দশটি কবিতা । শিশির আজম

0

শিউলি গাছ

উঠোনের বাম দিকে
শিউলি গাছ
মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে
সবুজ পাতা
কুচি কুচি ফুল
 
কদিন আগে
গাছের গোড়ার মাটি খুঁচিয়ে দিয়েছি
এখন
প্রতিদিন জল দিই
 
স্কুল থেকে ফিরে
খিদের কথা না বলে
আমার মেয়ে
ঝরে যাওয়া ফুলগুলো কচি হাতে কুড়োয়
 
ওদিকে রাজধানীতে
বিতাড়িত এক ডিক্টেটর
বিপ্লবের হুমকি দেন
উদার জনগণ
উনি কী বলছেন
উনি কী বলছেন

আমরা এক বিশাল সমুদ্রজাতি

আমরা এক বিশাল সমুদ্রজাতি, এ কেউ অস্বীকার করেনা, সমুদ্রের ফেনায় নির্মিত আমাদের সত্তা।

হ্যা, আমাদের ডানাই আমাদের সত্তা। হাজার হাজার বছর আমরা  ভেসে চলেছি। কখনো হারিয়ে এসেছি আমাদের ডানা গভীর সমুদ্রখাঁতে, সবুজ শৈবালে মিশে তা আরও উজ্জ্বল।

আমাদের সন্তানগন সমুদ্রের ফেনার উচ্ছাস। তাদের আছে পাখির ডানা, অপরাধ করবার সাহস, মানুষের ভিতরের অবাধ কুশায়ায় সন্তরণস্পৃহা। গাছকে কী শাস্তি দেব?

বলতে পার আমরা ভুলের সমাহার, রূপকথার অরণ্য। হ্যা, সত্যি। আমাদের ভাষা, আমাদের গান, আমাদের পার্বণ-রূপকথার সমাহার। আমরা তা সত্যি করেছি।

আমাদের নারীরা আমাদের আকাশ। কত কুয়াশা আসে, ঝড় আসে। নারীরা নক্ষত্রদের  ডেকে এনে বসিয়ে দেয় শিশুদের কপালে। তখন শুরু হয় নবান্ন।

আমরা এক বিশাল সমুদ্রজাতি। ফিনিসীয় যুবাটি আমাদের সব গল্পই জানে। সে শুনেছে তার মায়ের কাছ থেকে। নির্জন প্রতিটি সত্তা গাঁথা একই সুতোয়।

স্বীকার করতে হবে, বারবার আমরা পথ হারিয়েছি, বারবার খুঁজে নিয়েছি পথ। দৈত্যদের দেশ থেকে সাত ভাই চম্পা উদ্ধার করেছে বোন পারুলকে।

আমরা এক বিশাল সমুদ্রজাতি। আমাদের মাথার উপর বিশাল আকাশ। তাকে পালাক্রমে পাহারা দেয় সূর্য আর চাঁদ।

ছায়ার সীমান্ত ছায়ার পাখি

তুমি বললে সহজ এই ছায়াটুকু যেন আমি হারিয়ে না ফেলি। হয়তো এসবের কোন মূল্যই নেই, এই অহংকারের। কেবল ঘৃণা, কেবল অস্বীকার। একটা পাকা পেয়ারার ভিতর কতগুলো বিচি আছে এ তুমি অল্প মেহনতেই গুনে ফেলতে পার, যদিনা অসাবধানে খেয়ে ফের দুয়েকটা। এতে অবশ্য তোমার কোন দোষ নেই। একেকটা বিচি কোন অজানা দেশ থেকে, কয়েক মুহূর্তের জন্য, এসেছে আমাদের এই পেয়ারার ভিতর, শীর্ণ-পেট পাখির মতো।

মগজের মাঝ বরাবর সীমান্ত। পেরিয়ে যাচ্ছে আসছে ছোট ছোট পাখি, আর আমি এক কৃত্রিম গ্রহের অভ্যন্তরে ওজনহীন। কিন্তু আমার রযেছে স্মৃতি, পাথরের মতো, সমুদ্রে জন্ম আর উপত্যকা জুড়ে বিধি ও দায়দায়িত্বের আকর। সব তারাই ঘুমায়না, আমাদের পাহারা দেয়, আমাদের শেষ মাংসপিন্ড পর্যন্ত গলতে থাকে আগুনের শিখা হয়ে, মৃত্যুকে সরিয়ে।

ভয় পেয়েছিলে, বনজোনাকির অন্ধকারে যদি পৃথিবী ঝুঁকে পড়ে ভারসাম্যহীনতায়, যদি শিকার থেকে ফিরে আসে সেই জেলেরা যারা জন্ম নিয়েছে হাঙরের চোয়াল থেকে।

জানালার প্রাচীন ছত্রাকে বিচিত্র রঙের রোদ ভ্রুণ হস্তশিল্প। তবে সত্যি বললে বলতে হবে এটা বিমূর্ত। আমি বলছি সেই শিশুর কথা, যে আছে এক নারীর ভিতর, যে নারী এসেছে বিশাল এক সমুদ্রজাতির ভিতর সাঁতার দিয়ে।

আর দেখ কঙ্কালের শাখাপ্রশাখায় বায়ু ঘুরে ঘুরে ঝুপ করে ঘাসে দিয়েছে লাফ, ছায়ার সঙ্গে, বিশাল সবুজের নক্ষত্রপুঞ্জে। এখন সময় মেলানো যাবেনা, কারণ ঘড়ির কাঁটাগুলো অবাস্তব, মানুষকে জড়িয়ে রাখে সুদৃশ্য গোলকধাঁধায়। কথিত স্বল্পমূল্যের প্রবণতাগুলো হয়তো আরেকটু মনোযোগ পেতে পারতো।

মনে রাখতে হবে আজ আমরা যে এখানে এসেছি, এ কিন্তু ভালবাসার কারণে। ভালবাসায় কাঁটাও আছে। সময় একটা পিরামিড, এ সৃষ্টির দায়দায়িত্ব আমাদের সবার, হয়তো কোন সুড়ঙ্গ রয়েছে, যেখানে নির্জন দুটো পালক লিখে চলেছে নীল চোখ আর অবিশ্বাসের কাহিনী।

শেষ রাতের দিকে আমি ট্রেনের ভিতর শাখাপ্রশাখায় ভাগ হয়ে যাচ্ছি, হয়ে উঠছি গাছ। গাছের ছায়া থাকবে পাখি থাকবে, যেন আমরা জড়িয়েকুড়িয়ে ধাবিত হই সূর্যের সরু আগুনের দিকে।

দুনিয়া এক রকম থাকে না

কখনো কখনো ভাবি, আমরা ভালবাসার ভিতর দিয়ে ধাবমান। এই ভালবাসা কিন্তু একরকম নাও হতে পারে। তার কাঁটা আছে, কাঁটার স্মৃতি আছে। আর আছে গতি, গতির ভিতর নভেরার অপরাজেয় স্বপ্নগুলি।

দেখ ওই ব্যাঙ্গমা পাখিটিকে, তার জড়ো করা খড় পুড়ে গেল মানুষের কোলাহলে-মানুষ, অপরাধে ভরা, বায়ুমন্ডলের নিচের ধাপে দাঁড়িয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে হাত চাঁদের দিকে।

দুনিয়া এক রকম থাকে না। যে মাটি অভিব্যক্তিহীন তা খোঁচাও, দেখবে ঝুরঝুর করে খসে পড়েছে খ্রীস্টপূর্ব দশ হাজার বছরের আকরিক আর চোরাগোপ্তা জানলা।

হয়তো বায়ুর এক বুনট আছে। সে আসছে কত দূর থেকে, তার আমরা কিইবা জানি। হয়তো সে আমার ত্বকেরই গন্ধ।

রাতে আকাশে যখন তারারা বেড়াতে বেরোয়, আমরা তাদের দেখি, আমরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা তারা হয়ে যাই।

এখন আমাদের উচিৎ হবে আকাশে কাঁটাগুলোর অবস্থান বিষয়ে মানচিত্র তৈরী করা। আর শজারুর কাঁটার কথা যেন না ভুলি।

মধ্যরাতের কুয়াশা কারখানা

ঘাসের ভিতর সূর্য আর ছাইপোকা
পৃথিবীর জন্মরহস্যের উঁকি

মশামাছি ঘুমোবে না
যেন রেলগাড়ি সুতোয় জড়ানো

আকাশ বলছেঃ একটু দাঁড়াও
আমার মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে আনি

আমার চুলের মধ্য দিয়ে মাছ
সাঁতার কাটছে
আকাশের পশ্চিম তারাটি
মা হারানো

আমি খুলে ফেলি আমার পোষাক
চোখ বন্ধ
দেয়ালের ওপাশ নির্জন
নিষিক্ত আলোয় ভবিষ্যৎ জাদুরাস্তা

কাঠপেঁচা গেয়ে ওঠেঃ
শিশিরে ভিজেছে ডানা
শিশিরে ঘুমায় রাস্তা

আমের বাগানে কুয়াশার কারখানা
যত জন্তু-জানোয়ার
বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা
ভূগর্ভস্ত হাড়
রাফা সীমান্তের চাঁদ

যখন তুমি থাকো না তখন বুঝি তুমি আছ

জামার পকেটে বাতাস
সন্ধ্যার আকাশ
হরিণ
আর সলমাজরিতে
লুকোচুরি
 
বিশাল স্টেশন কুয়াশার কারখানা
শীতের বাহিনী
 
তেরশো বছর আগে
বাড়ি-পালানো ফড়িং
স্বপ্নে মিশে যেত
 
কাজ আর গাড়িঘোড়া আর সুচারু টেবিল
হয়তো সহানুভুতি কিছু
 
অজানা আঁধার
চাঁদের ইস্পাত
 
পিপাসায় শুকিয়ে মরছে
নদী
শান্ত পৃথিবীতে
সজারু ঘুমায়
 
 
 
কচুরিপানায় ঢাকা পুকুর

মৌমাছি ফুলে ফুলে বেড়ায়
মাছরাঙা ঝিমোয়
দুধে ডোবানো পতাকা রোদে শুকোলে
শিশুরা ছবি আঁকে
 
শিকড় বাঁচলে গাছ বাঁচে
কোথায় তুমি
আমরা ছিলাম কাদামাটিতে
পাথরের নির্যাসে
 
মেঘের ছেঁড়া পাতায় বিক্ষুব্ধ রূপকথারা
বোবা জন্তুটা রাস্তায়
বজ্রবিদ্যুৎ
জলের ভিতরে অসুখী জল

বারাক ওবামা : হোয়াট এ ফাকিং জোক

স্বপ্ন দেখি নিজের অজান্তে ভেঙে ফেলেছি
নিজের চশমা
স্বপ্ন দেখি কোন জল্লাদ আর অবশিষ্ট নেই
আমার ফাঁসি কার্যকর করতে
 
বাগদাদ অসভ্য এক শহর
আফগান শিশুরা একটানা সাত দিন না খেয়ে থাকতে পারে
আমেরিকার সৌন্দর্য
মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান
কেউ কি ঠিকঠাক বলতে পারে
ঠিক কতগুলো তারা রয়েছে মার্কিন পতাকায়
 
বাজার করা জীর্ণ থলেটার জিভঘষটানিতে
বাঙালী চাষী ভীতসন্ত্রস্ত: তার কিছু দাবিদাওয়া আছে
সে জানতো না এশিয়া কেমন
আর আমেরিকা দেশটা আসলে কাদের
 
কি বলছো
কোন দুঃখে আমেরিকা ব্লাক হতে যাবে
 
আমেরিকা স্ট্যাচু অব লিবার্টি
আমেরিকা হলিউড
আমেরিকা পেন্টাগন
আমেরিকা উদ্বৃত্ত অন্তর্বাস
 
ও হ্যাঁ আমেরিকা অবশ্যই বারাক ওবামা

হিমালয়

মনে কর এই পর্বত
একটা গাছ
গাছের ছায়া
ছায়ার পাখি
পাখির ফুলবীজ
 
প্রাণীদের বিচিত্র নিঃশ্বাস
ঘাসের অন্ধকারে
ঘাসের সবুজ অন্ধকার
অসহনীয় চিন্তা
আর ঝরাপাতার ভালবাসার স্তব্ধতা
তারা সান্তনা দেয় উপসাগরকে
নিজের মতো কিছুই
সে ধরে রাখতে পারে না
 
এখন ভাবি
তুমি কত বড় হয়ে গেছ
মনে রেখ
আমাদের সবার মতো
তুমিও দাঁড়িয়ে আছ ঘাসে
ঘাসে প্রজাপতি
প্রজাপতির নিবিড় রাত
শিশির সাপ ভাঙা দিন
স্নিগ্ধ অপরাধ
মাটিতে শক্ত পা
পর্বতের মতো হও
 
 
 
আলপিন

আলপিন আমাকে বলে ভালবাসতে
অশুদ্ধ এই জগৎকে
এই জগৎ অশুদ্ধ
আবৃত দরজাগুলো আগুনের গন্ডিতে ধ্রুবতারা
 
আলপিন ভাবে আমি একটা গাছ
আগুনের শিরাউপশিরাগুলোর ভিতর
আমি ভাবি আমি যদি হতে পারতাম আলপিন
আলপিনের ভিতর নির্জন সূর্যের পর্বত
 
আমার বাবা বুকে গেঁথে রাখতেন আলপিন
বাবার বাবাও
নিস্তব্ধ গুঞ্জনময় রাতের মতো ধারালো
আর ছোট ছোট অধৈর্য পাথরে বিরাট বিরাট খাঁদ
 
তুমি কী পার আলপিন
বুকের ভিতর ক্ষত তৈরী করা ছাড়া
সবাই ক্ষত দেখতে পায় বুকের ওপর
তোমাকে দেখে না

শিশির আজম
জন্ম : ২৭ আক্টোবর, ১৯৭৮
ঠিকানা : এলাংগী, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ।
পছন্দ : চায়ের দোকানে আড্ডা
 
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ
ছাই (২০০৫)
দেয়ালে লেখা কবিতা (২০০৮)
রাস্তার জোনাকী (২০১৩)
ইবলিস (২০১৬)

mail: shishir01978@gmail.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার