আর এইভাবে জঙধরা সুখ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। আমাদের সুখভর্তি মরিচা; আর দুঃখগুলো ইস্পাতের মতো বেগময়। সে যাই হোক, আমরা বেঁচে আছি, এটাই বড়ো কথা। জঙধরা সুখ নিয়ে- ইস্পাতগতির দুঃখ নিয়ে- আর যেটা মূল বিষয়- কিংবা বলতে পারেন আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র লক্ষ্য/উদ্দেশ্য/সার্থকতা/বৈশিষ্ট্য/তৃপ্তি/আকাঙ্খা/চাওয়া-পাওয়া- যে বিষয়টা অত্যন্ত মধ্যবৃত্তিয়- পিচ্ছিল সুবিধাবাদ নিয়ে আমরা নিজে নিজেই বেশ তৃপ্তিবোধ করি।
এর অর্থ দাঁড়ায়- আমরা বেঁচে আছি। অনেকেই মরে গ্যাছে- আমার অনেক বন্ধু, অনেক আত্মীয়, অনেক চেনা-জানা/অচেনা-অজানা; অনেকেই মরে গ্যাছে। আমাদের কাছাকাছি থেকেও অনেকে মরে গ্যাছে। আমরা বেঁচে আছি।
উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা, হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!
মানুষের লোকালয়ে লালিত লোভনকান্তি কবিদের মতো
তুমি বেঁচে থাকো।
তুমি ফের ঘুরে ঘুরে ডাকো সুসময়!
(উদিত দুঃখের দেশ ॥ আবুল হাসান)
২.
তার আছে প্রাণখোলা জীবনবোধের গান, যা সে হাঁটতে হাঁটতে গায়। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যেস। রাত নেমে এলে যখন চাঁদের দ্যাখা পাওয়া যায়, তখন তাকে ঘর থেকে ডেকে আনে চাঁদ; আকাশ থেকে ডাক দ্যায়; ওপরে উঠে আসতে বলে কিংবা নিজেই নেমে আসতে চায়। ডাকে আয় আয়। সে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, আঁতকে ওঠে। সকালে সূর্যকে দেখে তার চাঁদের কথা মনে পড়ে যায়। চাঁ দ, এর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যার জন্য তার এতো খ্যাতি-বিখ্যাতি, তা হল রাত না হলে তার দ্যাখা পাওয়া যায় না।
এইগুলো শুধু চলতে চলতে দেখা
যবে আমি একা,
যদি কেউ বলে চাঁদ নিয়ে তো হয়েছে
কথা ঢের, তোমার ভাবনা তুমি-ই
করো একা একা,
প্রয়োজন নেই পুরাতন তর্কের!
কালকের চাঁদ আজকে উঠেছে আবার
চলতি পথে দেখছি যে বারবার
দালানগুলো সবার চেয়ে উঁচু
তারি ফাঁকে একটুকরো আকাশ,
বিষ্ময় যদি দালানচূড়ায় ওঠে
থাকতেই পারে চাঁদ দেখার অবকাশ!
(চাঁদ দেখার অবকাশ ॥ আহমেদ নকীব)
৩.
প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে হঠাৎ রথি-মহারথিরা গাছ থেকে নেমে এলেন। এবং মাটিতে পা দিয়ে পরমূহুর্তেই বুঝতে পারলেন মা টি গ র ম। লাস্টবেঞ্চির ছাত্ররা ওতেই শস্যৎপাদনের লাগি অমানুষিক চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর ক্লাসের সেইসব উজ্জল সন্তানেরা, বৃদ্ধার স্তনের মতো; ওরাও ব্যস্ত, মাটিকে দিচ্ছে বরফের স্বাদ; কখনো ঠুকছে মাধা নরম গদিতে; কখনো দিচ্ছে গাল প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, লাস্টবেঞ্চির।
কার পক্ষে যাবো? কোন দিকে যাবো? আমাকে দিওনা গাল- আমি নিরুপায়
ক্লাশভর্তি উজ্জল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেপ সমস্ত কাগজ!
আমি বাজে ছেলে, আমি লাস্টবেঞ্চি, আমি পারবো না!
ক্ষমা করবেন বৃক্ষ, আপনার শাখায় আমি সত্যপাখি বসাতে পারবো না!
বানান ভীষণ ভুল হবে আর প্র“ফ সংশোধন করা যেহেতু শিখিনি
ভাষায় গলদ: আমি কি সাহসে লিখবো তবে সত্য পাখি সচ্চরিত্র ফুল?
আমার হবে না আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ আকাঠ!
সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই, দেখি
আমার কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে বিষের পুতুল।
(আমার হবে না আমি বুঝে গেছি ॥ আবুল হাসান)
৪.
মাঝরাতে জেগে যদি রাজাকারমন উসখুস করে মাফিয়া তোমার, ডেকে নিও কাছে, হৃদয়ের আলিঙ্গণে, মুখোশী নির্মূলকারীকে। সে দেবে মাথায় হাতবুলিয়ে পূণর্বার-পূণর্বার।
দৃশ্যমান সকল কিছুই সত্য নয়, কখনো অদৃশ্যমান অনেক কিছুই সত্য প্রমাণিত হয়।
ঐ পারের সৌন্দর্যের কথা ভেবে যেতে ইচ্ছে হয়। পার তো জানে না, পৃথিবীময় পরের রয়েছে একই দৃশ্য; অন্তত আমার কাছে তাই-ই মনে হয়, ব্যতিক্রম নয়।
আমি
একজন রাজাকার
…৭১ টি পাঁপড়ি মেলা
একটি সকালকে বলাৎকার করেছিলাম
সকালের মর্মে লুকায়িত রাগ
সাক্ষ্য দিচ্ছে
আমি একজন রাজাকার
……………………………….
রাজা যায়
রাজা আসে…
আমি কেবলি আকার পাই
আবডালে রয়ে যাই রাজাকার
রাজা কার
জানে যূধিষ্ঠির
(আমি
একজন রাজাকার ॥ আরণ্যক টিটো)
*
আমি রাজাকার।
আমি রাজাকার ৭১ নং ডিপার্টমেন্ট
স্টোরের চিফ একাউন্টেন্ট বলছি।
রক্তে মাখা পুঁজি আর
কলুষিত বুক নিয়ে আগামিকাল
আমি হজ্বে যাবো;
……………………………….
সত্যি বলছি
আমি পাল্টে গিয়ে
মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডারের
খাতায় নিজের নামটা লেখাব।
(অপরিবর্তনীয় ॥ শুভ্র সরখেল)
৫.
অন্তরটা তার বাজি ওঠে থাকি থাকি। কোন প্রচেষ্টা লক্ষিত হয় না থামানোর, বরং কৃতজ্ঞদৃষ্টির আমরা যখন তার সামনে থাকি তখনি বরং অধিক মর্মরি ওঠে অন্তর তাহার। যেতে যেতে দিন, এক কুমারীর সাথে দ্যাখা হয় তার। পরস্পর দ্যাখা-শোনা-বাদ্য-মর্মও চলতে থাকে। যুবকের মর্মও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাইতে থাকে; কুমারীর অন্তরের বাজনাও কি এতদিন পর অনুভূত হইল না কি; যেভাবে কাঁপিয়া উঠিল কবি!..
দেখা হয়েছিল শুকনো গাছের সাথে
গাছেরা কেবলি ঝরায় তাদের পাতা
কথা হয়েছিল নগ্ননারীর সাথে
গাছেরা খাদ্য চেয়েছে পদক্ষেপে
ভোজনবিলাসী পুরুষ খেয়েছে পাতা
অগ্নিদ্রবণ, নির্বাপনের স্বাদ-
আমাদের পিঠে কালো মোহরের ছাপ
আমাদের ঘরে ঘুনপোকাদের ঘর;
(আয়না ॥ শাহেদ শাফায়েত)
৬.
কলমের ঝনঝন শব্দে কাগজের ঘুম ভেঙে গেল। কাগজ জেগে বলল, আমার ঘুম ভাঙানোর অপরাধে তুমি অপরাধী, তা কি জান? কলম বলল, আমি অপরাধী জন্মলগ্ন থেকে। এরপর কোত্থেকে দোয়াত বলে উঠল, ওর জন্মই হয়েছে অপরাধের মধ্য দিয়ে; আমি ওরে জন্ম হতে চিনি; প্রচুর অপরাধে অপরাধী ও। কাগজের ঝুড়ি হঠাৎ বলে উঠল, ওনার দন্ড হোক।
পিপাসার্ত বাতাসের হাতে এক গ্লাস পরিপাটি জল
বিশুষ্ক গলার নলে পতন খুশিতে দিশেহারা
জলের গভীরে সামুদ্রিক ঘুম, আনিত ঘুমের নুনচোখ এলাকায়
কখনোবা ফেটেছে তোমার পিপাসার ডিম
তালা খুলে খামের শরীর থেকে বেরিয়েছে চৌকোণ বাতাশ
উড়েছে তোমার লম্বা চুল-লম্বা ফুল- ব্যাপক কোমলে
পর্যটক খাম মৃত্যুমনি ফুটফুটে হস্তাক্ষর
একে অন্যের জড়িয়ে কাঁধ- জলের তরল বিষ্ফোরণ
(পর্যটক খাম ॥ নাভিল মানদার)
৭.
একজন কবি আমাকে বলেছিলেন; সাম্য, সবকিছু বুঝে ফেলো না, তাহলে আর বাঁচতে ইচ্ছে হবে না; মন চাইবে আত্মহত্যা করি।
এসে দেখি সকলই ভোজবাজি
ঘর নেই গেরস্থালি নেই
কেবলই মানুষ
একে অপরের দিকে আঙুল তুলে
জগৎ বোঝাচ্ছে
আমার দায় নেই অত
এত কিছু বুঝতেও আসিনি
এসেছিলাম ঘরের সন্ধানে
এসে দেখি
মানুষেরা এখনো সেভাবে
ঘরটর বাঁধা শেখেনি
(লোকালয়ে ॥ সুহৃদ শহীদুল্লাহ)
[ কৃতজ্ঞতা: শিলাজিৎ, তানভীর তজিব, মাইকেল রবিন সরকার, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য ]