১.
কফির অর্ডার দিয়ে আমি প্রায় দশ মিনিট বসে আছি কুহেলিকা রেস্টুরেন্টের একটি চেয়ারে, কফিসহ রেস্টুরেন্টের ছেলেটার কোন খবর নেই। একবার ভাবলাম উঠে ম্যানেজারকে বলে আসি; মন চাইলো না। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্তি আচ্ছন্ন করেছে শরীরে, ম্যাজমেজে ভাব। অন্যদিন আমার সাথে মিতুও আসে কফি খেতে, কিন্তু আজ আসেনি। ও টিফিনের সময়ই আমাকে বলে দিয়েছিল আজ আসতে পারবে না, জরুরী ডাক্টার দেখাতে হবে। ভাবলাম মিতুকে একটু ফোন করা দরকার। কোথায় আছে কে জানে? আমি ফোন বের করতে যাবো, তখনই রেস্টুরেন্টের ছেলেটা একমগ ধোঁয়া ওঠা কফি এনে দিল। আমি আর ফোন না করেই তৃপ্তির চুমুক তুললাম গ্লাসে…।
মিতুকে নিয়ে আমার ছোট ছোট দুয়েকটি স্বপ্ন আছে। সেসব কখনোই ওকে বলি না, বা বলতে গেলে কী এক লজ্জা এসে বাধা হয়ে দাড়ায় তখন। বলার ইচ্ছাটুকুও হারিয়ে যায়। রেস্টুরেন্টে আমি যে টেবিলে বসে আছি, ঠিক তার এক টেবিল আগে একটি মেয়ে পেছন ঘুরিয়ে বসে আছে। তার সৌন্দর্য্যের উজ্জলতা এতো তীব্র যে, তার ঘিয়ে জামা আর ভেতরের ব্রা ভেদ করে সেটা আমার চোখে লাগছে। এজন্যই আমার মতে মেয়েদের বেশি সুন্দর হতে নেই, বেশি সৌন্দর্য্য তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। যেমন এই মেয়েটিও ধরে রাখতে অক্ষম হয়ে উঠেছে। আমি তাকিয়ে দেখছি, এর ভেতরে কখন যে আমার কফি শেষ হয়ে গেল টেরই পেলাম না।
রেস্টুরেন্টের কালো থাই থেকে সন্ধ্যে নামার লক্ষণ বুঝতে পারলাম আমি। আমার এখন ওঠা দরকার, তারপর কিছু কেনাকাটাও করতে হবে। উঠে গিয়ে ম্যানেজারের টেবিলে পষ্ণাশ টাকার একটা নোট রেখে বিল পে করতে দাড়িয়ে আছি, সহসা পাশ থেকে এক মেয়েলী কন্ঠে চমকে উঠলাম,
-আরে তামিম নাকি! কেমন আছো?
আমার বহুআগের চেনা মুখ। নাদিয়াকে এই কতবছর পরে দেখছি, ঠিক মনে নেই। সেদিন মা আমাকে টেলিফোনে জানিয়েছিল, তবে দেখা করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি, আজ এখানে দেখা। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না, এইসময় এইখানে এলো কীভাবে সে! আমি কিছুটা অপ্রস্তুত বা বিব্রত হয়েই বললাম,
-ভালো আছি। তুমি ক্যামন আছো?
-এইতো আছি! তো চাকরি-বাকরি ঢাকাতেই করছো নাকি?
-হ্যাঁ, কিন্তু তুমি! দেশে ফিরেছো কবে?
-বেশি না, প্রায় এক সপ্তাহ হবে এসেছি।
নাদিয়া খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে গেল, কিন্তু আমি পারছি না। আমার কাছে কেমন যেন মনে হচ্ছে নাদিয়ার সাথে আরো কথা বলা দরকার, সুখ দুঃখের, হাসি-কান্নার। নাদিয়া বোধহয় নিউইয়র্কের মতো রঙ্গিন শহরে থাকতে থাকতে ওসব কথা একদমই ভুলে গেছে। নাদিয়ার সাথে এতদিন পরের এই সঙ্গটা বেশ ভালো লাগছে আমার। রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে বললাম,
-নাদিয়া, তুমি কি ফ্রী আছো? ফুচকা বা কফি কিছু খাই, চলো।
নাদিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত ভেবে বললো, হুম, যাওয়া যেতে পারে। আমি ক্ষীণশব্দে অথবা মনে মনেই বললাম, চলো তোমার সাথে কথা আছে অনেক, হাসবো কাঁদবো। প্রেম করবো। নাদিয়া কিছুই শুনতে পেলনা। ও আমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে এগোল।
২.
মহাখালীর রাস্তা ধরে আমরা দুজন হাঁটছি, তার সাথে আমাদের ছায়াও, কখনো সামনে পড়ছে, কখনো পিছে। নাদিয়ার প্রশস্ত বুকে মাঝে মাঝে চোখ পড়ছে আমার। রোড লাইটের আলোয় ওর স্তনের নিপলগুলো জামার পরে ভেসে উঠেছে। আমি নাদিয়াকে বললাম, তুমি কি সুতির ব্রা পরেছো? আমার কথা শুনে ও কিছুটা সেই ক’বছর আগের মতোই ভীত চোখে তাকালো, কিন্তু ওর চোখে সাহসের চিহ্ন উপস্থিত। মানে ওর ভেতরে আমার কথার ফিরতি উত্তর উঁইচুঁই করছে। ও ঠোঁটের ডান কোণে মৃদু হাসি টেনে বলল, নাহ্, এটা নাইলোন টাইপের ব্রা।
-তাইনাকি, এমনতা পরে শান্তি পাও তুমি?
