আছে ঋষি, মৌনমন
একথা স্মৃতির দেহে, যদিও জানি না কোথায় কবে দেখেছি
আমাদের ঈর্ষা-ক্রোধ-রিরংসার লালা ঝরছে মুখে মুখে
ক্রমশ ব্যাধির মতো জড়িয়ে যাচ্ছে বিকলাঙ্গ মানুষদল
৩৩.
এমন শীতরাত্রি কাটিয়ে দিয়েছি, বিভেদের কিনারে একা
প্রতিদিন মুখ দেখি আর দেখি চেতনাসক্ত মুখোশগুলো
পৃথিবীর কোথাও কোনো রোদ নেই যে পুড়িয়ে পুড়িয়ে যাবে
অপেক্ষার তীক্ষ্ণ প্রহর জানে-হাতের কাছে পুড়ছে সর্বস্ব

৩৪.
এখন সব আছে, নদীর কাছে ,নিজের কাছে বলার মতো
শুধু মিথ্যের বেসাতি ঘরগুলো দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বল কলাবতী
দয়িতার শুদ্ধ ঠোঁট ও আঙুল পেরিয়ে এসেছে অন্য কেউ
ঘরকোণে একা একা বুঝি ছবি আঁকছে এলোকেশী শিশুরা

৩৫.
অখণ্ড বৃষ্টির কথাগুলো মনে পড়ে, দেহঘড়ি ভিজে যায়
শঙ্খের বাঁশি বাজে- আঙুলে, ঠোঁটে, কোমল-কাতর গৃহদাহ
দিকচিহ্নপুর খুঁজে ক্লান্ত হয়েছে শতাব্দী প্রাচীন মানুষ
প্রজাতির আর্তনাদ শুনে বুঝি বেহুদা মাতাল হয়ে ওঠে

৩৬.
এইখানে ছুঁয়ে থাকো, দেখো-কতটা আগুন ধরে থাকে ত্বকে
বিষাদে বিষাদে নদীবুক করি পান তীব্র আহ্লাদে-আক্রোশে
বিলুপ্ত রূপকথা রাতভোর পার করে দিয়েছে কাঙালীনি-
এখন দেহের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে সমস্ত শহরের রাস্তা

৩৭.
নির্ভেজাল বিষের শরীর, বুকে হেঁটে চলে যাচ্ছে বহুদূর
দীর্ঘ ছায়ার সারি জানে না, কোথাও কারো ছিল কী পরিচয়
বিপরীত বিশ্বাসে ভেঙে যায় খেলাঘর, বাক্সবন্দী রোদেরা
এই পা কোথায় এসে দাঁড়ায়, জানে না প্রতিবেশী আঙুলও

৩৮.
নিষেধের কোনো নিয়ম বালাই নেই-দিয়ে যাচ্ছে হুইসেল
আমি খুঁজি সীমানা পেরোনোর পথ, কোথাও আশা নেই কোনো
মৃত নদীর বুকজুড়ে শুধু পড়ে থাকে নুড়ি ও বালিঝড়
বিশ্বাসে হেরে গেলে কোনোকিছুই থাকে না আপন স্মৃতিময়

৩৯.
এখনো পাতালে মন, আকাশে পাড়ি দেয়নি পাখির ডানায়
সূর্যের মতো এমন প্রখর, হতে পারেনি, পৃথিবীর কোলে
তাই বুঝি ছুঁয়ে থাকে স্মৃতির পালক, নিঃশব্দ ছায়া হয়ে-
পেছনে কোথাও উদ্বাস্তু হাওয়ায় ভেঙে পড়ছে সবকিছু

৪০.
বন্ধু, এই বিশ্বাসের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত পা যুগল
কোথায় কবে হারিয়েছে মার্বেলস্মৃতি আজো মনে পড়ে শুধু
কেন হারিয়ে যায়, ব্যথার শ্রেণীমন্ত্রে লেখা হয় কোন পাঠ
কেউ জানে না, জানে শুধু উদভ্রান্ত পথের তীব্র চোখজোড়া

৪১.
কাঁচের শরীরে ভেঙে পড়ছে সমূহ আকাশ, দৃশ্যসীমানা
নিজেকে হারিয়েছি নিপুণ মোড়কেমোড়া রঙীণ ঠোঁটরেখা
খোলস পাল্টে বের হয়ে আসা চকচকে শরীরের সাপেরা
দাঁড়িয়েছে ফিরতি পথে, আমি পথ ভুল করে দাঁড়িয়ে আছি

৪২.
ব্যথার মতো সহজ আর কিছুই নেই, এ’কথা শিল্পরূপ
জীবন নিস্তরঙ্গ হয়ে গেলে, নিঃসঙ্গ পাখির মতো ডুব-
দিতে দিতে সকলেই হয়ে উঠি ধ্যানমগ্ন সারসের ঠোঁট
দীর্ঘ অপেক্ষা,কোনো কোনোদিন হয়ে ওঠে মৃতের মতো স্থির

৪৩.
সংকোচের শরীর নিয়ে সহসা দাঁড়িয়েছি বলবো বলে
জনসমাবেশে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি, আমি ব্যাধিগ্রস্ত নই
মুথানো ঘাস থেকে শিশিরের গন্ধ নিয়ে ডুব দিয়েছি জলে
মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা জমা ঠোঁটে দেখেছি শুধু ক্ষুধার প্রতিবিম্ব

৪৪.
কত আর মরে যাবো? পাহাড়ের মতো অটল এ প্রশ্ন যেন
কোথাও কি কমে গেছে পৃথিবীর গতি? সীমানা প্রাচীরতার?
কেবল জলের শরীর থেকে উঠে আসা প্লাবনধ্বণি শুনি
শুকনো মরুর মতো ঝাঁ ঝাঁ রোদের আগুনে পুড়ছি তবুও

৪৫.
মৃত নগরীর হাত ধরে আমরা যারা হেঁটে গ্যাছি দুরন্ত
তাদের শরীরে এখন মৃত জোনাকের গল্প, লোবান সুর
শরীরের গভীরে জমে গ্যাছে বর্ষজীবী গাছের ঘন ছায়া
ওখানে নিরন্তর ঘন্টা বাজছে, মধ্যযামের মতো একাকী

৪৬.
সেসব সুর বাজে ,মনের মন্দিরে ,যেখানে পাতা ঝরে পড়ে
সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে পড়ছে শব্দমালার মতো
আমাদের নিষেধদিন ফুরিয়ে গ্যাছে, এখন শুধু অপেক্ষা
মৃতের সারির ভেতর খুঁজে ফিরছে আপন মুখ গহ্বর

৪৭.
সম্পর্ক, ভুল করে দাঁড়িয়ে থাকে ফিরতি পথে, প্রতিসরণে
চঞ্চল চোখজোড়া শুধু উদ্বাস্তু হয়-খুঁজে নিশ্চিত সড়ক
আঙুলের মায়াগান ফুরিয়ে গেলে, থাকে শুধু শুকনো গান
শরীরের সীমানা ভুলে পাড়ি দেয় নিষিদ্ধ জলের আঁধার

৪৮.
আমি তো সেসব সুর গেয়ে চলেছি প্রতিনিয়ত, তালে তালে
বিশ্ব তল্লাটে কেবল বাজে এমন অনঘ, অবিনাশী গান
সেসব সুরের হাতে ধরে পাড়ি দিচ্ছি দ্বিপদী রোদ অঞ্চল
আপাতত ভুল নাম থেকে বেরিয়ে এসে, দাঁড়াই মুখোমুখি

৪৯.
একাকী রাতের ট্রেন ছুটে চলে গ্যাছে, কুয়াশাবিস্তৃত জলে
মুছে গ্যাছি রাত্রির সামিয়ানা, নিসঙ্ক ছায়ার সীমানারেখা
জীবন, লিখে রেখে গ্যাছে এইসব সার, খেয়ালি উপকথা
মৃত্যুময় দিক-দিগন্তে চিলমারি করছি দয়িতার ঠোঁটে

৫০.
দেবীকে প্রতিষ্ঠা করি, এইসব যাবতীয় সম্পর্কের রঙে
বিভেদে টুকরো টুকরো যাবতীয় আগুন, প্রেম ও পুণ্য
সময়ের খাঁজে খাঁজে লেখা হয় সেসব দুুঃস্বপ্ন, এলিজি
শহরে বিষবাস্প ওড়ে, মুখে মুখে রটে যায় সেসব কথা

৫১.
কখনো পাড়ি দিয়েছি এই ধবল দেহ, হিংস্র বনাঞ্চল
সম্ভাব্য দুঃখ ও পরমস্রোত পাড়ি দিয়েছি হাতে মৃতফুল
খুঁড়েছি প্রেম, খুঁড়েছি কামের গভীরতা-নৈঃশব্দ্য উঠান
সমগ্রভুক জোছনার মতো, পাড়ি দিয়েছি বোধের জলধি

৫২.
মৃতচোখ, মৃতনদী, মৃতফুল হারানোর গল্পগুচ্ছ্বগান-
থেমে গ্যাছে, পাড়ি দিয়েছে হিমালয় পাহাড়চুড়ো, জলধারা
অপ্রকাশিত সন্ধ্যার গান থেমে গ্যাছে-হাতে মৃতের পতাকা
ভালোবাসাহীন প্রেম শুধুই দেহজাত উষ্ণকুসুমজল

৫৪.
জটিল জড়তা নিয়ে অনুবাদ হচ্ছে বিকল্প সম্পর্ক ছায়া
মাঠে মাঠে নগ্ন হাত দ্যাখে ভাবি, এখানেই থেমে আছে সব
সম্ভাব্য মৃত্যু থেকে সরিয়ে রাখি শুভ্র পালক, চিঠির খাম
যেখানে পরতে পরতে জমছে মিহি ধূলোর স্তর, ধবল

৫৫.
এই যে ভেঙে পড়া ঝড়, জলের উত্থান-মৃতনদীর গান
নির্ঘুম চোখের নিচে দীর্ঘ ছায়া, সবকিছু নিয়ে বসে আছি
জলস্রোতে ভেসে যায় এই ঘরদোর-দেহবাড়ি চরাচর
তুমি বসে থাকো নিয়ে আয়ুর উষ্ণগ্রাম, ব্যক্তিগত উষ্ণতা

৫৬.
কেন এই অমোঘ মৃত্যু? প্রতিপদে, শিল্প-সাধ্য-সাধ মিলিয়ে-
ঝরে পড়ছে মানচিত্র, বুকের গভীর থেকে দারুণ রোদ
ভেঙে পড়ছে, উড়ে যাচ্ছে; ধ্যানমগ্ন ঋষির ঘরে বাস্তুহারা
কিছু মায়া বুঝিবা এখনো রয়ে গ্যাছে-পৌরাণিক গৃহকোণে

৫৭.
আমার তখন কেউ ছিল না, পাথরের চোখ থেকে ঝরে জল
মাঠের মুথানো ঘাস থেকে উঠে এসেছিল বিস্মৃতির কেউ
ভেজা কণ্ঠের আর্তনাদ শুনে পথে এসে দাঁড়িয়েছে পাতারা
দ্যাখেছি বিন্দু বিন্দু ঠোঁট থেকে কেঁপে উঠেছে দীর্ঘনিঃশ্বাস

৫৮.
আর ছিল অন্ধকার, পাথরের মতো শীতল এ’অন্ধকারে-
ঢেকে রেখেছি সকল ক্লেদ ও অপমান, অনঘ অনুভূতি
সারারাত শূনেছি হরিণদল হেঁটে গ্যাছে উদ্বাস্তু হাওয়া
চারধারে বৃষ্টির মতো ফুটেছিল কাঁটা, পাপড়িহীন বৃন্তে

৫৯.
কাঁচের পাহাড়ে পা রেখে সেদিন উড়াল দিয়েছি ডানা খুলে
মাটিতে শোয়ানো নদী দ্যাখে নেমে গ্যাছি জলকেলিরত বুকে
ওখানে অনেক পানি জমে গ্যাছে, ভেজা পাহাড়ের গন্ধ আসে-
আর আসে, ফেলে আসা স্মৃতিদের দীর্ঘ শরীরের অবসাদ

৬০.
সেই থেকে হাতে নিয়েছি স্বচ্ছ্ব রোদ, নিষেধের নানান গুচ্ছ
দুয়ারপ্রান্তে খোলা ছুরি, বিভেদের সকল রেখা আজ জানি
জানি, কোথায় ছায়াহীন শরীর ঝুঁকে পড়ে শরীরে শরীরে
নিজের ঐশ্বর্যের ভেতর ডুব দিয়ে আছি দেশলাই জ্বেলে

সৈয়দ সাখাওয়াৎ
কবি
প্রকাশিত কবিতাবইঃ খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ (২০১৪, কাঠপেন্সিল)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার