প্রথমভাগ: মৃত্যু
শূন্য একটি ধারণার নাম। এর কোনো অর্থ নেই। শূন্যের আশেপাশে কিছু থাকতে হয়। গণিতের নিয়মে তুমি যদি নিজেকে শূন্য ধরে নাও, তাহলে তোমার পাশে আমি অথবা আর কেউ না থাকলে শেষাবধি তুমি শূন্যই থেকে যাবে।
আকাশ শূন্য। আকাশ শূন্যতা ভালোবাসে না; খুঁজে নেয় পাখি, মেঘ অথবা পতনশীল বৃষ্টি ও বরফ।
আমি খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছি; মৃত্যুর মতো আর কোনো শূন্যসংখ্যা আছে বলে জানা নেই আমার। শূন্য নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সব সময় একটি সংখ্যা খুঁজছে; পক্ষান্তরে খুঁজছে আমাকে।
০১
অবরোধবাসিনীদের ভেতর থেকে আমার দাদা মোকসেদ আলি খন্দকারকে একজন স্ত্রী বেছে নিতে বলায় তিনি যাকে কবুল বলেছিলেন তিনি আমার দাদিআম্মা যিনি কিনা মৃত্যুর সময় কৃশকায় বালিকার ওজন নিয়ে মাটিতে শুয়েছিলেন। লবেজান আমার দাদিআম্মা। স্মৃতিশূন্য। বয়স একশত দুই।
সকল প্রশংসার মালিক আমার দাদিআম্মা, প্রথম প্রেমিকা। তারপর থেকে স্বপ্নে নারী প্রসঙ্গ এলেই দেখতে পাই মাতৃজরায়ুর ওপর গন্ধহীন গোলাপ, তসবির দানা। দাদিআম্মার মৃত্যুর পর একটিও নতুন কবুতর জন্ম নেয়নি; যে পায়রাগুলোকে উঠোনে দানা খুটে খেতে দেখছেন তারা প্রত্যেকেই দাদিআম্মার ক্লোন।
০২
নিকটশহর থেকে হেঁটে আসছি; হাটিকুমরুল বরাবর হাঁটছি; খুঁজছি গ্রামের পথ; তোমাদের বাড়ি। সাদাকালো গাছের ডালে ক্রমশ বেড়ে উঠছে কামনা ও সন্ন্যাস; আমার মেয়ে মাসুমা রুমা।
দাদিআম্মা; সকল প্রশংসা তাঁর যিনি আমার কৈশোরপ্রেমিকা; শৈশবে হারিয়ে ফেলা নির্বোধ গ্রাম। যাবতীয় গোপন ব্যাধির ভেতর ডুবে থাকা নির্বোধ শৈশবগ্রাম; দরোজার বাইরে ভিজতে থাকা দাদিআম্মার জামকাঠের খড়ম।
প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে লুকিয়ে থাকে কোনো না কোনো গোপন ব্যধি; যেমন কবিতার সত্তায় লুকানো থাকে গোপন আপসোস।
০৩
আকাশে বুড়ো চাঁদ; নগ্ন। এক নগ্নতার ভেতর দিয়ে আরো এক নগ্নতার দিকে হেঁটে যাওয়ার নাম মৃত্যু। মৃত্যুর বিপরীত দিকে হেঁটে যাবার অর্থ প্রেম; যাকে একদা আমি নিঃসঙ্গ নামে ডাকতাম।
ভোরের নীরবতা থেকে সন্ধ্যার মলিনতার দিকে অর্থহীন হেঁটে যাওয়ার নাম ভালোবাসা। মা, হাত রাখো বুকে। যেদিন রাবারের পাইপ ঝুলিয়ে গলায় একজন ডাক্তারকে আসতে দেখলাম সেদিন বুঝতে পারলাম, মায়ের হাতের কাছে আর কোনো স্টেথস্কোপ কাজে আসবে না কোনোদিন।
অক্সিজেনের পাইপ খামচে বসে আছে মৃত্যু। মৃত্যুকে পিছে ফেলে হেঁটে যাচ্ছি আমি; প্রেমিকা পুত্র অথবা কন্যা; প্রিয় পরিচিত মানুষেরা আমার।
০৪
মন বলছিল শিমুল বিপদে আছে। মায়ের আশঙ্কাই ঠিক। জামফলের কাছে প্রশ্ন, পৃথিবীতে প্রথম কোন পুত্র প্রিয় বস্তুর পরিবর্তে টাকা তুলে দিয়েছিলো মায়ের হাতে? তখন কি সে বুঝতে পেরেছিলো মুদ্রাপ্রথার পেছনে রয়েছে শয়তানের নিপুণ কারসাজি। নিজের অসুস্থতা গোপন রেখে আমার জন্য পাঠিয়েছো টাকা।
জামগাছ তলায় থেতলে থাকা কালো জামফল, কীভাবে টাকার কাছে বিকিয়ে দাও শাঁসভাঙা প্রেম? জামপাতায় ঝুলে থাকা দীর্ঘশ্বাস; আমার মায়ের চোখ তসবিদানার মতো এখনো আমার নাম জপ করছে।
আম্মা, মৃত্যুর পর যে জীবন পেয়েছো তা কি বেঁচে থাকা জীবনের চেয়ে কঠিন?
০৫
বেলাভূমির ওপর বসে আসে বিষণœ প্রাইমেট। জলের ভেতর মোহগ্রস্ত মাছ, মেটামরফৌজ্ড্ ব্যাঙ; হয়তো বা বিকৃত লিযার্ড।
মানুষের জন্ম হতে লেগেছে, সারে চার হাজার কোটি সৌরবছর। অথচ মৃত্যুর জন্য প্রয়োজন, মাত্র কয়েকটি সেকেন্ড।
০৬
হাঁসজন্ম ফিরে পেতে পত্র লিখেছি তাকে। মমি করে রেখে দাও হাঁসপত্র।
বুক থেকে খসে গেছে গোপন বোতাম; বোতামবিহীন সুতোতে ঝুলে আছি আমি। গূঢ়তম বেদনার প্রাত্যহিক উৎসব।
০৭
নিরাপদ আয়োজনে সাজিয়েছো গর্ভপাতের যথার্থ মঞ্চ। কপালে ও গলায় মাতামহীর চুম্বনের দাগ নিয়ে লুকিয়ে রয়েছি মাতৃজরায়ুর ভেতর।
জরায়ুর ভেতর থেকে দেখছি বাংলাদেশ। অসন্তোষ ও গর্ভপাত।
০৮
কবিতা এক অলৌকিক স্টিমার; উদ্দেশ্যবিহীন ভেঁপু অথবা জলের ভেতর দিয়ে কেঁপে কেঁপে চলা। কবিতা এক বিরামহীন ফরেস্ট। সেই বিরামহীন ফরেস্টের ভেতর আমি হাঁটছি। ভাবছি শেষাবধি মানুষই চূড়ান্ত অর্থে কথাজীবী জীব। শিমুল মাহমুদ কলবে রোশনি জ্বালাও, কবিতার তসবিহতে ধ্যান করো, আশিক-আগুন।
মৃতের পিতামহ আমার দাদাজান; কবিতার ছায়ায় আজানরত লস্কর মুন্সি।
০৯
একটি জীবকোষের মৃত্যুতে দেহের একটি মাত্র মৃত্যু সূচিত হয়। কোটি কোটি জীবকোষ নিয়ে এরপরও শরীর অনেক দিন বেঁচে থাকে। দাদিআম্মা বলতেন, এক একটি মৃত্যুতে এই বিশাল দুনিয়ার কোনো না কোনো গাছের অন্তত একটি লবেজান পাতা খসে পড়ে; এইভাবে পাতা খসে পড়তে পড়তে একদিন মানুষের শরীরে বেঁচে থাকা প্রতিটি জীবকোষ মরে যায়; আর তখন পৃথিবীর কোনো এক গুহায় সেই মৃত জীবকোষগুলো চুরি করে জেগে ওঠে ডাইনিজীবন; যে জীবন না পুরুষের, না কোনো নারীর।
১০
শীতকালীন ছুটিতে কলেজ হোস্টেলের সারি সারি কক্ষ; নিঃসঙ্গ ও ভৌতিক; দাঁড়িয়ে রয়েছে রাতভর, বিরামহীন, ছায়াবহুল।
জন্মাষ্টমীর রাত; ভৌতিক বাথরুমে গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে মরে গেছে অনিতা মোহান্ত। অনিতার ঝুলে পড়া শরীরী দৃশ্য কাঁপছে নিঃসঙ্গ বাথরুম জুড়ে।
শীতকালীন অবকাশে অনিতার বিরামহীন কাঁপতে থাকা শরীরী-ছায়া পাহারা দিচ্ছে হলুদ ও নীল রঙে মোড়ানো মহিলা হোস্টেল।
১১
নারগিস বেগম গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ওর আত্মা মেঘেদের সাথে মিলেমিশে চলে যাচ্ছে শূন্যে।
কথা বলছি আমরা; আমাদের কথারা পাল তুলে দিচ্ছে আকাশে; প্রতিটি কথা নিজেদের নাম ভুলে যাচ্ছে; ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যে; অবশেষে চলে যাচ্ছে নারগিস বেগমের আত্মার পাশ দিয়ে নীরবে।
১২
শীতের শরীর থেকে মুছে গেছে শীতের সুবাস। অযথাই কাঁপছো তুমি। ভাবছো, বর্ষার আগেই ফিরে আসবো আমি।
অথচ বিদেয় না নিয়েই পাকাপাকিভাবে চলে যেতে হলো আমাকে।
১৩
কবরে ঘুমিয়ে আছো তুমি। তোমাকে দেখবো ভেবে, ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা হচ্ছে কফিন। উপরে উঠে আসতেই জেগে উঠলে তুমি। মুহূর্তেই তোমার মুখ ভেঙে পড়লো কবরের মেঝেতে; যে কবরটি আমি খনন করে রেখেছিলাম আমাদের জন্মের আগে।
ভুলতে চাইছি তোমাকে। নারগিস বেগম, তোমাকে ঘিরে প্রতিটি ব্যর্থতার আমিই কারণ।
১৪
প্রিয় নারগিস বেগম, আমি তোমার কবরের পাশে অযথাই দাঁড়িয়ে; নক্ষত্রবিহীন আকাশে অনন্তের শূন্যতা; আদি ও অহমহীন। সবুজ পাতার আড়ালে কাঁপছে মৃত পাখিদের আত্মা।
১৫
তুমি আমার তলপেট ঘেঁসে খুব কাছাকাছি বসে আছো। জলের শেকড়ে লুকিয়ে রেখেছো প্রেম। জলের শেকড় ছিড়ে ক্রমশ ভেসে উঠতে শুরু করেছি, মরণশীল মানুষের শেষ উম্মত প্রিয় নারগিস বেগম।
রঙতুলির ঠোঁটে পাখিরক্ত তুলে নিয়ে নারগিস বেগমের মুখ আঁকছি; পারছি না। চিত্রকক্ষ থেকে পাখিরা ফিরে যাচ্ছে দৃশ্যহীনতার দিকে।
১৬
এমন এক ঋতুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি, যেখানে মৃত্যুর কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘরের বাইরে গিয়ে দেখি, রূপকথার দরোজা খোলা রেখে চলে গেছো তুমি। দুপুরের বিছানায় শুয়ে আছে মৃত আগস্ট।
পিছে ফেরার ক্ষমতা নেই পৃথিবীর; এমন কি ঈশ্বরও হাঁটেন না পেছনে।