-হুম, লণ্ডনে আমি যে হোটেলে থাকি, ওর নিচের মার্কেটে এগুলো অনেক দামে বিক্রী হয়। আমিও সখ করে কিনেছিলাম।
আমি মুচকি হেসে ওর হাত ধরে হালকা টানে দুজনের কাধ মিলালাম।
মেন রোডের পাশ দিয়ে অলিপুরের দিকে যে ছোট রাস্তাটি গেছে, ওর মুখেই মাঝারি সাইজের একটা চটপটি ফুসকার দোকান আছে। আমি নাদিয়ার সাথে খোলাখুলি কথা-বার্তার জন্য একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলাম। ঐ ভেবে দোকানটা খুব পছন্দ হলো আমার। দোকানে আরো পাঁচ ছ’জন লোক বসে গল্প করছে। আমি নাদিয়াকে নিয়ে একদম শেষ বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। নাদিয়া আর আমি মুখোমুখি বসা, ও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, আর আমি ওর ঘোলা চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। একসময় এই ঘোলা চোখ নিয়ে আমার পুরনো কত স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু দুর্দিনের বাতাসে সেগুলো সব ধুলোয় মিশে গেছে। সেসব স্বপ্ন আর কখনো কি পাওয়া যাবে! জানিনা।
নাদিয়া আমার বড়চাচির প্রথম ঘরের মেয়ে। চাচা বিয়ে করার পর মায়ের টানে প্রায় সাত মাস ধরে আমাদের বাড়িতে ছিল। তখন আমার বন্ধু বলতে ওই ছিল একমাত্র। কত প্রেম ছিল আমাদের মধ্যে। একদিন মাঝরাতে ওকে নিয়ে বারান্দার ফাঁকে চুমু খেয়েছিলাম, শুধু প্রেম করার সুবাদে। ও খুব আহ্লাদ নিয়ে বলেছিল, তোমার যদি বিয়ে করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে মন খুলে চুমু দিতে পারো। আর ইচ্ছা না থাকলে পরের মেয়েকে চুমু দিওনা। এটা খুব খারাপ।
আমি ওর কথা শুনে খুব হেসেছিলাম আর সেদিন থেকে শরীর ছোঁয়ারও স্পর্ধা পেয়েছিলাম। আমার খুব ইচ্ছা ছিল ওকে বিয়ে করার, এবং প্লান ছিল কেউ সম্মতি না দিলে পালিয়ে যাবার। কিন্তু সেসব কথা কোত্থেকে যে কোথায় উড়ে গেল, আমি ধরতে পারলাম না। একদিন চাচির পূর্বেকার স্বামী কিছু গুণ্ডা টাইপের লোক সাথে করে এনে আমাদের বাড়ি থেকে তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল। বাড়ির কেউ কিছু বললো না। শুধু চাচি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদলো আর তার মেয়ে নাদিয়াও কাঁদলো। আমি এই করুণ দৃশ্য দূর থেকে দেখে দেখে নিরবে শুধু চোখের জল ফেলছিলাম, আর কাপুরুষের মতো পাথর বনে বসে রইলাম।
তারপর প্রায় তিন কি চার মাস পরে আমি কাউকে না জানিয়ে ওদের বাড়ি গেলাম, ওর বাবা আমাকে দেখে স্নেহ করে ঘরে বসালেন এবং গম্ভীর হয়ে বললেন, নাদিয়া এখন ওর মামার সাথে লণ্ডনে থাকে। আমি কিছুটা হতাশ গলায় বললাম,
-ও কি আর কখনো দেশে ফিরবেনা?
-না, ফিরবে তো। এদেশের মেয়ে এদেশে আসবে না, তা হয় কী করে!
৩.
নাদিয়া ফুচকা খেতে খেতে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা, একাটা প্রশ্ন করি?
আমি আগ্রহ দেখাবার ভঙ্গিতে বললাম,
-হ্যাঁ, বলো বলো।
-আমি যে লণ্ডনে চলে গেলাম, তখন তোমার একটুও মন খারাপ হয়েছিল না?
-মন খারাপ করেই বা কী লাভ! যা হওয়ার তাতো হয়েই গেল।
নাদিয়া মুক্ত হাসি ছড়িয়ে বলল,
-আচ্ছা, চলো তাহলে এখন আমরা বিয়ে করি! আমাকে তো কত চুমুই না দিলে।
ওর কথা শুনে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। নাদিয়া আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে, অথচ ও জানেই না মিতুর গর্ভে এখন আমা বীর্যের সন্তান বড় হচ্ছে। আমি চোখের পানি সামলে নিয়ে উঠে দাড়ালাম, এবং বললাম,
-চলো নাদিয়া, এখন উঠি। অতঃপর আমরা উঠে গেলাম। কিন্তু ওকে আমার কথা সব এড়িয়ে গেলাম সল্প রোদবৃষ্টির মতো হাসি কান্না দিয়েই।
আবু উবায়দাহ তামিম
গল্পলেখক
কর্মী, মুহূর্ত ওয়েবম্যাগ
abuubaidahtamim@gmail.com
1 Comment
Pingback: চারবাক । নবপর্যায়ে প্রথম সংখ্যা । জুলাই ২০১৬ | চারবাক