নিমজ্জন
সন্ধ্যা, সকাল, দুপুর সমূহ বিবিধ লহমায় কঙ্কর।
দুর্লভদর্শন হুদহুদ,
বক্রঠোঁট; ঘাড়-বাঁকানো হুদহুদ হে,
কোনো দুপুরের সময়ে এসে ঝুটি মেলেছো তোমার, বাবলার ডালে। কী অপার মোহিনী! ডালে বসে ঝুটি ম্যালো ধর্ষকামিনী!
জলের বিছানা ছেড়ে,
চুল ছড়িয়ে এলোমেলো,
ডিমের কুসুম মতোন সূর্য,
সারি সারি ডিঙ্গির ডানাতে রেখে থুতনি,
হিপনোটাইজড তাকায় কার পানে!
কখনো প্রেমের সুর শুনাও তুমি ‘হুদহুদ’ রবে।
জননানন্দে কেঁদে উঠো কাতর, ক্রম ‘উপ উপ’ উঁচু সুরে।
দেহ বিলায়ে আশপাশ,
গলিত সূর্যের হৃদয়,
চুল ছাড়িয়ে দশদিক,
ঐ ডুবে যাচ্ছে কোথায়!
বাবুই, চড়ুই মহামতিদের ঝরোকার ঝিনুক জানো নি; শেখো নি উন্মোচন,
তবুও দুপুর, সন্ধ্যা, সকাল সমূহ এক লোকমায় পাথর।
অথচ হে প্রগলভ হুদহুদ;
বিমূঢ় পাতি হুদহুদ,
কোনো দুপুরেরই লক্ষ্যে এসে ঝুটি মেলেছ তুমি! কী অপার চাতুরী! ডালে ঝুটি ম্যালো শঙ্কার মুনি।
কণ্ঠের হৃদয়ে তোমার নাই কোনো সুর!
কাতরতার আত্মায় তোমার নাই আত্মা!
সূর্যের গলিত হৃদয়
দেহসহ নিয়ে,
চুল ভাসিয়ে শুধু,
ঐ ডুবে গ্যালো কোথায়!
নিমজ্জন ২
বৃক্ষের শাখা সুদূর দৃশ্যে রাখে নজর— তারও ভিতে, দূরেরও দৃশ্যের মূলে গহীন চোখ; কেবলই দৃষ্টি, পুষে রাখে তল।
ডালে ডালে তার মজ্জন-খাদ,
কী বুক আর কী মাজা তার,
মোহমজ্জনে আর মর্দনমোহে;
কিছুটা বেদনায়,— তবু বহুকাল
চলে রমণ তুমুল!
রমণ শেষে তুমুল,
সরে যাচ্ছে কারা এবার,
ছায়ারও মাড়িয়ে শেষ,
আর গাছেতে মাখাচ্ছে ভ্রম!
তারপরও দৃষ্টিই শুধু পুষে রেখে তল,
জেনে যাচ্ছে এখন,
হত্যায়, হায়াতে বিস্মৃতিই দৃঢ়তম প্রাণ।
শেকড় তার পলকে পলকে দেবে যায় আরো, মাখানো বেদনার ভারে;
যেহেতু কোথাও বৃক্ষ ও বিস্মৃতির স্থান পাশাপাশি নগরেও নাই কোনোখানে।
তার চক্ষু কেবলই ডুবে থাকে তলে,—
ভুগে আত্মজ দাবন,
ক্রমে বৈঠক কারো—
হেলায়ও একটাই যার ডেরা, স্মৃতির দিকেই তার দিক, নিজেই নিজেরে জানায়।
ফলত চলে আসে বেদনারও ফল; কেনান— এতোটা গোঁয়ার! এমন ডুবার অহমিকা তার!
বিষে অমৃত খুঁটে তার গেছে চিরকাল,
জানে, নিজের ভাষাই অভিমানে সবার অধিক,তবু—
জাড়ির প্রার্থনায় কেবল, যারা ছুঁয়েছে বাকল,— রয়ে রগেরও নিকট,
বিরুদ্ধে তাদের, এই দহনের সন্ন্যাস ছেড়ে
দাবমান গাছ চায় বিস্ফার; কাদা ফেড়ে ওঠা প্রেমে বিদ্রোহ-ধ্বনি,
—সেই তীব্রতায় ডাকে কতেক পাতা; মৃদু উদ্ধত,
যাদের সাথে ছিলো প্রণয়ে, তাদেরই দগ্ধ আত্মা;
সূর্য ভেদিয়া ফেরা দূর পাখিপালে,
ফাটলগ্রোথিত ভারী সেই মন ওড়ায় তারা,
ফলে খোঁড়া লাশের কবর তাদের,
মূলের বেদনার সাথে,
পড়ে থেকে থেকে
হয়ে যায় হাওয়া।
কবর-ফলক
সতেজ পাতার বাহার ধরে যে গাছটি মরে গেলো, তার জানাজায় তুমি হয়ে আছো কাতর।
গর্ভ হতে আমি এসেছি মাতা, তোমার নাড়ি, রক্ত নিজে চুষে গঠন করেছি শরীর।
মাকড় হতে যারে মানুষে দিয়েছো রূপ—
এই আমারে, বলো না ইবলিশ, বলো আজাজিল—
দ্যাখো, সেজদায় গিয়েই আমি বাঁকিয়েছি ঘাড়। তোমার জঠরের রক্ত-মাঙশই মূল সন্ধানে বিদ্রোহ ফুঁড়ে, প্রেমকে দিয়েছে বাঁক।
সতেজ পাতা থেকে এখন সরে গিয়ে বলো,—
ভেবেছো কি তুমি, জেমস হ্যাপবার্নের কবর; এপিটাফে যার লেখা:
“এইজড ওয়ান ডে”—
অনেক বীর ও ছা-পোষা অবাধ্যের পাশে, বাপেরও আগে যে গেছে শুয়ে?
তারপরও এইসব অনুযোগ ক্যানো!
তোমার সেইসব সন্তান; আমার ভ্রাতাদের মতো
গেঁথে গেঁথে কীটপদ, জন্মের ঘরে,
আমি মেলি নাই পাখ, উড়ালের পথে—
মাতৃকাঙ্ক্ষার কাছে, তাঁর অর্ধের কাছে উহাদের মতো অবাধ্য তোমার এই পুরুষ-পুত্র আজো হয় নাই।
এই গাছের পাতা এখনো কখনো; তুমুল ঝড়ের পরে, তাকায় তোমার ও তোমাতে তোমাদের পানে;—
কোলে জড়ানোর আগেই তোমার, চোখে রাখার আগেই জন্মের চোখ,
মাথার সাথে আরো কিছু ধ্বসিয়ে সে মরে যায় নাই!
নামাজ
দৃশ্যের দৌড়ে কিছুদূর রেখে সূর্যকে, বিশ্রামের ছায়ায় নেমে গেলো খরগোশপাল—
নারকেল গাছ যেহেতু ধরতে পারছে না আর, চিড়তে পারছে না দৃশ্য।
কবির আহম্মদ মাওলানা, এইসব হৃদয়ে অচেতন ধারণ করে ঘুমমুখে আপনি ফিরছেন পাশ। জোড়া খরগোশ জড়িয়ে যাচ্ছে একে অপরে— তখন চেতনায় আপনাকে ধরা কি দিচ্ছে না বেগম?
আজানের দূর আওয়াজ শ্রবণ ছুঁয়েছে আরো পর,
যখন শাড়িতে না-ঢাকা পা ঢেকে নিয়ে আঁধার ওযুখানায় যায়, আর আসে না ঝিলওয়ারা বেগম।
“ওযুখানার দিকে, ঝিলওয়ারা, তুমি কোথায় হারিয়ে গ্যাছো, এখন কোন নামাজ তুমি কোথা থেকে পড়ো?”—
অন্তর্গত এই আয়াত যখন বিনাসুর, বিত-তারতীল আপনি অবিরত পড়েন,
দুইটি নামাজ একসাথে তখন কিভাবে আদায় করেন!
ছুরি ও ছুরি
ওইযে বেলুন; বহুরঙা; আলোগর্ভা, তার ভেতরকার ব্যাসার্ধ একেক আমরা, খাড়ায়ে রয়েছি অনতিদূরে তার। যার থেকে সুতীব্র ফলক কতেক দৌড়ে, দেখায়ে বিভিন্নতা, আমাদের চোখপ্রাণে হানে মৃত্যু।
এহেন ছুরিরও আছে নম্রস্পর্শের ভূমি, আঘাতে ঝরে লোহু। কার রক্ত কার ধারে যায় লেগে,—
চুমুঠোঁটখোলা একাপতনের শব্দে, অজ্ঞাত কার কার্নিশ থেকে পড়ে টলটল এই বৃষ্টির এক ফোঁটা!
ওইযে বহুরঙা বেলুন— ভেতরে, আশপাশে খাড়ায়ে আমরা তার—
তারই ভেতরে আশপাশে যেকোনোখানে খাড়ায়ে এখন মূলত বাহিরেরই আমরা, একেক কর্তিত রেখ। আমরা সদাই বাহিরে দাঁড়ায়ে।
—বাহিরে দাঁড়ানো এহেন ছুরিরও ক্যানো থাকে নম্রস্পর্শের ভূমি!
রক্তের মতোই ক্যানো রক্তের ফোঁটা ঝরে আলো, রঙ, সুত্রে ফেলে মুহুর্তের ছেদ!
আর বিচ্ছুরণ, ক্যানো বারবার আসে ধেয়ে, ক্যানো সেও থাকে বারবার চেয়ে!
উবাইদুল্লাহ রাফী
কবি
3 Comments
Pingback: চারবাক । নবপর্যায়ে প্রথম সংখ্যা । জুলাই ২০১৬ | চারবাক
Pingback: নবপর্যায়ে প্রথম সংখ্যা । জুলাই ২০১৬ | চারবাক
Pingback: http://vioglichfu.7m.pl/