শব্দ মোক্ষ – শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে অনন্ত সম্ভাবনা তৈরি হলে কবিতা জন্ম নেয় । কবিতা মোক্ষ – কবিতা রূপক উপমা নিয়ে অদ্ভুত স্বপ্নরাজ্যে ঘুরিয়ে আনে পাঠককে – কবিকে করে তোলে স্বপ্নাতুর আলুথালু । আমার আকাশে কতো না নক্ষত্র প্রতি রাত্রেই জন্ম নিচ্ছে আবার প্রতি রাত্রেই ঝরে পড়ছে সে কোন কুহকে! কোন্ মোক্ষ লাভের নেশা আমাকে তাড়িয়ে ফিরে ঘর থেকে পথে, পথ থেকে আড্ডায়? সে কোন্ ‘পরশ পাথর আমি খুঁজে ফিরি ‘খ্যাপার মতোন’? এখনো ঘোরের মধ্যে সে কোন্ বনলতা প্রশ্ন রাখে কোথায় ছিলাম! কে এই বনলতা? কে তারে দেখেছে জগতে? সিংহল সমুদ্র থেকে কেন কবি ফিরে আসেন এই বাংলার মাঠ লতা ভাঁটফুলের সৌন্দর্যের কাছে? কবি আজ আর নেই জাগতিক জীবনে, কিন্তু বনলতা আমাদের বুকের গহীনে বসে আছে । এই বনলতার চোখ, চুল আর অপেক্ষার অফুরান ধৈর্য পাঠক মনের অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসা । এরকম একজন বনলতা জন্ম নেওয়া মানে একটি নতুন জীবনানন্দীয় মিথের জন্ম হওয়া – একটি কাহিনী, একটি প্রেম আর অনেক পাওয়া না পাওয়ার বেদনা মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকে – এই তো মিথ ।
তেমনি সহস্র বছরেরও অনেক অনেক আগে কোনো এক কবি মেঘের খামে পাঠিয়েছিলেন ভালোবাসার বার্তা – শকুন্তলা হয়তো সে বার্তার রাখেনি খবর, কিন্তু মেঘে মেঘে বেলা অনেক গড়িয়ে গেলেও আমরা ভুলি নি সে মেঘবার্তার বাণী । সে উজ্জয়িনিপুর নেই, নেই কবি কালিদাস, তবু ‘তাহার কালের স্বাদ ও গন্ধ, আমি তো পাই মৃদুমন্দ, আমার কালের কণামাত্র পাননি মহাকবি’ । আজ শকুন্তলা কী কবি কালিদাস আর সেদিনের রবীন্দ্রনাথ সকলেই কি স্বপ্নজগতের বাসিন্দা নয়? সকলকেই আজ মিথিক্যাল মনে হয় যেন! তাই তো উচ্চারণ হয় – ‘ফিরে এসো পূর্ব মেঘ, ফেরো উত্তরের মেঘও . . .প্রেয়সীকে বোলো নাকো হৃদয়ের সুব্যাকুল কথা’ । একেবারেই কালিদাসের উল্টো সুর । কেননা ‘ট্রয় ধ্বংস করবে, প্রেম আজ অতো শক্তিমান নয়’ উজ্জয়িনিপুরের মেঘ যখন প্রেয়সীকে বার্তা বয়ে নিতো, একালের মেঘকে কবি ফেরত আনছেন; আর তার কারণ জানতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করছেন ট্রয়ের কাহিনী জানতে ।
এদিকে রাজায় রাজায় লড়াই এখনো সমানতালেই চলছে, উলুখাগড়ার প্রাণের খবর কে রাখে আর? সেই মহাভারতের শকুনি, দুঃশাসন-দুর্যোধন এখনো চাল দিচ্ছে নতুন পাশার ছকে, এখনো হাজারো যুধিষ্ঠির ‘ইতি গজ’ মৃদু উচ্চারণে তাল মিলাচ্ছে কালের চাকার সাথে । আমরা কি কখনো ভাবতে চেয়েছি কেন শকুনি এতো জটিলতার জন্ম দিয়ে যায়? আমরা কি কখনো ভেবেছি কোনো মা-বাবা তার সন্তানের নাম দুঃশাসন কী দুর্যোধন রাখতে পারে না? আমরা ভাবি নি, কেন একলব্য তার আঙ্গুল বিসর্জন দেয়? এখনো কতো হাটে কতো প্রান্তরে কতো একলব্য অকাতরে বিলাচ্ছে আঙ্গুল । এখনো যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকেই অভিমন্যুর বীরত্ব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তবে ফিরিবার মন্ত্র তার জানা নেই । এই লড়াই চলছে চিরকাল – মহাভারত যেন এক চলমান চিরšতন কাহিনী! আমরা তার পাশার ছকের ছক্কা মাত্র ।
আমাদের ইতিহাস সময়ের বিবর্তনে লোককথা উপকথাতে পরিণত হয়ে যায় । তাই তো এতো সুন্দর নাম ‘মীরজাফর’ আজ অর্থ পাল্টে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হয়ে গেলো কী অবলীলায়! কোনো সম্ভ্রান্ত মীর পরিবারেও আজ আর কারও নাম মীরজাফর রাখে না তো কেউ! আর কী আশ্চর্য ব্রিটিশ পদানত হওয়াতেই যেন রামায়নের পুনর্বীক্ষণ চলে – আর আমাদের ধর্মমতি বিভীষণকে আমরা কি চিহ্নিত করি নি গৃহশত্রু হিসেবে? প্রতিনিয়তই কবি তার পাঠ-কে পুনর্পাঠ করেছেন যুগেযুগে । তাই মেঘনাদ বধ কাব্য রাম কী লক্ষণকে নায়কের আসন থেকে সরিয়ে দেয় খলনায়কের পদে। এইভাবে কালে কালে পুরাণ, পুঁথি, লোককথা, উপকথা, ইতিহাস, মহাকাব্য সবকিছুই পরবর্তী কালের কবির কলমের নতুন বীক্ষণ পেয়ে নতুন ব্যঞ্জণায় হেসে ওঠে । আমাদের মুক্তি সংগ্রামেরও নানা কাহিনী ধীরে ধীরে মিথের মর্যাদায় সমাসীন হচ্ছে, কালান্তরে আরও হবে ।
রবীন্দ্রনাথ মনে হয় বাংলার কবিদের মধ্যে খুব বেশি মাত্রায় বিভিন্ন মিথিক্যাল অনুসঙ্গকে নিজ লেখায় ধারণ করেছেন । মাইকেল মধুসুদন দত্ত তো করেছেনই । এমনকি জীবনানন্দও বাদ যান নি । আধুনিক বাংলা কবিতার নিসঙ্গ শেরপা শামসুর রাহমান কি মিথের শরণ নেন নি? ‘একিলিসের গোড়ালি’ কবিতা কি গ্রীক মিথলজি না পড়ে অনুধাবন সম্ভব? আবার যখন আমরা পড়ি ‘নিহত জনক আগামেমনন কবরে শায়িত আজ’, তখন কি আমরা জানতে বাধ্য হই না ‘কে এই আগামেমনন’? আর কেন কবি তাকে নিয়ে কবিতা লিখেন? ইলিয়াড না পড়ে আমাদের জাতির জনককে নিয়ে লেখা এই অসাধারণ কবিতা কি হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব? শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে যখন আল মাহমুদের বিশ্বাস ছিলো, তখন লিখেছেন ‘সোনালী কাবিন’ যার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ইতিহাস ও মিথ তার নিবাস গড়েছে । মিথের এই আন্তর্বয়ন এক চলমান কবিতার টেক্সট কিংবা অপরিহার্য অনুসঙ্গ ।
আধুনিক কবিতার এই জ্বাজ্বল্যমান মিথ ব্যবহার থাকার পরেও উত্তর আধুনিক কবিতার সাথে মিথ ব্যবহারকে যেন বেশি অঙ্গাঙ্গি জড়িত মনে হচ্ছে? কেন? তবে কি উত্তর আধুনিক কবিতা মাত্রই মিথ সর্বস্ব? আবার সেই উত্তর আধুনিকতার গায়ে লেগেছে পশ্চাৎপদতার অপবাদ! মিথের ব্যবহার মানুষের কাছে কবিতাকে সুন্দর করে উপস্থাপন করার জন্য, যে গল্প মানুষের নিত্য জানা, তার অনুসঙ্গ টেনে কবিতার নতুন বিষয়কে মানুষের কাছে সহজ ও বোধগম্য করে তোলে মিথের ব্যবহার ।
উত্তর আধুনিক কবিতায় মিথের ব্যবহারে কিছুটা আধিক্য ঘটলেও আধুনিক কবিতার সাথে উত্তর আধুনিক কবিতার পার্থক্য কিন্তু চেতনার জগতে । ‘হাস্য মুখে দাস্য সুখ’ নিয়ে যে আধুনিকতার জগত বাংলা কবিতায় গড়ে উঠেছিলো তার ইউরো কেন্দ্রিক মানসিকতা ক্রমশঃ আমাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দিয়ে যাচ্ছিলো । সে বিবমিষাময় চেতনা থেকে সাংস্কৃতিক উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা যখন কবিকে তার ইতিহাস-সংলগ্ন হতে বা জনসম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে তারই জন্য যেন বার বার কবিতা মুখ তুলে চায় লোকজ কী মহাকাব্যিক অনুসঙ্গ কিংবা মিথের স্মরণাপন্ন হওয়ার । ‘উপনিষদের বেড়া ডিঙোতে ডিঙোতে / বোধিবৃক্ষ আঁকড়ে ধরে গৌতমের ঘ্রাণ’ [স্বপ্নদিন] – শৈশবের বেড়ে ওঠার কালে নানান বাধা অনুশাসন থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বোধোদয়ের যৌবন কিংবা নির্যাতিত জাতির চেতনা লাভ, যে অর্থেই ভাবি না কেন মিথের এমনতরো সম্মিলন বা সংশ্লেষণ কি আমাদের নতুন বিন্যাসে ভাবাতে চায় না?
ধরা যাক এই বর্ষা মৌসুমের কথা । সারা দেশ জুড়ে নানা স্তরের জলাবদ্ধতা কী প্লাবন আমাদের নিত্য নিয়তি । আর তার সাথে যে চিত্র আমরা দেখি, তা হচ্ছে কিছু ফটোলোভী সমাজকর্মী আর নেতার তৎপরতা । কেউ যদি উচ্চারণ করে ‘নূহের নৌকায় শুধু ঈশ্বরের সুসন্তান থাকে’ – তা কেবল দৃষ্টান্তই তুলে ধরছে না, স্মরণ করে নিচ্ছে প্রাচীন একটি মিথের চিরন্তন কাহিনীকে [মানচিত্র / শাদা অন্ধকার]। কিংবা ‘নুহের প্লাবন থেকে কবি যদি বেঁচে বর্তে যায়’ [বাঁচার প্রবল শর্তে / শাদা অন্ধকার] বাক্যটি উচ্চারণ মাত্রই বন্যার ভয়াবহতার চিত্র চোখে ভেসে ওঠে বৈকি! সাথে সাথে আমরা বুঝতে পারি মিথ কেবল একটা ঘটনাকে তুলেই ধরে না, তাকে ব্যাখ্যাও দিয়ে দেয় ।
আবার কখনো এক মিথের সাথে অন্য আরেক মিথের মিথষ্ক্রিয়া উপস্থাপন করে ভিন্ন মাত্রিকতা । ‘ভাত কাপড়ের তৃষ্ণা ক্ষুধায় কাতর আমরা / লক্ষ্মীদেবীর পা চেটে আজ সারা’ যেমন সাধারণ বাঙ্গালি মানসের বিত্ত লাভের আকাঙ্ক্ষায় লক্ষ্মীর আরাধনাকে বর্ণিত করে, তার পর পরই ‘অ্যারেস থেকে জীবনযুদ্ধ কৃষ্ণ থেকে দুর্নীতিটা / শিক্ষা অহর্নিশি যাপন স্বরস্বতীর বেশি’ আজকের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র আর পাশাপাশি বেঁচে থাকার সংগ্রাম – আমাদের ছলনা চাতুরি সব কিছুকে যে এই জাতি একত্রে ধারণ করছে তারও বিবরণ ফুটিয়ে তোলে । সাথে সাথে গ্রীক দেবতা অ্যারেসের চেতনা আর মহাভারত যুদ্ধে কৃষ্ণের ছলনার প্রশিক্ষণে বিদ্যাদেবীর ভূমিকাকেও করে তোলে প্রশ্নবিদ্ধ । আর আমরা কি দেখি না এত ছলনা এত সংগ্রাম সবকিছুই আমাদের জীবনকে যে জটিল কুঞ্জে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে, তাতে ‘হালখাতাতে জমাজাতি শূন্য কেবল শূন্য থাকে / জীবনটা বেশ বৃথা!’ আর এই উপলব্ধির জন্য যুধিষ্ঠিরের নিবিষ্টতা নিয়ে স্মৃতির সহস্র পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখতে হবে – যেমন কেরামানের কিতাব উল্টে আমলনামা দেখা হবে । পুরো ব্যাপারটা একটি ছোটো কবিতার কয়েকটি চরণের মধ্যে ধারণ করা হয়েছে – কিন্তু পাঠককে সঞ্চালিত করেছে সমগ্র মানব সভ্যতার নির্যাসকে উপলব্ধি করতে । (জীবন যাপন / শাদা অন্ধকার / ২০১০)
আর এই দৃশ্যমান অথচ অন্ধকারের যুগে আমরা যখন বাস করি, আমরা জানি – ‘শাদা অন্ধকারে কেউ আর দেখি না ভবিষ্যৎ – সকলেই ধৃতরাষ্ট্র, কেউবা গান্ধারী’ । এই একটি কাব্য-বাক্য আমাদের একসাথে দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ – কিন্তু আমাদের অনেকেই তা দেখতে পান না – যেমন অন্ধ ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র । আবার কেউ কেউ ধৃতরাষ্ট্রের মতো অন্ধত্ব বরণের লক্ষ্যে চোখে গান্ধারীর মতো পট্টি লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন । আর তখনই কি জীবনানন্দের কবিতা মিথের ব্যঞ্জনা নিয়ে বলে ওঠে না ‘যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা’ । কবিতা কেবল মিথকে উপস্থাপন করেই ক্ষাšত নয় । মূল চরিত্রের ভিন্ন আঙ্গিক ও ভিন্ন মাত্রিকতাও তুলে ধরে । ‘আমরা দেখি না রাতে, কতো দ্রৌপদীর লজ্জার বাজার দর কমে গেছে’ – আমাদের রূপজীবীনিদের নতুন মাত্রতে ভাবার উস্কানি দেয় ।
কবিতা আজ নানান মাত্রিকতায় নিজেকে মেলে ধরে । মানুষের প্রতিবাদ, মানুষের ব্যর্থতা কী আকুতি সব কিছুই আজ আন্তর্বয়ন আর মিথের ব্যবহারে নতুন ব্যঞ্জনা তৈরি করে । ‘ঝিনুক সইতে পারে আমি তো সইবো না’ – এমন প্রবল প্রতিবাদের মধ্যে কবি পুরো জাতির কী বিশাল জনগোষ্ঠীর সুদীর্ঘকাল ধরে কষ্ট সয়ে ফসল ফলানোর ঈঙ্গিত দেন, যেমন প্রচণ্ড বেদনা নিয়েও ঝিনুক মুক্তা ফলায়; কিন্তু আজ প্রতিবাদের সুর বেজে উঠেছে । একই সাথে কবিতাটি আন্তর্বয়ন করে আরেকটি বিখ্যাত কবিতার -‘ঝিনুক নিরবে সহো’। আর পরক্ষণেই কবিতা মিথের শরণাপন্ন হয়ে উচ্চারণ করে – ‘মনসা ছোবল তুমি দিও না এ দুর্দৈবের দেশে / আমি তো বেহুলা নই, ভেলা ভেসে গাং পাড়ি দেবো / সাবিত্রিও নই আমি, হানা দেবা যমরাজপুরী’ । এখানে চির পুজিত মনসা নয় – নায়কের আসনে বসে চাঁদ সওদাগর, যে বারবার সংগ্রাম করে ছয় সন্তান হারায় । উচ্চারিত হচ্ছে মানুষের দুর্বলতার কথা; মানুষ বেহুলা কী সাবিত্রীর মতো সাধনা করার শক্তি আজ আর রাখে না । কারণ আজকের মানুষ অতি সাধারণ – ‘সফেন ভাতের গন্ধে আমি তো আকুল / পাখির কাকলি শুনে দিনের দুবেলা করি পার’ ।
আবার যখন কবিতা উচ্চারণ করে ‘আস্থা নির্বাসনে গেলে আমরা মোহনলাল / সমর প্রাঙ্গনে ভীষ্মসম শর-কণ্টকিত’ – তখন সমাজের অস্থিরতার মধ্যেও মোহনলালের মতো সাহসিকতায় সংগ্রামের দৃপ্ত চেতনা প্রকাশ করে তারুণ্য । এদিকে ১৭৫৭ সালের মোহনলাল আর মহাভারতের ভীষ্ম সে কোন্ অমোঘ মুহূর্তে মানব সংগ্রামের কাতাওে একসাথেই দাঁড়িয়ে পড়ে । আবার সে কখনো টেলেমেকাসের মতো ‘উদ্ধারকর্তা পিতা’র জন্য আক্ষেপ করে – ‘ফিরে এসো ওডিসিয়ুস, হে আমার পরম উদ্ধার । সকল কথার মূল সুর ‘আস্থা বাড়িতে থাক্ সন্তানের ফুটফুটে হাসি’ [আস্থা আমার আকাশ কুসুম]। উদ্ধার কি কখনো হয়েছিলো? কিংবা হবে? আমাদের ইতিহাসে ১৯৭১ ছাড়া সত্যিই কি কোনো বিজয় রয়েছে? যে কায়কোবাদের মন ভোরের আজান শুনে নেচে উঠেছিলো আজকের কবির মন কি নাচতে পারে? আজ তো কবির দু’চোখে জোটে না ভোর! কেউ বলে আদিযুগে আমাদেও সুখ ছিলো । গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের কাহিনী আমরা কি জানি নি? কিন্তু কাহ্নপা কিংবা শবরীপাদের কবিতা কি আমাদের অভাবের বারতা শোনায় নি? সে-ই থেকে সেন-পাল-ইখতিয়ার-মুঘল-ব্রিটিশ-পাকিস্তান – কতো না শাসন আমাদের দেখতে হয়েছে – ‘রাজায় রাজায় কতো না লড়াই পানিপথে স্থলপথে? এই শতবর্ষ অন্ধকার ঘুচানোর বারতা নিয়ে যে ‘আগামেমনন’ বঙগবন্ধু আমাদের যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিলেন, এনে দিলেন স্বাধীন ভূখন্ড -সে কোন্ বিভীষণ তাঁকে আজ ছিনিয়ে নিয়েছে, এখনো বাতাসে ঘসেটির তীব্র আনাগোনা । আমাদের অন্ধকার কিছুতে ঘোচে না। ‘সম্মুখের আমাকে টানে পশ্চাতের আমি’ – এ যেন অ্যালিসের আজব জগত [শতবর্ষ অন্ধকার] ।
তিরিশ দশকের রোমান্টিক আবহে একদিন কবি লিখেছিলেন ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’। কিন্তু অবক্ষয়ী আধুনিক যুগের বাস্তবতা হলো ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই, কিন্তু শান্তি পাবে না’ । এর সবই কালের আঁচড়ে লেখা । তিরিশ দশকে কবি যখন ভাবের সলিলে ভাসছেন যে ‘তিনি’ মেলাবেন, ষাটের বাস্তবতায় কবি টের পেয়েছেন তিনি হয়তো মেলাবেন প্রেমিকের সাথে প্রেমিকাকে, কিন্তু শান্তি মিলবে না কিছুতেই । সময়ের ঘড়ি বেজে উঠলেই সুকান্তের মতো অনেকেই বিদ্রোহ করেছে – কালের চাকায় আজ তাই দেখি ‘প্রেমিক মিলেছে প্রেমিকার সাথে ঠিকই, কিন্তু শান্তি মেলে নি তো কোনো ঘাটে / বৈরুত থেকে গাজা প্রান্তরে ছোটে ইয়াসির আর আরাফাতদের সংসার’ [হোলি উৎসব]। আন্তর্বয়ন কবিতাকে বহুমাত্রিকতা দেবার সাথে সাথে পূর্বসুরী কবিকে মিথিক্যাল অবস্থানে বসিয়ে দেয় ।
তারপরও আজকের কবি অবক্ষয়ী হতাশায় মগ্ন নয় । এই সময়ের স্রোতে ভাসতে তাকে হবে, তবে মনের ভেতরের আকুতি ‘অনাগত শিখার আগুন হোক সবার প্রতীতি’ । আর তাই কবিতা উচ্চারণ করে ‘ভাসতে ভাসতে ভেলা জাগলো লখিন্দর / সত্যবানও প্রাণ পায় সাবিত্রীর দারুণ সহনে’ । তাই ‘দালির ঘড়িতে যদি কালের বারোটা বাজে / প্রভাতের কতো দেরি শবরী বালিকা জানে খুব’ [ভাসান]। এইভাবে ‘আমি তো বেহুলা নই’ উচ্চারণ করে যে কবি মনসার ছোঁবল থেকে বাঁচতে চায়, সেই একই কবি – ছোঁবল খাওয়া জাতির প্রতীক হয়ে উচ্চারণ করে পরম প্রতীতি – ‘চিত্রকলা ভেদ করে জাগরুক সুলতানী পেশল পুরুষ…’
মোক্ষলাভের স্বপ্ন নিয়েই কবিতার যাত্রা শুরু হয় । আর তাকে যে কবি পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তাকে যেন ‘খুসবু বাগের নারী পাথর সরিয়ে আজ হাতছানি ডাকে’। তাই কবিতা উচ্চারণ করে ‘আমি অন্ধ হলে সেও চোখে দেখে না গান্ধারী’। আর এভাবেই মিথ আর আন্তর্বয়নের হাত ধরে কবিতার এগিয়ে চলা – মোক্ষলাভ ।
জিললুর রহমান
উত্তর আধুনিক কবি ও প্রাবন্ধিক ।
‘লিরিক’ গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য ।
কবিতা, প্রবন্ধ মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ ।
2 Comments
Pingback: চারবাক । নবপর্যায়ে প্রথম সংখ্যা । জুলাই ২০১৬ | চারবাক
Pingback: নবপর্যায়ে প্রথম সংখ্যা । জুলাই ২০১৬ | চারবাক