১.
তোমায় আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখিনি কখনও, সেটার প্রয়োজনও জানা ছিলো না তখন… কারন পর্দায় ভেসে ওঠা তোমার ছবিটুকুই কেমন যেন গভীর শরীরী অনুভূতি দিতো আমায় ৷ তোমার ঐ রোদচশমায় ঝলমলিয়ে ওঠা প্রবাসের আলো তরঙ্গের আকারে, আমার কাদামাটি মাখা গায়ে কী যেন পাওয়ার ঊচ্ছাস নিয়ে আসত ৷ তারপর সে চশমা বদলেছে, আমি অলীক সম্পর্কের স্তর বদলেছি, তুমি কতো কতো উড়োজাহাজ বদলেছ, আমি হোঁচট খেয়েছি, আমি চটি বদলেছি, তুমি শহর বদলেছ ..ডায়েরির পাতায় এসেছ গেছ রাত্রির নিস্তব্ধতায়, খামে পোরা চিঠি কত চোখে করে খুলেছি ৷
আমি ভুলে গেছি এ পৃথিবী বিশাল, ভুলেছি তোমার হাতের চেটোর বিস্তৃতি, ভুলে গেছি তুমি ছুটছো অনেক দ্রুত, তোমার জন্য থামাটাই বিস্মৃতি… ব্যস্ততায় পুড়ে যাওয়া কোন উত্তর আমি চাই নি ৷ লক্ষযোজন দূরে থেকে মানুষে মানুষে যেটুকু সোহাগ হয়, সে ভাষায় কেবল আঁকিবুকি জন্মায়, পৃথিবীর ভাষা তাকে ডাকে না বলে “অধিকার” ৷
কারন… তোমায় আঙুল দিয়ে ছুঁইনি কখনও ৷
২.
রেঙ্গুনের বর্ষা তোমার জানলার কাঁচ বেয়ে নামাত বিপুল প্লাবন, আমার ছাদে শ্যাওলাদের ভিড় বাড়াচ্ছিল বিষণ্ন ছায়া-রোদ ৷ … তোমার গাড়ি এগোচ্ছে কতো মোড় পেছনে ফেলে, জানলার ধারে বসে তুমি সিগারেটে টান দিলে, ঠোঁটে করে ছড়িয়ে দিলে ধোঁয়া আমার কুয়াশা জীর্ন দুপুরবেলায় ৷
তুমি তো অচেনা,.. তোমাকে দেখা হয়নি বিকেলের রোদে, দেখা হয় নি দুপুরের রাস্তায়, দেখা হয় নি গোপন কোন মুহূর্তের ইতিহাসে,.. তোমার সিঁড়ি চিকন ধূলায় মোড়া, আমার পৌঁছতে এখনও দেরি আছে ৷
৩.
এ তো প্রেম নয়, … বহু কোটি কাল ধরে, দুজনে যেমন হেঁটে চলেছি নিজেদের রাস্তায় … ধ্রুবতারার মতো আচ্ছন্ন হয়ে, জ্বলে উঠে মোমবাতির মতো, জোনাকির মতো মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকারে…
প্রতিটি সকালে বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে আমি চোখ বুজেছি, দেখেছি অলস বিদেশি রোদ ছড়িয়ে যাচ্ছে তোমার পিঠ ঘেষে, শিশুর মত চোখ খুলছো তুমি, তোমার বুকের ওপর অভিমানের বেলা বাড়ছে তরতরিয়ে … রেলিংয়ের ফাঁকে হাত বাড়িয়ে আমি পৌছতে চাইছি এই দৃশ্যে, তখনই তুমি বিছানা ছাড়ছো নিস্পৃহতায়, ধুয়ে ফেলছো এই সকালটা শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে, আমি গুলে ফেলছি সকালের চায়ে…
আমাদের সময় নেই কাউকে খুঁজে দেখার ৷ মাইলফলকের তলায় চাপা দিয়েছি সমস্ত দৃশ্য, সকালের চোখে লেখা ৷ তোমার জন্য থাকলো ইরাবতী, আমার সুবর্নরেখা ৷
৪.
আমায় টানছে আরবসাগরের জল, তোমায় টানছে উপত্যকা… ভিন্ন দুটো ট্রেনে অগ্রিম টিকিট কেটে রাখা ৷ তুমি বাক্সতে গুছিয়ে রাখছ সূক্ষ্ম হিসেব আর ব্যস্ততা, যত্নে গুনছ ১,২,৩ … আমি পাতা ওল্ঢাচ্ছি ৷
আমাদের ভয় নেই পুড়বার, নিজেদের গচ্ছিত রেখেছি একটা ঠাণ্ডা ঘরে, আমরা মিশে যেতে শিখেছি সেই ভিড়ে যেখানে সবাইকে মানুষেরই মতো দেখতে ৷
সন্ধ্যার একলা হাত ধরে নেমে আসছে বাড়ি ফিরবার ডাক, জোয়ারের মতো লাফিয়ে পেরোচ্ছে শহর, মাঠ, বন্দর,..
নেমে আসছে অবসর, আমাদের বিপন্নতাকে আরো স্পষ্ট করে দিতে ৷
ফিরে তো যেতেই হবে আশ্রয়ে, কিছুক্ষণ হারিয়ে যাবার মতো জায়গা কী আছে পৃথিবীতে?
৫.
তুমি ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসো যখন ঠিকানায়, আমার থালা সাজাতে ইচ্ছে করে, ভাবি যদি স্যালাডের সঙ্গে মাখিয়ে রাখতে পারতাম কিছুটা গল্প,.. ফিসফিসিয়ে, রাত্র্রের পথ ধরে ফিরে যেতাম ফেলে আসা পৃথিবীতে, আমরা হাত ধরতে পারতাম ৷
কিন্তু তুমি তো উন্নত, প্রতিটি কোশে, প্রতিটি কণিকায় বিবর্তিত,.. যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য বন্ধ রাখতে হয় আদান-প্রদান, গুনতে পারি ব্যবধান,.. তাই গল্পগুলো খামে পুরে রাখি, নিস্তব্ধতা আমাদের পরিপূরক ৷
আমাদের কোনো দেশ নাই ৷ আমরা হারিয়েছি আকাশ, ফুরিয়ে দিয়েছি অবকাশ, …আমরা খুঁড়ে দেখেছি ভেতরে, খানিকটা জেগে রয়েছি কেবল, বাকীটা মৃতপ্রায়!
আবার ঢেকে দিয়েছি মাটি, চোখের আড়ালে, আমাদের চোখের চেয়ে শুষ্কতর বালি… খুঁজে পেতে পার সাহারায়… ৷
৬.
যদি চোখ বন্ধ রাখো, পাঠাতে পারি বৃষ্টি পড়ার গান ৷ যদি ঘুমোতে চাও, আনতে পারি আদিম গুহার অন্ধকার ৷ যদি জানালা খোলো, ঝড় হয়ে সব উড়িয়ে দিতে পারি ৷ যদি হাত দাও, তবে এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি বিশ তলার বারান্দা থেকে, …আমরা মিশে যেতে পারি পাহাড়ের রাস্তায়, চাঁদের আলোয়, তুষারের নরম বুকে, যেমনটা ঠিক স্বপ্নে দেখেছিলাম ৷
আমি দূর থেকে ডাকছি তোমার নাম, তোমার শরীর মেঘে মিলিয়ে যাচ্ছে, আমার ডাকের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ছায়াপথ ৷
আমি তলিয়ে যাচ্ছি জলে, তুমি রঙিন কিছু ঢেলে নিচ্ছ গ্লাসে; সম্ভাবনা অনেক কিছুই ছিলো ।
তবে তুমি সময় ধরে চলো, আমারও কাজ নেই বিশ্বাসে ৷
অবন্তী সেন
কবি
1 Comment
Pingback: চারবাক । নবপর্যায়ে প্রথম সংখ্যা । জুলাই ২০১৬ | চারবাক