শামশাম তাজিল এর চারটি কবিতা

0

ঠিকানা

আজন্ম লালিত বিষাদ, তুমি নাম দিলে মেঘ।
টেনে দিলে সীমানা প্রাচীর, আর সেই বিজ্ঞপ্তি সাটিয়েছো দেয়ালের ওপাশে। আমি প্রতিদিন পড়ি-একই ভাষার নানা ব্যঞ্জনা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। মাঝরাতে পাড়ি দিই অভিমানের ঘর। যদিও তখন কেউ থাকে না পাশে। তুমি আমার থেকে সমদূরত্বে দাঁড়িয়ে মেপেছো সম্পর্কের বৈভব। বৃষ্টির হাতে ছিলো ডাক ভুল করা চিঠি, তুমি কেবল খুঁজে বেরিয়েছো ডাকহরকরার ঠিকানা। এইসব চিন্তায় কেটেছে প্রহর। ভালোবাসার বসতভিটায় ঘুঘু চড়িয়ে প্রেম গেছে মুকুলদের বাড়ি। আর তার বউ যে-দিন মারা গেলো  সেদিন মুকুলের চোখে ঝরেছে সেই বৃষ্টি যার ঠিকানা খুঁজে  খুঁজে অন্ধ হয়েছে তোমার চোখ।

ক্ষমা করো প্রভু, দাও প্রায়শ্চিত্তের বর

পক্ষীর দেশে নাই সুরের নহবত; বাজে না অলীক পাখোয়াজ।
নিজের ভেতর বইছি করাল স্রোতস্বিনী, জরায়ুর উর্বরতা খেয়েছে পিতৃব্য ও তার সন্তান; আর আমাকে ডাকছো ভারুই ভারুই, কেবল পক্ষী নই, আমি ব্যথিত ভরদ্বাজ
জরায়ু ছিন্ন ভূমিজ সন্তান, সেধেছি আমার গান-অনির্বচনীয় সুধা।
(ক্ষমা করো পিতার ভুল)
জ্বলে জ্বলে  বসুধা-আমার বাণী হয়েছে তোমার মগ্নতার ফসল।
আত্মমগ্ন ভুলে পিতার অভিশাপে পুড়ে গেছে মমতার সন্তানের দৃষ্টি ও দ্যুতি।
আমিও সেই একই ভ্রান্তিতে করেছি নিজের ক্ষতি।
ক্রমাবর্ত ভুলে পিতা ও প্রাকপুরাণিক অতীত অজাচার-নিহত সন্তান আমারই অভিশাপে; আমার গলায়ও পিতার জোয়াল।
অগ্নি, চির শুভ্র শুচিতার কারিগর, গ্রহণ করো মোরে।
পুড়ে পুড়ে হই মানব; শরীর থেকে মুছে যাক ঋষির কাপট্য ও পিরান; এক সঙ্গে কাঁদবো পিতা আর সন্তানের হোক শুভ পরিনাম।
আমার দেহের থেকে মুছে যাক যোগীর বদনাম।
পক্ষীর দেশে আমি কেবল বাজাতে চাই সুরের নহবত।
পেতে চাই প্রকৃতির দর্শন, আর স্রষ্টার সহবত।

বিভূতি পড়ার আগেই পাঠকের মৃত্যু ঘটে

আরণ্যক দুঃস্বপ্নে কাটে রাত, নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নৌকা জল কেটে পাড়ি দেয় ঘুমঘোর জ্যামিতিক তটরেখা
পা ডুবিয়ে বসে থাকে বট, প্রেতনারী চুলের অন্ধকার মেলে করে গহীন স্তব্ধতার চাষ,
পন্নগ ছড়ায় নিঃশ্বাস পরাবর্ত জলে প্রত্যাহত অনুতাপ
কবরের নির্জনতায় প্রকৃতির একমুঠো অনুরাগ বৃক্ষের ছায়া
বনফুলের ডালি নিয়ে আর্যপুরুষ শোধ করে ঋণ
যার পাওনা আদায় হয় নি বহুদিন
কুহকের লালিত্যে ভুলে থাকা দ্রাবিড় পরিচয়
নিজের ভেতর গড়া আহত অহংকার অপ্রবেশ্য দেয়াল তোলে
পাশাপাশি বসবাস করেও হয় নি তাকে চেনা
পূর্ব-পুরুষের বিচ্যুতির কালিমা আজও আমার মুখে ও কপালে!
ঢেকে দেই প্রেমের ছলনায়
আরণ্যক নারী তবু দ্বিধাহীন ভালোবাসে
বিভূতির মগজে পাপ আর প্রায়শ্চিত্তের  বোধ কলমের নিবে পায় মুক্তির পথ, আহা- এইকথা বুঝতে কেটে গেলো অর্ধেক জীবন এমনই নির্বোধ

পরমাভাষার সংকেত

শয়তান আয়নায় নিজের মুখ দেখলে প্রলাপ বকে।
বেলজিয়ামের প্রতিটি আয়নার দোকানে কারা যেনো সাদা কাগজ সেঁটে দিয়ে গেছে মাঝরাতে।
যদিও কখনো দেশের বাইরে পা ফেলি নাই, আর সেই সম্ভাবনা তেমন দেখি না, অধিকন্তু তথ্যপ্রবাহের যুগে সবকিছুর যোগানদার ভূত, যাকে মুঠোবন্দী করেছে মানুষ।
সেই সাদা কাগজে কী সব লেখাও রয়েছে, যার মর্মোদ্ধার করতে ইয়োরোপ গলদঘর্ম
কারা যেন সেই লেখাগুলোর ছবিও পাঠিয়েছেন কলিম খানের কাছে-
‘শব্দবীজের মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে থাকে শব্দবৃত্তি’
এই কথা বলে বানপ্রস্থে গেছেন ভর্তৃহরি।
আর ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার আরাধনা করে কলিম খান হারিয়েছেন ক্রিয়াপদ, তিনিও যাচ্ছেন ভর্তৃহরির দেশে।
কে দেবে তার সমাধান?
কী ভেবে আয়নার সম্মুখে ধরেছিলাম সেই সব ছবি: মিষ্টির দোকানে মিষ্টি থাকে না, সে পড়ে কল্লোল কিন্ডারগার্টেনে।
কে যেনো কানে কানে বলে গেলো এইকথা, আরও বলেছে: সেইসব ছবির মর্মোদ্ধার তোমার কর্ম নহে বাপু। তবু বলে যাই, তোমরা নিজের দিকে তাকিও না, আয়না ফেটে যাবে। যেমন সংবাদ সম্মেলনে ছিলো না কোনো সাংবাদিক, তেমনি আয়নায় অন্যকিছু তো দেখবে না, শুধু প্রলাপ বকবে।
তাই আয়না নিজেই ঢেকেছে তার মুখ এক অজানা ভাষায়।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার